জ্যামিতিবিদ ইউক্লিড বিশ্বের সব শিক্ষিত মানুষদের কাছেই খুব পরিচিত, কিন্তু এই বিশ্বজোড়া এই খ্যাতি সম্পন্ন এই ব্যক্তি সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে তেমন কিছু জানা যায় না। শুধু এইটুকু জানা যায় যে তিনি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় অধ্যাপনা করতেন। তাঁর জন্ম এবং মৃত্যুর তারিখ সম্বন্ধে এখনও কেউ নিশ্চিত হতে পারেন নি। এমনকি তাঁর জন্মস্থান ও দেশের কথাও সঠিক ভাবে কেউ বলতে পারেন নি। অনেকের মতে তিনি ছিলেন গ্রীক।
সম্রাট
আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন ও মার্টিন লুথারের মত ব্যক্তিরা তাদের জীবদ্দশায় বেশী
পরিচিতি লাভ করেছিলেন কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাদের থকে ইউক্লিডের খ্যাতিই
দীর্ঘস্থায়ী হয়ে আছে। আর তার রচিত অবিস্মরণীয় গ্রন্থ দ্য এলিমেন্টস কার্যকর ও সার্থক
পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। মানুষের মনকে যৌক্তিক বিচারের উপযুক্ত করে
তুলতে ইউক্লিডের এলিমেন্টস যুক্তিবিদ্যায় অ্যারিস্টটলের লেখা যে কোন বইয়ের থেকেও
বেশী প্রভাব ফেলে।এলিমেন্টস হল পূণার্ঙ্গ অবরোহ সংগঠনের সবথেকে উল্লেখযোগ্য ও
প্রতিষ্ঠিত উদাহরণ, বইটি তাই আত্মপ্রকাশের পর থেকে অনেক বিখ্যাত চিন্তাবিদকে
বিমোহিত করেছে।
তিনি
বিভিন্ন ধরনের বই লিখেছিলেন, যাদের কয়েকটি এখনও টিকে আছে, ইতিহাসে তাঁর অবস্থান
কিন্তু প্রধানত জ্যামিতি বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত পাঠ্যপুস্তক দ্য এলিমেন্টস – এর উপর নির্ভরশীল।
গ্রীক ভাষায় লিখিত এলিমেন্টস অন্য বহু ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। তাঁর এই বইটির প্রথম
মুদ্রিত সংকলনটি পাওয়া যায় ১৪৮২ সালের প্রথম দিকে, গুটেনবার্গের ছাপাখানা
আবিষ্কারের প্রায় ৩০ বছর পর। ওই সময় থেকে এলিমেন্টস এর এক হাজারেরও বেশী বিভিন্ন
সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর এই বই-এর
গুরুত্ব উপস্থাপিত কোনও একক তত্ত্বের মধ্যে নিহিত নয়। এই বইয়ের প্রায় সবগুলো
তত্ত্বই ইউক্লিডের আগেই আবিষ্কৃত হয়েছিলো বা জানা ছিল এবং অধিকাংশের সপক্ষে যথেষ্ট
প্রমাণও ছিল। ইউক্লিডের বড় অবদান হল বিষয়বস্তুর বিন্যাসে এবং বইটির সার্বিক
পরিকল্পনাকে সূত্রায়িত বা বিধিবদ্ধ করায়। এইসব কাজের জন্য তিনি কয়েকটি স্বতঃসিদ্ধ
সত্য (Axioms) ও
স্বীকার্য (postulates ) নির্বাচন
করেন । তিনি তার তত্ত্বসমূহ (Theorems ) যত্নসহকারে
এবং সতর্কতার সাথে ধারাবাহিকভাবে বিন্যস্ত করেন যাতে প্রতিটি তত্ত্ব যৌক্তিকভাবে পূর্ববর্তীটিকে
অনুসরণ করে বা পূর্ববর্তীটির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। প্রয়োজনে তিনি কোনও অসম্পূর্ণ
ধাপ বা প্রমাণের পূর্ণতা দিয়েছেন ও অনুপস্থিত প্রমাণের বিকাশ সাধন করেছেন। সেই সময়
এলিমেন্টস এর মত এতো মূল্যবান আর কোনও গ্রন্থই ছিল না। প্রধানত এটি সমতল জ্যামিতি
ও ঘন জ্যামিতির বিকাশ সাধন করলেও বীজগণিত ও সংখ্যাতত্ত্বের একটা বিরাট অংশও এতে
উপস্থাপন করা হয়। ইউক্লিড এমন সাড়া জাগানো কাজ করেছিলেন যে এলিমেন্টস প্রকাশের
আগের সব জ্যামিতি পাঠ্য বইয়ের জায়গা এই বইটি দখল করে নেয়। এর ফলে অন্য বইগুলোর কথা
সহজেই মানুষেরা ভুলে যেতে থাকে।
অবশ্য
আইনস্টাইনের সার্বিক তথ্য গৃহীত হওয়ার পর বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন যে ইউক্লিডের
জ্যামিতিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ জ্যামিতিক ব্যবস্থা হিসেবে ভাবা যায় না।
যেমন ব্ল্যাক হোল ও নিউট্রন নক্ষত্রের কাছাকাছি যেখানে মাধ্যাকর্ষণ ভীষণ তীব্র
সেখানে ইউক্লিডের জ্যামিতিক তত্ত্ব সঠিক চিত্র দিতে অক্ষম এবং মহাবিশ্বের সঠিক বর্ণনা
দিতে অসমর্থ। তবে একটা কথা সবাই স্বীকার করেন যে ইউক্লিডের কাজ সহায়তার কাছাকাছি
ছিল এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে তাঁর কর্মকাণ্ডের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আজও আমাদের কাছে
চিরস্মরণীয় হয়ে আছে এবং থাকবে।
লেখক পরিচিতি –
কালীপদ চক্রবর্ত্তী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী এবং দিল্লি থেকে ম্যানেজমেন্ট-এর পড়াশোনা। দিল্লি থেকে প্রায় ১৮ বছর ‘মাতৃমন্দির সংবাদ’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন এবং ‘সৃষ্টি সাহিত্য আসর’ পরিচালনা করেছেন। বর্তমানে ‘দ্যুতি সাহিত্য সভা’ পরিচালনা করেন।
দিল্লি, কলকাতা এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন। কলকাতার আনন্দমেলা, আনন্দবাজার পত্রিকা, সাপ্তাহিক বর্তমান, নবকল্লোল, শুকতারা, শিলাদিত্য, সুখবর, গৃহশোভা, কিশোর ভারতী, চিরসবুজ লেখা, সন্দেশ, তথ্যকেন্দ্র, স্টেটসম্যান এবং অন্যান্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রকাশিত বই-এর সংখ্যা ৬ টি এবং প্রকাশের পথে ৪টি বই।
‘ভারত বাংলাদেশ সাহিত্য সংহতি সম্মান’, পূর্বোত্তর আকাদেমির পুরস্কার, ‘বরুণা অসি’-র গল্প প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ, আরত্রিক সম্মান, তুষকুটি পত্রিকা সম্মান, কাশীরাম দাস সম্মান, সতীনাথ ভাদুড়ী সম্মান লাভ করেন। এছাড়াও আরও কিছু পুরস্কার লাভ করেছেন।
বর্তমানে দিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘কলমের সাত রঙ’ পত্রিকার সাথে যুক্ত।