মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের সমতুল্য । মাতৃভাষার প্রতি আত্মিক টান
মানুষের জন্মগত । মানুষের চিন্তার ভাষা,ভাবনার ভাষা,প্রেম নিবেদনের ভাষা,শোকের ভাষা,গানের ভাষা,সন্তানকে রূপকথা বলার ভাষা,চিরবিদায় নেবার ভাষা মাতৃভাষা ।
মাতৃভাষা মানুষের
শিক্ষার প্রধান অঙ্গ । মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসে ভাবার গুরুত্ব অপরিসীম। নিজের
সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করে মাতৃভাষা । প্রবলতম ভাষা ও সংস্কৃতির চাপে
অতীতে পৃথিবীর বহু ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে এবং এখনও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভাষা
বিলুপ্ত হওয়ার পথে রয়েছে। মাতৃদুগ্ধের মত অপরিহার্য বিষয় মাতৃভাষার আবহাওয়া
থেকে এমনকি ক্ষুদ্র ভাষিক গোষ্ঠীরাও যাতে বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করতে
রাষ্ট্রসংঘ ১৯৯৯ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ' হিসেবে ঘোষণা
করে।
এর পূর্বে একুশে
ফেব্রুয়ারি বাংলাভাষীদের কাছে বিশেষ
করে বাংলাদেশের অধিবাসীদের কাছে ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে
মর্যাদা পেয়ে আসছিল । ১৯৫২ সালের পর থেকে বাংলাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছিল ।
ভাষার প্রতি ভালবাসার
আত্মবলিদানের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরলতম ঘটনা। শহীদ স্মরণে শহীদের রক্তে ছাপা হয় বাংলা ভাষা
আন্দোলনের ইতিহাস। পৃথিবীর বৃহত্তম ভাষাগুলির মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান পঞ্চম ।
সারা পৃথিবীতে বাংলাভাষীর সংখ্যা প্রায় তিরিশ কোটি । ইতালিয়ান , স্প্যানিশ,ফরাসি ভাষার মতো উন্নত ভাষাভাষীদের
সংখ্যা এর ধারেকাছেও আসতে পারে না। তবু বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতে
বাঙালিকে তার বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি রাজপথকে পিচ্ছিল
করতে হয়েছে । মাতৃভাষার জন্যে এরকম রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের কোনও নজির ইতিহাসে ছিল
না ।
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে
ব্রিটিশ ভারত দ্বিখণ্ডিত হওয়ার মাধ্যমে ‘ভারত ’ ও 'পাকিস্তান '
নামক দুটো রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের অব্যাহতি
পরেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম প্রদেশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ) ওপর পাকিস্তানি শাসকেরা উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে
চেয়েছিল । ভাষার চাপে পাকিস্তানের শাসকেরা বাঙালির আত্মপরিচয় তার মাতৃভাষা
বাংলাকে উর্দুর প্রজারূপে চিহ্নিত করতে চেয়েছিল । সফল হলে বাঙালির জীবন থেকে
বাংলাকে মুছে ফেলে 'খাঁটি পাকিস্তানি 'করা যেত। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকদের
সে প্রয়াস সফল হয়নি। কারণ পূর্ব পাকিস্তানি হলেও সে বাঙালি,একথা বাঙালি ভুলতে রাজি হয়নি বলে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই তারা
মাতৃভাষা রক্ষার দাবীতে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিল ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যা
পরিপূর্ণতা লাভ করে । ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে মাতৃভাষা রক্ষা করতে গিয়ে
রফিক,সালাম ,জব্বর,বরক,সালাউদ্দিন প্রমুখ-সহ নাম
না জানা অনেকে 'শহীদ 'হয়ে গেলেন এবং তার পরবর্তীতেও সে ধারা অব্যাহত রইল।
একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষাশহীদদের রক্তস্নাত ভাষাদিবস। 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো
একুশে ফেব্রুয়ারি / আমি কি ভুলিতে পরি?’ – আমরা যে ভুলতে
পারিনি তার প্রমাণ সেদিনের ভাষা আন্দোলনে শহীদের ঘাতকের হাত
থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা
। এর মাধ্যমে বাঙালি একটা কথা প্রমাণ করতে পেরেছে – কোন
ধর্মীয় বিধানের পরিচয়ে নয় ,মানুষ তার পরিচয়কে খুঁজে নেয়
তার ভাষার বন্ধনের মধ্যে। একুশে ফেব্রুয়ারি সেই কারণে আত্মিক জাগরণের বিস্ফোরণ –
এ দেহের সংগ্রাম নয় ,একটি হৃদয়ের বিস্ফোরণ –বাঙালির হৃদয়,বাংলার হৃদয়।
১৯৫২ সালের পর থেকে বাংলাদেশে
একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। ওই
দিনটির স্মরণে বাংলাদেশের পাশাপাশি স্বাধীন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ,ওড়িশা,ত্রিপুরা,অসম,মেঘালয়,বিহার,ঝাড়খণ্ড,আন্দামান প্রভৃতি স্থানেও ভাষা শহীদ দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হতে থাকে । তাছাড়া ইউরোপ, আমেরিকা,অস্ট্রেলিয়া,মধ্যপ্রাচ্য প্রভৃতি স্থানের প্রবাসী
বাঙালিরাও একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে থাকে।
ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়নের
ফলস্বরূপ প্রবলতম ভাষা ও সংস্কৃতির চাপে পৃথিবীর বহু ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে
এবং আরও অনেক ভাষা বিলুপ্তের মুখোমুখি । এ অশুভ প্রক্রিয়া রোধকল্পে বিশ্ববাসীর
মধ্যে সচেতনতা আনয়নের লক্ষ্যে রাষ্ট্রসংঘ প্রতি বছর ‘আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস 'পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' উদ্যাপনের ক্ষেত্রে প্রকৃষ্টতম দিন হিসেবে সন্দেহাতীত ভাবে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি'দিনটি নির্বাচকদের সামনে এসে
দাঁড়ায় । সেজন্যে ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে ইউনেস্কো তথা রাষ্ট্রসংঘ একুশে
ফেব্রুয়ারিকেই ' আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ’ - এর সম্মান দেয় । এ ব্যাপারে কানাডা , মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি স্থানে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিরাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করে।
২০০০ সাল থেকে শুধু বাংলাভাষীরা
নয় ,সারা বিশ্বের মানুষ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি '-কে ‘আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস ' হিসেবে উদ্যাপন করে
আসছে । তাই একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা তাবৎ বাংলাভাষীর
গর্বের দিন । বাঙালির অর্থাৎ দুই বাংলার এবং বিশ্বের সর্বত্র
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলা ভাষাভাষীর মানুষের ভাষাপ্রেম সর্বজনবিদিত। সব
বাঙালির ভাষাপ্রেম সেকুলার একুশকে কেন্দ্র করেই দেশ ও রাষ্ট্র পরিচয়ের সীমানা
ডিঙিয়ে ভাষা দিবসকে আন্তর্জাতিক বাঙালির সর্বজনীন দিবসে পরিণত করেছে। বাঙালি
হিসেবে অবশ্যই এটা আমাদের পরম গর্বের বিষয়।
আমাদের মাতৃভাষা
বাংলার শক্তি,সৌন্দর্য,ভাবব্যঞ্জনা অসীম । স্বাধীন ভারতের অধিবাসী হয়েও পশ্চিমবঙ্গবাসী তথা বাংলাভাষী হিসেবে আমাদের অতিরিক্ত গর্ব করার আরও অনেক বিষয় রয়েছে।
স্বাধীন ভারতের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা বাংলা ভাষার সর্বপ্রধান কবি তথা বিশ্বকবি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্যগুলি (যেমন – ওড়িশা,আসম,বিহার,ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি)
-র ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ও সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য প্রত্যক্ষ ও
পরোক্ষভাবে ব্যাপক অবদান রেখেছে। পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে এটা আমাদের বিরাট গর্বের
বিষয় । কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এই যে,এই প্রতিবেশী
রাজ্যগুলিতেও বাংলাভাষীরা তাদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা করতে অতীতে যথেষ্ট
হেনস্থার স্বীকার হয়েছেন । বর্তমানেও যে সে দুঃখজনক ধারা শেষ
হয়ে গিয়েছে তা বলা যাবে না । ১৯৬১ সালের ১৯ মে অসমের শিলচর শহরে ১১ জন শহীদ হয়েছিলেন মাতৃভাষা বাংলার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে । তাছাড়া অসম সহ
প্রতিবেশী অন্যান্য রাজ্যে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা করতে সেসব স্থানের
বাঙালিদের বিভিন্ন রক্তঝরা আন্দোলনের কথাও উল্লেখ করা যায় ।
আমাদের মাতৃভাষা
বাংলা কোমল বিষয়বস্তুকেই শুধুমাত্র প্রকাশ করতে সক্ষম নয়,জটিল ও
গুরুগম্ভীর বিষয়কেও তা প্রকাশ করতে পারে । তা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের দৈনন্দিন
কাজকর্মে মাতৃভাষা বাংলা ভীষণভাবে অবহেলিত । বাংলা ভাষার স্বাভাবিক মর্যদা
সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মানুষই লজ্জাজনক ভাবে উদাসীন। তাদেরকে মধ্যযুগের (
সতেরো শতকের ) কবি আবদুল হাকিমের শ্লেষাত্মক পংক্তিমালা স্মরণ করতে অনুরোধ করি –
যে সব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী ।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ।।
দেশি ভাষা যার মনে ন জুয়ায় ।
নিজ দেশ ছাড়ি কেন বিদেশ ন যায় ।।
বিশ্বায়নের জোয়ারে সমাজের সর্বস্তরে ইংরেজি ভাষার প্রভুত্ব বেড়ে চলেছে ভীষণভাবে। বাংলা, উড়িয়া,অসমিয়া,তামিল,তেলেগু,কন্নড়,মালয়ালাম প্রভৃতি দেশীয় ভাষাগুলির মধ্যে একের প্রতি অন্যের আত্মিক টান শিথিল হতে শুরু করেছে। অন্যদিকে বিদেশি ভাষার হাত ধরে উদার বাণিজ্যিকীকরণের হাতছানিতে আজ স্বাধীন ভারতের সমাজজীবন আলোড়িত । এই আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক শোষণের পিছনে বিদেশি ভাষার ভূমিকাকে মোটেই অস্বীকার করা যায় না । তদুপরি স্বাধীন ভারতের উগ্র হিন্দি জাতীয়তাবাদীরাও যেভাবে হিন্দি প্রভুত্বকে চাপাতে চাইছে তার পরিণতি কিন্তু ভাল নাও হতে পারে । ভারতের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাষাকে হিন্দি ভাষার ছাতার তলে ঠেলে ঢুকিয়ে নিয়ে সেগুলিকে সেই ভাষার পরিচয়ের মধ্যে বিলীন করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। অন্তত একথা কিন্তু কেউ প্রমাণ করতে পারেনি যে,তথাকথিত হিন্দি বলয়ের এই ভাষাগুলি সরকারি হিন্দি ভাষা থেকে সৃষ্টি হয়েছে ।
ভাষার শক্তি
অদ্ভুত । ভাষা আমাদের সংযোগের সেতু । আবার ভাষার
ভিন্ন ব্যবহারে এক মানুষ আরেক মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যায় । ভাষা আনে ঐক্য,ভাষা আনে বিভেদ।
ভাষার এই বিপরিতমুখি ব্যবহার ও সংবেদনশীল চরিত্রকে মনে রেখেই ভাষার প্রতি সহমর্মির্তা বোধের প্রয়োজন। বাংলা ভাষার জন্যে একুশে ফেব্রুয়ারি বা উনিশে মে
সৃষ্টি হতে পারলে,অন্য ভাষার জন্যেও যে কোন এক ভাষা শহিদ দিবসের সৃষ্টি
হবে না এমন কথা বলা যায় না। তাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে নিজের ভাষার জন্যে
গলা ফাটানোই যে সব নয় ,অন্যের ভাষার সঙ্গে নিজের ভাষার বিভিন্নমুখি সম্পর্ক
স্থাপনও যে জরুরি,এই তাত্ত্বিক দিকটি আমাদের বুঝতে হবে ।
মানুষের
বিবর্তনের ইতিহাসে ভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। নিজের সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য
করে মাতৃভাষা । ইউরোপে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশের ক্ষুদ্র ভাষিক গোষ্ঠী সুইডিশ,ডাচ,নরওয়ে প্রমুখ
সবাই রাষ্ট্রীয় কাজে,শিক্ষা এবং গবেষণার ব্যবহার করে নিজ নিজ মাতৃভাষা।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখায় কিংবা বাস্তবজীবনে চিরায়ত ভারতের অন্তর্নিহিত
ভাবটিকে প্রকাশ করেছেন। 'বৈচিত্র্যের মাঝে ঐক্য ','মিলিবে মিলাবে
কেউ যাবে না ফিরে' প্রভৃতি যেমন ভারতের বিভিন্ন জাতির ক্ষেত্রে সত্য
তেমনি বহুভাষী ভারতের বিভিন্ন ভাষার ক্ষেত্রেও সত্য ।
আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারিতে শুধু বাংলা ভাষার জন্যে নৃত্যগীত না করে
বহুভাষী ভারতের অন্যান্য ভাষার মানুষদেরও আমাদের কাছে টানতে হবে। কেননা ভাষা -
সাম্প্রদায়িকতা আর ভাষা - ভালবাসা এক নয়। সে কারণে বাংলা ভাষার বিপর্যয়ের জন্যে
শুধু অন্যকে,বিশেষ করে হিন্দি ও ইংরেজিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বরং বহুভাষী ভারতের অন্যান্য মানুষদেরও আমাদের কাছে
টানতে হবে। এতে বাঙালি বাঁচবে বই মরবে না,পাশাপাশি ভারতের
মতো বিশাল দেশের জাতীয় ঐক্যও অনেকখানি সুরক্ষিত এবং সুসংহত হবে। আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবসের প্রসূতি -মহান ভাষার পতাকাধারী হিসেবে
আমাদের পক্ষে এর মাধ্যমে মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদ ভাইদের প্রতিও যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা সম্ভব হবে ।
লেখক পরিচিতি –
ড.বাসুদেব রায়ের জন্ম ১৯৬২ সালে। কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশিত বই মানব' (কাব্যগ্রন্থ), দ্বিতীয় বই রক্তের বাঁধন (উপন্যাস)। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা করলেও প্রবন্ধ সাহিত্যের দিকে তার ঝোঁক বেশি। তদুপরি গবেষণামূলক প্রবন্ধ তথা বই লিখতে তিনি অধিকতর উৎসাহী। গবেষণামূলক বইয়ের পাশাপাশি সাধু-মহাপুরুষদের জীবনী-গ্রন্থ, একাঙ্কিকা ইত্যাদি সম্পাদনাও করেছেন তিনি।
ড.বাসুদেব রায়ের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। হার উল্লেখযোগ্য গবেষণা গুলোর মধ্যে রয়েছে মনসামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ', চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সমাজ-চিত্র ইত্যাদি। তাঁর যৌথ রচনা ও উপেক্ষণীয় নয়।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বাসুদেব রায় নিরলস ভাবে লিখে চলেছেন। এছাড়াও নতুন করে তিনি একক ও যৌথভাবে বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক কাজে হাত দিয়েছেন। নিয়মিত বিভিন্ন e magazine-এ লেখেন।
একুশে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস । একুশে ফেব্রুয়ারী
শহীদ দিবস হিসাবে বাংলাদেশে পালন করা হয় । ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে এবং
ধর্মের ভিত্তিতে ভারতের বিভাজন হয় । জন্ম হয় পাকিস্তানের। 'সিএপি' অর্থাৎ কনস্টিটিউশনাল অ্যাসেম্বলি অব
পাকিস্তানের দ্বিতীয় অধিবেশন চলছিল করাচিতে, তারিখটা ছিল
২৩শে ফেব্রুয়ারী ১৯৪৮ সাল । পাকিস্তানের রাস্ট্রভাষা কী হবে তাই নিয়ে বিতর্ক।
উর্দু তো হবেই এবং ইংরেজিও চলতে পারে ।
আজকের বাংলাদেশ তখন ছিল পূর্ব পাকিস্তান,অর্থাৎ পূর্ব
বাংলা । বাংলার প্রতিনিধি, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রস্তাবের
সংশোধনী এনে বললেন,'বাংলাভাষাকেও এই স্বীকৃতি দিতে হবে।'করাচির মাটিতে মহম্মদ আলি জিন্নার সামনে অকম্পিত কন্ঠে বাংলাভাষার জন্য
তাঁর মত সরব হতে বাংলা প্রদেশের বাঙালি প্রতিনিধিরা অনেকেই পারেননি সে দিন ।
গণপরিষদের সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত
দৃঢ় ও স্পষ্টভাবে বক্তব্য রাখলেন,'দেশের ছয় কোটি নব্বই
লক্ষ নাগরিকের মধ্যে চার কোটি চল্লিশ লক্ষ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন তাহলে আপনিই
বলুন মহাশয়, রাষ্ট্রভাষা কী হওয়া উচিত?
একটা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা তো সেই ভাষাই হওয়া উচিত যাতে বেশীর ভাগ মানুষ কথা বলেন।' সে দিন তাঁকে সমর্থন করেছিলেন কেবল তিনজন প্রতিনিধি , প্রেমহরি বর্মা,ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত ও শ্রীশচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়। কংগ্রেসের রাজকুমার চক্রবর্তীও বলেন,'উর্দু
পাকিস্তানের পাঁচ প্রদেশের কোনওটিরই কথ্য ভাষা নয়। … বাংলাকে আমরা দুই অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্য চাপ দিচ্ছি
না । শুধু চাই 'সরকারী ভাষা' হিসেবে
বাংলা ভাষার স্বীকৃতি ।' বলা বাহুল্য ওই প্রস্তাব সে দিন সমর্থন পায়নি । ১১ই মার্চ ১৯৪৮
গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা উর্দু মর্মে বিল পাস
হয়ে গেল ।
অধিবেশনে যাওয়ার আগে ধীরেন্দ্রনাথ
দত্ত বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে ছিলেন । মানুষের ভয়ের নয়, মনের কথা জেনেছিলেন । ভাষা হারালে একটা জাতি হারিয়ে যাবে । তিনি জানতেন
চিঠির খামে লেখা ঠিকানা, জমি বেচা কেনার স্ট্যাম্প পেপারে
লেখাজোখার মত সাধারণ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ভাষাও তাঁদের অচেনা মনে হবে । অধিবেশন শেষে
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলায় ফিরলেন । তেজগাঁ বিমান বন্দরে এক অভিনব ঘটনার সম্মুখীন
হলেন । বিমান থেকে নেমে তিনি দেখলেন, জনা পঞ্চাশ যুবক গেটের
কাছে দাঁড়িয়ে, তাঁদের গায়ে আবার চাদর । তিনি ভাবলেন, বাংলার দাবি জানিয়ে এসেছেন বলে এরা নিশ্চয় রেগে গিয়েছে এবং চাদরে লুকিয়ে
অস্ত্র এনেছে তাঁকে আক্রমণ করবে বলে ! তিনি পায়ে-পায়ে এগোলেন । কাছে আসতে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল । চাদরের নিচে থেকে বেরিয় এল
রাশি-রাশি ফুল । যুবকেরা সেই ফুল বর্ষণ করল মাতৃভাষার জন্য
যুদ্ধের প্রথম বীর সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপর । এরা সকলেই ছিল ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ।
পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্র, পূর্ববাংলার উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া উর্দু ভাষা মেনে নেয়নি পূর্ববাংলা। গর্জে উঠল বাংলা । পূর্ববাংলার বাঙালাভাষী জনতা উচ্চকন্ঠে তীব্র প্রতিবাদ জানায়
এবং দাবী করে একমাত্র উর্দু নয় বাংলা ভাষাকেও আর একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি
দিতে হবে। এভাবেই ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সুত্রপাত হয় পূর্ব বাংলায়। ১৯৪৮ সালের
২রা মার্চ সর্বদলীয় সংঘর্ষ সমিতির প্রতিষ্ঠা হয় ও ১১ই মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘট ডাকা
হয়। রাস্তায় রাস্তায় মানুষ শ্লোগান দিতে
থাকে "রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা
চাই"। ১৯৫২ এর সেই
রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দিন,২১শে ফেব্রুয়ারী, সমগ্র
বিশ্ব দেখল মাতৃভাষার জন্য মানুষকে প্রাণ দিতে ।
মাতৃভাষার জন্য শহীদ
হল সালাম,বরকত , রফিক, শফিউর ও জব্বার। মাতৃভাষার জন্য এঁদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি।
অবশেষে ভাষা
আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৫৬ সালে যখন
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
ধীরেন্দ্রনাথের বক্তব্যই বাংলা ভাষা আন্দোলনকে প্রথম পর্বে একটা সাংগঠনিক রূপ দিয়েছিল । আজকের বাংলাদেশে তাঁর নামে রাস্তা আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে একটি গ্রন্থাগার আছে ও জাদুঘরে ছবিও আছে কিন্তু সাধারণ বাঙালির মনে কতখানি আছে জানা নেই । অথচ এই ব্যক্তি পূর্ব বাংলায় ( আজকের বাংলাদেশে ) ভাষা আন্দোলনের পথিকৃৎ । ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ পাকিস্তানী সেনা সপুত্র তাঁকে কুমিল্লার ময়নামতির বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় সেনা ক্যান্টনমেন্টে । অকথ্য নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে সকলের অজান্তে শেষ হয়ে গেল একটি অসাধরণ জীবন ।
তথ্য সূত্র : বাংলা ভাষার স্মরণীয় যোদ্ধা – সোনালী দত্ত ।
লেখিকার পরিচিতি - যদিও জন্ম পলাশীপাড়া, নদীয়া জেলা পশ্চিমবঙ্গ, কিন্তু তার শৈশব বেড়ে ওঠা, শিক্ষা-দীক্ষা সব এলাহাবাদেই। এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থশাস্ত্রে এম.এ.। ১৯৮১ সালে এলাহাবাদ থেকে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা তৃণীর’ প্রকাশ করতেন।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় (দেশে ও বিদেশে) লেখা প্রকাশিত হয়। হিন্দি ও ইংরাজিতেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। পানামার কবি রাখোলিও সিনান-এর দশটি স্প্যানিশ কবিতা বাংলাতে অনুবাদ করেছেন। অনুশীলন পত্রিকা, সুইডেন থেকে রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৩ সালে প্রাপ্তি। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে ঈশ্বর ও মানুষ’ (অণুগল্প ও ছোট গল্প সংকলন)।
***********
২১ শে ফেব্রুয়ারী- এই মহান দিনটির কথা ভাবতে গেলেই অনিবার্যভাবে দেশভাগের ( ১৯৪৭ ) কথা মনে আসে । স্বাধীনতার নামে ঐ অবিবেচক এবং কুৎসিত ঘটনাটি যদি না ঘটতো তবে পাকিস্তান নামে একটি কাল্পনিক পরিত্র - রাষ্ট্রের ( 'পাকিস্তান ' শব্দটির অর্থ পবিত্রস্থান ) উদ্ভব হতো না এবং ২১ শে ফেব্রুয়ারীর ঘটনাটিও ঘটতো না । কিন্তু বাস্তবে এই অনাকাঙ্খিত অসম্ভব ঘটনাগুলিই ঘটে গেছে । বলা ভালো ঘটানো সম্ভব করা হয়েছে । তবে কার কী লাভ হয়েছে জানিনা । তবে ভারতীয় বহুত্ববাদী সংস্কৃতির ঐতিহ্য বাহী ভারত - রাষ্ট্রের সর্বনাশের পথ যে খুলে দেয়া হয়েছে- সেকথা ইতিহাসের আমার দৃশ্যপটে প্রতিষ্ঠিত সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে ।
প্রখ্যাত বাংলা চলচ্চিত্রকার
শ্রী ঋত্বিক ঘটক মহাশয় তাঁর “ সুবর্ণ - রেখা “ চলচিত্রখানিতে নাকি বোঝাতে
চেয়েছিলেন দেশভাগ একটি জাতির শুধুমাত্র একটি প্রজন্মকেই উদ্বাস্তু করে দেয় না ;
পরন্তু তা সেই জাতিকে বংশ - পরম্পরায় উদ্বাস্তু করে ছাড়ে ।
অর্থাৎ জন্মের আগেই সেই জাতির পরবর্তী প্রজন্মকেও উদ্বাস্তু বানিয়ে রাখার এক সু-চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আর কি ! এমন মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা এই ভারত ।
উপমহাদেশে উত্তর - স্বাধীনতাকালে জন্মানো কোটি কোটি বাঙালির মতো বর্তমান লেখকেরও
আছে । রাজনীতির সংশ্রবহীন পরবর্তী প্রজন্মের জাতক হিসেবে
তাই অসহায় একটি প্রশ্ন এই পরিণত বয়সেও আমার মনকে কুড়ে কুড়ে খায়- মনুষ্যসৃষ্ট
এই বিপর্যয় কি রোধ করা যেতো না ? হাতে গরম রুটির মতো কী
দিয়েছিল দেশভাগ এই জাতিকে ? উত্তরটা খুঁজে পেয়েছি
বিশিষ্ট সাংবাদিক শ্রী সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত মহাশয়ের সাম্প্রতিককালের একটি লেখায় । “ভারতবর্ষের স্বাধীনতা এসেছে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ”
শিরোনামে তিনি জানিয়েছেন – ছয় লক্ষ
লোক খুন , এক কোটি চল্লিশ লক্ষ লোক তাদের পিতৃ - পুরুষের
ভিটে থেকে বিতাড়িত , এক লক্ষ তরুণী অপহৃতা , তাদের কেউ কেউ বলপূর্বক ধর্মান্তরিত- কেউ বা পণ্য হিসাবে বিক্রিত যাট
হাজার নারী ধর্ষিতা তাদের মাঝে ছয় হাজার বিকলাঙ্গে পরিণত। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার মোটামুটি এই হলো খতিয়ান
। ( দৈনিক
স্টেটসম্যান : ১৫ আগস্ট ২০১০ : শিলিগুড়ি : পৃষ্ঠা -৪) । মনোবিকলনে একটি জাতি
মানসিকভাবে সম্পূর্ণ পঙ্গু না হয়ে গেলে এমন মনুষ্যত্বহীন হৃদয় বিদারক ঘটনা, তা সে যে অজুহাতেই করা হয়ে থাকনা কেন,ভুলে
যেতে পারেনা । পারার কথাও নয় ।
তাই
ইতিহাসের কথায় কান পেতে শুনতে পাই- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে দক্ষিণ -
পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গন থেকে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু দেশের নেতৃবৃন্দকে দেশভাগ
মেনে না নেয়ার কাতর প্রার্থনা জানাচ্ছেন । বেতার তরঙ্গে ভেসে আসা সেই আকুল আবেদনে
যাঁরা কান দিলে সর্বনাশা দেশভাগ প্রতিরোধ করা যেতো- আমাদের দুর্ভাগ্য ( বিশেষত
বাঙালিদের ) তাঁরা তা শুনেও শোনেননি । অনিবার্য পরিণতি যা হওয়ার তাই হলো ।
মাতৃভূমির অঙ্গচ্ছেদে রক্তাক্ত হলো আমাদের জীবন ,
আমাদের সমাজ , আমাদের স্বপ্ন- যে স্বপ্ন
- সাধনায় সর্বস্ব পণ করেছিল দেশের মানুষ । স্বাধীনতার রঙ্গমঞ্চে অভিনীত এই
কুনাট্যের সাথে নব - গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে মঞ্চস্থ হতে দেখা গেল আর এক
বিস্ময়কর রঙ্গ - নাট্য । রাজধানী রওয়ালপিন্ডি থেকে উড়ে এসে বাঙালির পিন্ডি চট্কাতে
পূর্ব - বাংলার ( পূর্ব - পাকিস্তানের ) ঢাকা শহরে দাঁড়িয়ে জিন্না দ্ব্যর্থহীন
ভাষায় জানিয়ে দিলেন- উর্দুই হবে সে দেশের রাষ্ট্রভাষা । তাজ্জব কি বাত্ ! যে
অঞ্চলগুলি কাল্পনিক পবিত্র রাষ্ট্রটির অন্তর্ভূক্ত হলো সেইসব কোন অঞ্চলের মানুষের
মাতৃভাষাই উর্দু নয় । তদুপরি সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের বাংলা ভাষার ন্যায্য দাবিকেই
নস্যাৎ করা হলো বাংলার বুকে দাঁড়িয়েই ।
এই
উপমহাদেশে কত কীই না হয় ! ভগবান পরশুরামের দেশ এই ভারতবর্ষ । শুধুমাত্র পিতার
আদেশ পালন করতে তিনি মাতৃহত্যা পাপ করেছিলেন । সেই দেশের মানুষ আমরা। মাতৃভূমির
অঙ্গচ্ছেদ তো আমাদেরই করতে হবে । মাতৃভাষা অপবিত্রজ্ঞানে পরিত্যাগ তো করতেই হবে ।
নইলে কীসের জন্য সেই বিখ্যাত উক্তি : “সত্য
সেলুকাস , কী বিচিত্র এই দেশ ভারতবর্ষ । ” দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ভারতের মতো আরো কিছু দেশ জার্মানি, ভিয়েতনাম,কোরিয়া ইত্যাদিও ভাগ হয়েছিল ।
কিন্তু তারা কেউই বিভক্ত দেশের নাম থেকে নিজেদের মাতৃভূমির মূল নামটি এবং মাতৃভাষা
পরিত্যাগ করেনি । ব্যতিক্রম শুধু আমাদের ভারতবর্ষের পাকিস্তান – যে নামের কোন ঐতিহাসিক , সামাজিক , সাংস্কৃতিক , নৃতাত্ত্বিক ভিত্তিই নেই । তবু
একপক্ষের ‘‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান ” – এর রণহুঙ্কার ; আরেক পক্ষের রণক্লান্ত অবসন্ন
মানসিকতার প্রশ্রয়ে তা প্রতিষ্ঠা পেয়েই গেল । এ আমাদের জাতির জীবনে জীন ( Gene
) বাহিত মাতৃ - হত্যার ঐতিহাসিক পাপ প্রবণতা । এ পাপের মূল্য
আমরা দিয়েই চলেছি । এর শেষ কোথায় জানিনা । তবে ভগবান পরশুরাম দীর্ঘদিনের বহু
সাধ্য - সাধনায় প্রায়শ্চিত্ত করে পাপমুক্ত হতে পেরেছিলেন । সেই প্রায়শ্চিত্তের
এক ক্ষীণ প্রয়াস দেখতে পেয়েছি যখন শেখ মুজিবর রহমান ও ঢাকার বাঙালি ছাত্ররা
জিন্নার মুখের উপর বলে দিয়েছিলেন না । উর্দু নয় । বাঙালির প্রায়শ্চিত্তের সাধ্য
- সাধনার সেই শুরু । ২১ শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ , যার
প্রতিশ্রুতিময় অভিব্যক্তি মাত্র । বাংলা ভাষা শহীদ দিবস থেকে একাত্তরের
মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে ১৯৯৯ – এ রাষ্ট্রসংঘ ঘোষিত বিশ্বমাতৃভাষা দিবস যার মহত্তর উত্তরণ । এত কিছুর পরেও
প্রায়শ্চিত্তের প্রশ্ন তবু যেন অমীমাংসিত থেকেই যায় !
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের কথা উল্লেখ করেছি । সে সময়ের আর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ
না করে পারছিনা । সবাই জানেন , ইঙ্গ - মার্কিন
বিজয়ীপক্ষ মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের জন্য ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।
প্যালেস্তেনীয়রা পার্শ্ববর্তী দেশে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় পায় । সেই
প্যালেস্তেনীয় এক উদ্বাস্তু কবির একটি কবিতা ( বাংলায় অনূদিত ) পড়ার সৌভাগ্য
আমার হয়েছিল গত শতকের আশির দশকে । তিনি তাঁর কবিতায় উদ্বাস্তু তাঁবুর শিবিরে বসে
লিখেছিলেন- স্বপ্নে তিনি তাঁর ফেলে আসা গ্রামে ফিরে ফিরে যান । দেখতে পান ভালবাসার
সব স্মৃতি - বিজড়িত ঘরবাড়ি ,আঙ্গুর ক্ষেতে .... ইত্যাদি ।
ইয়াসের আরাফাতের নেতৃত্বে প্যালেস্তেনীয়দের স্বাধীনতা সংগ্রাম সফলতা পায় ।
উদ্বাস্তু সেই কবি নিজ গ্রমে ফিরে যান ।
অথচ আমার বাঙালি
জীবনে ভাগ্যের কি বিচিত্র পরিহাস- দেশ স্বাধীন হলে আমাকে দেশান্তরী হয়ে উদ্বাস্তু
হতে হয় ; দেশ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভ করলে নিজ
গ্রামে ফিরে যাওয়ার অধিকার থাকে না পাসপোর্ট , ভিসা,
সীমান্ত রেখার বাধায় । কিন্তু ঘুমোলে আমিও মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখি
আমার ফেলে আসা গ্রামের করুণ দৃশ্যাবলী । আমিও কবিতা লিখি । তবে একুশে ফেব্রুয়ারীর
দেশের মানুষ বলে সেই কবিতায় থাকে অপ্রাপ্তির বেদনাঘন অসহায় অনুভবের কথা :
আমি আর তোমায় দেখবো না
আমার জলপরী ;
দেখবো না তোমার রাঙামাটির পথ
ধানক্ষেত নদী আর পুকুর
দেখবোনা বাঁশবন নীলাকাশ
বাতাসে শিমুল তুলো ওড়া
বর্ষায় দুধ - সাদা বক ; নিদাঘ
দুপুর –
দেখবোনা কোন কিছু আর ।
তবু অনেক দূরে স্থির ঘুমে
রাতের করুণ স্পর্শে স্বপ্ন দেখি তোমাকে
আমাকে ছুঁয়ে তুমি নীরব নিবিড়তায় লীন-
অন্তরে ভেসে ওঠে নীলাকাশ
সাদা মেঘ বৃষ্টি বাতাস .....
( জলপরী )
লেখক পরিচিতি :
জন্ম দিনাজপুর শহরে (১৩৬০ বঙ্গাব্দে)। অবসরপ্রাপ্ত বাণিজ্য বিষয়ের অধ্যাপক। উত্তরবঙ্গের লেখক। উল্লেখযোগ্য বই : " ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা" ( অণু- কাব্য-গ্রন্থ ) , "গল্পের আঁকিবুকি" ( গল্প- গ্রন্থ), " The Least Developed SAARC Members : Bangadesh, Bhutan, Nepal & Maldives" ( প্রবন্ধ-গ্রন্থ ) ইত্যাদি ।
বঙ্গ ও বর্হিবঙ্গের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন ।
**********
সাজিভরা বর্ণফুল-
অতসী অপরাজিতা
আকন্দ আলোকলতা
কৃষ্ণকমল কদম্ব কেয়া
গেঁথে গেঁথে চন্দ্রহার
কিরীট কাঁকন কেয়ূর…
এক আকাশ শব্দমালা
ঝরায় আলোর ফুল অফুরান
অস্তিত্বের গহন গভীরে নাভিমূলে-
মা বাবা বান্ধব সন্ততি,
কপোতাক্ষ গঙ্গা মেঘনা
বীরসিংহ জোড়াসাঁকো
চুরুলিয়া পথ বেয়ে ধানসিঁড়ি...
আহ্লাদে আদরে মাখা বর্ণমালা
ভিটেমাটি মায়াছাদ আশ্বাস
নিবিড় চুম্বক টানে দু হাত বাড়ায়,
বারো মাস তেরো পার্বণ
দিনলিপি উষ্ণ লালন
শুকতারা শিশির শালুক
হিজল আউল বাউল বট
জোনাক-তুলসীতলা সন্ধ্যাদীপ-
ঘামতেলে ধোয়া ফুটে থাকে
মা-র মুখ আকাশপ্রদীপ।
কবি পরিচিতি
-
কবিতা, নিবন্ধ, ভ্রমণসাহিত্য, গল্প, উপন্যাস নিয়ে তাঁর কাজ। দিল্লি ও বৃহৎবঙ্গের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, বাংলায় বেশ কিছু ক্ষুদ্র পত্রিকা, আনন্দবাজার, সাপ্তাহিক বর্তমান, রবিবাসরীয় বর্তমান, আজকাল সফর, কৃত্তিবাস, কবি সম্মেলন, উদ্বোধন, নিবোধত, ইত্যাদিতে কবিতা এবং গদ্য দুইই প্রকাশিত হয়েছে, হচ্ছে।
আকাশবাণী, বাংলা টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেল, বাংলাদেশ টিভি ছাড়াও নানা মঞ্চে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বাংলাদেশ জাতীয় কবিতা উৎসব এবং একুশে বইমেলায় দিল্লির প্রথম অংশগ্রহণকারী দলে সদস্য।
দুটি কবিতা সংকলন
‘ছুয়েঁ দাও মরুভূমি’ ও ‘রোমাঞ্চ ভ্রমণে’ প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা বইমেলায়। বিভিন্ন সাহিত্য সম্মানে সম্মানিত দিল্লি রাজধানীক্ষেত্র ইন্দিরাপুরম-এর এই সাহিত্যপ্রেমী
দিল্লি বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশিত ‘দিগঙ্গন’ এবং
কলকাতা বইমেলায় বহির্বঙ্গের শ্রেষ্ঠ লিটল ম্যাগাজিন সম্মানে পুরস্কৃত ‘উন্মুক্ত
উচ্ছ্বাস’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য।
**********
একুশ আমার
কৃষ্ণা মিশ্র
ভট্টাচার্য
আজ যদি আকাশের বুক চিরে লেখা হয় তোমাদের নাম
আগুন কিংবা রক্তের অক্ষরে
বিষণ্ণ রাতের নীল ধ্রুবতারা-র মুখ ছুঁয়ে
গ্রানাইটের খাঁজে খাঁজে রুক্ষ মাটির ক্যানভাসের
তিলক জুড়ে
পাথরে বালুতে গোড়ালি ডুবোনো ঝিরঝির
ঝর্ণার জলে
শালবনে,মহুয়ার গভীর ছায়া পল্লবে
পাগলা ঝোরার টুং টাং সকালের নূপুরের
ছন্দে
আজ যদি শেষ জোছনার মায়াময় মেহফিলে
কালপুরুষের তর্জনী মন্দ্রে লেখা হয়
তোমাদের নাম
মেঘ মল্লারের কান্না জড়ানো বর্ণালী
পালকে
বাংলার নরম মাটির ,হাওরের, জলে
ফুটে থাকা
শাপলা ,শালুকে
কলমিলতার দোদুল ফুলের টুপটাপ ঝরে পড়া
জলজ শব্দে
আজ যদি মেঘনা, পদ্মা, সুরমা
বরাকের
ডহরের ঘোর লাগা উত্তাল জল কল্লোলে
রক্তগভীরে
মৃত্যু উপত্যকা জুড়ে দরবারী কানাড়ায়
বেজে ওঠে
তোমাদের নাম
একুশ আমার, ঊনিশ আমার
তোমাকে প্রণাম
তোমাকে সালাম।।
লেখক পরিচিতি –
জন্ম-কলকাতা য় ।আসামের বরাক উপত্যকায় বড় হয়ে ওঠা ।
প্রকাশিত গ্রন্থ
১--সাপ শিশির খায় (গল্প গ্রন্থ)
২--দেবী দহন--(কবিতা গ্রন্থ)
ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত
প্রকাশিত অডিও ভিডিও সিডি--দিল্লি হাটার্স তিন কবি
********************
বাংলা
আশীষ কুন্ডু
মা - মা -,হয়েছিল শুরু
ভাষা তো ভাবের গুরু
মন তো শিষ্য ভাবের
মন অধীন মস্তিষ্কের !
বাংলা আমার ভাষা
স্বপ্ন দেখার পরিভাষা
আমার চরম সুখের
ব্যক্ত বেদনা দুঃখের !
বাংলা এত মিস্টি ভাষা
দেয় বুকে বল ও আশা
বর্ণপরিচয়ে শেখা শুরু
বাংলাই আমার গুরু!
ভাষার লড়াইয়ে রেশ
জন্ম নিল বাংলাদেশ
বাংলার জগদীশ বোস
নেতাজী,সত্যেন বোস!
রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ
রবি ঠাকুর, অরবিন্দ
নজরুল ও মধুসূদন
সত্যজিৎ,অমর্ত্য সেন!
সব ক্ষেত্রে সব বিষয়ে
আমরা বাঙালী এগিয়ে
এ ভাষায় "জণগণমন "
বন্দেমাতরম রাস্ট্রগান!
"আমার সোনার বাংলা"
পদ্মায় স্বপ্নের ভেলা
বাংলা ভাবি বাংলা বলি
বাউল গানে পথ চলি।
কবি পরিচিতি -
পেশায় স্বনিয়োজিত সংস্থায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। পরিবেশবিদ, আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা Health Climate Initiatives এর সঙ্গে যুক্ত ।
**********
মাতৃজঠরের ঘেরাটোপের গভীর অন্ধকারে
আমাদের রক্ষা করে যে মা
তার মমতার ভাষা
কর্ণকুহরে প্রবেশের আগে
গেঁথে যায় আমাদের মর্মের গহীন অতলে ।
মা আমাদের সঙ্গে
সুখে দুঃখে সর্ব সময় সর্বক্ষণ ;
আমাদের মানসিকতার বিকাশ ,
বুদ্ধির প্রকাশ , সংস্কৃতি বোধের প্রসার
ঘটেছে তার সাথে দিনরাতের
কথোপকথনের ভাষায় ,
আমাদের এক পরিপূর্ণ জীবন গড়ে উঠেছে
এক সত্তায় একই মাতৃভাষায় ।
আমরা জেনেছি মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধসম ,
সেই ভাষার অবমাননায়
লাঞ্ছিত হয় আমাদের মা ,
মাতৃভাষা রক্ষা আমাদের
মাতৃঋণ পরিশোধের প্রথম সোপান ।
তার স্বীকৃতিতে আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবসের আয়োজন
চেতনা জাগায় আমাদের বোধের ।
কোন রাজশক্তি পারে না ছিনিয়ে নিতে
বহু সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ের বিনিময়ে
অর্জিত চিরায়ত এই অধিকার ।
কবি পরিচিতি-
তপন চ্যাটার্জীর জন্ম কলকাতার উপকণ্ঠে কাঁচরাপাড়ায়। শিক্ষাগত যোগ্যতায় BE(Elect.),MBA এবং সর্বভারতীয় ইঞ্জিনীয়ারিং সারভিস্ পরীক্ষা দিয়ে CEA তে Asstt. Director পদে যোগ দিয়ে ২০০৯ সালে Chief Engineer পদ থেকে অবসর নিয়েছিলেন। এরপর কয়েক মাস GERC তে Consultant পদে কর্মরত থাকার পর আসাম ইলেকট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশনে (AERC) Member পদে যোগ দিয়ে ২০১৪ সালে অবসর নেন।
চাকরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এবং আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি, ব্রিটেন ও সমগ্র পশ্চিম ইউরোপে বেশ কয়েকবার ভ্রমণ করেছেন। বিভিন্ন টেকনিক্যাল ম্যাগাজিন ও সেমিনারে লেখা প্রকাশিত হয়েছে ও Guest Faculty তে ছিলেন।
সাহিত্যের জগতে তপন চ্যাটার্জী কবিতা ,গল্প ,ভ্রমণ কাহিনী এবং প্রবন্ধ লেখেন ও বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় এবং একটি কবিতার বই আছে।
একজন বাচিক শিল্পী হিসেবে তপন চ্যাটার্জীর বেশ কয়েকটি আবৃত্তি এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান YouTube এবং Facebook এ আছে ও সমাদৃত হয়েছে।