নৈনিতাল ঘুরতে গিয়েছি ।
প্রথমবার যাওয়া তাই একেবারেই অচেনা জায়গাটা । বাস থেকে নেমে কোনো হোটেলে উঠব
ভাবছি এর মধ্যে দেখা হয়ে গেল আমার এক কাকুর সঙ্গে,তিনি আর্মিতে চাকরি করেন । জায়গাটা বেশ নিরিবিলি বিশেষ কোনো লোকজন নেই
। কাকুকে দেখে বেশ খুশি হল মনে । যেন মেঘ না চাইতেই জল । অচেনা অজানা জায়গায় যদি
নিজের কাউকে পাওয়া যায় তার মত খুশি আর কিছুতেই হয়না । কাকুর সঙ্গে কাকুর একজন
কলিগও ছিলেন । কাকু জানালেন এখানে একটু দূরে একটা আর্মি ক্যাম্প আছে । সেখানে একটা
অনুষ্ঠানের উনি চিফ গেষ্ট হয়ে এসেছেন । কাকু আমাকে সঙ্গে যেতে বললেন।
কাকু বললেন ,
"কতদিন পর তোর সঙ্গে দেখা বলতো!
একটু কথাও বলতে পারলাম না ঠিক মত । চল আমার সঙ্গে অনুষ্ঠানটাও এনজয় করা যাবে আর
দুজনে গল্পও করতে পারব । "
সত্যি কথা বলতে কি আমারও
ইচ্ছে হচ্ছিল কাকুর সঙ্গে আরও একটু সময় কাটাই,তাই আর না করলাম না। কাকুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে চলতে শুরু করলাম ।
মেইন রোড থেকে নেমে একটা গ্রামের ভেতরে ঢুকলাম । রাস্তা পাকা কিন্তু সরু । দুদিকে
চাষের জমি । অপূর্ব সুন্দর একটি গ্রাম । চারিদিক সবুজে সাজানো । লোকজন খুবই কম ।
দূরে দূরে দু-একজন লোক দেখা যাচ্ছে । আমরা যেদিকে যাচ্ছি
তারাও সেদিকেই যাচ্ছে । কারোই মুখ দেখা যাচ্ছে না । কাকুর সঙ্গে গল্প করতে করতে
হাঁটছি । একটা রিক্সাও নেই কোথাও । অগত্যা হাঁটতেই হবে । কিছুক্ষণ পর কাকু আর
কাকুর কলিগকে আর দেখতে পাচ্ছিনা । ওনারা দুজন এত জোরে
হেঁটেছে যে আমি আর ধরতে পারিনি । পাশে দেখি আমার ঠাম্মা ।
ঠাম্মা বললো – তোর কোনও ভয় নেই। আমিতো আছি তোর সাথে। কাকুদের মনে হয় দেরী হয়ে
গেছে, তাই ওরা তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেছে।
আমি বললাম " তুমি
কোথা থেকে এলে ? "
- " আমি তো তোর সাথে
সাথেই আসছিলাম, তুই কি ভুলে গেছিস? আমি
আর কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে লাগলাম । একটু দূরে গিয়ে রাস্তাটা দুদিকে ডিভাইড হয়ে
গেছে । একটা গেছে উত্তর দিকে আর একটা গেছে দক্ষিণ পশ্চিম কোণাকুণি ৷ কোন দিকে যাই
... ঠাম্মা উত্তর দিকে চলতে বলল । কাউকে দেখছি না যে তাকে জিজ্ঞেস করব । একটু দূরে
গিয়ে দেখি একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা আমাদের দিকে আসছেন । বেশ ভদ্র এবং শিক্ষিত মনে হল
। ওনাকে দেখে একটু ভরসা পেলাম । বললাম , "আন্টি আমরা
আর্মি ক্যাম্প যাব সেটা কোন দিকে ? "
আন্টি বললেন - তোমরা ভুল করে অন্য পথে এসেছো। ওই দিকের
রাস্তাটায় যাও, বলে অন্য দিকে একটা রাস্তা দেখিয়ে দিলেন।
আমরা রাস্তা পরিবর্তন
করলাম । উনিও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলতে লাগলেন । আমি চলছি আর চারিদিকের দৃশ্য দুচোখ
ভরে দেখছি । চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে । এক জায়গায় দেখলাম হোগলার ক্ষেত । কি সুন্দর
ফুল ফুটে আছে । কাশ ফুলে ভরে আছে দিগন্ত । কাশফুল ও হোগলা ফুলগুলো এত লম্বা লম্বা
হয়েছে যেন আকাশ ছোঁয়ার পরিকল্পনা তাদের । আমার খুব ইচ্ছে হলো একটি হোগলা ফুল
নিয়ে যাই ,সবাইকে দেখাতে পারব । বৃদ্ধা
মহিলাকে বললাম , আপনার কাছে চাকু জাতীয়
কিছু আছে ? আমি একটা হোগলা ফুল কাটব " ।
উনি বললেন ,"নেই " । সামনে একজন বৃদ্ধ কৃষককে দেখলাম । ওনাকে বললাম ,
"আঙ্কেল, কাটনে কে লিয়ে কুছ মিলেগা? ইয়ে ফুল ম্যাঁ ঘর লে জানা চাহতা হুঁ।ম্যাঁ
কবি হুঁ। মেরা কবিতা মে ইয়ে ফুলকে বাড়ে মে লিখা হুঁ, লেকিন বহুল লোগো কো ইয়ে ফুলকে
বাড়ে মে পাতা হি নেহি। ম্যাঁ উনলোগো কো দেখানে চাহতা হুঁ। একথা বলে আমি একটু এগিয়ে
যেতেই যেতেই উনি চোখের নিমিষে উধাও হয়ে
গেলেন। পাশে একটি বাড়ি আছে যেখান থেকে সবাই আমাদের দেখছিল ।
ভাবলাম ওই বাড়ি থেকে একটা ছুরি /চাকু নিয়ে আসি । বাড়ি
ঢুকে দেখি কেউ কোথাও নেই । তখন গা টা কেমন ছমছম করে উঠলো । ভয়ে কেঁপে উঠলো আত্মা
। বুঝতে পারলাম কিছু একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার ঘটছে এখানে ।
ঠাম্মাকে বললাম চলো ফিরে চলো । হনহন করে হাঁটতে শুরু করলাম মেইন রোডের দিকে । একটু
দূরে এসে পিছন ফিরে একবার তাকালাম দেখি সেই বৃদ্ধা মহিলা সাদা চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছেন । পিছনের চুল গুলোকে সামনে টেনে এনেছেন এখন
আর মুখ দেখা যাচ্ছে না ।
আমি তাকাতে উনি বললেন , "যা চলে যা । সেই অনুষ্ঠান অনেক আগেই হয়ে গেছে । এই গ্রামের সব মানুষ সেই
অনুষ্ঠানে ছিল । সেখানে আত্মঘাতী হামলা হয় । সব শেষ হয়ে গেল
। ওখানে মনে হয় আর কেউ বেঁচে নেই ! বলেই উচ্চস্বরে হা হা হা হা করে হাসতে লাগলেন । আমাদের
তখন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছি প্রায়। দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম। পাগুলো যেন চলছিলই না। মেইন রোডের কাছাকাছি আসতেই
নজরে এলো খুব সুন্দর সুন্দর লাল, নীল, হলুদ কটা মুরগির বাচ্চা আমার পেছনে পেছনে আসছে । দু’হাতে তুলে নিলাম তাদের । রাস্তায় উঠে দেখি একটা মিনি বাস দাঁড়িয়ে ।
দৌড়াতে দৌড়াতে গিয়ে উঠে পড়লাম বাসে । বাসেও খুব একটা ভীড় নেই । একজন বললেন ,"বাচ্চাগুলোকে বাসের মধ্যে ছেড়ে দিন ওদের আর কোনো ভয় নেই । মুরগির
বাচ্চাগুলোকে একটু আদর করে বাসের মধ্যেই ছেড়ে দিয়ে ঠাম্মাকে খুঁজতে লাগলাম ।
কোথাও নেই তিনি । বাস ছেড়ে দিল । বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার সেই কাকু একটু
দূরে দাঁড়িয়ে আছেন । আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছেন । বড্ড করুন ছিল সে দৃষ্টি
...
লেখিকার পরিচিতি -
কৈশোর কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার একটি গ্রামে। বৈবাহিক সূত্রে দিল্লিতে আসা । ছোটবেলা থেকেই লেখালিখি শুরু। স্কুলের ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশিত হত।
এ পর্যন্ত ছয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দিল্লি, কলকাতা এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লেখা প্রকাশিত হয় । প্রতিদিনই কিছু না কিছু লেখেন। লেখার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পান।