সরস্বতী পূজা
নিয়ে লিখেছেন
ড. প্রকাশ অধিকারী এবং
অনন্ত কৃষ্ণ দে
ভগবানের রাজ-দরবারে
একজন
শিক্ষা-মন্ত্রী আছেন---
তিনি মা
সরস্বতী ।
তাঁর
দপ্তরে বিদ্যা, শিক্ষা, তথ্য, সংস্কৃতি
সব এক হাতে
সামলান...
সুপার-সোনিক
বিমান শ্বেত রাজ-হংস
তাঁর বাহন
।
দৈব
শক্তির পরেই
মানুষের
মাঝে শ্রেষ্ঠ শক্তি
বিদ্যা-বুদ্ধি
তিনি বিলোন ।
তাই , আমরা বলি---
বুদ্ধিং
যস্য , বলং তস্য
!
ধন-বল , জন-বল , ক্ষাত্র-বল---
বিদ্যা
বিনে সবই বিফল...
আমরা
মনুষ্য-শিশু
সদা হীনবল---
তাই , ভক্তিভরে প্রার্থনা জানাই :
সরস্বতী
মহাভাগে
বিদ্যেকমললোচনে
,
বিশ্বরূপে
বিশালাক্ষী
বিদ্যাং
দেহি
নমস্তুতে
।
মা তুমি
আমাদের বিদ্যা দাও
বুদ্ধি
দাও, জ্ঞান দাও, বিবেক দাও
বৈরাগ্যও
দাও---
যেন আমরা
মানুষ হই !
আমাদের
প্রার্থনা স্বীকার করো---
বিদ্যাবত্তায়
মানুষ করো...
কবি পরিচিতি :
জন্ম দিনাজপুর শহরে (১৩৬০ বঙ্গাব্দে)। অবসরপ্রাপ্ত বাণিজ্য বিষয়ের অধ্যাপক। উত্তরবঙ্গের লেখক। উল্লেখযোগ্য বই : " ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা" ( অণু- কাব্য-গ্রন্থ ) , "গল্পের আঁকিবুকি" ( গল্প- গ্রন্থ), " The Least Developed SAARC Members : Bangadesh, Bhutan, Nepal & Maldives" ( প্রবন্ধ-গ্রন্থ ) ইত্যাদি ।
বঙ্গ ও বর্হিবঙ্গের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখেন ।
**********
খবরের কাগজের প্যাকেট-টা সুজিতের হাতে দিয়ে সুব্রত বলল, “এই নে, বাবার কাচানো ধুতি, বাদশা-দা কে দিয়ে কুঁচিয়ে নিস। তোর
চুলটাও ভালো করে কেটে সেট করে নিস, বেশ
একটা ধেড়ে কার্ত্তিক এর মতো লাগবে।“ বাদশা দার সেলুন থেকেই সুজিত চুল কাটে। আর
আমাদের পাড়ায় বাদশা নাপিত ধুতি কোচাঁতে খুব পারদর্শী। এই
জন্য অন্য পাড়াতেও বাদশা দা’র বেশ কদর আছে। সুব্রতর কথায় রকে উপস্থিত সবাই হেসে উঠলাম। গতকাল রাতেই
ঠিক হয়েছে এবারে সরস্বতী পূজাতে আমরা সবাই
একযোগে ধুতি-পাঞ্জাবী পড়বো। রকে প্রস্তাবটা পেশ করেছিল ভোম্বল। অরুন সন্মতি
জানিয়েছিল। চারজন অর্থাৎ আমি, সৌমেন, বিশু
আর দেবা ভোম্বলের পক্ষেই রায় দিলাম। অসীম বিকল্প প্রস্তাবে পায়জামা
পাঞ্জাবী-র কথা বলল। কিন্তু বাদ সাধলো
সুজিত। সে ‘নোটা’ বেছে নিল। প্রথমত বাড়িতে ধুতি নেই এবং দ্বিতীয়ত তার এই চার ফুট
দশ ইঞ্চি মার্কা হাইটে ধুতি পড়লে জোকার জোকার লাগবে। এর পরেই সুজিতের উপর এ্যাটাক
শুরু হলো। কিল, গাট্টা ও চড় সমানে চলতে লাগলো। সুব্রত টিউশন থেকে ফিরে এসে সুজিতকে
স্রেফ সাইডে নিয়ে গিয়ে রক্ষা করলো। সুজিতের ধুতির দায়িত্ব নিল সুব্রত। বিশু
চিরকালই একটু খুতখুতে স্বভাবের। সে প্রস্তাবের পক্ষে সায় দিয়েও ধুতি পাঞ্জাবী পড়ে
মেয়েদের স্কুলের সামনে ...। ব্যাপারটা কেমন যেন সেকেলে টাইপের লাগছিলো তার। এখন
আলট্রা মডার্ন যুগ। স্পাইক চুল, লাল-নীল জাম্বো টি শার্ট, মুখে অমিতাভ বচ্চনের
দিওয়ার এর কায়দায় ঝুলন্ত সিগারেট, চোখে নীল চশমা। তবেই না মেয়েরা পটবে। বাঙ্গালীর
ভ্যালেন্টাইন ডে এই সরস্বতী পূজা। এদিন ছেলেদের সিগারেটে হাতেখড়ি আর মেয়েরা প্রথম
কদম ফুলের সন্ধান পায়। অবশেষে ঠিক হল সাত রকবাজ সরস্বতী পূজার দিন ধুতি পাঞ্জাবী
পড়ে জ্যান্ত লক্ষ্মী-সরস্বতীর প্রতীক্ষা করবে।
আজ সরস্বতী পূজা। বাঙ্গালীর ভ্যালেন্টাইন ডে। কিন্তু গতকাল রাত থেকে আকাশের অবস্থা খারাপ। ঝড়ো হাওয়া বইছে। ভোর থেকে আবার বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। সরস্বতী পূজার দফা-রফা হবে মনে হচ্ছে। এই দুর্্যোগের মঝে সাত-সকালে অরুন এক কান্ড করে বসলো। সবাইকে রকে জড় করে ছাতা মাথায় আমরা গেলাম ছিনাথ লেনে মুজিব মিষ্টান্ন ভাণ্ডার-এ। আজ চিরাচরিত নিয়ম ভাঙ্গা হবে। কচুরি-সিঙ্গারা আর জিলিপি খেয়ে অঞ্জলি দেওয়া হবে। সুজিত খেতে চাইছিলো না, বিশু জোর করে একটা জিলিপি মুখে ঢুকিয়ে দিলো। অরুন গতকাল তার ছাত্রী কাম প্রেমিকা কল্পনা দের বাড়ি থেকে টিউশনের টাকা পেয়েছে। তাই এই বিলি ব্যবস্থা। টিউশন প্রায় আমরা সকলেই কম বেশী করতাম। কিন্তু অরুন মেধাবী তাই ওর ছাত্র-ছাত্রীর সংখা বেশী। সেদিন সকালে পেটপুজো করে আমরা ঠিক করলাম সকাল এগারো-টার সময় আবার মিলিত হবো। কিন্তু বৃষ্টি ধরলে হয়! ছাতা মাথায় করেই আমরা বাড়ি ফিরলাম।
বৃষ্টি সেদিন ভিলেনের মতো আমাদের মত অনেকের বুকে তীর বিঁধে বেলার দিকে বিদায় নিল। বৃষ্টি থামলো বটে, কিন্তু রাস্তায় জল-কাদার জন্য ধুতি-পাঞ্জাবীরা আলমারিতে মাথা ঠুকতে লাগলো। সাধারন পোষাকে বাইরে এসে দেখলাম পূজো বেশ জমে উঠেছে। পূজা প্যান্ডেল গুলো থেকে বেশ উচ্চগ্রামে মাইকে গান বাজছে। আমার বাড়ির সামনের মেয়েদের স্কুলের সামনে বেশ ভিড়। শাড়ি পড়া মেয়েদের সংখ্যাই বেশী। ছেলেরা তীর্থের কাকের মত স্কুলের দিকে তাকিয়ে আছে। কখন তাদের প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হবে। এর মধ্যে অনেক বে-পাড়ার ছেলেকে দেখা গেল। অঞ্জন দত্ত তখনো গান লেখেন নি। আমদের ঠেকে অরুন ছাড়া তখন প্রায় সবাই এসে গেছে। বিশু তার সাইকেল নিয়ে এসেছে। অরুন,কল্পনাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। আজ সবার হাতেই জলন্ত সিগারেট। কাউন্টার পার্টের জন্য কেউ আর অপেক্ষা করছে না। আজ বিশেষ দিন। হটাত বিশু একটা কান্ড করে বসল। দূর থেকে মনীষা-কে দেখে মুখে জলন্ত সিগারেট নিয়ে সাইকেলে চেপে কায়দা মারতে লাগলো। মনীষা কাছে আসতেই বিশু যেন আরো চনমনে হয়ে উঠলো। সাইকেল টা নিয়ে মনীষার পিছন পিছন যেতে গিয়ে ভারসাম্য রাখতে না পেরে একটা পা ঝপাং করে নর্দমার জলে পড়ল। কাদাজল ছিটকে মনীষার সিল্কের শড়ির থেকে মুখের অবস্থা তখন দেখার মত! বসন্ত বিলাপ সিনেমার এটা একটা ভালো দৃশ্য হতে পারতো। যাই হোক সেদিন ব্যাপারটা আর বেশীদুর গড়ায়নি। তবে তারপর থেকে মনীষা কে দেখলে বিশু একটু অফ সাইটে থাকতো।
সকালে কচুরী নিমকি খেয়ে আমরা পুরোনো স্কুলে অঞ্জলি দিতে গেলাম। বেশ কিছু স্যারের সঙ্গে দেখা হল। বেশ বড় ঠাকুর। ছেলেরা ভালো সাজিয়েছে। সংস্কৃত শিক্ষক বরেন বাবু স্যার পূজা করবেন। উনি আমাদের কুশল জিজ্ঞাসা করে হাতে ফুল দিলেন। “জয় জয় দেবী চরাচরসারে, কুচযুগ-“ পুস্পঞ্জলির মন্ত্র শেষ হয় আর উপস্থিত অনেক দুষ্টু ছেলের ফুল ঠাকুরের পায়ে না পড়ে বরেন বাবু স্যারের গায়ে পড়তে থাকে। আমরা হাসতে থাকি কিন্তু হতবাক হই না। শুধু স্কুল জীবনের কথা ভেবে নস্টলজিক হই।
সরস্বতী পুজার আর একটা ঘটনা আজ খুব মনে পরছে। আমরা তখন স্কুলে ক্লাস টেন-এ পড়ি। নিয়ম অনুসারে দশম শ্রেনীর ছাত্ররা সরস্বতী পুজার দায়িত্বভার গ্রহন করে। আমরা চার-পাঁচজন স্কুলের মাতব্বর ছিলাম। পড়াশুনায় একটু ভালো রেজাল্ট করার জন্য স্যারেদেরও প্রিয়প্রাত্র ছিলাম। আগে আমাদের স্কুলে পাত পেড়ে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। বছর দুই ধরে প্যাকেট চালু করা হয়েছে। বসিয়ে খাওয়ানোর খুব হ্যাপা। পুজোর আগের দিন সব ব্যবস্থা শেষ করে আমরা ঠিক করলাম রাতে নির্ঝঞ্ঝাটে প্যাকেটিং করবো।
কাগজের বাক্সোতে চারটে লুচি, চার পিস আলুরদম, বোঁদে আর একটা করে লেডিকেনি দিয়ে সরস্বতী পূজার প্যাকেট তৈরী করা হচ্ছে। আমি, তপন, অমল আর বাবুল। আমরা চারজনেই এই মধ্যরাতে এই কাজের দায়িত্ব নিয়েছি। স্কুলের হলঘরে কাজ চলছে। অনেকগুলো প্যকেট রেডি হওয়ার পর তপন বলল, “একটু দম নিয়ে নিই। “ তপন ফুঁকত, এটা আমরা জানতাম। কিন্তু স্কুলে! শেষের দিকে এসে বাবুল টয়লেটে যেতে চাইলো। অমল ওপরেই রইলো। তিনজনে নিচে নেমে দেখি গেটে তালা দেওয়া। টয়লেট গেটের বাইরে, মাঠের এককোণে। দারোয়ান মথুর গেটে তালা দিয়ে খাটিয়ায় নাক ডাকছে। মথুর বিহারীর নাক ডাকার সে কি আওয়াজ! চাবি তো মথুরের কাছে, তালা খুলবো কি করে? মথুরের খাটিয়ার কাছে গিয়ে অনেক ডাকাডাকির পরেও ঘুম ভাঙ্গানো গেল না। অতপরঃ। তপন একটা উপায় বার করলো। হলঘরে জগে খাওয়ার জল ছিল। তপন জল নিয়ে এসে মথুরের পেটের ঠিক তলায় বেশ খানিকটা ঢেলে দিল। মথুরের নাকডাকা বন্ধ হয়ে গেল, চিৎকার করে গালিগালাজ করতে করতে খাটিয়ায় উঠে বসতেই আমরা সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উপরের হলঘরে। খানিক পরে আমরা নিচে টয়লেটে যেতে গিয়ে দেখি, মথুর বাইরের রাস্তায় পাড়ার ছেলেদের বাপ-বাপান্ত করছে। সকালে হেড স্যারের কাছে অবশ্য শুনেছিলাম পাড়ার ছেলেরা রাতে মথুরকে বিরক্ত করেছে আর আমরা তখন কাজ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
লেখক পরিচিতি -
জন্মঃ কলকাতার বাগবাজারে। মহারাজা কাসিমবাজার স্কুল ও বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াশুনা। বিজ্ঞানে স্নাতক। স্কুল, কলেজ, অণু পত্রিকা ও বিভিন্ন ম্যাগাজিনে লেখা। নাটক ও স্কাউটিং এর সাথে যুক্ত। বর্তমানে দিল্লী ও কলকাতার বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেন। কলমের সাত রঙ পত্রিকার একজন সক্রিয় সদস্য।