আমার মনে হয়
প্রত্যেকটি বাঙালির কাছে ২৩শে জানুয়ারি হল খুবই পবিত্র ও
স্মরণীয় দিন। বাঙলার তথা ভারতবর্ষের মুক্তি আন্দোলনের পুরোধা হিসেবেই মহান নেতার
প্রতি এই জাতীয় সার্বজনীন শ্রদ্ধা নিবেদন বিশ্বের খুব কম নেতার ভাগ্যেই ঘটেছে।
নেতাজীর এই জনপ্রিয়তার কারণ হল, তাঁর চিন্তাধারার মূল সূত্রটি খাঁটি ভারতীয়।
শুধু নিজের
স্বার্থের কথা চিন্তা না করে দেশ ও মানুষের কথা চিন্তা করেছেন সবসময়। মানুষের
দুঃখ, কষ্টগুলোকে তিনি অনেক বড় করে দেখেছেন। আর সেকারণেই ব্রিটিশদের শোষণ ও
নির্যাতন থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে মুক্ত করার জন্য আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছেন।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করার জন্য যে সকল মহান ব্যক্তি,
বিপ্লবী, লড়াকু যোদ্ধা জীবন উৎসর্গ করেছেন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু তাঁদের মধ্যে
অন্যতম।
সুভাষ চন্দ্র বসুর
বয়স যখন ১৩/১৪ বছর তখন তাঁদের এক আত্মীয় কটকে তাঁদের বাড়ীতে বেড়াতে আসেন। তিনি
তাঁদের বাড়ীর নিকটেই থাকেন। নেতাজী একদিন তাঁর বাড়ীতে বেড়াতে যান এবং তাঁর ঘরে
স্বামী বিবেকানন্দের অনেকগুলো বই দেখতে পান। তিনি স্বামীজীর বইগুলো তাঁর কাছ থেকে
আনেন এবং পড়েন। এভাবে স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের
প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। স্বামীজীর বক্তৃতা ও চিঠিপত্রগুলো তাঁকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ
করে।
স্বামীজীর বক্তৃতাবলী
ও শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ পাঠ করার পর তিনি পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়েন। আধ্যাত্মিক
উন্নতি করার জন্য যোগ অভ্যাস শুরু করেন। কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে দরিদ্রনারায়ণের
সেবায়, রুগ্নের শুশ্রূষায় এবং দুঃস্থের দুঃখ মোচনে অধিকাংশ সময় ব্যয় করতেন। কি করে
স্বামীজীর আদর্শকে তাঁর জীবনে সফল করবেন, এটাই ছিল তখন নেতাজীর একমাত্র চিন্তা।
স্বামী
বিবেকানন্দের বেদান্ত সাধনার উত্তর পুরুষ সুভাষচন্দ্র ভারতের মুক্তি আন্দোলনের
যোগ্য সৈনিক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। স্বামীজীর মানস-পটে যে মানুষ সৃষ্টির
কল্পনা প্রতিভাত হয়েছিল, তাঁর সেই চিন্তা মানসের সিদ্ধ পুরুষ হলেন নেতাজী
সুভাষচন্দ্র। তাঁর আধ্যাত্মবাদ ও কর্মবাদের সামগ্রিক সমন্বয় আমরা নেতাজীর চরিত্র ও
জীবন দর্শনে দেখতে পাই। আসমুদ্র হিমাচল ও বিশ্ব পরিভ্রমণ কালে ভারতবর্ষের রুগ্ন,
পঙ্গু সমাজের চিত্র দর্শন করে মাতৃ-উপাসক ঋষি বিবেকানন্দ জাতির মোহনিদ্রা ভঙ্গ-কল্পে
উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন – কয়েক হাজার যুবক ও কয়েক কোটি টাকা
পেলে ভারতবর্ষের সমাজের মোড় তিনি ঘুরিয়ে
দিতে পারেন। স্বামীজীর সে আহ্ব্বান ব্যর্থ
হয়নি। তাঁর সেই সাধন-লব্ধ অমৃতের পুত্র নেতাজী। বিশ্বজয় করেছিলেন স্বামীজী তাঁর সাধন-লব্ধ
উপলব্ধি নিয়ে। আর নেতাজী বিশ্বজয় করেছিলেন তাঁর কর্ম দিয়ে। স্বামীজী বাঙলার
প্রেরণা ও অনুভূতি , আর নেতাজী কর্মী ও সেবক। স্বামীজী ভারতবর্ষের প্রাণ ও দর্শন,
নেতাজী যোদ্ধা ও ইতিহাস। একজন যুগান্তর ঘটিয়েছেন, অপরজন নতুন যুগের সৃষ্টি করেছেন।
অনেকে প্রশ্ন করেন, নেতাজী
কি বিপ্লবী? আমার মনে হয় নেতাজীই বিপ্লব ।
তাঁর পরিচয় তাঁর ব্যক্তি সত্ত্বায় নয়। তাঁর পরিচয় অসীমের মধ্যে। তাঁর জীবন চেতনা
শুধুমাত্র বিপ্লবের ব্যবহারিক অর্থের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সুদূর প্রসারী সাংগঠনিক
অর্থে তা কার্যকরী। নেতাজীর সত্যানুসন্ধানে বিপ্লবের যে রূপ আমরা দেখতে পাই, তা হল
সামগ্রিক অর্থে পরিবর্তন। এ পরিবর্তন শুধুমাত্র বিবর্তনবাদের শ্লথ ক্রমবিকাশ নয়, এ
হল সমষ্টিগত ভাবে প্রতিটি কর্মধারায় এক আবেগ সঞ্চারী পরিবর্তন। তাই নেতাজীর
উপলব্ধি, মত, কর্মধারা অন্যান্য ভারতীয় নেতাদের থেকে স্বতন্ত্র ও মৌলিক। বিভিন্ন
বিপরীত ধর্মী ভাবধারার ও আদর্শবানের সমন্বয় সাধন তাঁর কর্মধারার মূল মন্ত্র। এই সমন্বয়ের
অর্থ কোনও আপোষ নয়, এর ব্যাপকতর অর্থ হল যা কিছু পঙ্গু, যা কিছু জীর্ণ, যা কিছু
অক্ষম তাকে নিঃশেষে পরিত্যাগ করা।
অহিংসায় নয়,
উদারতায় নয়, শক্তি প্রয়োগ করেই ব্রিটিশকে ভারত থেকে তাড়াতে হবে- এই মন্ত্রকে ধারণ
করে তিনি ব্রিটিশ শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই-সংগ্রাম চালিয়েছেন । ভারতের
যুব সম্প্রদায়কে নেতাজী বলেছিলেন "তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের
স্বাধীনতা দেব"। ভারত উপমহাদেশে সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের সংগঠক হিসেবেও তিনি
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যে কারণে বিপ্লবী যোদ্ধারা তাঁকে নেতাজী বলে
সম্বোধন করতেন। তিনি এ উপমহাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনেরও অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন।
নেতাজীর বলতেন - আমি
রাজ্য চাইনা, স্বর্গ চাইনা, পুনর্জন্ম চাইনা, আমি চাই আমার দেশের সকলের দুঃখ নিবারণ।
যোগ্য নেতার মত মহৎ কামনা ছিল তার।
বলিষ্ঠ নেতৃত্ব
দেওয়ার যোগ্যতা ছিল বলেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা কামনায়
সুভাষচন্দ্র এক বিরাট অভিযান চালাতে সমর্থ হয়েছিলেন। এখানেই তাঁর নেতৃত্বের সার্থকতা। নেতাজী
সম্পর্কে আর নতুন করে বলার কিছু নেই। শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই নেতাজী সম্পর্কে
ওয়াকিবহাল। তাঁর জীবনীও প্রায় সকলেই পড়েছেন, তাই সে প্রসঙ্গে আর যাচ্ছিনা। নেতাজীকে
দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি কিন্তু আমার বাবার কাছে নেতাজী সম্পর্কে অনেক শুনেছি। ভারতবর্ষ
স্বাধীন হওয়ার আগে ১৯৩৯ সালে আমার বাবা, স্বর্গীয় হরিপদ চক্রবর্ত্তী তখন রেলওয়েতে
চাকরী করতেন এবং ঢাকা শহরে থাকতেন। আমার বাবা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসকে যখন প্রথম
দেখেন তখন তাঁর কি অনুভূতি হয়েছিল তা তিনি লিখে গেছেন। বাবা যখন নেতাজী সম্পর্কে
কিছু বলতেন, তখন দেখেছি তার চোখে-মুখে এক উজ্জ্বল ভালবাসা, শ্রদ্ধা। তার মুখ দেখেই
বোঝা যেত যে তিনি নেতাজীর একজন পরম ভক্ত ছিলেন। নেতাজীর মধ্যে এক আদর্শ মানুষ,
নেতা এবং জন-দরদী দেশপ্রেমীকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনি দেখেছিলেন অল্প সময়ের মধ্যে
নেতাজী কিভাবে দেশের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সকলকে কিভাবে
আকর্ষিত করত। তাঁর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর কিভাবে দেশমাতৃকার জন্য প্রাণ দিতে উদ্বুদ্ধ
করত সব স্তরের মানুষকে। তাইতো তিনি আজও আমাদের কাছে চিরস্মরণীয়। এখন সে কথা ভাবলেই
কেমন অবাক লাগে। এ কোনও সাধারণ মানুষের কাজ হতে পারেনা। তিনি ছিলেন অসামান্য।
সকলের মন জয় করে নিতে সিদ্ধহস্ত।
আমার পিতা, স্বর্গীয় হরিপদ
চক্রবর্ত্তী-র লেখা ডাইরী থেকে নেতাজী সম্পর্কে কিছু লেখা পেয়েছি। তার কিছু অংশ
নিচে উল্লেখ করলাম।
প্রথম দেখা
“ সে আজ অনেক দিনের
কথা। ইংরেজি ১৯৩৯ সাল। আমি তখন ঢাকা শহরে থাকি। গ্রীষ্মকাল। রাতের আহার সেরে
রাস্তায় পায়চারি করছি। বেশ গরম – ঘুম আসছিল না। হঠাৎ দেখি মুখে চোঙা লাগিয়ে একজন
লোক যেন কি বলে চলেছে। তার সাথে আরও ২/৪ জন লোক আছে। কাছে যেতেই কানে এল, “ আজ রাত
১১টায় সুভাষচন্দ্র বসু বাহাদুরাবাদ ট্রেনে ঢাকা আসছেন । শুনে মনটা নেচে উঠল।
সুভাষচন্দ্রকে দেখার সৌভাগ্য এর আগে আমার কোনও দিন হয়নি। খবরের কাগজে প্রায়ই তাঁর
বিষয়ে অনেককিছুই পড়ি। তিনি তখন ফরওয়ার্ড ব্লক নিয়ে ব্যস্ত। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে
এসেই নিজের আদর্শে গড়ে তোলেন ফরওয়ার্ড ব্লক। বাংলা তথা সার ভারতের তরুণরা দলে দলে
যোগ দেয় সেখানে। আমিও তখন তরুণ। আমার মনেও বয়ে গেল এক স্রোত।
রাত ১১টার অনেক
আগেই স্টেশনে গিয়ে বসে রইলাম। স্টেশন এলাকা তখন লোকে লোকারণ্য। গাড়ি ঠিক ১১টার এসে
পৌঁছতেই জনতা “সুভাষচন্দ্র কি জয়, বন্দেমাতরম” ইত্যাদি ধ্বনি দিতে শুরু করে। উৎসুক
নেত্রে চেয়ে আছি। গাড়ির দিকে। কখন দেখব সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত মহাপুরুষকে। সহসা প্রথম
শ্রেণীর কামরার সামনে এসে দাঁড়ালেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।
আমার বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা
আজ পূর্ণ হল। দেখে দু-চোখ জুড়িয়ে গেল। অল্পক্ষণের মধ্যেই সহকর্মীরা মাল্যদান করে
গাড়ি করে নিয়ে গেলেন তাঁকে। কিন্তু আমার সাধ মিটল না। আরও দেখতে ইচ্ছে হল। কি যেন
যাদু আছে ওই চোখে। তাই প্রাণ বড়ই ব্যাকুল হয়ে উঠল আবার দর্শনের আকাঙ্ক্ষায়।
পরের দিন ঘুম থেকে
উঠেই ছুটলাম খোঁজ নিতে – কোথায় তিনি আছেন। কিন্তু বেশিদূর যেতে হল না। দেখলাম বহু
লোক ছুটছে তাঁকে দেখার জন্য। আজ সকালেই নাকি তিনি তিন চার জায়গায় বক্তৃতা দেবেন ।
নবাবপুরে এক বাড়ির সামনেই একখানা টেবিল ও কয়েক খানা চেয়ার পাতা। বহুলোক জমায়েত
হয়েছেন সেখানে। তিনি শীঘ্রই আসছেন। নারী, পুরুষ, শিশু বহু লোকের সমাগম। বেলা প্রায়
৭টা হবে। একখানা মোটর এসে দাঁড়াল। অমনি জনতা জয়ধ্বনি করে উঠল। সঙ্গে গাড়ি থেকে
নামলেন সুভাষচন্দ্র বসু। খদ্দরের ধুতি ও পাঞ্জাবী পরিধানে – মাথায় গান্ধী টুপি।
সেই সৌম্যমূর্তি এসে দাঁড়ালেন টেবিলের ধারে। মনে হল কোনও দেব-পুরুষ যেন নেমে
এসেছেন ধরায়। জনতার মুখে একটুও শব্দ নেই। সবাই দেখছে অনিমেষ নেত্রে। সুভাষচন্দ্রের
চোখে-মুখে তখনও যেন ঘুমের রেশ লেগেছিল। মনে হল অধিক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলেন গত
রাতে। তিনি হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন যে তিনি মাত্র পাঁচ মিনিট শুধু
কয়েকটি কথা বলবেন। কারণ সময় খুব কম। তিনি এখানে বক্তৃতা দিতে আসেন নি। তিনি
ফরোয়ার্ড ব্লককে সাহায্য করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে বাঁচিয়ে রাখতে উপস্থিত জনতাকে
অনুরোধ করলেন। দেখতে দেখতে উপস্থিত জনতার মধ্যে থেকে অবস্থাপন্ন কিছু লোক অর্থ
সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিতে লাগলেন। পাঁচ সাত মিনিটের মধ্যে পাঁচ-ছয় হাজার টাকা
যোগাড় হয়ে গেল। আমি অবাক হয়ে সব দেখছিলাম। এ এক যাদু-খেলা না আর-কিছু! মাত্র পাঁচ
মিনিটের মধ্যে এতগুলো লোকের মন যিনি জয় করে নিতে পারেন – তিনি কে? তিনি হলেন আমাদের প্রিয় নেতা সুভাষচন্দ্র বসু –
ত্রিপুরী কংগ্রেসের সভাপতি – ভাবীকালের নেতাজী – ভারতের মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর এই
ব্যক্তিত্বের জন্যই তৈরি হয়েছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজ। আর সে কারণেই বৃটিশ সিংহ দু’শো
বছরের জমিদারীর মায়া কাটিয়ে লেজ গোটাতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আজ তিনি কোথায় – আর
তাঁর আদর্শই বা কোথায় !”