দ্বিতীয় পর্ব পড়ার জন্য এখানেক্লিক করুন
রবীন্দ্রনাথের কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য শুধু তাঁর নিবিড় অনুভূতি অথবা কল্পনার ব্যাপকতা নয় , ব্যাপকতা ও গভীরতার অপূর্ব সমাবেশেই তাঁর প্রতিভা বিকাশ লাভ করেছে । যে যে উপায়ে এই সমাবেশ সম্ভব হয়েছে তা অনুধাবনযোগ্য । রবীন্দ্রনাথ মানবজীবন ও বিশ্বপ্রকৃতির অন্তরালে আনন্দময় মহাসত্তার লীলা অনুভব করতে চেয়েছেন । সব খণ্ড খণ্ড সৌন্দর্যের পেছনে অখণ্ড সৌন্দর্যসত্তার অস্তিত্বে তিনি বিশ্বাস করেছেন । নর - নারীর প্রেমকে তিনি বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে সংযুক্ত করে প্রিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেছেনঃ
এ নীল আকাশ এত লাগিত কি ভালো ,
যদি না পড়িত মনে তব মুখ - আলো ।
অপরূপ মায়াবলে তব হাসি - গান
বিশ্বমাঝে লভিয়াছে শত শত প্রাণ ।
তুমি এলে আগে - আগে দীপ লয়ে করে ,
তব পাছে পাছে বিশ্ব পশিল অন্তরে ।
( চৈতালী : ‘প্রিয়া ')
রবীন্দ্রনাথের প্রায় প্রত্যেক কবিতার মধ্যে ব্যক্তিগত অনুভূতির সঙ্গে বিশ্বের নিবিড় সম্পর্কের কথা প্রকটভাবে ব্যক্ত হয়েছে । বৈষ্ণব কবিতায় এই সংযোগের আভাস আছে । পদাবলিকর্তা জ্ঞানদাস বলেছেন :
মলয়জ পবন পরশে পিক কুহরই
শুনি উলসিত ব্রজনারী ।
উলসিত পুলকিত সবহুঁ লতা তরু
মদন ভেল
অধিকারী ।।
আবার,
দাদুরি উনমত ভাষা ।
বিরহিনি জীবন নৈরাশ ৷
এই শ্রেণির সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত কবিতা বিদ্যাপতির :
কুলিশ শত শত পাত মোদিত
ময়ূর নাচত মাতিয়া ।
মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী
ফাটি যাওত ছাতিয়া ৷ ।
তিমির দিগভরি ঘোর যামিনী
ন থির বিজুরিক পাঁতিয়া ।।
বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙয়বি
হরি বিনে দিন রাতিয়া
( ৭২০ সংখ্যক পদ )
এই প্রকারের পদে মাধুর্য আছে । কিন্তু এরূপ রসনিবিড় পদের সংখ্যা খুব বেশি নেই । কোনো কোনো পদে ব্যক্ত হয়েছে যে , বর্ষার দুর্যোগে রাধিকার পক্ষে সংকেত স্থানে যাওয়া দুরূহ হয়েছে; তথায় প্রকৃতির সঙ্গে নায়িকার বিরুদ্ধতাই প্রকট হয়েছে। পদাবলি সাহিত্যে এরূপ পরস্পর বিরুদ্ধভাবাপন্ন পদ যে দেখতে পাওয়া যায় তার একমাত্র কারণ বৈষ্ণব কবিদের মনে এ বিষয়ে কোনো গভীর বিশ্বাস ছিল না । রবীন্দ্রনাথ কিন্তু প্রণয়ীর বেদনাকে সর্বত্রই বিশ্ববেদনার অঙ্গ করে নিয়েছেন । বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যে চিরন্তন প্রণয়ের আদান - প্রদান চলছিল ; কেউ তার সন্ধান রাখত না । হঠাৎ কবি প্রণয়রহস্য প্রকাশ করে দিলেন । অবশ্য সমস্ত কথা এখানে অভিব্যক্ত হয়নি; কিন্তু চাঁদের সঙ্গে চকোরীর ,মেঘের সঙ্গে বিদ্যুতের ,তটিনীর সঙ্গে সাগরের যে নিগূঢ় প্রণয় সম্বন্ধ ছিল তা কবি প্রকাশ করে দিয়েছেন ।
রবীন্দ্র কাব্যের বৈশিষ্ট্য হলো,তাতে রক্তমাংসের নিবিড়তা ও কল্পলোকের বিরাট বিস্তৃতি উভয়েরই সন্ধান পাওয়া যায় । বৈষ্ণব পদাবলি ,কীটসের কাব্য - এতে যে প্রণয়ের চিত্র আঁকা হয়েছে তার সঙ্গে শেলীর কাব্যবর্ণিত প্রেমের সাদৃশ্য নেই ; কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কাব্যে উভয় প্রকারের রসের সমন্বয় ঘটেছে । একই বিষয়ে তাঁর দুটি প্রেমের কবিতার বিশ্লেষণ করলে এ বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট হবে । মদনভস্ম নিয়ে রবীন্দ্রনাথ দুটি কবিতা লিখেছেন : 'মদনভস্মের পূর্বে ও 'মদন ভস্মেরপর ' । এ দুটি কবিতায় প্রণয় দেবতাকে কবি দেখেছেন দুটি বিশেষ ভাবে ; কবিতা দুটির বিষয় এক হলেও রস সৃষ্টিতে বৈচিত্র্য আছে । ভস্মীভূত হবার পূর্বে মদনকে দেখতে পাই দেহী দেবতারূপে । রবীন্দ্রনাথের কল্পনা অনন্তপ্রসারী । তাই যখন তিনি দেহী মদনের কথা লিখেছেন , তখনো মদনকে শুধু রতিদেবীর স্বামী হিসেবেই দেখেননি , তাঁর কাব্যে রতির উল্লেখ পর্যন্ত নেই । তিনি এঁকেছেন মদনকে নিখিল প্রণয়ীরূপে । সে কুসুমরথে বিশ্ব ভুবন সঞ্চরণ করে বেড়াত , পথিকবধূ তার চরণে প্রণাম করত , তরুণ ও তরুণীরা ফুলবর্ষণ করে তার অভ্যর্থনা করত , কুমারীগণ তার দেউলে প্রদীপ জ্বালাত ও গোপনে ফুলমুকুলে তার সায়ক গড়ত। মুগ্ধ কিশোর কবি আপন মনে রাগিণী রচনা করত এবং যুবতী পঞ্চশর নিয়ে খেলা করত ; কিন্তু উদ্যত ধনু দেখে প্রণয়ভীরু ষোড়শী ‘চরণে ধরি করিত মিনতি ! 'এই চিত্র নাগরের চিত্র ; বৈষ্ণব কবি এরূপ নায়ক কল্পনা করতে পারলে আনন্দিত হতেন । কিন্তু এ নায়ক শুধু বহুবল্লভ নহে ,বিশ্বপ্রণয়ী ,এবং প্রেরণায় বিশ্বের সকল নর - নারীর ‘ পরাণ হত অরুণ বরণী '। এই বিশিষ্ট ভাবটি বৈষ্ণব কবিতায় থাকলেও রবীন্দ্রনাথ একে বিস্তৃতি দিয়েছেন । অপর কবিতাটির রস অন্যরকমের । এখানে কোনো বিশেষ নায়কের কথা নেই । বিশ্বময় এক অনির্দেশ্য বেদনা ছড়িয়ে গেছে ,কবি তাকেই ভাষা দিতে চেষ্টা করেছেন । কল্পনা ( ১৯০০ ) কাব্যের " মদনভস্মের পূর্বে কবিতায় দেখা যায়ঃ
পঞ্চাশের গোপনে লয়ে কৌতূহলে উলসি
পরখছলে
খেলিত যুবতী।
এবং
কাননপথে কলস লয়ে চলিত যবে নাগরী
কুসুমশর মারিতে গোপনে ,
যমুনাকূলে মনের ভুলে ভাসায়ে দিয়ে গাগরী
রহিত চাহি আকুল নয়নে ।
কিন্তু দ্বিতীয় কবিতা 'মদন ভন্মেরপর ' - এ দেখা যায় একটা অচেনা , অজানা , সর্বত্র পরিব্যাপ্ত ব্যাকুলতা তরুণীর হৃদয়ের চঞ্চলতা তারই অঙ্গমাত্র :
আজিকে তাই বুঝিতে নারি কিসের বাজে যন্ত্রণা
হৃদয়বীণাযন্ত্রে মহা পুলকে !
তরুণী বসি ভাবিয়া মরে কী দেয় তারে মন্ত্রণা
মিলিয়া সবে দ্যুলোকে আর ভূলোকে ।
এই কবিতায় কবি বিশ্ব চরাচরব্যাপী আকারহীন ব্যাকুলতার কথা লিখেছেন ,কিন্তু তাঁর কাব্যে শেলীর কাব্যের অস্পষ্টতা নেই । পঞ্চশরে দগ্ধ হবার পরে যে শিহরণ বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে তা অনির্দেশ্য , কিন্তু তা রূপহীন নয় । কবি নিখিল ভবের সকল দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন এবং আকারবিশিষ্ট পদার্থের বেদনার মধ্য দিয়ে অরূপ বেদনাকে অপরূপ রূপ দিয়েছেন ।
রবীন্দ্রনাথের
প্রেমের কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে নর - নারীর হৃদয়ের সংযোগের
সন্ধান , আর একটি বৈশিষ্ট্য এই কবি
প্রেমকে তার ক্ষুদ্রতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে দেখতে পারেননি । তিনি প্রেমকে প্রেমের
অতীত কল্যাণের রাজ্যে নিয়ে গেছেন । তিনি নারীর দুটি মূর্তি দেখেছেন :
কোন ক্ষণে
সৃজনের সমুদ্রমন্থনে
উঠেছিল দুই নারী
অতলের শয্যাতল ছাড়ি ।
.... একজন তপোভঙ্গ করি
উচ্চহাস্য- অগ্নিরসে ফাল্গুনের সুরাপাত্র ভরি
নিয়ে যায় প্রাণমন হরি ,
দু - হাতে ছড়ায় তারে বসন্তের পুষ্পিত প্রলাপে ,
রাগরক্ত কিংশুকে গোলাপে ,
নিদ্রাহীন যৌবনের গানে ।
আরজন ফিরায়ে আনে
অশ্রুর শিশির - স্নানে
স্নিগ্ধ বাসনায় ;
..
ফিরাইয়া আনে ধীরে
জীবনমৃত্যুর পবিত্র সংগমতীর্থতীরে
অনন্তের পূজার মন্দিরে ।
( বলাকা ২৩ সংখ্যক কবিতা )
বলাকা ( ১৯১৬ ) রবীন্দ্রনাথের পরিণত বয়সের লেখা । এটি গীতাঞ্জলি ( ১৯১১ ) , নৈবেদ্য (১৯০১ ) প্রভৃতির পরের যুগের কাব্য । সুতরাং মনে হতে পারে যে ,নারীর কল্যাণী মূর্তি রবীন্দ্রনাথ দেখতে পেয়েছেন প্রৌঢ়ত্ব অতিক্রম করে । কিন্তু একথা সত্য নয় । প্রথম বয়সের প্রেমকাব্যেও কল্যাণময়ী রমণীর চিত্র আছে চিত্রা ( ১৮৯৬ ) কাব্যে 'রাত্রে ও প্রভাতে ’ কবিতা 'দুই নারী'-র প্রায় বিশ বছর পূর্বের লেখা । এখানে কবি বলছেন :
কালি মধুযামিনীতে জ্যোৎস্নানিশীথে
কুঞ্জকাননে সুখে
ফেনিলোচ্ছল যৌবনসুরা
ধরেছি তোমার মুখে ।
………প্রাতে কখন দেবীর বেশে
তুমি সমুখে উদিলে হেসে –
আমি সম্ভ্রমভরে রয়েছি দাঁড়ায়ে
দূরে অবনতশিরে
আজি নির্মলবায় শান্ত উষায়
নির্জন নদীতীরে ।
( চিত্রা )
প্রথম বয়সে অনেক কবিতায় রবীন্দ্রনাথ নারীর দেহ ও দেহের মিলনের বর্ণনা করেছিলেন । সেই সব কবিতায় যে রুচির পরিচয় পাওয়া যায় তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে । এ প্রসঙ্গে সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত তাঁর গ্রন্থে বলেছেন :
আধুনিক সাহিত্যের অশ্লীলতাকে আক্রমণ করে কবি যখন প্রবন্ধ লিখেছিলেন ,তখন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইঙ্গিত করেছিলেন , 'বিজয়িনী ','স্তন ','চুম্বন ','হৃদয় যমুনা 'প্রভৃতি কবিতার প্রতি । দেহ ও দেহের মিলন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে সমস্ত কবিতা লিখেছিলেন তা বিশ্লেষণ করলে তাঁর প্রতিভার স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারি । তিনি নারীর দেহকে পাপ - লালসার লীলাভূমি বলে পরিত্যাগ করেননি । তার রমণীয়তাকে তিনি স্বীকার করেছেন , তার মাধুর্য তাঁর কাব্যে অপরূপ হয়ে উঠেছে ।
চতুর্থ পর্ব পড়ুন
আগামী কাল
লেখক পরিচিতি –
রঘুনাথ ভট্টাচার্য-এর জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায় । ধামরাই কলেজ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন । বাংলায় স্নাতকোত্তর ও পিএইচ ,ডি । বিভাগীয় প্রধান , বাংলা বিভাগ , নবযুগ কলেজ , ধামরাই , ঢাকা ।
প্রকাশিত গ্রন্থ - ( ১ ) বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য ( ১৯২০-১৯৩০ ) । ( ২ ) সবুজপত্র গোষ্ঠীর সাহিত্য ভাবনা। (৩ ) প্রবন্ধ সংগ্রহ । ( ৪ ) ঈশ্বর ভাবনার বিবর্তন ও অন্যান্য প্রবন্ধ । ( ৫ ) বাংলার বৈষ্ণব দর্শন : সাহিত্যে রাধা ও কৃষ্ণের ক্রমবিবর্তন । এছাড়াও যৌথভাবে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ।