অসীম বা ইনফিনিটির সত্যিকারের উদাহরণ হ’ল আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ড বা ইউনিভার্স।এর যেমন সীমা নেই একে জানার ইচ্ছাও মানুষের তেমনিই অসীম। কিন্তু যে জিনিষ আজ আছে তা নিশ্চয়ই একদিন শুরু হয়েছিল এবং একদিন শেষও হবে।এই ত নিয়ম।তাই এই ব্রহ্মাণ্ড যেমন রয়েছে এরও নিশ্চয়ই একদিন শুরু হয়েছিল।
আজ পর্যন্ত অর্জিত জ্ঞান থেকে আমরা জানি যে কোটি কোটি
বছর আগে মহাকাশে এক ভয়ানক বিস্ফোট ঘটেছিল-কেন কেউ জানেনা। এই ভয়ঙ্কর বিস্ফোটকে
বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে “বিগ-ব্যাঙ্গ (Big-Bang)”।বেলজিয়ামের মহা-বিশ্বতত্ত্ববিদ (Cosmologist),ক্যাথলিক গির্জার পুরোহিত,জর্জ লিমেইটার (George
Lemaitre) প্রথম এই ‘বিগ-ব্যাঙ্গ’ তত্ত্ব (Theory)’র মতবাদ শুরু করেন। পরে বৈজ্ঞানিক মহল এই মতবাদকেই স্বীকার
করে নেন। এই মতবাদ অনুসারে একটি ছোট কিন্তু অসাধারণ ঘনত্ব-যুক্ত অগ্নি-বলয় (Fire Ball) এর শুরুর
দিনটি কেমন ছিল-এটা জানার আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরন্তন। বিস্ফোটের ফলেই ১৩৮০ কোটি বছর
আগে আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছিল। এই বিগ-ব্যাঙ্গ থেকে যদি সময়ের শুরু
গণনা করা হয় তাহলে সেই বিস্ফোট ঘটেছিল ১৩৮ কোটি বছর আগে। কিন্তু ওই ঘটনার এক মিনিট
পরে বা দশ মিনিট পরে অথবা দশ-দিন বা দশ বছর পরে ব্রহ্মাণ্ড দেখতে কেমন ছিল সেটা
জানার জন্য মানুষ পাগল হয়ে উঠেছিল। এই ‘উতলা’ অবস্থার জন্যই গালিলিও দূরবীন আবিষ্কার করলেন। কিন্তু দূরবীনের সাহায্যে আর
কতদূর দেখা যায়?বড় জোর কিছু গ্রহ,নক্ষত্র বা তারাদের,তার বাইরে
সব ‘ধুন্ধলা’ বা কুয়াসা
ছন্ন। যত বড় দূরবীনই হোক পৃথিবীর উপর থেকে আর কতদূর দেখা যায় অসীমের? বৈজ্ঞানিকেরা ভাবলেন ,তাহলে পৃথিবী ছেড়ে আকাশে এগিয়ে
গিয়ে দূরবীন লাগালে আরও দূরে দেখা যাবে। এই উদ্দেশ্যেই ৩২ বছর আগে ২৪ শে এপ্রিল,১৯৯০ সালে এক বিশাল টেলিস্কোপ পাঠানো হ’ল মহাকাশে। ‘নাসা’র স্পেস-সাঁটল (Space
Shuttle) ডিসকভারি (Discovery)’-র পিঠে
বেঁধে এই বিপুল ক্ষমতা-সম্পন্ন, ‘হুবেল টেলিস্কোপ’কে পাঠানো হ’ল পৃথিবীর ৩৪০ মাইল বা ৫৪৭
কিলোমিটার উপরে। ‘হুবেল’ টেলিস্কোপ ৫৪৭ কিলোমিটার উপর থেকে মহাকাশে নজর রাখে আর ৯৫ মিনিটে একবার করে
পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে। ‘হুবেল’ এইভাবে ২৪ ঘণ্টায় ১৫বার পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে সারা ব্রহ্মাণ্ডের উপর নজর
রাখছে। বিখ্যাত মহাকাশ বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড হুবেল এর নামেই ওই বেতার টেলিস্কোপ (Hubble Radio Telescope)-টি’র নামকরণ করা হয়েছিল। এই প্রবল ক্ষমতা-সম্পন্ন টেলিস্কোপ গত ৩২ বছর মহাকাশ
থেকে কাজ করে আমাদের জ্ঞানের পরিধি অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। ‘হুবেল’ই আমাদের সাহায্য করেছিল
ব্রহ্মাণ্ডের বয়স (১৩৮০ কোটি বছর) নির্ণয় করার। এই আয়ু-কাল প্রায় আমাদের পৃথিবীর
আয়ু-কালের তিনগুণ,তাইনা? আমাদের সৌর-মণ্ডলের গঠন হয়েছিল,আমরা জানি, মহাকাশের ধুলো-ময়লা আর গ্যাসের মিশ্রণের কুয়াসা যার নাম ‘সৌর-নেবুলা’ থেকে। সে ছিল ৪৫০০ কোটি বছর আগে। ক্রমশ,সূর্য থেকে নির্গত,উষ্ণ ‘সৌর-বায়ুর’ প্রভাবে সেই কুয়াশা দূর হয়ে গেলে
প্রকাশিত হ’ল সৌর মণ্ডলের গ্রহ,উপগ্রহ আর নক্ষত্ররা।
আবার ‘হুবেল’ই আবিষ্কার করেছিল সৌরমণ্ডলের সবচেয়ে ছোট গ্রহ ( এখন অবশ্য একে আর পূর্ণ গ্রহ
বলা হয় না) প্লুটোর দুটি উপগ্রহ-“নিক্স আর হাইড্রা (Nix and Hydra)”।
হুবেলের সাহায্যেই আমরা জানতে পারি,আমাদের এই ব্রহ্মাণ্ড ক্রমশ আরও বড় হচ্ছে আর কি গতিতে বড় হচ্ছে।
‘হুবেল
আমাদের দেখাল গ্রহ,নক্ষত্র আর তারাদের-মরুভূমির
বালুকণার মত। আবার এইভাবেই হুবেল তার ক্ষমতার সীমাও প্রকাশ করে দিল-হাজার হাজার
গ্যালাক্সি বা তারা-মণ্ডলী যা ‘হুবেলে’ ধুলো-ময়লার জটের মত দেখায় সেগুলোর সম্বন্ধে জানার ক্ষমতা হুবেলের নেই। অথচ
এদের না জানলে ‘বিগ-ব্যাঙ্গ’-এ কি হয়েছিল তা জানবো কি করে? তাই ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম-মুহূর্তে বা
তার পরে তাকে দেখতে কেমন ছিল তা জানার জন্য আমাদের ‘দৃষ্টি-শক্তি’ বাড়াতে হবে। চশমা নেবার আগে ও পরে
যেমন হয়-‘ধুন্ধলাপন’ বা ‘কুয়াসা’ কেটে গিয়ে
আমাদের দৃষ্টি যেমন পরিষ্কার হয়ে যায় তেমনি ভাবে আমরা দেখতে পাবো এতকাল অদেখা তারা-মণ্ডলীর
গঠন আর নতুন তারা আর গ্রহের জন্ম কিভাবে হয়। সেই থেকে আমরা বুঝতে পারবো আমাদের সৌর-মণ্ডলীর গঠন কিভাবে হয়েছিল।
এই উদ্দেশ্যেই প্রায় ৩০ বছর আগে মাত্র ৫০ কোটি
আমেরিকি ডলারের বাজেট নিয়ে নতুন প্রকল্প শুরু হয়েছিল। কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৯৬তে,আর টেলিস্কোপটি উৎক্ষেপণের কথা ছিল সন ২০০৭- এ । নানা কারণে সেই সময় সীমা পিছোতে পিছোতে ২০২০-তে উৎক্ষেপণ হবে বলে ঠিক করা হয়েছিল। কিন্তু
জগত-ব্যপী করোনা-ভাইরাস মহামারীর কারণে আবার পিছতে হোল। আরও দেড় বছর গড়িয়ে গেল। শেষ
পর্যন্ত গত বছর (২০২১) এর শুভ খ্রিস্ট-মাসের দিন ২৫শে ডিসেম্বর সকাল ৭টা ২০মিনিটে ( আমেরিকার পূর্ব-উপকূলের সময়, ইএস টি) এই সুবিশাল মহাকাশ টেলিস্কোপটি ফরাসী-গায়নার উপকুল থেকে বিশাল বড় দুটি
রকেটের সাহায্যে সফল ভাবে উৎক্ষিপ্ত হ’ল। ‘নাসা’র এক অবসর-প্রাপ্ত বিখ্যাত মানুষের
নামানুসারে এই টেলিস্কোপটির নামকরণ করা হয়েছে, “জেমস ওয়েব
স্পেস টেলিস্কোপ” বা জে ডবলু এস টি (JWST)। এটি একটি বিশাল প্রায় ৬ টন ওজনের টেলিস্কোপ; ’হুবেল’ টেলিস্কোপের চেয়ে দ্বিগুণ ভারী এই উন্নত ও শক্তিশালী মহাকাশ দূরবীন হুবেল এর
১০০গুন শক্তি সম্পন্ন আর মহাকাশের অনেক উঁচু স্থানে, ১৫লক্ষ কিলোমিটার উপরে (চাঁদের চেয়ে চারগুণ দূরে) এল-২ (L2) পয়েন্টে স্থাপিত করা হবে। এই এল-২ পয়েন্ট
এমনই স্থান যেখান থেকে সূর্য,চাঁদ আর
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ আর ‘ওয়েব’এর গতির প্রভাব ‘শূন্য’ হয়ে যায়।
(ক্রমশ) …
দ্বিতীয়
পর্ব পড়ুন আগামী রবিবার (১৬.০১.২০২২)
লেখক পরিচিতি –
ড. তুষার রায়-এর স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ লেখা। ওই সময়েই “শুকতারা”তে “অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু “Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পান।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর আই. আই. টি, দিল্লি থেকে পড়াশুনা ও গবেষণা,কিছুদিন অধ্যাপনা,তারপর সরকারী বৈজ্ঞানিক দপ্তরে কার্যকালে পৃথিবীর কয়েকটি দেশেও কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে।
পঞ্চাশটিরও বেশি প্রবন্ধ নামী বৈজ্ঞানিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে (ইন্দোর) আমন্ত্রিত প্রবন্ধ পাঠ করার গৌরবও ভাগ্যে ঘটেছে। বিগত দেড় বছর করোনার প্রকোপে ছাপাখানা বন্ধ থাকার কারণে অনেক ই-ম্যাগাজিনে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে।
দিল্লি থেকে প্রকাশিত বহুল জনপ্রিয় ই-ম্যাগাজিন, “তাৎক্ষণিক”এর ‘জানা-অজানা’ কলমে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ টি জনপ্রিয়-বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি “দেশ” ওয়েব-সাইটে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং বিশেষ প্রশংসিত হয়েছে।