দেব-দর্শন
তো হয়নি; দেবালয়ই ‘সই’। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আর
কি। ছোটবেলায় বন্ধুদের সংগে দেখে এসেছিলাম শরৎ চন্দ্রের মামার
বাড়ির জন্মস্থান,“দেবানন্দপুর”। সেই স্মৃতি এখনও অমলিন।
জীবনের
কয়েকটি বহুমূল্য বছর কাটিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই বাড়িতেই।লেখা
হয়েছিল কয়েকটি উপন্যাস,গল্প আর প্রবন্ধ। হাওড়া স্টেশন থেকে দক্ষিণ-পূর্ব রেল-পথের
প্রায় ৭৫ কিলোমিটার দূরে ‘দেউলটি’ স্টেশন থেকে তিন কিলোমিটার পথ অতিক্রম করলেই পৌঁছে যাবেন এই
মহান সাহিত্যিকের বাড়ি-“শরৎ স্মৃতি মন্দির’-এ। ‘দেউলটি’ স্টেশনটি হ’ল এই লাইনের চা-সিঙ্গাড়া আর ‘অমৃত্তি’র জন্য বিখ্যাত।‘মেচেদা’ স্টেশনের দুটি স্টেশন আগে। দেউলটি থেকে ভাড়ার গাড়ি,ট্যাক্সি,অটো,টোটো বা সাইকেল রিক্সা পাওয়া যায় ‘শরৎ স্মৃতি মন্দিরে’ যাওয়ার জন্য।
সামনে,পিছনে বাগান-ঘেরা ছোট দোতলা টালির
ছাদের বাড়িটি বিদেশি ‘বর্মা’স্টাইলে তৈরি। রাস্তা থেকে বাড়ির গেটে ঢুকতেই মনে এক ভীষণ
সম্ভ্রমে আপনা-আপনিই মাথাটা নত হয়ে গেল। ঢুকেই সামনে ছোট দোতলা বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে,বাঁদিকে একটি সুন্দর বাগান,তাতে শরৎ চন্দ্রের একটি আবক্ষ
মূর্তি। রূপের বন্যা ছড়িয়ে বয়ে যাওয়া রূপনারায়ণ নদীর ধারে ‘সমতা’ গ্রামে এই বাড়ির জমিটি উনি
কিনেছিলেন বার্মা থেকে ফেরার পর,১৯১৭ সালে-মাত্র ১১০০টাকায়। তখন রূপনারায়ণ বাড়ির গা’ ঘেঁষেই বইতো। এখন,অবশ্য,নদী খানিকটা সরে গেছে-যেন এই
মহামানবকে শ্রদ্ধা জানাতেই।
বার্মা
থেকে ফিরে ১১বছর কাটিয়েছিলেন হাওড়ার শিবপুরের একটি বাড়িতে। ‘সমতা’ গ্রামের জমিতে বাড়ি করা শুরু হয়
১৯২৩ সালে।ওই বছরেই এই বাড়িতে চলে আসেন। সবমিলিয়ে সে সময়ের মোট ১৭
হাজার টাকা খরচে এই বাড়িটি তৈরি করান। তারপর,অবশ্য,আশে-পাশের কিছু জমি আর পুকুর কিনে বাড়িটির সৌন্দর্য বর্ধনের
কাজ করান। উনিই তখন এই এলাকার নাম দিলেন “সমতাবেড়”। বাড়ির পিছনের অংশে একটি কাঁচা মাটির কুঁড়েঘর ছিল যা
এককালে রান্নাঘর হিসাবে ব্যবহৃত হ’ত। পরে ১৯৭৬ -এর বন্যায়
সেটি ভেঙ্গে পড়ে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০০১ সালে ‘হেরিটেজ অ্যাক্ট’ অনুসারে এই বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণ এর অধিগ্রহণ করেন; পরে ২০০৯সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার
বাড়িটির সম্পূর্ণ সংস্কার সাধন করান। বর্তমানে
এটি একটি সংরক্ষিত স্থান,তবে কোন প্রবেশ-মূল্য দিতে হয়না।
মাত্র দুই
বছর প্রথমা স্ত্রী শান্তি-দেবীর সঙ্গে ‘ঘর’ করেছিলেন। শান্তি-দেবীর মৃত্যুর (১৯০৮) দু’বছর পরে ১৯১০-এ শরৎচন্দ্র
দ্বিতীয় বিবাহ করেন-হিরণ্ময়ী দেবীকে। শরৎচন্দ্রের ভাই,বেলুড় মঠের দীক্ষিত স্বামী
বেদানন্দও এই বাড়িতেই থাকতেন ওঁর সঙ্গে। এখন বাড়ির পিছনের অংশে শরৎ চন্দ্র,হিরণ্ময়ী দেবী আর স্বামী
বেদানন্দের সমাধি-স্মৃতি প্রস্থর দেখা যায়। এর সামনে গিয়ে সশ্রদ্ধ্
মাথা নোয়ালাম। সম্ভবত: অনেক বছর বার্মাতে থাকার ফলেই শরৎচন্দ্রের বাঁশ আর পিয়ারা
গাছের উপর আন্তরিক আকর্ষণ ছিল।এই বাড়ির পিছনে তাই আছে একটি ছোট বাঁশঝাড় আর পেয়ারা
গাছ।
এই বাড়িতে
অবস্থানের সময়ই মহান কথাশিল্পী কালজয়ী কয়েকটি উপন্যাস ও গল্প রচনা করেছিলেন। তাদের
মধ্যে আছে ‘দেনা-পাওনা’,’পথের দাবী’,মহেশ,শেষ পত্র ইত্যাদি। জনপ্রিয় উপন্যাস গুলি ছাড়াও এই অসাধারণ
প্রতিভাধর সাহিত্যিক ২৭টি বড় গল্প
ও চারটি নাটকও রচনা করেছিলেন। ‘নারীর মূল্য’,’স্বদেশ ও সাহিত্য’ ইত্যাদি কয়েকটি বিখ্যাত প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন। ‘মহেশ’ ও ‘অরক্ষণীয়া’-র রচনাও সমতাবেড়ের বাড়িতেই হয়েছিল। বাড়ির সিংহ দরজায় মহেশ
থেকে উদ্ধৃতিও পাথরে লিপিবদ্ধ করা রয়েছে।
নিজে
সক্রিয় বিল্পবী না হয়েও ওঁর যোগাযোগ ছিল অনেক বিপ্লবীর সঙ্গে আর সময়ে সময়ে ওদের
স্থান দিয়ে সাহায্য করতেন। মহান নেতা বিপ্লবী রাসবিহারী বসু সমেত সেসময়কার
অনেক বিপ্লবী নেতাই এ বাড়িতে এসেছিলেন বলে জানা যায়। নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোস কয়েক
বারই এসেছিলেন এখানে আর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এসে ওঁকে একটি রাধা-কৃষ্ণের যুগল
মূর্তি উপহার দিয়ে বলেছিলেন, “এ মূর্তির যোগ্য স্থান এই বাড়িতেই”। সেই থেকেই এ’বাড়িতে এই দু’ফুটের মূর্তির ভক্তিভরে দৈনিক পূজা-অর্চনা
হয়। দোতালার একটি ঘরে আজও প্রতিদিন একজন পুরোহিত এসে এই বিগ্রহের পূজা করে যান।
মোট বারো
বছর শরৎচন্দ্র কাটিয়েছিলেন সমতাবেড় এর বাড়িতে। পরে সম্ভবত, স্বাস্থ্যের কারণেই, কোলকাতার বালিগঞ্জ অঞ্চলে বাসস্থান
স্থানান্তরিত করেন আর সেখানেই ১৯৩৮ সালে ৬৫ বছর বয়সে দেহ রক্ষা করেন।
ফেরার পথে
অদূরে রূপের ছটা ছড়িয়ে বয়ে যাওয়া রূপনারায়ণে বছরের শেষ সূর্যাস্ত দেখে গাড়িতে
উঠলাম।
লেখক পরিচিতি –
ড. তুষার রায়-এর স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ লেখা। ওই সময়েই “শুকতারা”তে “অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু “Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পান।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর আই. আই. টি, দিল্লি থেকে পড়াশুনা ও গবেষণা,কিছুদিন অধ্যাপনা,তারপর সরকারী বৈজ্ঞানিক দপ্তরে কার্যকালে পৃথিবীর কয়েকটি দেশেও কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে।
পঞ্চাশটিরও বেশি প্রবন্ধ নামী বৈজ্ঞানিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে (ইন্দোর) আমন্ত্রিত প্রবন্ধ পাঠ করার গৌরবও ভাগ্যে ঘটেছে। বিগত দেড় বছর করোনার প্রকোপে ছাপাখানা বন্ধ থাকার কারণে অনেক ই-ম্যাগাজিনে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে।
দিল্লি থেকে প্রকাশিত বহুল জনপ্রিয় ই-ম্যাগাজিন, “তাৎক্ষণিক”এর ‘জানা-অজানা’ কলমে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ টি জনপ্রিয়-বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি “দেশ” ওয়েব-সাইটে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং বিশেষ প্রশংসিত হয়েছে।