Advt

Advt

Shasti-Galpo-Story-1st-Part-Nityaranjan-Debnath-Tatkhanik-Bangla-Bengali-Online-emagazine-সাহিত্য-পত্রিকা-ছোট-পত্রিকা

Shasti-Galpo-Story-Nityaranjan-Debnath-Tatkhanik-Bangla-Bengali-Online-emagazine-সাহিত্য-পত্রিকা-ছোট-পত্রিকা

 

লোকটার একটা পা নেই । হাতও একটা কম । অর্থাৎ এক হাত ও এক পা নিয়ে তার সংগ্রাম । না পারে দাঁড়াতে না পারে হাঁটতে। তবে খুঁটি ধরে বা দেয়াল ধরে দাঁড়াতে পারে । ওদের সাহায্যে হাঁটি হাঁটি পা পা করে একটু একটু এগোয় নিজের নিত্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো করার চষ্টা করে— ওই টুকুই । তাতেও কখনও একটু বেসামাল হলেই ধপাস । হয়েছেও কয়েকবার । একবার তো মাথা ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড । ব্যান্ডেজ বেঁধে থাকতে হয়েছে তিনমাস । হলেও ওই সময়টা আয় - পয় ভালো হতো । দেখেই দয়ালু মানুষদের হৃদয় স্পর্শ করে যায় । এক টাকা দু টাকার বদলে পাঁচ টাকা - দশ টাকা নির্দ্বিধায় দিয়ে দিত । হলে কী হবে ? একদিকে আসে অন্যদিকে হাওয়া । সবই যায় তার বসের পকেটে । ইনকাম ভালো হলে খাওয়টার একটু রকমফের হয়ঐটুকুই তার লাভের লাভ ।

লোকটা পঞ্চাশ পেরিয়ে একান্নতে পা দিয়েছে । দেখলেই বোঝা যায় এককালে বেশ তাগড়াই চেহারা ছিল । শরীর ভাঙতে ভাঙতে এখন তালপাতার সেপাই হয়ে গেছে । হবে নাই বা কেন ? মাপা খাওয়া । যা বরাদ্দ তা পেটের এক কোণায় পড়ে থাকে । বাকিটা ঢক ঢক করে জল খেয়ে মনকে সান্ত্বনা দেয়- এতেই খুশি থাক বাপ ।

যে তার বস , এককালে সে - ই তার ছেলে ছিল । বয়স চব্বিশ - পঁচিশ । পেটানো স্বাস্থ্য । স্পেশাল মাছ - মাংস ছাড়া তার খাওয়া রোচে না । নিত্য দিনই চিকেন বা মটন তার চাই-ই চাই। তাহলে আয়রণম্যান হবে না কেন ? এককালে বাপ খেয়েছিল, এখন ছেলে তার স্থান দখল করেছেএটাই তো দুনিয়ার নিয়ম ।

সকাল নটার মধ্যে লোকটাকে খাওয়া - দাওয়া কমপ্লিট করে রেডি হতে হবে । বসের হুকুম । এক মিনিট এদিক - ওদিক হলেই ঠ্যাঙানি । এক হাত - এক পা নিয়ে কী করে যে ছোট বাথরুম , বড় বাথরুম করতে হয় , তার উপর স্নান , স্নান নয় কাকস্নান বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার । ভুক্তভোগী ছাড়া এসব বুঝবে না কেউ । দু - একবার জগৎ থেকে বিদায় নেবার চেষ্টা করেছিল । সফল হয়নি । উলটে ডেমারেজ চার্জ দিতে হয়েছে । একটা পা তাতেও ফাটল দেখা দিল । সেই আবার ব্যান্ডেজ । হাতেও চোট পেয়েছিল । শুধু কষ্ট আর কষ্ট । একমাত্র কেউ যদি বিষ এনে দেয়, চিরশান্তি পেত । কিন্তু কে এনে দেবে ? সে সৌভাগ্য করে তো জন্মায়নি ।

ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে নটায় হাওড়ার সাবওয়েতে সিঁড়ির নিচে তাকে বসিয়ে দেওয়া হয় । একটা সাদা মার্কিন কাপড়ের টুকরো বিছিয়ে তার উপর এনামেলের তোবরানো বড় এক বাটি । রাত আটটা পর্যন্ত তার ডিউটি । মাঝখানে তিনটে থেকে চারটের মধ্যে পাউরুটি বা রুটি আসে । ইনকামের বহর দেখে পাউরুটির সাইজ ঠিক হয় । আজকাল মানুষ সেয়ানা হয়ে গেছে । কানা খোঁড়া - ল্যাংড়া দেখেও মন টলে না । হাত বাড়িয়ে সারাক্ষণ থাকতে হয় । তাতেই মা - বোনদের যা একটু নজর আসে । এক টাকা - দু টাকা ছুঁড়ে দেয় । ইদানীং বা আবার এক টাকার কয়েন দেখলে ক্ষেপে যায় । ওটা নাকি অচল হয়ে গেছে । বাজারে চলে না । এতে লোকটার কী দোষ ? তার চেষ্টার কোনো খামতি নেই । তবু হাতে না মেরে ভাতে মারার চেষ্টা । সবই কপাল ।

( দুই )

ছেলেটির যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তাকে ধরে নিয়ে আসে । নলহাটি স্টেশনে দু-নম্বর প্লাটফরমের এককোণে মায়ের সঙ্গে থাকত । মা পঙ্গু । স্টেশনেই ভিক্ষে করত । ট্রেন ঢুকলে ছেলেটি ট্রেনে উঠে যাত্রীদের কাছে হাত পাততো । যা পেত মায়ে - পোয়ে ঠিক চলে যাচ্ছিল । হঠাৎ একদিন এক যাত্রী ট্রেনেতেই ভালোমন্দ খাইয়ে ঘুমের ওষুধও খাইয়ে দিয়েছিল বোধ হয় । ঘুমে একেবারে কাদা । যখন জাগলো তখন সে অনেক দূরে । কলকাতা দমদমের কাছে একটি বস্তিতে শুয়ে আছে । মায়ের জন্য হাউমাউ করে কেঁদেছিল । পুরো একটা দিন কিছু মুখে দেয়নি । ওরা খেতে দিয়েছিল । ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে । তাতেও তাদের কোনো হেলদোল নেই । ঘরে আটকে রেখেছে , কোথাও যেতে দেবে না । মায়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল , কিন্তু উপায় নেই । ঐ বয়সেই বুঝে গিয়েছিল এদের ফাঁদ থেকে পালানো সম্ভব নয় । তবে ওরা খুব আদর করত । ভালো ভালো খেতে দিত । কয়েক মাস যেতে না যেতেই লোকটা বলল , “এবার থেকে ওকে মা বলবি । আর আমাকে বাবা ।

নতুন মা-টাকে প্রথম থেকেই ওর পছন্দ হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু লোকটাকে নয় । তবু এক আধদিন বাবা বলে ডেকেছে । মন থেকে নয় ভয়ে । নতুন মা খুব ভালো ছিল । ওকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই গুন গুন করে গান গাইত । বিছানায় পাশে নিয়ে শুতো ।

বছর ছয় - সাত যেতে না যেতেই ছেলেটি বুঝে গেললোকটা সাংঘাতিক । যে কোনো সময় মানুষ খুন করতে পারে । এতটুকু হাত কাঁপবে না ।

একদিন দেখা গেল তিন বছরের একটি মেয়েকে কোথা থেকে তুলে নিয়ে এসেছে । মাসখানেকের মধ্যে মেয়েটি নিজের হয়ে গেল । কন্নোকাটি আর করে না । উল্টে লোকটাকে বাবা বাবা বলে ডাকে ।

বস্তিতে পাশাপাশি দুটো ঘর ছিল । একদিন দুপুরবেলা মেয়েটি ঘুমুচ্ছিল । পাশে ছেলেটিও শুয়েছিল। মা কয়েকদিন আগে কোথায় চলে গেছে ছেলেটি জানে না । 

লোকটাকে জিজ্ঞেস করলে বলে বেড়াতে গেছে । ফিরতে দেরি হবে । লোকটা ঘরে ঢুকে বলল , এ্যাই মন্টু , তুই পাশের ঘরে যা , আমি এখানে বিশ্রাম নেব । ছেলেটিকে ওরা মন্টু বলে ডাকত। মায়ের দেওয়া নামটা তখন মুছে গেছে । মন্টু অবাক । লোকটা তো এই ঘরে সাধারণত আসে না । পাশের ঘরটাতেই বরাবর থাকে । আজ কী হলো ? মন্টুর কৌতূহল হল খুব । পাশের ঘরে গিয়েও তার সন্দেহ হল লোকটা সত্যিই বিশ্রাম নেবে । কিনা সে জানলা দিয়ে দেখবে।

জানলা দিয়ে যা দেখল , সে জীবনে ভুলতে পারবে না । ঘুমের মধ্যে মেয়েটার ডানহাতটা ধরে এমনভাবে মুচড়ে দিল ভাবা যায় না । তারপরই হ্যাঁচকা এক টান । মন্টু হতবাক । কট করে একটা আওয়াজ হলো । কাঁধ থেকে হাতের হাড় ভেঙে সরে এসেছে । মেয়েটি যন্ত্রণায় সে কী চিল চিৎকার। বীভৎস দৃশ্য । লোকটি তখনও থেমে নেই । মেয়েটির ডান পা - টা উল্টিয়ে আচমকা ঘুরিয়ে মোচড় দিলো । ওঃ দেখে ঠিক থাকা যায় না । মেয়েটি তখন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে ।

মন্টু ভয়ে জড়সড় । বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁপতে লাগল । ভয়ে সারাক্ষণ শুধু কেঁদেছে । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল ।

পরদিন সকালে লোকটা বলল , " তোর বোনের হাত - পা ভেঙে গেছে । হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে । "

কয়েকদিন পর লোকটার সঙ্গে হসপিটালে দেখতেও গিয়েছিল । ডাক্তার বলেছেন , " হাত - পা অপারেশন করে বাদ দিতে হবে । " তখনও কাউকে বলার সাহস হলো না যে এই লোকটাই অপকর্মগুলো করেছে ।

অপারেশনের কুড়ি দিন পর ছোট্ট বোনটিকে একটি হাত এবং একটি পা বাদ দিয়ে বাড়িতে আনা হল ।

আস্তে আস্তে পরে জানা গেল লোকটির এটাই ব্যবসা । দিনসাতেক পরেই বাচ্চা মেয়েটিকে শিয়ালদা স্টেশনে বসিয়ে দেওয়া হলো ভিক্ষে করার জন্য । আরও আছে । একজন বসে বিধাননগর স্টেশনে , আরেকজন হাওড়ায় ।

মন্টুর যখন সতের আঠার বছর বয়স হয়েছে তখন ওর উপর দায়িত্ব ঐ তিনজনকে তিন স্টেশনে নিয়ে গিয়ে ঠিক জায়গায় বসিয়ে দিতে হবে । আবার তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ ওদের টিফিন নিয়ে এবং যা টাকাপয়সা পেয়েছে- সে - সব নিয়ে আসতে হবে । টাকাপয়সা ভালোই হয় । ঐ তিনজনের জন্য অন্য একটি বস্তিতে ঘর ভাড়া নেওয়া আছে । এদের কখনোই মন্টুদের বস্তিতে আসার অধিকার নেই । বিধাননগর স্টেশনে যে ছেলেটি বসে , তারও নাকি ঐ লোকটাই হাত - পা ভেঙেছে । মন্টুকে সে নিজে বলেছে ।

(ক্রমশ) ……

দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন আগামী সোমবার (২৪.০১.২০২২)  

লেখক পরিচিতি: 

জন্ম পৈত্রিক বাড়ি বর্ধমান জেলার কাটোয়া-র পানুহাট-এ। পড়াশুনা কাটোয়া কলেজ। বর্তমান নিবাস হুগলী জেলার চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।

তাঁর প্রথম গল্প---চেতনা। প্রকাশিত হয় ছোটদের পত্রিকা "শুকতারা"য়, ১৯৯৬ এপ্রিল সংখ্যায়। তারপর বড়দের পত্রিকা--দেশ, কালি ও কলম, শিলাদিত্য, শুভমসাময়িকী, তথ্যকেন্দ্র, উৎসব, কথাসাহিত্য, কলেজ স্ট্রিট,  দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,সুখবর, সংবাদ নজর, খবর  ৩৬৫ দিন এবং লিটল ম্যাগাজিন-এ নিয়মিত লেখেন।

তিনটি গল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। " শতানীক" (ষাণ্মাসিক) সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। 

Shasti-Galpo-Story-Nityaranjan-Debnath-Tatkhanik-Bangla-Bengali-Online-emagazine-সাহিত্য-পত্রিকা-ছোট-পত্রিকা