লোকটার একটা পা
নেই । হাতও একটা কম । অর্থাৎ এক হাত ও এক পা নিয়ে তার সংগ্রাম । না পারে দাঁড়াতে
না পারে হাঁটতে। তবে খুঁটি ধরে বা দেয়াল ধরে
দাঁড়াতে পারে । ওদের সাহায্যে হাঁটি হাঁটি পা পা করে একটু একটু এগোয় নিজের নিত্য
প্রয়োজনীয় কাজগুলো করার চষ্টা করে— ওই টুকুই । তাতেও কখনও
একটু বেসামাল হলেই — ধপাস । হয়েছেও কয়েকবার । একবার তো
মাথা ফেটে রক্তারক্তি কাণ্ড । ব্যান্ডেজ বেঁধে থাকতে হয়েছে তিনমাস । হলেও ওই সময়টা আয় - পয় ভালো হতো । দেখেই দয়ালু মানুষদের হৃদয় স্পর্শ করে
যায় । এক টাকা দু টাকার বদলে পাঁচ টাকা - দশ টাকা নির্দ্বিধায় দিয়ে দিত । হলে
কী হবে ? একদিকে আসে অন্যদিকে হাওয়া । সবই যায় তার বসের
পকেটে । ইনকাম ভালো হলে খাওয়টার একটু রকমফের হয়— ঐটুকুই
তার লাভের লাভ ।
লোকটা পঞ্চাশ
পেরিয়ে একান্নতে পা দিয়েছে । দেখলেই বোঝা যায় এককালে বেশ তাগড়াই চেহারা ছিল ।
শরীর ভাঙতে ভাঙতে এখন তালপাতার সেপাই হয়ে গেছে । হবে নাই বা কেন ? মাপা
খাওয়া । যা বরাদ্দ তা পেটের এক কোণায় পড়ে থাকে । বাকিটা ঢক ঢক করে জল খেয়ে
মনকে সান্ত্বনা দেয়- এতেই খুশি থাক বাপ ।
যে তার বস , এককালে
সে - ই তার ছেলে ছিল । বয়স চব্বিশ - পঁচিশ । পেটানো স্বাস্থ্য । স্পেশাল মাছ -
মাংস ছাড়া তার খাওয়া রোচে না । নিত্য দিনই চিকেন বা মটন তার চাই-ই চাই। তাহলে আয়রণম্যান হবে না কেন ? এককালে বাপ
খেয়েছিল, এখন ছেলে তার স্থান দখল করেছে— এটাই তো দুনিয়ার নিয়ম ।
সকাল নটার মধ্যে
লোকটাকে খাওয়া - দাওয়া কমপ্লিট করে রেডি হতে হবে । বসের হুকুম । এক মিনিট এদিক -
ওদিক হলেই ঠ্যাঙানি । এক হাত - এক পা নিয়ে কী করে যে ছোট বাথরুম , বড়
বাথরুম করতে হয় , তার উপর স্নান , স্নান
নয় কাকস্নান – বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার । ভুক্তভোগী ছাড়া এসব
বুঝবে না কেউ । দু - একবার জগৎ থেকে বিদায় নেবার চেষ্টা করেছিল । সফল হয়নি ।
উলটে ডেমারেজ চার্জ দিতে হয়েছে । একটা পা তাতেও ফাটল দেখা দিল । সেই আবার
ব্যান্ডেজ । হাতেও চোট পেয়েছিল । শুধু কষ্ট আর কষ্ট । একমাত্র কেউ যদি বিষ এনে
দেয়, চিরশান্তি পেত । কিন্তু কে এনে দেবে ? সে সৌভাগ্য করে তো জন্মায়নি ।
ঠিক কাঁটায়
কাঁটায় সাড়ে নটায় হাওড়ার সাবওয়েতে সিঁড়ির নিচে তাকে বসিয়ে দেওয়া হয় । একটা সাদা মার্কিন কাপড়ের টুকরো বিছিয়ে তার উপর
এনামেলের তোবরানো বড় এক বাটি । রাত আটটা
পর্যন্ত তার ডিউটি । মাঝখানে তিনটে থেকে চারটের মধ্যে পাউরুটি বা রুটি আসে । ইনকামের বহর দেখে পাউরুটির সাইজ ঠিক হয় । আজকাল মানুষ সেয়ানা
হয়ে গেছে । কানা খোঁড়া - ল্যাংড়া দেখেও মন টলে না । হাত বাড়িয়ে সারাক্ষণ থাকতে হয় । তাতেই মা - বোনদের যা একটু নজর আসে । এক টাকা - দু টাকা ছুঁড়ে
দেয় । ইদানীং বা আবার এক টাকার কয়েন দেখলে ক্ষেপে যায় । ওটা নাকি অচল হয়ে গেছে
। বাজারে চলে না । এতে লোকটার কী দোষ ? তার চেষ্টার কোনো
খামতি নেই । তবু হাতে না মেরে ভাতে মারার চেষ্টা । সবই কপাল ।
(
দুই )
ছেলেটির
যখন পাঁচ বছর বয়স তখন তাকে ধরে নিয়ে আসে । নলহাটি স্টেশনে দু-নম্বর প্লাটফরমের এককোণে মায়ের সঙ্গে থাকত । মা পঙ্গু । স্টেশনেই
ভিক্ষে করত । ট্রেন ঢুকলে ছেলেটি ট্রেনে উঠে যাত্রীদের কাছে হাত পাততো । যা পেত
মায়ে - পোয়ে ঠিক চলে যাচ্ছিল । হঠাৎ একদিন এক যাত্রী ট্রেনেতেই ভালোমন্দ খাইয়ে
ঘুমের ওষুধও খাইয়ে দিয়েছিল বোধ হয় । ঘুমে একেবারে কাদা । যখন জাগলো তখন সে অনেক
দূরে । কলকাতা দমদমের কাছে একটি বস্তিতে শুয়ে আছে । মায়ের জন্য হাউমাউ করে
কেঁদেছিল । পুরো একটা দিন কিছু মুখে দেয়নি । ওরা খেতে দিয়েছিল । ছুঁড়ে ফেলে
দিয়েছে । তাতেও তাদের কোনো হেলদোল নেই । ঘরে আটকে রেখেছে , কোথাও যেতে দেবে না । মায়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল , কিন্তু উপায় নেই । ঐ বয়সেই বুঝে গিয়েছিল এদের ফাঁদ থেকে পালানো
সম্ভব নয় । তবে ওরা খুব আদর করত । ভালো ভালো খেতে দিত । কয়েক মাস যেতে না যেতেই
লোকটা বলল , “এবার থেকে ওকে মা বলবি । আর আমাকে বাবা । ”
নতুন
মা-টাকে প্রথম থেকেই ওর পছন্দ
হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু লোকটাকে নয় । তবু এক আধদিন বাবা বলে ডেকেছে । মন থেকে নয়
ভয়ে । নতুন মা খুব ভালো ছিল । ওকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই গুন গুন করে গান গাইত ।
বিছানায় পাশে নিয়ে শুতো ।
বছর
ছয় - সাত যেতে না যেতেই ছেলেটি বুঝে গেল— লোকটা সাংঘাতিক । যে কোনো সময় মানুষ খুন করতে পারে । এতটুকু হাত
কাঁপবে না ।
একদিন
দেখা গেল তিন বছরের একটি মেয়েকে কোথা থেকে তুলে নিয়ে এসেছে । মাসখানেকের মধ্যে
মেয়েটি নিজের হয়ে গেল । কন্নোকাটি আর করে না । উল্টে লোকটাকে বাবা বাবা বলে ডাকে
।
বস্তিতে
পাশাপাশি দুটো ঘর ছিল । একদিন দুপুরবেলা মেয়েটি ঘুমুচ্ছিল । পাশে ছেলেটিও
শুয়েছিল। মা কয়েকদিন আগে কোথায় চলে গেছে ছেলেটি জানে না ।
লোকটাকে জিজ্ঞেস করলে বলে বেড়াতে গেছে । ফিরতে দেরি হবে ।
লোকটা ঘরে ঢুকে বলল , এ্যাই মন্টু ,
তুই পাশের ঘরে যা , আমি এখানে বিশ্রাম
নেব । ছেলেটিকে ওরা মন্টু বলে ডাকত। মায়ের দেওয়া নামটা তখন মুছে গেছে । মন্টু
অবাক । লোকটা তো এই ঘরে সাধারণত আসে না । পাশের ঘরটাতেই বরাবর থাকে । আজ কী হলো ?
মন্টুর কৌতূহল হল খুব । পাশের ঘরে গিয়েও তার সন্দেহ হল লোকটা
সত্যিই বিশ্রাম নেবে । কিনা সে জানলা দিয়ে দেখবে।
জানলা দিয়ে যা দেখল , সে জীবনে ভুলতে পারবে না । ঘুমের মধ্যে মেয়েটার ডানহাতটা ধরে এমনভাবে
মুচড়ে দিল ভাবা যায় না । তারপরই হ্যাঁচকা এক টান । মন্টু হতবাক । কট করে একটা
আওয়াজ হলো । কাঁধ থেকে হাতের হাড় ভেঙে সরে এসেছে । মেয়েটি যন্ত্রণায় সে কী চিল
চিৎকার। বীভৎস দৃশ্য । লোকটি তখনও থেমে নেই । মেয়েটির ডান পা - টা উল্টিয়ে আচমকা
ঘুরিয়ে মোচড় দিলো । ওঃ দেখে ঠিক থাকা যায় না । মেয়েটি তখন অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে
।
মন্টু ভয়ে জড়সড় । বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁপতে লাগল । ভয়ে
সারাক্ষণ শুধু কেঁদেছে । ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিল
।
পরদিন সকালে লোকটা বলল , " তোর বোনের হাত - পা ভেঙে গেছে । হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে । "
কয়েকদিন পর লোকটার সঙ্গে হসপিটালে দেখতেও গিয়েছিল । ডাক্তার
বলেছেন , " হাত - পা অপারেশন করে
বাদ দিতে হবে । " তখনও কাউকে বলার সাহস হলো না যে এই লোকটাই অপকর্মগুলো করেছে
।
অপারেশনের কুড়ি
দিন পর ছোট্ট বোনটিকে একটি হাত এবং একটি পা বাদ দিয়ে বাড়িতে আনা হল ।
আস্তে আস্তে পরে জানা গেল লোকটির এটাই ব্যবসা । দিনসাতেক পরেই
বাচ্চা মেয়েটিকে শিয়ালদা স্টেশনে বসিয়ে দেওয়া হলো
ভিক্ষে করার জন্য । আরও আছে । একজন বসে বিধাননগর স্টেশনে ,
আরেকজন হাওড়ায় ।
মন্টুর যখন সতের আঠার বছর বয়স হয়েছে তখন ওর উপর দায়িত্ব —
ঐ তিনজনকে তিন স্টেশনে নিয়ে গিয়ে ঠিক জায়গায় বসিয়ে দিতে হবে
। আবার তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ ওদের টিফিন নিয়ে এবং যা টাকাপয়সা পেয়েছে- সে -
সব নিয়ে আসতে হবে । টাকাপয়সা ভালোই হয় । ঐ তিনজনের জন্য অন্য একটি বস্তিতে ঘর
ভাড়া নেওয়া আছে । এদের কখনোই মন্টুদের বস্তিতে আসার অধিকার নেই । বিধাননগর
স্টেশনে যে ছেলেটি বসে , তারও নাকি ঐ লোকটাই হাত - পা
ভেঙেছে । মন্টুকে সে নিজে বলেছে ।
(ক্রমশ)
……
দ্বিতীয়
পর্ব পড়ুন আগামী সোমবার (২৪.০১.২০২২)
লেখক পরিচিতি:
জন্ম পৈত্রিক বাড়ি বর্ধমান জেলার কাটোয়া-র পানুহাট-এ। পড়াশুনা কাটোয়া কলেজ। বর্তমান নিবাস হুগলী জেলার চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন।
তাঁর প্রথম গল্প---চেতনা। প্রকাশিত হয় ছোটদের পত্রিকা "শুকতারা"য়, ১৯৯৬ এপ্রিল সংখ্যায়। তারপর বড়দের পত্রিকা--দেশ, কালি ও কলম, শিলাদিত্য, শুভমসাময়িকী, তথ্যকেন্দ্র, উৎসব, কথাসাহিত্য, কলেজ স্ট্রিট, দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,সুখবর, সংবাদ নজর, খবর ৩৬৫ দিন এবং লিটল ম্যাগাজিন-এ নিয়মিত লেখেন।
তিনটি গল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। " শতানীক" (ষাণ্মাসিক) সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন।