Advt

Advt

Gangotri-Vramon-2nd-Part-Travel-by-Juthika-Chakraborty,Tatkhanik-Online-emagazine-সাহিত্য-পত্রিকা-ছোট-পত্রিকা

 ভ্রমণ কাহিনী

১ম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

লেখিকার অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।

Gangotri-Vramon-2nd-Part-Travel-by-Juthika-Chakraborty,Tatkhanik-Online-emagazine-সাহিত্য-পত্রিকা-ছোট-পত্রিকা

ছবি - যূথিকা চক্রবর্তী (লেখিকা)-র তোলা

যাবার জন্য তৈরী হয়ে বাইরে এলাম , দেখি আমার জন্য সবাই দাঁড়িয়ে আছে । সান্ত্বনা দিয়ে বললাম , “তোমার এত ভাবছ কেন ? আমি তো বাড়ী থেকে অনুমতি নিয়েই এসেছি । আমি যাব । আসি তবে ’ – এই বলে রওনা হলাম।কিছু অঘটন হলে হবে কিছু করার নেই - ম্যানেজারের সঙ্গে ঘোড়া ষ্ট্যান্ডে এলাম । ঘোড়া না নিয়ে শক্তপোক্ত একটা খচ্চরের পিঠে চেপে বসলাম আর দুজন সঙ্গী হলেন । ম্যানেজার বার বার মনে করিয়ে দিলেন । যথাস্থানে পৌঁছে অযথা দেরী না করে ফিরে আসবেন তাড়াতাড়ি । পথে রাতে থাকার জায়গা আছে তবে সেটা করবেন না আমি অপেক্ষায় থাকৰ ,ফিরে আসবেন রাতেই দেরী হলেও । এমন সময়ে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে সেই বয়স্কা মহিল ঘোড়াস্ট্যাণ্ডে চলে এসে বললেন আমিও গোমুখ যাব । আমার সব দায়িত্ব আমার । ঘোড়ায় চেপে আমাদের সাথে রওনা দিলেন । মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল । এ কি হঠকারিতা । মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলে মা গঙ্গাকে স্মরণ করে চলা শুরু করলাম গোমুখের পথে । গোমুখ আমার সারা জীবনের স্বপ্ন । বালিকা বয়সে পাঠ্য বইয়ে পড়েছিলাম ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে '। তখন সেই বয়সে আমার মনে হয়েছিল জগদীশ চন্দ্রের এই লেখা গদ্য নয় যেন স্বপ্নের এক কবিতা । সেই উৎসে আজ আমি চলেছি । আমার কোন পিছুটান রাখিনি । মুক্ত মনেই রওনা হয়েছি ।

ইষ্টদেবীকে স্মরণ করে প্রণাম করে জয় গুরু বলে গুরুদেবের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে রওনা হলাম। এক অনাবিল শান্ত,স্তব্ধ,অপরূপ পাহাড় ঘেরা পথে আমি চলেছি । দুপাশে পাহাড়ের শ্রেণী,কেউ কাছে কেউ দুরে,মাঝখানে খরস্রোতা ভাগীরথী বয়ে চলেছে সশব্দে । নদীবক্ষে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র উপলখন্ড । একেকটা খন্ড একতলা দোতলা বাড়ীর সমান উঁচু কিন্তু অদ্ভুত গোলাকার বাঁদিকে পাহাড় শ্রেণী ডানদিকে নদীতীর ঘেঁযে কোথাও কিছুটা বিস্তৃত,কোথাও মাত্র ৩ ফুট চওড়া পথ । অপর পাড়ে ডান দিকে গিরিশ্রেণীসবাই আমার অচেনা , অজানা তবে প্রত্যেকেই আপন আপন বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র । প্রত্যেকেই সুন্দর মনোমুগ্ধকর এ বলছে আমায় দেখ ও বলছে আমায়, আমি কাকে দেখি । জলকলতান ছাড়া প্রকৃতিতে ছিলনা কোন শব্দ অদ্ভুদ নিস্তব্ধ চারিধার ! কান পেতে থাকলে যেন বহুদুর থেকে ভেসে আসছিল 'টুপটাপ ' দু'একটা শব্দ । শশনে হাওয়া ছিল না , যা থাকবে শুনেছিলাম , সূঁচের মত তীক্ষ্ণমুখ বৃষ্টি ছিল না , যা থাকবেই শুনেছিলাম , ছিল মাতাল করে দেওয়া উতল হাওয়া । প্রকৃতি অপরূপ এবং নিঃশব্দ কিন্তু পথ ভয়ঙ্কর । ঘণ্টা খানেকের উপর চড়াই উৎরাই ভেঙে চলবার পর বুঝলাম পথ যথার্থই দুর্গম । ১৯ কিলোমিটার ঘোড়ার পিঠে চড়ে যাওয়া সহজ কাজ ছিলনা । মাত্র ৩ ফুট চওড়া রাস্তার বাঁদিকে পথ ঘেঁষে খাড়া পাথরের দেওয়াল ডানদিকে তীব্রস্রোতা ভাগীরথী । কোথাও আবার মাথার উপর ছাতের মত বেরিয়ে আছে পাথর । ১০ কিলোমিটার গিয়ে 'চিরবাসা চটীতে বিশ্রাম নিয়ে চা,জল খেয়ে আবার চলা । সেই মহিলা দেখলাম চটীতে পাতা গদীর উপর শুয়ে পড়লেন । মাথা না ঘামিয়ে রওনা হলাম । ডানদিকে ভাগীরথী বয়ে চলেছে বিপুলগর্জনে । বাঁদিকে গা ঘেঁষে খাড়া পাথরের দেওয়াল কোনটা সবুজে মোড়া , কোনটা ন্যাড়া , কোনটার আবার কালো গায়ের ফাটল ধরে মাথা থেকে গোড়া অবধি সাদা বরফের দাগ যেন জটাধারী । ১৯ কিলোমিটারের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় ৩/৪ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে । ঘোড়াগুলি যে কোথা দিয়ে সহিসরা পার করে নিয়ে যায় জানিনা । তবে আমার  সহিসকে আমি মোটা বকশিসের কথা বলে কোন সময়ের জন্য কাছছাড়া করিনি । আমার সহিস ইন্দরসিং একজায়গায় পৌঁছে বলল , ৎরাইয়ে , পয়লসে যানা পড়েগা । যানা পড়েগা যখন তখন যাব তো বটেই।কিন্তু একি বিচিত্র পথ রে বাবা মাইলজুড়ে পড়ে রয়েছে বিরাট সব গোলাকার পাথর খন্ড । সেগুলি পার হয়ে কি ভাবে যাব ভাবছি। লাঠি ব্লকে ইন্দরসিং একটা পাথরে পা রেখে দাঁড়াচ্ছে আর আমি বাঁহাতে লাঠি আর ডানহাতে ইন্দর সিং-এর কোটের হাতা খামচে ধরে লাফ দিয়ে পার হচ্ছি । আমার ছোটখাট চেহারা । একটা পাথর থেকে আরেকটা পাথরে আমাকে এভাবেই লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে হচ্ছে । একটু অন্যমনস্ক হলেই হাড় আস্ত থাকবে না । এই সময়ে আমার মনে হচ্ছিল ঠাকুরমার ঝুলির সেই রাজপুত্রের কথা,যে সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে প্রথমে পেল এক হাড়ের পাহাড় তারপর সেটা পেরিয়ে পেল এক মাথার খুলির পাহাড় । আমিও যেন বোল্ডার নয় এক মাথার খুলির থেকে আরেক মাথার খুলিতে লাফিয়ে পার হচ্ছিলাম । চলতে চলতে হাঁফাচ্ছি আবার একটু দম নিয়ে আবার চলছি । একসময়ে শেষ হল এই পথ । বাহনের পিঠে চড়লাম । ঘোড়ার পিঠে চড়ে তিনবার পাহাড়ী ছোট নদী পার হতে হয়েছে । সহিসরা ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে সরু তক্তাপাতা সেতুদিয়ে পার হচ্ছে আর ঘোড়া তার অভ্যস্ত পথে ঘুরে ঘুরে নদী পার হচ্ছে । তখন খুব ভয় করছিলশরীর একেবারে সিটিয়ে বসে থাকতাম । কিছুতো করার ছিল না,তাই ভয় পাওয়াটাও বাদ দিয়ে দিলাম। ৩ ফুট পাথরের রাস্তার দেওয়ালে অনেক জায়গাতেই পাথর বেরিয়ে থাকে একটু অন্য মনস্ক হলেই ঠোকর লাগে,কোথাও মাথার উপর ছাদ ঝুলে আছে । কখন উঁচুতে,কখনো নিচুতে মাপমত মাথা নিচু না করলে মাথা ছাতু হবে । পথ যেটাকে বলছি সেটা বড় বড় পাথর খন্ড ফেলে কাদা মাটিতে ভরাট করা । বৃষ্টি হলে মাটি গলে গিয়ে গর্ত হয় আর গর্তে ঘোড়ার পা আটকালে বা ফসকালে সবই ফসকা গেরো । আমাদের ভাগ্য ভালো দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি হয়নি । এ পথে এটা বিরল এবং সৌভাগ্য তো বটেই । হঠাৎ ইন্দরসিং চিৎকার করে বলল ,'আন্টিজী সামহালকে'ভয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি ৩/৪ হাত রাস্তা , সোজা ৪৫ ° ডিগ্রী কোণ তৈরী করে উপরে উঠে গেছে এবং সামনে শূন্য, ইন্দরসিং সারাক্ষণ আমার পাশে পাশেই চলছিল লাগাম ধরে। ওকে এখন পাশে দেখতে না পেয়ে ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম ইন্দরসিং তুমি কাঁহা ? বহোত ডর লাগতা হ্যায় । ' — ' কোই বাত নেহি , ম্যায় ইধারই হুঁ । '

ততক্ষণে ৪৫ ডিগ্রির মাথায় চড়ে গেছি । ঘোড়ার পা সামলানোর জন্য ইন্দর সিং পিছনে । অবাক হয়ে দেখি ওধারে ঠিক একইরকমভাবে পথটা নেমে গেছে । যতবার ভেবেছি আর ভয় পাব না এমন এক একটা জায়গায় এসেছি যেখানে আতঙ্কে হাড় হিম হয়ে যায় । যেমন উৎরাই তেমন চড়াই । অনবরত হাত সামনে পিছনে করে শরীরের ভারসাম্য রাখতে হচ্ছে । ঘোড়ার অবস্থান যখন Parallel to Perperdicular হচ্ছে তখন পিঠে যে বসে আছে তার অবস্থা । যখনই বাড়ির কথা ভাবছি তখনই ঠোক্কর খেতে হচ্ছে । পথ খুব ভয়ের কিন্তু প্রকৃতির রূপ যখনই দেখছি তখনি মন ভরে যাচ্ছে আনন্দে । " নীরব নির্জন চারিধার ' ভাগীরথীর গর্জন ছাড়া প্রাণের কোন কোলাহল নেই । মনে হচ্ছে যেকোন জায়গায় বসে থাকলে নাওয়া খাওয়া ভুলে সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়।‘চিরবাসা’-র পর ৬ কিলোমিটার গিয়ে ‘ভূজবাসা চটীতে বিশ্রাম । চটীর নাম ‘ভূজবাসা’হলেও ধারে কাছে কোথাও আর একটিও ভূর্জবৃক্ষ নেই । ভূজবাসা থেকে রওনা হবার কিছু পরেই পৌছলাম আর এক জায়গায় যেখানে বিপদ স্রেফ ভাগ্যের ব্যাপার । সাবধানতা এখানে হাস্যকর । এ পথে ইনিই মূর্তিমান বিভীষিকা ! 'গিলা পাহাড় ' – অনেক আগে থেকেই যে টুপ টাপ ' সংগীতের মত মিষ্টি শব্দ ভেসে আসছিল তা এনারই কীর্তি । অনবরত এর গা থেকে ছোট মাঝারি , বড় , অতি বড় পাথর ঝরে পড়ছে । পাহাড়টি ভয়ঙ্কর এবং দেখতে এতই সুন্দর যে মুহূর্তের জন্য চোখ ফেরাতে পারিনি । ইন্দরসিং ও পাহাড়ের দিক থেকে এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি না সরিয়ে প্রাণপণে তার প্রাণীটাকে আরোহী সমেত সামনের দিকে টেনে নিয়ে চলছিল । যাক্ পেরিয়ে এলাম নিরাপদে । এবার বাহন ছেড়ে দিতে হল । এসে গেছি প্রার্থিতস্থানে প্রায় ।

 ক্রমশ .................................

পরের পর্ব পড়ুন আগামীকাল (১৯.০১.২০২২)

লেখিকার পরিচিতি –

যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।