ভ্রমণ কাহিনী
হিমালয় ভ্রমণ
নিয়ে www.tatkhanik.com
–এ কয়েকটি পর্ব লিখেছি। এবার গঙ্গোত্রী ভ্রমণের
কথা তুলে ধরছি। এবারে গঙ্গোত্রী-র দিকে চলার পথে অলকানন্দাকে তেমন করে পাশে পাচ্ছিলামনা।পাচ্ছি
একটু দূরে দূরে পাহাড়ের গা বেয়ে দুধগোলা জল ঝাপিয়ে
পড়ছে পাহাড় থেকে নীচে । মনে হচ্ছে কেউ যেন গ্যালন গ্যালন দুধ জ্বালদিচ্ছে আর সেই
দুধ উথলে উঠছে নিরন্তর । ঘনসবুজে ছাওয়া পাহাড়ী পথে দুধসাদা অলকানন্দার রূপ দেখে
প্রাণমন জুড়িয়ে গেল । আমরা বিকেল ছ'টা নাগাদ উত্তরকাশীতে পৌঁছে গেলাম, বৃষ্টি
হচ্ছে ভালোই । তার মধ্যে দল দু'ভাগ হয়ে গেল । অনেকেই কেদারবদ্রী
সেরে হরিদ্বারে ফিরে যাবেন – সেখান থেকে ঘরমুখো । ভাগীরথীর কূলে হিমালয়ের বুকে শেষ
আধুনিক শহর উত্তরকাশী। হিউয়েন সাঙের বিবরণীতে ব্রহ্মপুর নামে উত্তরকাশীর উল্লেখ
আছে । কথিত আছে কিরাতরূপী শিব ও অর্জুনের দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয়েছিল এই উত্তর কাশীতে ।
মহাভারতের জতুগৃহও নাকি তৈরী হয়েছিল এই উত্তরকাশীতে ।
এখানে সন্ধের
পর আমাদের দলে যোগ দিলেন আরও তিনজন যাত্রী , এসেছেন বর্ধমান থেকে । একজন পুরুষ দুজন মহিলা শিক্ষিকা – এরা গঙ্গোত্রী গোমুখ ও যমুনোত্রী
যাবেন । একরাত উত্তরকাশীতে কাটিয়ে পরদিন সকালে আমরা গঙ্গোত্রীর পথে রওনা হলাম ।
কেদারবদ্রী থেকে গঙ্গোত্রীর রাস্তা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র । প্রকৃতির শোভা মুগ্ধ করে
রাখে সারাপথ । এমন দৃষ্টিনন্দন পাহাড়ী পথ আগে কোথাও দেখিনি । খাড়া পাহাড়ের গা
বেয়ে রাস্তা,অন্যদিকে গভীর খাদ । পাইন গাছে ছাওয়া দুধারে গভীর বনাঞ্চল – ঢালে ঢালে আবাদ । দেখলে মনে হয়
যেন সাজান বাগান । পথ খুব প্রশস্ত নয় এবং মোটামুটি মসৃন । জায়গায় জায়গায়
অবশ্য দুটো গাড়ী পাশাপাশি চলতে পারেনা এগিয়ে পিছিয়ে যেতে হয় । আবার এপথে বড়
গাড়ী চলে না । ট্যাক্সি সুমো অথবা জীপ । গঙ্গাকে ডাইনে রেখে আমাদের দুটো Sumo চলছে । কতবার যে উপরে
উঠলাম আবার নামলাম এবং এইভাবে একটা পাহাড় থেকে পাশের পাহাড়ে গেলাম । পাশে পাশে
চলেছে গঙ্গা । গঙ্গার একপারে সামান্য ঢাল আর একপারে সুতীব্র খাড়া নিরেট পাথরের
দেওয়াল । ধরালিতে হাত পা ছড়ানর জন্য ১০/১৫ মি . গাড়ী থেকে নেমে দাঁড়ালাম । কী
বিচিত্র প্রাকৃতিক শোভা ! দুপাশে আগাপাশতলা সবুজ ভেলভেটে মোড়া সুউচ্চ পাহাড় ।
তারই পাশে আবার অপরাহ্নের নরম রোদে ঝলমল করে ওঠা রৌপ্য কিরীটশিরে নাম না জানা
অপরূপ সব শৃঙ্গ । সকল সৃষ্টির পিছনেই কি বিচিত্র ছলনাময়ী প্রকৃতির ছলনা রয়েছে – কবিগুরুর ভাষায় বলি –
“তোমার সৃষ্টির পথ
রেখেছ
আকীর্ণ করি
বিচিত্র
ছলনাজালে
হে
ছলনাময়ী । ”
বিকালেই
আমরা পৌঁছে গেলাম গঙ্গোত্রীতে । বাস থেকে নামতেই কানে এল ভাগীরথীর
গর্জন । হুড়মুড় করে যেন বয়ে চলেছে কাছেই কোথাও । কেদারে ছিল দুদ্দাড়
নেমে আসা মন্দাকিনীর কলরোল,এখানে তেমনি গঙ্গার তীব্র গর্জন । হোটেলে পৌঁছতেই গর্জন
তীব্রতর হল । রাস্তার ধারে আমাদের হোটেল একতলা দেখালেও ভেতরে নেমে গেছে তিনতলা
নীচের দিকে । পাশ দিয়ে সিঁড়িও নেমে গেছে – বুঝলাম নামতে পারলেই গঙ্গা হাতের কাছে । এখানেও পাহাড়
ফাটিয়ে সৃষ্টি হয়েছে গোমুখ - বাধনছেড়া গঙ্গা ঝাপিয়ে পড়ছে বিরাট শিলাখন্ডের উপর ।
এবারে
আমার ঘরসঙ্গী দুজনের কথা একটু না বললেই নয় – কাহিনী অম্পূর্ণ থেকে যাবে । ওরা হেঁটে
কেদারধামে গেছেন এবং হেঁটেই নেমেছেন । ওঠার সময়ে পথে বিকেলে বৃষ্টিতে ভিজতে
হয়েছে এবং রাত ৮ টা নাগাদ কেদারধামে পৌঁছেছেন । সকালে আবার ভোর ভোর রওনা হতে হবে
বলে ওরা রাত্তিরেই মন্দিরে গেছেন । কিন্তু দুয়াররুদ্ধ তাই দেবদর্শন হয়নি ।
ক্ষুণ্ন মনেই ফিরে এসেছেন । আগের দিনের বৃষ্টিতে ভেজা এবং কেদারের রাতের অসম্ভব
ঠান্ডা গঙ্গোত্রীতে পৌঁছে বড়জন শয্যা নিলেন – জ্বর সঙ্গে শ্বাস কষ্ট । হৃদয়েও ব্যথা । ডাক্তার দেখানো হল
– ডাক্তার
পরামর্শ দিলেন উত্তরকাশীতে নেমে যেতে । উনি নামবেনননা এখানেই
থাকবেন । এদিকে বদ্রীনাথে আমি নিজেকে নিয়েই মগ্ন ছিলাম ওদের খবর রাখতে পারিনি ।
আসলে রাতে শোবার সময় ছাড়া তো দেখা হবার কথা নয় , কেননা অন্য সময়ে আমি আমার মত ঘুরেছি । পরে শুনি বদ্রীনাথে
সকালে বড়বোনকে বলে ছোটবোন বেরিয়ে যায় মন্দিরে যাচ্ছি বলে । দিন গড়িয়ে বিকেল
হতেই বড়বোন আর স্থির থাকতে না পেরে আমাদের অন্যান্য সঙ্গীদের কাছে এসে হাউমাউ করে
কাঁদতে কাঁদতে বলেন যে ও জীবনে হতাশা জনিত কারণে খুব দুঃখী এবং ভয়ঙ্কর Depressed তাই কিছু করে
বসেনি তো ! আপনারা একটু খুঁজুন । সবাই মিলে মন্দিরের সামনে পিছনে
চারপাশে অনেক খোঁজাখুজি করেও না পেয়ে অগত্যা থানায় গিয়ে ডাইরী লেখায় দেবাশিষ,বিশ্বনাথ
এবং আরও কেউ কেউ ছিল ,সাথে দিদিতো ছিলই । তখন জানা যায় ছোটবোনের বয়স ৫৩ বৎসর । অথচ আমার
কাছে কি ছোটই না সেজে থাকত । যাক গে সেসব । সন্ধের মুখে
তিনি আশ্রমে ফেরৎ আসেন এবং সব শুনে ধমকে বলে যে থানায় যাবার কি দরকার ছিল ? আমি কি বাচ্চা নাকি যে হারিয়ে যাব
? আমি তো
মন্দিরের পেছনেই সারাদিন বসে ছিলাম । ওর কথাবার্তায় সকলে তো
হতভম্ব । আমি শুনে বললাম ,'ওরা একটু অদ্ভুত প্রকৃতির – ওদের নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না । রাত্তিরে এক ঘরে থাকতে হয়
থাকি । ”
রাতে সবাই
খেয়েদেয়ে শোবে । তার আগেই দেবাশিষ জানাল ‘মাসীমা আমরা কেউ গোমুখ যাব না – নতুন যে দুই মহিলা এসেছেন আপনি
ওদের সঙ্গে কথা বলে নিন । ”
আমি
জানালাম ' আমার কথাবার্তা আগেই হয়ে গেছে । আমি গোমুখ যাবই। তোমরা
আমাকে নিয়ে চিন্তা কোর না । বরং ভদ্রমহিলা যাতে বেশী অসুস্থ না হয়ে পড়েন সেকথাই
ভাব। সবাই শুতে গেল । মিনতির খুব ইচ্ছে ছিল যাবার । ও ডান্ডি চেপে কেদারে গেছে ।
গোমুখেও যাবার ইচ্ছা ছিল সেভাবেই ,কিন্তু পথ নাকি ভীষণ দুর্গম তাই বিশ্বনাথ রাজী নয় ,সুতরাং ওর যাওয়া হল না । বেচারা !
এবার দেখা যাক বেচারা কে ? আমি না মিনতি ? সবাই হয়ত বা ঘুমিয়েও পড়েছে এমন সময় ছোটবোনের শুরু হল
প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট । সে কী টান রে বাবা ! আমার ঘরেও শ্বাসকষ্টের রুগী আছেন কিন্তু
এমনটা আমি দেখিনি । বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে ঘরের মধ্যে এমাথা ওমাথা দৌড়তে লাগল
আর প্রাণঘাতী চিৎকার ও বাবা মরে গেলাম ! মরে গেলাম বলে চিৎকার। আমি উঠে কাছে বসিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম , বললাম বালিশে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে
বসতে,তাতে হয়ত একটু কমবে । কীসের কি , কিছুতেই কমে না , চিৎকারও থামে না । নিরুপায় হয়ে আমি
বাইরে এসে পাশের ঘরের দরজা ধাক্কাতে লাগলাম । একে একে সবাই উঠে এল সোরগোল শুনে ।
ম্যানেজার এল । বললো – “ডাক্তার যখন দিদিকে দেখছিলেন তখন কেন বলেননি
আপনার শ্বাসকষ্ট আছে ? এত রাতে আমি গাড়ী জোগাড় করে উত্তরকাশীতে কোথায় আপনাদের নিয়ে যাবো! এতরাতে আমি কিছু করতে পারব না,আমার
মাথায় কিছু আসছে না । সবাই হতভম্ব । এটা ওটা সান্ত্বনা দিয়ে সবাই কিছুক্ষণ পরেই
যে যার মত শুতে চলে গেল । মিনতি শুধু বলল ‘ মাসীমার ঘুম হবে না আজও ’ । দুই রুগী নিয়ে আমি বসে রইলাম । সারারাত মেয়েটার গায়ে
মাথায় হাত বুলিয়ে চলেছি আর ও ‘গেলাম , বাবারে মারে মরে গেলাম ' বলে সমানে কাতরাতে লাগল ।
একসময়ে সকাল হয়ে গেল । আমি স্নানে চলে গেলে ডাক্তার এসে দেখে দুবোনকে অবিলম্বে
উত্তরকাশীতে নেমে যেতে পরামর্শ দিলেন আর বললেন অক্সিজেন সিলিন্ডার সংগ্রহ করতে ।
ডাক্তার চলে গেলেন কিন্তু ওরা দুবোন কেউ যাবেনা উত্তর কাশীতে । আমি বললাম ‘ দেখ – আমি বেড়িয়ে যাচ্ছি । ১৯
কিলোমিটার পথ যাব আবার যত দেরীই হোক আজই ফিরব । ফিরে যদি দেখি তোমরা আবার রাতের মত
কষ্ট পাও তবে আমার অবস্থাটা কি হবে । আমি তোমাদের জন্য রাতেও ঘুমাতে পারব না ? ” ছোটবোন বলল 'আপনি আপনার মত ঘুমাবেন,আমাদের
নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না । বললাম – ‘এ কথা তোমাদের মুখেই মানায় । ধন্য তোমরা ।
ক্রমশ ............
পরের পর্ব পড়ুন আগামীকাল (১৮.০১.২০২২)
লেখিকার পরিচিতি –
যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।