মদনপুর
স্টেশনে দাঁড়িয়ে মৌ ট্রেনের অপেক্ষা করছিল । অনেক অপেক্ষার পর ট্রেন তো এল
কিন্তু পা রাখবার জায়গা নেই । কিছুতেই সে ট্রেনে উঠতে পারল না ট্রেন ছেড়ে
দিল।এরই মধ্যে ভিড়ের ভেতর থেকে একটা শক্ত হাত এসে মৌ এর হাত ধরে এক টান মেরে টেনে
তুলল ট্রেনে । এক ধাক্কায় মৌ তার বুকের উপর গিয়ে পড়ল । কোনো মতে নিজেকে সামলে
নিয়ে মৌ ধন্যবাদ বলল অপরিচিত ছেলেটিকে । এত ভিড় যে মৌ ভিতরের দিকে যেতে পারছিল
না । অমল বুঝতে পেরে আগে আগে চলল আর মৌকে বলল ,
"আমার পিছনে পিছনে আসুন ” । মৌ ওকে লেপ্টে থেকে ধীরে ধীরে
ভিতরে ঢুকল । একটু ঠিক মত দাঁড়িয়ে নিয়ে আবার মৌ অমলকে কৃতজ্ঞতা জানাল । ধীরে
ধীরে দুজন একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হল।
অমল
কলকাতায় একটা বড় কম্পানিতে চাকরি করে । মৌ একটা কোচিংসেন্টারে
ভর্তি হয়েছে চাকরির পড়াশুনা করবার জন্য । অমলের সুন্দর চেহারা । যেমন গায়ের রং
তেমন বলিষ্ঠ হৃষ্টপুষ্ট শরীর । সারা শরীরে একটা মিষ্টি পারফিউমের গন্ধ। মৌ এর মনে
যেন মাদকতা সৃষ্টি করল ।
একনজরেই অমলকে ভাল লেগে যায় তার । আর মৌ ? সে তো অপূর্ব সুন্দরী । যে একবার
তাকে দেখবে সে দ্বিতীয় বার ঘুরে না দেখে পারবে না । স্কুল কলেজে তাকে অনেকেই প্রোপোজ
করেছে কিন্তু সেই দিকে দৃষ্টি দেয় নি সে । অনেক বড় হাওয়ার স্বপ্ন ছিল ওর দুচোখে ।
লেখা পড়া শেষ হয়েছে, এখন একটা চাকরি পেলেই বিয়ের কথাটা ভাববে । তারপর থেকে
দুজনের মাঝে মাঝেই দেখা হয়। কথাবার্তা হয় । প্রথমে বন্ধুত্ব হয় । তারপর প্রেম ।
এখন রোজই দেখা হয় দুজনের । ফোনে কথা হয় । দুজনেরই দিনগুলো খুব আনন্দেই কাটছিল ।
দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে গেল ।
আজ মৌ এর
জন্মদিন। লাল রং এর একটা শাড়ী পরেছে মৌ । খুব সেজেছে আজ । চোখ ফেরানো দায় । ও
মদনপুর স্টেশনে গিয়ে দাঁড়াল । সেখানে আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল অমল । দুজন উঠল
ট্রেনে । আজ তো অমলকেও ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে । হলুদ রঙের সার্ট আর কালো রঙের প্যান্টে
ওকে খুব মানিয়েছে । ট্রেন থেকে নেমে অমল একটা ট্যাক্সি ডাকল । সে নিজেও অফিসে গেল
না আর মৌকেও কোচিং এ যেতে দিল না । মৌকে নিয়ে একটা বড় হোটেলে গিয়ে উঠল । আগে
থেকেই রুম ভাড়া করে রেখেছিল অমল । ওরা চাবি নিয়ে রুমে ঢুকল । দুজনেই আজ খুব
আনন্দিত । অমল বলল ,"আজ তোমার জন্মদিন শুধু আমরা দুজনই সেলিব্রেট করব " ।
বলতে বলতে অমল ওকে কাছে টেনে নিল । "
মৌ তুমি
এত সুন্দরী কেন হলে ? আমি আর নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারছিনা গো । আরও একটু
কাছে এসোনা সোনা , তোমাকে একটু আদর করি । ” বলতে বলতে অমল ওকে আরো কাছে টেনে নিল। অনেক চেষ্টা করেও
নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেনি মৌ সেদিন । সে এক অনন্য অনুভূতি । আবেগে অনুরাগে
আপ্লুত হয়ে মৌ নিজেকে সমর্পণ করে দেয় অমলের হাতে । সারা জীবন সাথে সাথে থাকবে এই
প্রতিজ্ঞা করে দুজন চলে যায় দুজনের বাড়িতে। সারা রাত মৌ ঘুমাতে পারে না । একটা অপরাধ বোধ
ভিতরে ভিতরে ওকে কষ্ট দিচ্ছিল । মনে মনে ভাবল সকালে উঠেই ফোন করবে অমলকে যেন দু এক
দিনের মধ্যেই এসে মৌ এর বাবার সঙ্গে ওদের বিয়ের কথাটা বলে । সকাল হতেই ও অমল কে
ফোন করে কিন্তু অমলের ফোন বন্ধ বলে জানতে পারে । সারাটা দিন হাজারবার কথা বলার
চেষ্টা করে সে কিন্তু ফোন খোলা পায় না । নানা দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে আরো দুটো
দিন কাটিয়ে দেয় মৌ । ওর শুধু মনে হচ্ছিল তার অমলের নিশ্চয়ই কোনো বিপদ হয়েছে না
হলে এত দিন তার সঙ্গে কথা না বলে সে থাকতেই পারে না । যে মানুষ দিনে দশ বার ফোন
করে একবার ফোন তুলতে একটু দেরি হলে রেগে মেগে আগুন হয়ে যায় সে কি করে দু দুটো
দিন কথা না বলে থাকতে পারে ? কোনো কুল কিনারা না পেয়ে তৃতীয় দিন অমলের অফিসে গিয়ে
পৌছায় মৌ । সেখানে গিয়ে শোনে অমল এক মাসের ছুটি নিয়েছে । হন্তদন্ত হয়ে সেখান
থেকে অমলের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে পরের দিন মৌ পৌঁছে যায় অমলের রানাঘাটের বাড়িতে ।
সেখানে
গিয়ে দেখে বাড়িতে প্যাণ্ডেল করা প্রচুর লোকজন এদিক ওদিক ঘুরছে। একজনকে ডেকে মৌ
জিজ্ঞাসা করল এই বাড়িতে কি হচ্ছে ? সে বলল এই বাড়ির বড় ছেলে অমলের আজ বৌভাত । মৌ যেন আকাশ
থেকে পড়ল সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে না পেরে আবার জিজ্ঞাসা করল কার বৌভাত ? ভদ্রলোক আবারও বলল ,"অমলের বৌভাত । দীর্ঘ
পাঁচ বছর ধরে প্রেম চলছিল মাধুরির সঙ্গে , শেষ পর্যন্ত দুজন সাতপাকে বাঁধা পড়ল । " সে খুব
আনন্দের সঙ্গে কথা গুলো বলে হো হো করে হাসতে লাগলো। সে এতই আনন্দিত ছিল যে মৌ এর
ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া মুখটা দেখতে পেল না । মৌ যেন একটা পাথরে পরিনত হল । হাত, পা, বুদ্ধি
কিছুই যেন আর কাজ করছে না ।
ওর মাথার
মধ্যে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে , সেটা হল " অমল যদি মাধুরির সঙ্গে প্রেম করত তাহলে তার
ঙ্গে যেটা করত সেটা কী ছিল ? "প্রেম অপ্রেমের এই গোলোক ধাঁধায় হাবুডুবু খেতে খেতে কখন
কিভাবে যে সে বাড়ি ফিরে এসেছিল তার নিজেরই মনে নেই । দীর্ঘ একমাস ধরে সে ঘরের
মধ্যেই রয়েছে। না খেতে পারছে ,না ঘুমাতে পারছে , না পড়তে পারছে । মাঝে মাঝে তার মনে হচ্ছে সে যেন পাগল হয়ে
যাবে। নিজেকে সে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছে না ।
পরিচিতি -
কৈশোর কেটেছে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার একটি গ্রামে। বৈবাহিক সূত্রে দিল্লিতে আসা । ছোটবেলা থেকেই লেখালিখি শুরু। স্কুলের ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশিত হত।
এ পর্যন্ত ছয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দিল্লি, কলকাতা এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লেখা প্রকাশিত হয় । প্রতিদিনই কিছু না কিছু লেখেন। লেখার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পান।