ডেনিস লিলি বল করছেন , উইকেটে দাঁড়িয়ে মহিম হালদার শক্ত হাতে
ব্যাট ধরে । দুশো গজ দৌড়ে এসে লিলি বল ছোড়েন । মহিম স্কোয়ার কাট করে । বল স্লিপ
গলিয়ে , কভার পার হয়ে বাউণ্ডারি লাইনের দিকে চলে যায় । চারজন
অস্ট্রেলীয় ফিল্ডার দ্রুত ছুটে এসেও বল রুখতে পারে না । মহিমের ব্যক্তিগত রান হোল
ছিয়াশি ভারতের তিনশো সাতাত্তর । ভারতীয় ক্রিকেটের এই সংকটজনক মহিমের বলিষ্ঠ
ব্যাটিং দেখে দর্শকরা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে উঠে তালি দেয় ,
গলা ফাটিয়ে
অভিনন্দন জানায় । এমনকি ' মহিম হালদার জিন্দাবাদ '
ধ্বনিও কানে আসে
। ভারতীয় ক্রিকেটে নবাগত বাঙালি ব্যাট্সম্যানের কৃতিত্বে মাঠে উচ্ছ্বসিত প্রশংসার
বন্যা বয়ে যায় । মহিম স্মিত হেসে হাত তুলে জনতার অভিনন্দন গ্রহণ করে । তারপর
উইকেটের সামনে ‘পজিশন’ নেয় । আর মাত্র চৌদ্দটা রান করতে পারলেই
প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন যেসব ক্ষণজন্মা ব্যাট্সম্যান তাদের তালিকায় মহিমের
নাম যুক্ত হবে । লিলি অধৈর্য হয়ে পাছায় বল ঘসে,কপালের ঘাম মুছে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে বল করে
, ফিল্ডাররা গুটিগুটি এগিয়ে এসে মহিমকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে । কিন্তু টেস্ট
ক্রিকেটার মহিম হালদার এতটুকু ভয় পায় না । বলের লাইনে ব্যাট এনে অসীম ধৈর্য এবং
সতর্কতার সঙ্গে সে রান তুলতে থাকে । ভারতের মান সম্মান এখন তার ব্যাটের ডগায় ।
মাঠের পঞ্চাশ হাজার দর্শক ছাড়াও ট্রানজিস্টার ,
টেলিভিশনের
সামনে অগণিত জনতা যে তার খেলা শুনছে কিংবা দেখছে এ কল্পনায় মহিমের মনে জোর আসে । কাট্ , স্ট্রোক ,
হুক ,
ড্রাইভ—
মহিমের হাতে
বিকেলের পড়ন্ত রৌদ্রে খোলা তলোয়ারের মতো ব্যাট ঝিকিয়ে ওঠে । তারপর একসময় জনতার
কানফাটানো তালির আওয়াজ ও উচ্ছ্বাসের মধ্যে ভাষ্যকারদের মুখে ফেনা তুলে মহিম
সেঞ্চুরি পূর্ণ করে । ডন ব্র্যাডম্যান থেকে আব্বাস আলি বেগ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সব
ব্যাটসম্যানদের নাম পুনঃ পুনঃ উচ্চারিত হয় চারপাশে । ক্যাপ্টেন ও অন্যান্য
খেলোয়াড়রা মাঠে ছুটে এসে মহিমকে কাঁধে করে নৃত্য করে । দর্শকরা পর্যন্ত পুলিশের
লাঠি উপেক্ষা করে ছুটে এসে মালা দিয়ে যায় মহিমের গলায় । আর ভারতকে নিশ্চিত
পরাজয় থেকে রক্ষা করে , ক্রিকেটের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়
সংযোজন করে মহিম হালদার উচ্ছ্বাসের স্রোতে হাবুডুবু খায় ।
পানের দোকানের সামনে চোখবুজে একাগ্র চিত্তে মহিম রেডিওতে ক্রিকেটের ধারাবিবরণী
শুনছিল। ভারতের আরো একটা উইকেট পড়লো । আট উইকেটে একশো ছিয়াত্তর । নাঃ ,
ফলো অন থেকে
বাঁচবার কোনো আশাই নেই । মহিম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো পাঁচটা । বড় জোর আর
আধঘণ্টা খেলা হবে । কিরমানির উপর ভরসা করা যায় না । দু'চারজন আশাবাদী শ্রোতা কবে কোন টেস্টে
কিরমানি পঁচিশ রান তুলেছিল স্মরণ করিয়ে দেবার চেষ্টা করলে ,
চারপাশ থেকে
ভারতীয় ক্রিকেট সম্বন্ধে কাঁচা খিস্তি শোনা যায় । হাতের আধপোড়া সিগারেটটা
ছুঁড়ে ফেলে মহিম বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগোয় । বাসস্ট্যান্ডে অফিস ফেরত যাত্রীদের ভিড় । দু'চারটা বাস এসে ত্রিশ সেকেন্ডের জন্য
দাঁড়িয়ে চলে যায় । অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতি সম্পন্ন দু'একটি চ্যাংড়া ছেলে ছুটে গিয়ে কোনোমতে
হ্যান্ডেল ধরে ঝুলে পড়ে । মহিম বার দুয়েক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ছটা পাঁচের
গাড়ির লাইনের শেষ মাথায় গিয়ে দাঁড়ায় ৷ বেশ কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে । কাছে
একটা কৃষ্ণচূড়া গাছে তিনটে কাক ডাকছে । সান্ধ্য পত্রিকা হেঁকে যাচ্ছে একটা বছর
দশেকের নগ্নদেহ কিশোর । কেউ কেউ টেস্ট ম্যাচের পরিণতি জানবার জন্য বিশ পয়সা খরচ
করে চারপাতার সান্ধ্য পত্রিকা কিনে নেয় । কনকনে হাওয়ায় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে
থেকে হাত পা অসাড় হয়ে আসতে থাকায় মহিম পা বদলায় ,
হাত ঘসে ,
থুতু ফেলে তারপর
আরেকটা সিগারেট ধরায় ।
ম্যাকেনন ম্যাকেনজির সিনিয়র একজিকিউটিভ মহিম হালদার অফিসে চার চারটে জরুরি
মিটিং সেরে টাইয়ের নট ঠিক আছে কিনা আয়নার সামনে দেখে নিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে
মেরুন রঙের ফিয়াট গাড়িতে গিয়ে বসলো । গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে কোটের পকেট থেকে
স্টেট এক্সপ্রেস বের করে লাইটারে ধরিয়ে নিল । রাস্তায় এত ভিড় যে মহিমকে হর্ণটা অনবরত বাজিয়ে যেতে হয় । কনট প্লেসে
সুপার মার্কেটের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে সে ভিতরে গিয়ে সুদৃশ্য প্যাকেটে
এসেক্সফার্মের এমব্রয়েল্ড চিকেন নিয়ে এল । পাঠার মাংস খাওয়া বারণ ,
ওতে নাকি ফ্যাট
হয় । জনপথের উপর ফুলের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করালে প্রতিদিনের মতো ফুলওয়ালা
দৌড়ে এসে তার হাতে পাঁচমিশেলি ফুলের একটি ভারী স্তবক দিয়ে যায় । কোটের ভিতরের
পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে মহিম দশটাকার নোটটা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ছুড়ে দেয় ।
লোকটা টাকাটা লুফে নিয়ে মাথায় ঠেকায় । মহিম হালদারের মতো নিয়মিত খদ্দের পেয়ে
সে যে বেঁচে বর্তে আছে সেই ভাবটাই যেন তার চোখে মুখে ফুটে ওঠে । জিমির জন্য এক
প্যাকেট ডগ - বিস্কুট আর টিনার জন্য ক্যাডবেরির মিল্ক চকোলেট নিতে মহিম ভোলেনা ।
হাউজ খাসের কোম্পানির দেওয়া পাঁচ কামরার ফ্ল্যাটে পৌঁছে কলিং বেল টিপলে রেখার
মতো দেখতে মহিমের স্ত্রী সুপ্রিয়া এসে দরজা খুলে দেয় । ব্রিফকেসটা সোফার উপর
ছুঁড়ে ফেলে ‘ইয়ে হ্যায় জিন্দেগী '
ছবিতে নবীন
নিশ্চলের কায়দায় – ' হা - ডু - ডু ডারলিং ' বলে মহিম সুপ্রিয়াকে ‘
হাগ ’
করে তারপর আলতো
চুমু খায় , ঠোটে নয় , সেন্সরের কাচি বাঁচিয়ে ঠোটের সিকি ইঞ্চি
তফাতে । জিমি এসে গা বেয়ে লাফিয়ে ওঠে , টিনা দৌড়ে এসে মহিমের হাত ধরে । নিটোল
সংসার , কোথাও কোনো ফাঁক নেই । জিমি কার্পেটের উপর বসে কড়মড় করে
বিস্কুট খায় । টিনা চকলেট চুষতে চুষতে বলে , ‘ড্যাডি ,
জান ,
জান আজ আমাদের
মাদার সুপারিয়র আমাকে কী বলেছে ? ”
মহিম টিনাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে গালে টোকা দিয়ে বলে ,
“আমি কী করে জানবো
, ডার্লিং ? ” টিনা মাথা ঝাকিয়ে অঙ্গভঙ্গি করে মাদার সুপারিয়রের গলা নকল
করে বলে , “বলেছে , ইউ আর এ নটি গার্ল '
। ”
সুপ্রিয়া এসে জানায় বাথটাবে গরম জল দেওয়া হয়েছে ।
আধঘণ্টা পরে কুসুম কুসুম গরম ফেনায়িত জলে গা ভিজিয়ে ,
ক্লান্তি দূর
করে , ঢিলে হাউসকোট পরে স্যাণ্ডউইচ আর কাজুবাদামের সঙ্গে কফিতে
চুমুক দিতে দিতে আজ রাতে যে তিনটে পার্টিতে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ,
তার কোনটাতে
যাবে স্থির করে ফেলে মহিম । ঘরের মধ্য থেকে ট্রাভোস্টার '
মিডনাইট ফিভারের
' গান কানে আসে । মহিম মুচকি হাসে । রান্না করার সময় ইংরেজি গান শুনতে এত
ভালোবাসে সুপ্রিয়া !
পিছন থেকে পেটমোটা জলহস্তীর মতো থলথলে চেহারার একটা লোক টিফিনের বাক্স দিয়ে
মহিমের পিঠে গুঁতো মারে– ' আগে বাড়ো '। মহিম এগিয়ে যায় । যক্ষ্মা রোগীর
বুকের খাঁচার মতো হাড় জিরজিরে চেহারার ডি . টি . সি . - র একটা বাস সাপের মতো
প্যাচানো লাইনটাকে ধীরে ধীরে গিলে খাচ্ছে । ঢ্যাঙা ,
হলদে দাঁত
কণ্ডাক্টর ফুটপাথে বাসের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটছে ,
মুখে গোঁজা
বিড়িটা সময়মতো টান দিতে না পারায় নিভে গেছে । মহিম বাসে উঠে দেখে বাসের সিট ভর্তি হয়ে গেছে । পিছনের দিকে এক কোণায়
সে কোনোমতে সেঁটে যায় । এতক্ষণে তার শরীরটা একটু গরম হয়ে ওঠে । সরকারি চাকুরেরা
ট্রান্সফার , প্রমোশন , ডি . এ . এফিসিয়েন্সি বার ,
চিনির দাম ,
ক্রিকেট এবং
সুন্দর ডাকাতের সর্বশেষ কীর্তি নিয়ে আলোচনা করে । পাদানি পর্যন্ত লোক উঠলে ,
গলা খাঁকারি
দিয়ে বাস স্টার্ট নেয় , তারপর প্রচণ্ড শব্দে সব আলোচনা ডুবিয়ে
দিয়ে ছুটতে শুরু করে ।
........................... (ক্রমশ)
২য় পর্ব পড়ুন আগামী কাল (২১.১২.২০২১)
লেখক পরিচিতি
জন্ম এবং শিক্ষা কলকাতায়; কর্মজীবন দিল্লিতে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রালয়ে। গল্প লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষ দিকে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। ইংরেজিতে দেশে এবং বিদেশে ওঁর কিছু গল্প এবং তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি থেকেও ওঁর কয়েকটি গল্প প্রচারিত হয়েছে। বাঙলায় একটি উপন্যাস এবং একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দেশ, আনন্দবাজার, সাপ্তাহিক বর্তমান, নবকল্লোল, কালি ও কলম(বাংলাদেশ) এবং দিল্লি ও কলকাতার অনেক সাহিত্য পত্রিকায় গল্প লেখেন উনি। দিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘ কলমের সাত রঙ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন উনি।