Advt

Advt

Mayurer Khacha (Rommya Rachana) by Dr. Tarun Kumar Dey, Tatkhanik Bangla / Bengali Online e magazine

Mayurer Khacha (Rommya Rachana) by Dr. Tarun Kumar Dey, Tatkhanik Bangla / Bengali Online e magazine

 

ইছাপুর ও সরস্বতী পুজোঃ  কলকাতা থেকে সামান্যই দূরে উত্তর ২৪ পরগনার শহরতলী ইছাপুর। নামটা পরিচিত, কারণ দু-দুটি অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি রয়েছে ওইখানে। স্থানীয় নাগরিকরা তো বটেই, বিহার,উত্তর প্রদেশ,আসাম উড়িষ্যা সহ ভারতের সব প্রদেশ এবং দেশভাগ হবার পরে এখনকার বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ ওই  অঞ্চলে এসেছেন জীবিকার প্রয়োজনে। একদা নগণ্য গ্রাম বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে স্কুল, পোস্ট অফিস, পৌরসভা, ব্যাঙ্ক, লাইব্রেরি, ইমারত, বাজার, দোকান, পাকা রাস্তা ইত্যাদিতে সেজে উঠেছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ছয় দশকে এই পরিবর্তন ধীরে ধীরে হচ্ছিল। ১৯৬২-র যুদ্ধের পরে দ্রুত গ্রাম থেকে  শহরে পরিণত হয়েছিল ইছাপুর। একটা সময় ছিল, যখন ইছাপুর এবং পাশপাশি অঞ্চলের বিপুল সংখ্যক যুবক অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির কর্মী হয়েছিলেন। আরও বহু মানুষ পরোক্ষে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির সঙ্গে জীবিকা সূত্রে যুক্ত ছিলেন। বলতে গেলে ওই অঞ্চলের জীবনযাত্রার মান অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির জন্যই উন্নত হয়েছে। শুধু তাই নয়, শিক্ষা সংস্কৃতি ক্রীড়া সব ক্ষেত্রেই ইছাপুর উজ্বল হয়ে উঠেছে। কিন্তু ওই তথ্য পরিবেশনের জন্য আজ মুখ খুলিনি। ১৯৬২-র অব্যবহিত পরে ইছাপুরে সরস্বতী পুজোর যে জোয়ার এসেছিল এখনও স্তিমিত হয়ে যায়নি; খানিকটা সংহত হয়েছে মাত্র। ], সেই সময়ের একটি ঘটনা পরিবেশন করতেই আজ ল্যাপটপ নিয়ে বসেছি।

ময়ূর আনয়নঃ  সাধারণত দুর্গাপুজোই হোত বারোয়ারী অর্থাৎ পাড়াভিত্তিক। ইছাপুরের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিল কিছু মণ্ডপ। প্রতিটি মণ্ডপের কাছাকাছি থাকা নাগরিকদের চাঁদাই ছিল ওইসব দুর্গোৎসবের উদ্যোক্তাদের সম্বল। অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির কোয়ার্টার্সের কলোনিগুলোতে, আমি নিশ্চিত নই, হয়তো ফ্যাক্টরি থেকে সহায়তা করা হোত। ওই পুজোগুলোই বিশেষ জমজমাট হোত। লক্ষ্মী পুজো,সরস্বতী পুজোর তুলনায় কম হোত ] কার্ত্তিকপুজো প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই হোত। তবে কালীপুজো পরিবার এবং বারোয়ারি দুই  পক্ষের উদ্যোগেই হতে দেখতাম। আর যে সব মণ্ডপে দুর্গাপুজো হোত, সেখানে অবশ্যই লক্ষ্মী এবং কালীর আরাধনা হোত। প্রত্যেক  স্কুলেই সরস্বতী পুজো হোত। বিশ্বকর্মা আর গণেশ তখন যথাক্রমে ফ্যাক্টরিতে আর দোকানেই হতে দেখতাম। শিবরাত্রিতে, শিবের পুজো মন্দিরেই হোত। শীতলা আর চণ্ডীর পুজোও বিশেষ কোথাও কোথাও হতো। দোলের সময়ে  কোনো কোনো বাড়িতে পুজো হোত। মহাবীরের পুজো হোত ব্যায়ামাগার এবং কুস্তির আখড়ায়। অবশ্য  দুয়েকটি বারোয়ারি মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কিন্তু তখনও হিন্দিভাষী ছাড়া কাউকে সেখানে প্রণাম করতে দেখিনি।  শনির মুর্তিও তখন গাছতলায় রাখা এখনকার মতো প্রকট হয়নি। মূল কারণ কী বলতে পারবো না।

১৯৬২-র পর  থেকেই  ইছাপুরে দ্রুত সরস্বতী পুজো বাড়তে শুরু করেছিল। দু-তিন বছরের মধ্যেই বহু বারোয়ারি সরস্বতী পুজো প্রচলিত হয়ে গিয়েছিল। সে সবের অনেকগুলোতেই মনোরম সাজ-সজ্জা হোত। কয়েকটি ক্লাব  এমন সাজাতো যে,দূর দূরান্ত থেকেও ওই সময়ে অনেকে ইছাপুরে আসতেন। ধীরে ধীরে একটা,অবশ্যই সুস্থ প্রতিযোগিতার মনোভাব কিছু ক্লাবের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল।

                          একটি মাঝারি সামর্থের ক্লাব ছিল 'বৈশাখী দল'। অন্যান্য বড় ক্লাবগুলোর সব সদস্যই চাকরি করতেন। তাঁরা মোটা টাকা চাঁদা দিতেন। কিন্তু 'বৈশাখী দল'-র একজনও চাকরি করতেন না। কিন্তু চাকরিকরা লোকেদের  ক্লাবগুলোর থেকে পিছিয়েও থাকতেন না তাঁরা। প্রতিবারই মণ্ডপ সাজানোয় কিছু না কিছু নূতনত্ব আনতেন তাঁরা।

                           সে বার কী কারণে জানি না, 'বৈশাখী দল'-র ফাণ্ড আশানুরূপ ছিল না। পুজোর দিন কয়েক আগে তাঁরা হিসাব করে দেখেছিলেন যে, পুজোর আয়োজন করবার পরে মণ্ডপ-সজ্জার জন্য সামান্যই হাতে থাকছে। কিন্তু লোকের চোখে একেবারে খেলো হতেও চাইছিলেন না তাঁরা। অথচ পুঁজি যে খুবই কম ! বড় ক্লাবগুলোর বাজেটের পাঁচ ভাগের একভাগও ছিল না। একেবারে ম্যাড়ম্যাড়ে পুজোও তো করা যায় না। সমবয়সীরাই যে টিটকিরি দেবে। ই বিষয় নিয়ে রোজই বিকালে সবাই বসে আলাপ করছিলেন তাঁরা। কিন্তু মানরক্ষার উপায়  কিছুই বার করা যাচ্ছিল না।

                          একদিন বিকালে মুখ নিচু করে সবাই বসে ছিল। হঠাৎ  দলের সব থেকে কম বয়সী সদস্য বিশু  বলেছিলেন - আমি গতবছর বাবা-মার সঙ্গে পণ্ডিচেরী গিয়েছিলাম। পণ্ডিচেরীর শ্রীঅরবিন্দ আশ্রমের ডাইনিং হলের কাছেই একটা গণেশ মন্দির দেখলাম।

                           দলের সেক্রেটারি অমিত চটে গিয়ে বলেছিলন - গণেশ মন্দির দেখতে আমাদেরও ছুটতে হবে নাকি?

                           বিশু বলেছিলেন - তা নয়। ওই গণেশ মন্দিরের সামনে একটা হাতি বাঁধা থাকে।

                           কমল খিঁচিয়ে উঠেছিলেন - তুই কি আমাদেরও প্যাণ্ডালের সামনে হাতি বেঁধে রাখতে বলছিস?  হাতি আনতে সার্কাস পার্টিকে অনেক টাকা দিতে হবে। তারপর তার মাহুতের খরচ লাগবে। আর হাতির খোরাক জোগাতে কত লাগবে জানিস  ? ইছাপুরের সব ক্লাবই ফতুর হয়ে যাবে পাঁচদিন হাতি পুষতে গেলে। তা ছাড়া পারমিশন পেতে তো জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে যাবে। তাও পাওয়া যাবে কিনা কে জানে?

                           বিশু একটু আমতা আমতা করে বলেছিলেন - হাতি রাখবার কথা বলছি না। সহজে সস্তায় হয়, এমন কিছু যদি আনা যায় -

                           অমিত প্রায় লাফিয়ে উঠেছিলেন - ঠিক বলেছিস। কিন্তু কী আনা যায়? কম খরচে হবে, আবার অ্যাট্রাকশনও আনবে।

                           শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়েছিল দুটো ময়ূর প্যাণ্ডালের দোরগোড়ায় রাখা হবে। দুপাশে অবশ্য দুটো বড়সড় খাঁচা বানাতে হবে। আর খাবার ! তা হাতির তুলনায় কিছুই খরচ হবে না বলা চলে।

                           দলের মুষড়ে পড়া সব সদস্যের মনেই চনমনে ভাব এসে গিয়েছিল।

তৃতীয় দিবসের দ্বিপ্রহরঃ সরস্বতী পুজোর আগের রাতেই জোড়া ময়ূর এসে গিয়েছিল। খাঁচা তার অনেক আগেই বসানো হয়েছিল। খাঁচা যখন  বসানো হচ্ছিল, তখন দু-চারজন জানতে চেয়েছিলেন - খাঁচা কী কাজে লাগবে ? এঁরা উত্তর দিয়েছিলেন - দেখতেই পাবেন। ময়ূরেরা সন্ধ্যার আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। এঁরা সাত তাড়াতাড়ি দলের একজনের বাড়িতে সে দুটোকে চালান করেছিলেন। সেই সদস্যের বাড়ির পেছন দিকটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ছিল। মণ্ডপের গেটে প্রতিষ্ঠা করবার আগে কেউ ময়ূর যুগলকে দেখতে পাবে না।

                            বারোয়ারী পুজো সব প্যাণ্ডালেই হয় বেলা বারোটার পরে। কিন্তু সেবার কী ভাবে যেন পুরুতমশায়ের কানে জোড়া পাখির খবর পৌঁছে গিয়েছিল। তিনি সকাল দশটার আগেই চলে এসেছিলেন। প্রতিবার আসতেন, সোজা মণ্ডপে প্রবেশ করতেন, উদ্যোক্তাদের  গাল দিতেন, দশ মিনিটের মধ্যে পুজো করেই দ্রুত পায়ে প্রস্থান করতেন। সেবার মণ্ডপে ঢোকবার আগে তিনি ময়ূরের খাঁচা দুটোর সামনে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়েছিলেন। তারপর খোশ মেজাজে  মণ্ডপে ঢুকে পুজোয় বসেছিলেন। পুজোতে অবশ্য আগের মতো দশমিনিটই ব্যয় করেছিলেন। কিন্তু চলে যাবার আগে আর একবার ময়ূর জোড়াকে নিরীক্ষণ করে গিয়েছিলেন। উদ্যোক্তাদের বলে গিয়েছিলেন - ঠিক মতো দেখাশোনা করিস কিন্তু; পাখিদুটোকে কষ্ট দিস না। এঁরা বুঝেছিলেন - সবই ময়ূরের অবদান।

                             প্রত্যেকবার ভিড় হোত সন্ধ্যার পরে। কারণ দর্শকরা সবাই আসতেন মণ্ডপ সাজানো দেখবার জন্য। মূর্তি দেখবার জন্য প্রায় কেউই আসতেন না। আর মণ্ডপের আলোর কাজ তো রাতেই উপভোগ্য । সেবার দিনেই এঁদের মণ্ডপ জমজমাট হয়ে গিয়েছিল। বাচ্চা বুড়ো যুবক যুবতী - সবাই ময়ূর দেখবার জন্য 'বৈশাখী দল'-র মণ্ডপের দিকে ছুটে এসেছিলেন। এমন কি চাকরি-করিয়েদের ক্লাবের সদস্যরাও অনেকে এসে এঁদের অভিনন্দন জানিয়ে গিয়েছিলেন। ওইসব দেখে অমিত বিশুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন - তোকে আমরা মোগলাই আর কষা মাংস খাওয়াবো।

                               পুজোর দিন তো বটেই, পরের দিনও মণ্ডপের সামনে মানুষের স্রোত বয়ে গিয়েছিল - সূর্যের আলো থাকাকালীন তো বটেই,সন্ধ্যা নামবার পরেও। ব্যাপার-স্যাপার দেখে উদ্যোক্তাদের বুক গর্বে ফুলে উঠেছিল। বিশু আবদার করেছিলেন - একদিনে হবে না, আমাকে তিনদিন  মোগলাই-কষা খাওয়াতে হবে। অমিত সমেত সবাই একসঙ্গে তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন - তোকে সপ্তাহ জুড়ে খাওয়াবো।

                               আনন্দের ধাক্কায় তারা সবাই পুজোর রাতে মাংস- ভাতের আয়োজন করেছিলেন। পরের রাতে হয়েছিল  পরোটা, ডিমের কারি আর পায়েস। নিজেরাই রান্না করেছিলেন। পায়েসটা অবশ্য ভাল হয়নি। তবে আনন্দের ডগমগ থাকার জন্য ওঁদের সবই অমৃত মনে হয়েছিল।

                               রান্না করবার অভ্যাস কারোই ছিল না। তাই দুদিনই খেতে খেতে দুটো-আড়াইটে বেজে গিয়েছিল। তারপর শুরু হয়েছিল আড্ডা। দু রাতেই শুতে শুতে প্রায় ভোর হয়ে গিয়েছিল। তারপর আলো ফুটতেই প্যাণ্ডালের লাইট অফ করবার জন্য উঠতে হয়েছিল। সকালে তো আর ঘুমানো যায় না। তাছাড়া পরদিন দধিকর্মারও আয়োজন করতে হয়েছিল। মনের আনন্দে তাঁরা ভাঁড়ে করে দধিকর্মা আশেপাশের সব বাড়িতে বিতরণ করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ফলে পুজোর পরদিনও চব্বিশ ঘণ্টায় তাঁরা কেউ ঘুমোতে পারেননি। পুজোর আগের রাতটা তো নানা কাজে জেগেই কাটাতে হয়েছিল।

                              কাজেই পুজোর পরে দুরাত শেষ হয়ে যখন ভোর হয়েছিল, তখন সবারই দুচোখ ঘুমে বুজে আসছিল। বিশু আর গোপাল ছাড়া অন্য সবাই বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। বিশু আর গোপালের বয়স দলের অন্যদের থেকে একটু কম ছিল। তাঁরা ওই ডামাডোলের মধ্যেই খানিকটা ঘুমিয়ে নিয়েছিলেন। তাই তাঁদের হাতে মণ্ডপের ভার দিয়ে দুপুর আসবার আগেই  অন্যেরা বাড়ি চলে গিয়েছিলেন। ময়ূরের সঙ্গে যে কেয়ারটেকার ভদ্রলোক এসেছিলেন, তিনিও  - তোমরা তো আছ, আমি একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি - বলে চলে গিয়েছিলেন। আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিলেন যে তিনি সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবেন।

নিদ্রাভঙ্গঃ    তাঁর  প্রস্থানের পরেই ঘটেছিল বিপত্তি। বাঁদিকের ময়ূরটা বোধ হয় মস্তান প্রকৃতির ছিল। সে তার স্টীলের তারের খাঁচার দুটো তার টানাটানি করে অনেকটা ফাঁক করে ফেলেছিল। ময়ূরের জন্য গ্যারান্টি-মানি জমা রাখতে হয়েছিল। টাকার অঙ্কটা খুব কম ছিল না। খাঁচার ওই ফাঁক গলে মস্তান ময়ূর যদি পালায় তাহলে গ‍্যারান্টি-মানির এক পয়সাও আর ফেরৎ পাওয়া যাবে না। এদিকে কেয়ারটেকারবাবুও বাড়ি গেছেন। বিশু আর গোপাল নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে খুবই ভয়ে ভয়ে মস্তানকে ধরাধরি করে তুলে এনে অন্য খাঁচায় রেখেছিলেন। না, মস্তান সে সময়ে এঁদের ঠোক্কর দেয়নি। কেয়ারটেকারের পরামর্শে খাঁচা দুটো বেশ বড়সড়ই করা হয়েছিল। দুটো ময়ূরের ভালভাবে জায়গা হয়েও খাঁচার ভেতরে অনেকটা জায়গা ফাঁকা ছিল। কাজেই পাখিদুটোর চলাফেরার অসুবিধা হয়নি। তখন দুপুর প্রায় দুটো বাজে। আগের দুদিনের ঘোরাঘুরি সেরে দর্শকরাও বোধহয় ক্লান্ত ছিলেন। ফলে একটা খাঁচা যে খালি সেটা দেখবার জন্য তেমন কেউ ছিল না। এরপরেই বিশু আর গোপাল মূর্তির পেছনের ঘেরা জায়গাটায় শুয়ে পড়েছিলেন। আর শোয়া মাত্রই দুজনের চার চোখ জুড়ে ঘুম এসেছিল।

                              হঠাৎ তাঁদের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ও কিসের চিৎকার ! কেউ কি ময়ূর নিয়ে পালাচ্ছে ? কিন্তু এতো ময়ূরের ডাক নয়। দুজনেই লাফিয়ে উঠেছিলেন। চিৎকার হয়েই যাচ্ছিল। ওঁরা তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন। ওঃ হরি ! এ যে একটা নেড়ি কুকুর । খালি খাঁচার মধ্যে ঘুরছে আর বেরুতে পারছে না বলে আর্তনাদ করছে। গোপাল কাছে গিয়ে দেখেছিলেন মস্তান যে ফাঁকটা করেছিল, যেখানটা ওঁরা টেনেটুনে মোটামুটি কমিয়ে রেখেছিল, সেটা আগের চেয়েও বড় হয়ে গেছে। বোঝা গিয়েছিল, কোনোভাবে কুকুরটা ওই ফাঁক দিয়ে খাঁচায় ঢুকেছে, তারপর বেরুতে না পেরে আতঙ্কে চেঁচাচ্ছে। কিন্তু খাঁচার ফাঁকটা বড় হলেও কুকুর ঢোকবার মতো তো নয়। আর কুকুর খাঁচার ভেতর ঢুকবেই বা কেন? 

                              বিশু  তার টেনে ফাঁকটা আরও বড়ো করে কুকুটাকে ডেকেছিলেন। বিশু পাড়ারই ছেলে। কুকুর তাঁকে চিনত। বুঝেছিল বিশু তাকে উদ্ধার করতে চাইছেন। সে দিব্যি তারের ফাঁক গলে বেরিয়ে এসেছিল। তারপর কৃতজ্ঞ চিত্তে বিশুর দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়তে শুরু করেছিল। বিশু বলেছিলেন - যা, পালা। সঙ্গে সঙ্গে লেজ গুটিয়ে কুকুর দে ছুট।

                              গোপাল হাসতে হাসতে মন্তব্য ছুঁড়েছিল - আরাম করে ঘুমুবে বলে ব্যাটা কুকুর ময়ূরের খাঁচায় ঢুকেছিল। ভালই সাজা পেয়েছে।

                              বিশু গম্ভীর গলায় বলেছিলেন - না রে। কুকুরটাকে কেউ খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়েছে।

                              গোপাল সে কথা উড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

                              কিন্তু বিশু তাঁকে দেখিয়েছিলেন - খাঁচার ভেতরে বিস্কুটের গুঁড়ো, এমন কি বিস্কুটের দু চারটে ছোটো ছোটো টুকরোও পড়ে আছে। মস্তান ময়ূরকে যখন সরানো হয়েছিল, তখন খাঁচায় ওইসব কিছুই ছিল না।

                              দেখেশুনে গোপালও বিশুর সঙ্গে একমত হয়েছিলেন।

                              বিকেল পর্যন্ত ভেবেও কোন্ খলনায়ক বিস্কুটের লোভ দেখিয়ে ময়ূরের খাঁচায় কুকুর ঢুকিয়ে দিয়েছিল, তাঁরা দুজনে ভেবে পাননি। সন্ধ্যার মুখে বাকি সবাই  এসে যোগ দিয়েও সেই রহস্যের সমাধান 'বৈশাখী দল' করতে পারেন নি। তবে উৎসবের বাকি সময়টা তাঁরা কেউ না কেউ খাঁচা দুটোর পাশে বসে থাকতেন।


লেখক পরিচিতি - 

তরুণকুমার দে নরেন্দ্রপুরের রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের স্নাতক।পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রনিকস অ্যাণ্ড টেলি-কম্যুনিকেশন বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী এবং  বায়োলজিক্যাল এফেক্টস অব  ইলেকট্রিক অ্যাণ্ড ম্যাগনেটিক ফিল্ডসে পি এইচ  ডি  অর্জন করেছেন। তিনি প্রায় তিন দশক ধরে সাধারণ মানুষের কাছে বাংলাভাষায় প্রযুক্তির  তথ্য পরিবেশন করছেন, যে প্রচেষ্টার একটি ফসল তাঁর অজানা দূষণ গ্রন্থ।

যাত্রার বিশিষ্ট পালাকার ব্রজেন্দ্রকুমার দে-র কনিষ্ঠ পুত্র। ছেলেবেলা থেকেই গল্প, প্রবন্ধ ও নাট‍্যজাতীয় রচনায় আগ্রহী।

প্রকাশিত গ্রন্থ : বধূ বিনোদিনী, অজানা দূষণ, পালাকার অঘোরচন্দ্র কাব‍্যতীর্থ, পালাকার ব্রজেন্দ্রকুমার দে, যাত্রা নাটক প্রসঙ্গ, প্রসঙ্গ : ব্রজেন্দ্রকুমার দে।

অভিনীত যাত্রাপালা: বধূ বিনোদিনী, সুলতান মামুদ, চাঁদ সদাগর, নসীব, আলোর সারথি (ব্রজেন্দ্র-জীবনী)।