শত্রুপক্ষের চোখে ধুলো দিয়ে পূর্বনির্ধারিত সময়ে অসীম দক্ষতার সঙ্গে মহিম পাকিস্তানের আকাশ সীমা অতিক্রম করে করাচি বিমানবন্দর ও পোতাশ্রয়ের উপর দু'ডজন করে বোমা ফেলে । আগুনের হলকা ওঠে , আকাশ লাল হয়ে যায় , ফায়ার ব্রিগেডের ক্ষীণ ঘণ্টাধ্বনিও যেন সে শুনতে পায় । আর পিঁপড়ের মতো মানুষজন দিশেহারা হয়ে পাগলের মতো ছোটাছুটি করে । মহিম তৃপ্তির হাসি হাসে । এবার ঘরে ফেরার পালা । কিন্তু কে জানতো পাকিস্তানী রাডারে তার জাওয়ার ধরা পড়ে যাবে শেষ পর্যন্ত , আর একেবারে আচমকা নর্থওয়েস্ট থেকে এ্যারো ফর্মেশনে পাঁচখানি পাকিস্তানি হান্টার তাকে তাড়া করবে ? মহিম এতটুকু বিচলিত বোধ করে না । তার উপর ন্যস্ত শুরু দায়িত্ব সে সুষ্ঠুভাবে পালন করেছে । যুদ্ধে ভারতের জয় সুনিশ্চিত করে দিয়েছে মহিম , এখন আর তার ভয় কী ? লড়াই কাকে বলে সে দেখিয়ে দেবে । হিম্মতের সঙ্গে ভারতীয় বিমানবাহিনীর মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখে সে লড়াই করবে ... আর তাতে যদি তার মৃত্যু হয় , কী এসে যায় ? গান ক্যারেজে ভারতীয় তিনরঙা পতাকায় ঢাকা তার মৃতদেহকে যখন বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে গান স্যালুট দেবে , বিউগলে লাস্ট পোস্ট বাজবে আর তার নামে ঘোষিত হবে ‘ পরম বীর চক্র ' তখনও কি মহিমের মা বুঝতে পারবে না মহিম এক হাজার টাকা মাকে পাঠাবার ভয়ে ভীত নয় , দেশের জন্য হাসিমুখে সে জান কোরবানি করতে পারে ? খুব বড় একজন জ্যোতিষী মনোজ কুমারের হস্তরেখা বিচার করে জানিয়েছেন যে ছয় অক্ষরে ফিল্মের নাম রাখলে ছবি ' হিট' করবে । শুধু এই কারণেই মহিমের দেশপ্রেমের মহিমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে …কুমার যে ফিল্মটি তুলবে তার নাম হবে — ' ইন্সান বনো ” । রাহুল দেববর্মনের সুরে আশা ভোসলের গলায় মহিমের ফুলে ঢাকা শবদেহ শ্মশানে নিয়ে যাবার সময় বিশাল শোভাযাত্রার মধ্যে একজন সুন্দরী যুবতী ভিখারিনীর করুণ , অশ্রু - ভারাক্রান্ত , নিটোল গলায় ' ইনসান বনো ' শব্দ দুটি দিয়ে শুরু করা গানটি ফিল্মটির নামকরণের সার্থকতা ফিল্মের সুপারস্টার নরেন্দ্রকুমার । দর্শকদের বুঝিয়ে দেবে । ' করমুক্ত ' এই ছবিটিতে মহিমের ভূমিকায় অভিনয় করবে মুম্বাইয়ের সুপারস্টার নরেন্দ্র কুমার।
সেই পাঁচখানি শত্রুপক্ষের বিমান মহিমের জাওয়ারকে তাড়া করলে পালিয়ে যাবার
চেষ্টা না করে অসীম বিক্রমে মহিম তার প্লেনের মুখ ঘুরিয়ে রুখে দাঁড়ায় । এরপর
আকাশে যে ভয়াবহ লড়াই শুরু হয় তার নমুনা মহিমের দেখা একাধিক ফিল্মে দেখা গেছে ।
দুই হাতে পিস্তল চালিয়ে মহিম ত্রিশ সেকেন্ডের মধ্যে চারখানা প্লেনে আগুন ধরিয়ে
দেয় । চার চারটে পাকিস্তানী হান্টার জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে আরব সমুদ্রে পড়ে
তলিয়ে যায় । কিন্তু শেষ হান্টারটা অত্যন্ত কৌশলে মহিমের গুলি এড়িয়ে জাওয়ারকে
আক্রমণ করে । গোলা বারুদ শেষ হওয়ায় শুধু হাতেই মহিম লড়াই করে যায়। সুযোগ বুঝে
ককপিটের ঢাকনা খুলে মাথা বের করে বাঁ হাতে থ্রটল চেপে ধরে ডান হাতে বিরাশি সিক্কার ঘুসি ছোঁড়ে মহিম । পাকিস্তানি
হান্টারের ককপিটের মজবুত কাচের আবরণ ঝন ঝন শব্দে ভেঙে যায় । মহিম এবার দাঁড়িয়ে
উঠে সজোরে খেকো দুশমনটাকে আক্রমণ করে । তখন হান্টার আর জাওয়ারের চালকদের মধ্যে
তুমুল মুষ্টিযুদ্ধ শুরু হয় । যুদ্ধের মোড় সুনিশ্চিতভাবে ভারতের পক্ষে ঘুরিয়ে
দেবার পর এখন সুস্থ দেহে ভারতের মাটিতে ফিরে আসার অর্থ …কুমারের ফিল্মটিকে মাটি করা ,
একথা মহিম ঘোর
লড়াই - এর মধ্যেও ভুলতে পারে না । তাই দুশমনের গুলিতে এতক্ষণ পরে তার জাওয়ারে
আগুন লাগে । তার আগে অবশ্য খালি হাতেই মহিম পাকিস্তানি হান্টারের কলকব্জা বিগড়ে
দেয় । কন্ট্রোল হারিয়ে বিকট শব্দে হান্টারখানা চড়কি বাজির মতো ঘুরতে ঘুরতে আরব
সমুদ্রে পড়ে । মহিম পড়তে পড়তেও আপ্রাণ চেষ্টায় তার জাগুয়ারকে ভারত সীমান্তের
দিকে চালিয়ে নিয়ে যায় । মা এবং মাতৃভূমির কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে মহিম কী করে
তার অমূল্য প্রাণ বিসর্জন করবে ?
সন্ধেবেলা বরাপোতা গ্রামে শনে ছাওয়া ছোট্ট কুঁড়েঘরের দাওয়ায় বসে মাটির
উনুনে পাতা জ্বালিয়ে ভাত রাঁধছিল মহিমের বিধবা মা । হঠাৎ হুড়মুড় করে চাল থেকে
গড়িয়ে একটা ভারী মতন জিনিস পড়লো উঠোনে । '
ও মা ! ’
বলে আঁতকে উঠে
মহিমের মা কুপিটা তুলে ধরলো । কুপির আলোয় সে দেখলো উঠোনে হামাগুড়ি দিয়ে একটা
কিস্তৃতকিমাকার জীব তার দিকেই এগিয়ে আসছে । জীবটির মুখে ,
হাতে ,
মাথায় থক্ থক্
করছে গাদা গাদা রক্ত । মহিমের মা চোখ কপালে তুলে দেখলো এই অদ্ভূত জীবটির একহাতে
একটা সদ্য ছেঁড়া লাউ আর এক হাতে একটা রক্তাক্ত কাগজের টুকরো । মায়ের পায়ের কাছে
লাউটাকে রেখে ডানহাতে রক্তমাখা দুটো পাঁচশো টাকার নোট
আকাশের দিকে তুলে ধরে মৃত্যুপথযাত্রী ফ্লাইট লেফটেনান্ট মহিম হালদার দাঁতমুখ
খিঁচিয়ে বিকৃত , ভারী গলায় যথোচিত নাটকীয় করুণতার সঙ্গে
তার অস্তিম ডায়লগটি বলবার চেষ্টা করে । কিন্তু আবেগের ধাক্কায় তার মুখ দিয়ে
শুধু অর্থহীন বাছা বাছা কয়েকটি উর্দু শব্দ বের হয়—
' “ তকৃদির ... তক্লিফ্
... শরাফত ... ইমান ... হকীকৎ .. জুল্ল্ম ... ইনসাফ ... মুকাদ্দর ... জালালত ...
কাতিল ” । এতক্ষণে মহিমের মা বুঝতে পারে রক্তের পিপেতে চোবানো জীবটি
তারই প্রবাসী ছেলে । দু'পা পিছিয়ে এসে আদুরে গলায় মহিমের মা
ছেলেকে বলে ,“বেঁচে থাক্ বাবা , বড় কাজের ছেলে তুই । সাত সমুদ্দুর তের
নদীর পার থেকে এসেই চাল থেকে লাউটাকে পেড়ে দিলি । আমার কি সাধ্য ছিল চালে উঠে অত
ভারী লাউ কেটে নামাই?” তারপর ,
কুপির আলোয়
মহিমের হাত মুখ ভালোভাবে দেখে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে গলায় একটু বিরক্তির রেশ এনে
মহিমের মা বলে , “কিন্তু একি সং সেজেছিস তুই বলতো ?
ছোটবেলায় সেই
মুখে ভুষো কালি মেখে মাকে ভয় দেখাবার অভ্যেসটা তোর দেখছি আর গেল না। এক বাগান
টমেটো নষ্ট করে এমন খেলা খেলতে আছে কখনও ছিঃ । যা মুখ টুখ ধুয়ে আয় ,
মুড়ি খেতে দিই
তোকে । ” এই বলে মহিমের মা পাঁচশো টাকার নোট দুটো মহিমের হাত থেকে ছোঁ
মেরে নিয়ে ঘটির জলে ধুয়ে মাটির উনুনের ঝিকের উপর শুকোতে দেয় ।
অতঃপর ভারতীয় বিমান বাহিনীর চোখের মণি ফ্লাইট লেফটেনান্ট মহিম হালদার ডোবার
জলে চান করে এসে লুঙ্গি পরে দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে গোগ্রাসে কাঁচালঙ্কা আর শশা
সহযোগে একবাটি মুড়ি ধ্বংস করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ।
লেখক পরিচিতি
জন্ম এবং শিক্ষা কলকাতায়; কর্মজীবন দিল্লিতে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রালয়ে। গল্প লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষ দিকে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। ইংরেজিতে দেশে এবং বিদেশে ওঁর কিছু গল্প এবং তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি থেকেও ওঁর কয়েকটি গল্প প্রচারিত হয়েছে। বাঙলায় একটি উপন্যাস এবং একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দেশ, আনন্দবাজার, সাপ্তাহিক বর্তমান, নবকল্লোল, কালি ও কলম(বাংলাদেশ) এবং দিল্লি ও কলকাতার অনেক সাহিত্য পত্রিকায় গল্প লেখেন উনি। দিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘ কলমের সাত রঙ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন উনি।