“এক ইনসান , এক দুনিয়া এক জিন্দগী ”
সাতজন ডাকাত
সমস্বরে জবাব দেয় , যেন বহুকাল ধরে তারা এই মন্ত্র উচ্চারণ করে আসছে । মহিম
হঠাৎ কান পেতে শোনে , তারপর চোখ নাচিয়ে ভ্রু কাপিয়ে ফিসফিস
করে বলে ,“আওয়াজ , মৌত কী আওয়াজ আরহা হ্যায় । আচ্ছীতারা
শুনলো , কিতনী মিঠি আওয়াজ , নেহী ?
” তার নির্দেশে
সবাই কান পেতে যমের পায়ের মিঠে আওয়াজ শুনে চঞ্চল হয়ে ওঠে । বন্দুকে গুলি বারুদ
ভরতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তারা । মহিম ডাকু জীবন - মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়িয়েও
রসিকতা করতে পারে , কিন্তু সব কিছুরই সময় আছে । ডানহাতে স্টেনগান তুলে ধরে
মহিম ডাকু এবার হাঁক দেয় , — “ হাতিয়ার তৈয়ার ?
" " জী ,
হাঁ ”
, জবাব আসে । মহিম
এবার তার ডাকু জীবনের সারকথা ভয়ঙ্কর পিলে চমকানো ,
বাজখাই গলায়
ঘোষণা করে— “ যো ডর গয়া ও মর গয়া । ”
সাতজন ডাকাত
একসঙ্গে গোঁফ চুমরে , পাথরে বন্দুক ঠুকে হাঁক দেয় ,
“জান হাজির ,মালিক । ”
একটু পরেই পুলিশের জিপের আওয়াজ পরিষ্কার শোনা যায় । হনুমানের চাইতেও বেশি
ক্ষিপ্রতায় মহিমের স্যাঙাতরা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে । শুরু হয় ঘোর যুদ্ধ । গুরুম ,
গুডুম ,
ঠা - ঠা - ঠা ,
ট্যা - ট্যা -
ট্যা , সবরকম শব্দই শোনা যায় । রাইফেল ,
স্টেনগানের
গুলির শব্দে পাখিরা ত্রাসে উড়ে যায় । পাথুরে জমিতে ধুলো ওড়ে আর বাতাস বারুদের
গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে । গুলি খেয়ে মহিমের দলের ডাকতরা '
অ - আ - আ '
বলে পার্বত্য
উপত্যকায় প্রতিধ্বনি তুলে শরীর মুচড়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠে বম্বের ধুরন্ধর ফাইট
ডাইরেকটার রভির নির্দেশনা মনে রেখে ঠিক দেড়পাক ঘুরে ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে মুখ
থুবড়ে পড়ে । কিন্তু চম্বলের ত্রাস মহিম ডাকু এত সহজে ধরা দেয় না । গলার সোনার
চেনের সঙ্গে ‘ জয় শিব শঙ্কর ’ লেখা লকেটটি মাথায় ঠেকিয়ে মহিম ডাকু
শক্তি সঞ্চয় করে নিয়ে ত্রিশজন পুলিশকে এফোড় ওফোড় করে দেয় । স্টেনগানের নল এত
তেতে ওঠে যে মহিমকে থুতু দিয়ে তা ঠাণ্ডা রাখতে হয় । শেষ পর্যন্ত প্রায় শ '
দুই পুলিশকে
ঘায়েল করার পর একটা গুলি এসে বেঁধে মহিমের বুকে । '
সোভানাল্লা '
বলে ডাকু মহিম ,যার মাথার দাম পঞ্চাশ হাজার পঁয়তাল্লিশ
ইঞ্চির ছাতি কাঁপিয়ে লুটিয়ে পড়ে পাথরের গায়ে ।
খবরের কাগজে মহিম ডাকুর ছবিসহ বৈচিত্র্যময় জীবনের কাহিনি বের হলে লোকে জানতে
পারে তার হৃৎপিণ্ডের ওজন ছিল পাক্কা তিন কিলো । ভারতীয় মূল্যবোধের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে
‘ ডাকু মহিম ' নামে তিন ঘণ্টার রঙিন ,
নাচেগানে ভরপুর
যে মহৎ ফিল্মটি তোলা হয় তাতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে দারা সিং । কিন্তু দারা সিং
থাকবে অথচ নিশি থাকবে না , এ কী করে সম্ভব ?
কাজেই পরিচালকের
নির্দেশে ফিল্মে মহিম ডাকু হীরা নামে এক দস্যুনেত্রীর সাহচর্য লাভ করে দর্শকদের
মনোরঞ্জন করে । ফিল্মে ডাকু মহিম দরিদ্রদের মধ্যে বস্তা বস্তা টাকা ছড়িয়ে তার
তিন কিলো হৃৎপিণ্ডের প্রকৃত মহত্ত্ব প্রমাণ করে এবং সেই সঙ্গে দর্শকমণ্ডলীর মধ্যে
উদারতার এমন উষ্ণ প্রস্রবণ বইয়ে দেয় যে পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টায় শিশুরা পর্যন্ত আইসক্রিম
, চকলেট না খেয়ে স্কুলের গেটে খুচরো পয়সা ভিখিরিকে দান করে ফেলে । ফিল্মে মহিম
ডাকু ও তার দলের মনোরঞ্জন করার জন্য পদ্মা খান্না দুবার উরু দেখিয়ে নেচে যায় ।
আর কল্যাণজী - আনন্দজীর সুরে কিশোর কুমারের গলায় “
মারেঙ্গে ,
মারেঙ্গে ,
জীয়েঙ্গে হম ”
গানটির সময়
দারা সিং যেভাবে ঘনঘন চোখের মণি ঘোরায় তাতে দর্শকরা তার অভিনয় ক্ষমতার সবিশেষ
পরিচয় পায় । মহিম ডাকুর মৃত্যু দৃশ্যে মুহ্যমান হয়ে দর্শকরা বুক চাপড়ে এত
কান্নাকাটি করে যে ফিল্মটির প্রযোজক সরকারের কাছে আবেদন করলে, মহানুভব সরকার ‘ডাকু মহিম’ কে করমুক্ত বলে ঘোষণা করে
কৃতার্থ হয়ে যায়।
দেওয়ালের গায়ে লাইটের আলো শুষে সাদা হয়ে যাওয়া সাহেব টিকটিকিটা একটা পোকা
ধরে ফেলে । মহিম বালিশের নীচ থেকে ঘড়ি বের করে দেখে রাত বারোটা । মা কি একবারও
ভাবলো না এক হাজার টাকা বেশি পাঠাতে হলে মহিমের কী ভয়ঙ্কর অসুবিধে হবে ?
দিনে সে এক
প্যাকেট ফিল্টার লাগানো উইলস ফ্লেক খায় , সপ্তাহে দিন তিনেক হোটেলে মাংস খায় আর
মাত্র গোটা দুই হিন্দি ফিল্ম দেখে । এছাড়া গরমে মাঝে মধ্যে বিয়ার এবং শীতে আর্মি
ক্যান্টিনের সস্তা রাম কিঞ্চিৎ বেশি দামে ব্ল্যাকে কিনে খেয়ে সে কোনোমতে একক
নারীসঙ্গহীন দুর্বিষহ জীবনের অসহ্য যন্ত্রণা ভুলবার চেষ্টা করে । এক হাজার টাকা বেশি পাঠাতে হলে তার জীবনে সুখ
বলে আর কিছু থাকবে না । হয়তো সিগারেট ছেড়ে কামিনী বিড়ি এবং বিয়ার ছেড়ে দেশী ঠর্রার দোকানে কুলিমজুরদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়াতে হবে । মা কি চায় সে চিম্টে ,
লোটা কম্বল ,
রুদ্রাক্ষের
মালা হাতে নিয়ে চাকরি ছেড়ে অবিলম্বে হরিদ্বারের পথে পা বাড়াক ?
কিন্তু তাকে
নিয়ে ‘হর হর মহাদেব ’ বা ‘
ভক্তিমে শক্তি '
জাতীয় ছবি হবে
ভাবলে তার গা গুলিয়ে ওঠে । এ কল্পনাও তার পক্ষে অসহ্য । এমনকি গেস্ট আর্টিস্ট
হিসেবে দেবকন্যা বা অপ্সরীর ভূমিকায় নলিনী ইন্দ্রের রাজসভায় কোমর দুলিয়ে নেচে গেলেও নয় । মহিম
যদি আত্মবিসর্জন করে তবে মহৎ উদ্দেশ্যেই করবে । একশো টাকার এক ব্যাণ্ডের পকেট
ট্রানজিস্টারে একাত্তর সালে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের সময় বিবিধ ভারতীতে মনোজ
কুমারের ফিল্মে মহম্মদ রফির গাওয়া দেশাত্মবোধক গান শুনে মহিম যে দেশকে ভালোবাসতে
শিখেছে সে কি বৃথা যাবে ? দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে এবং সেই সঙ্গে এক হাজার টাকার মন খিঁচিয়ে দেওয়া ভাবনাটাকে
দূরে সরিয়ে রাখবার প্রয়োজনে খাটিয়ার নীচ থেকে রামের বোতলটা বের করে ছিপি খুলে
মহিম দুপেগ রাম গলায় ঢেলে দেয় ।
ভারতীয় বিমান বাহিনীর দুর্ধর্ষ ফ্লাইট লেফটেনান্ট মহিম হালদার বিমানবন্দরে
তার সহকর্মীদের সঙ্গে করমর্দন করে , শুভেচ্ছা বিনিময় সেরে উইং কম্যাণ্ডারের
উৎসাহবর্ধক পিঠ চাপড়ানো উপভোগ করে দৃঢ় পদক্ষেপে অপেক্ষমাণ জাওয়ার বোমারু
বিমানের ককপিটে চড়ে বসে । তারপর হেডগিয়ার মাথায় চাপিয়ে যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে
সে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে নির্দেশের অপেক্ষা করতে থাকে । আজ তার উপর ভার দেওয়া
হয়েছে করাচি বিমানবন্দর ও পোতাশ্রয়ের উপর বোমা ফেলার কতকাল ধরে মহিম এই যুদ্ধের
আশায় বুক বেঁধে আছে । গত পাঁচ বছর ধরে দুই দেশের নেতাদের মধ্যে কত চিঠি চালাচালি ,
বাদ - প্রতিবাদ ,
হুমকি পাল্টা
হুমকি চললো , মহিম তো অধৈর্য হয়ে আশাই ছেড়ে দিয়েছিল । শুধু 'হিন্দুস্তান কি কসম ','পাঁচ হিন্দুস্তানী ',
'আমন '
এই ধরনের
দেশাত্মবোধক ফিল্ম দেখে আর বিবিধ ভারতীতে এসব ছবির রক্ত গরম করা গান শুনে সে আপ্রাণ
চেষ্টায় তার স্বদেশপ্রীতিকে জিইয়ে রেখেছে । যাহোক পাঁচজন অনুপ্রবেশকারীকে নিয়ে
বাদ - প্রতিবাদ করতে করতে শেষ পর্যন্ত যে দুই দেশ যুদ্ধ বাঁধাতে পারলো এর জন্য
মহিম তার শত্রু পক্ষের সরকারের প্রতিও সামান্য একটু কৃতজ্ঞতা বোধ না করে পারে না ।
কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ‘টেক অফ '
নির্দেশ পেলে
মহিম শক্ত হাতে থ্রটল চেপে ধরে। জ্যামুক্ত তিরের মতো জাওয়ার রানওয়ের উপর ছুটে
গিয়ে হাওয়ায় ভেসে পড়ে ।
দু'হাজার .... তিন হাজার ... পাঁচ হাজার ফিট উপরে উঠে যায়
মহিমের জাগুয়ার । নীচে আরব সমুদ্র সূর্যের আলোয় ঝিক্মিক্ করে । নেভিগেশন চার্ট
, ম্যাপ , কম্পাস এবং আরও অনেক জটিল যন্ত্রপাতি নাড়াচাড়া করে মহিম
আলটিচুড , স্পীড , ডাইরেকশান কন্ট্রোল করে সঙ্গম ছবিতে দেখা
রাজেন্দ্র কুমারের কায়দায় । তারপর মনোবল অটুট রাখার জন্য ‘
মেরী দেশ কি
ধরতী সোনা উজলে , উজলে হীরা মতি ' গানটির সুর ভাঁজে শিস্ দিয়ে ।
……(ক্রমশ)
৪র্থ ও শেষ পর্ব
পড়ুন আগামীকাল (২৩.১২.২০২১)
লেখক পরিচিতি
জন্ম এবং শিক্ষা
কলকাতায়; কর্মজীবন দিল্লিতে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন
মন্ত্রালয়ে। গল্প লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষ দিকে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায়
সাহিত্য চর্চা করে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। ইংরেজিতে দেশে এবং বিদেশে ওঁর কিছু
গল্প এবং তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি থেকেও ওঁর কয়েকটি গল্প প্রচারিত
হয়েছে। বাঙলায় একটি উপন্যাস এবং একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দেশ, আনন্দবাজার, সাপ্তাহিক বর্তমান, নবকল্লোল, কালি ও কলম(বাংলাদেশ) এবং
দিল্লি ও কলকাতার অনেক সাহিত্য পত্রিকায় গল্প লেখেন উনি। দিল্লি থেকে প্রকাশিত ‘ কলমের সাত রঙ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন উনি।