জানা অজানা
আজকাল আমরা দেখতে পাই, অ্যাথেলেটিক গেমে বিজিতদের খেলায় হেরে যাওয়ার গ্লানি নিয়ে খেলার মাঠ ত্যাগ করলেই চলে কিন্তু এমন এক সময় ছিল যখন হেরে গেলে তাদের মৃত্যু বরণ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকতো না। রোমানদের সময় বিজিতদের এরকম ভয়ঙ্কর পরিণতির সন্মুখীন হতে হোত। পাঁচশো বছরেরও বেশী সময় ধরে হাজার হাজার হতভাগ্য মানুষেরা মারা পড়েছে বিনোদনের এই চাহিদা মেটাতে গিয়ে, বিনোদনের উপকরণ হিসেবে। রোমান যুগে মানুষের লড়াই হোত জংলী হিংস্র প্রাণীদের সাথে। খালি হাতে কয়েদীরা লড়তো, যুদ্ধ করতো সশস্ত্র যোদ্ধাদের সাথে। নারী আর শিশুদের সহ্য করতে হত নানা রকম অমানুষিক অত্যাচার এবং এসব করা হোত বিকৃতমনোভাবী রোমান জনগণকে আনন্দ দেওয়ার জন্য। বিনোদনের উপকরণ হিসেবে বন্দীদের, ক্রীতদাসদের এবং বিচারে দোষী প্রতিপন্ন হওয়া মানুষদের প্রায়ই ক্ষুধার্ত বাঘ বা সিংহের সামনে ছেড়ে দেওয়া হোত। আর সে দৃশ্য দেখে গ্যালারিতে বসে থাকা রোমান দর্শকেরা আনন্দে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিতো। এসব বর্বরোচিত খেলার উদ্যোক্তারা মনে করতেন, এরিনার মধ্যে দু’জন মানুষকে আগে ছেড়ে দিয়ে তাদের লড়াই উপভোগ করা যাবে এবং পরে ক্ষুধার্ত সিংহ ছেড়ে দিলে মজাটা আরও দ্বিগুণ বেড়ে যাবে। বন্দী খ্রিস্টানদের গায়ে আলকাতরা মাখিয়ে মাঠে পাঠানো হতো। তাদের ওপর উঁচু হারে বাজি ধরাও হতো। রিং-এর মধ্যে রাতের বেলাতেও লড়াই চলত।
জাহাজে করে যুদ্ধ বন্দীদের নিয়ে আসা হত। জাহাজে মানুষ ছাড়াও থাকত জিরাফ, গণ্ডার, হাতি, জলহস্তী, এমনকি শ্বেত ভাল্লুকও। সেসময় রোমে যে সব বিদেশীরা আসতেন, তারা প্রায়ই বন্য প্রাণী নিয়ে আসতেন রোমান সম্রাটের জন্য উপঢৌকন হিসেবে। ওগুলো সেরা উপহার হিসেবে বিবেচিত হোত।
এরিনার মধ্যে যে সব বন্দীরা পরস্পরকে হত্যার নেশায় উন্মত্ত হয়ে উঠতো, তাদের বলা হোত গ্ল্যাডিয়েটর। রোমান সম্রাট, মার্কাস, বছরে লাখ লাখ পাউণ্ড খরচ করতেন ক্রীতদাস কিনতে। তাদের পরে গ্ল্যাডিয়েটর বানানোর ট্রেনিং দেওয়া হোত। সে সময় সবথেকে জনপ্রিয় খেলা ছিল চ্যারিয়ট রেস। খেলাটা নিতান্তই খেলা হিসেবে শুরু হলেও অল্পক্ষণের মধ্যে সেটি রূপান্তরিত হোত নিষ্ঠুরতা আর সহিংস প্রতিযোগিতায়। বেশীরভাগ চ্যারিয়টিয়ার ছিল ক্রীতদাস। তারা জয়ী হতে পারলে হাজার পাউণ্ড পুরস্কার পেত। আর পরাজিত হলে মৃত্যু ছিল অবধারিত। ভাগ্যবান জয়ী গ্ল্যাডিয়েটর জেতার টাকা দিয়ে কিনে নিত নিজের স্বাধীনতা।
এরকম একজন ভাগ্যবান ক্রীতদাসের নাম ছিল ডিওক্লিস। সে এক হাজার চ্যারিয়ট রেস জিতেছিল। সে একজন সিনেটরের থেকে একশো গুণ বেশী আয় করেছিল। তার জনপ্রিয়তা আজকালকার পপ তারকাদের থেকে কোন অংশে কম ছিল না। তাকে এক নজর দেখার জন্য তার বাড়িতে ভিড় করতো অসংখ্য মানুষ। সরাইখানার মালিকেরা সাইনবোর্ডে লিখে রাখতো – ‘এখানে ডিওক্লিস খাবার খেয়ে গেছেন’। এথেকেই বোঝা যায় যে সে কতটা জনপ্রিয় ছিল।
কখনো কখনো একসাথে শতাধিক গ্লাডিয়েটরকে এরিনায় হাতাহাতি যুদ্ধে নেমে পড়তে হোত। এ লড়াই চলতো ততক্ষণ, যতক্ষণ না এরিনার মাটি রক্তে লাল হয়ে ওঠে। একবার এ ধরনের একটি ‘খেলা’ চলেছে একনাগাড়ে ১২২ দিন। সম্রাট ট্রাজান ১১,০০০ ক্রীতদাস এবং দাগী অপরাধী ও ১০,০০০ প্রাণী হত্যা করেন ওই খেলায়।
এসব লড়াই-এ কে জিতবে তা নিয়ে দর্শকেরা বাজি ধরতো। বিক্রি হোত লটারির টিকিট। লটারি জিতলে বিজয়ী ব্যক্তি উপহার পেত একটি চমৎকার বাড়ি, সুদৃশ্য আসবাব অথবা সুন্দরী নারী। ফলে এসব লড়াইয়ে সহিংসতা হোত বেশী। তবে বেশীরভাগ সময়ই বিজয়ী চমকপ্রদ পুরস্কারের বদলে ধোঁকা খেত বেশী। বিজয়ীকে চমৎকার সাজানো বাক্স ধরিয়ে দেওয়া হোত, যার মধ্যে থাকতো ভিমরুল। বাক্স খোলা মাত্র ভিমরুলের দল হামলা করতো বিজয়ীর ওপর, আর তার অবস্থা দেখে বিনোদন প্রত্যাশী দর্শক হেসে গড়াগড়ি যেত। আজ আমাদের সে কথা ভাবতেও অবাক লাগে। সবথেকে আনন্দের বিষয় যে সেই প্রথা আজ বিলুপ্ত হয়েছে, বেঁচে গেছে বহু গ্লাডিয়েটরের প্রাণ।