মানবজাতি
সুখ কামনাকেই জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য বলে মনে করে। কাম বিষয়ে যে সুখ তাতে চিরন্তনী সুখ
মেলে না ভোগের মাধ্যমে । ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। কিন্তু। ত্যাগেও প্রকৃত সুখ নেই যদি তার
ভেতর ভক্তি না থাকে - ভক্তি মুক্তির অধিকারী,প্রকৃত সুখ এতেও নেই! প্রেমই প্রকৃত সুখের
চিরন্তনী অবস্থা।সেই প্রেম পেতে হলে নানাবিধ ভক্তিই একমাত্র উপায় ।
“অর্চণং বন্দনং দাস্যং সেবনং তথা কীর্ত্তণং
শ্রবণং
সখ্যং তথৈবাত্ম নিবেদনম্।"
এই
নববিধ ভক্তির ভেতর তারকব্রহ্ম নাম - কীর্তনই প্রধান অঙ্গ - কারণ এতে প্রেম সংযোগ আছে
।
“কৃতে যদ্দায়তো বিষ্ণুং ত্রেতায়াং যজমুখৈঃ।
দ্বাপরে পরিচৰ্যায়াং কলৌতৎহরি কীর্ত্তণাৎ।”
তাই
ধর্ম,অর্থ,কাম,মোক্ষ এমনকি শ্রীকৃষ্ণ প্রেম এই তারক ব্রহ্ম নামের ভেতর আছে ।
“কলিযুগে
নামরূপে কৃষ্ণ অবতার” সর্বশাস্ত্রের এই সিদ্ধান্ত।ভগবতের মতে,কলিযুগে যারা জন্মগ্রহণ
করবেন, সেই সব গুণজ্ঞ এবং সারভাগী জনগণের কাছে শ্রীভগবান তার পুণ্যময় নাম প্রচার করবেন।ফলত
নাম প্রচার করার কাজটি স্বয়ং ভগবানকেই করতে হয়। নাম অর্থই পরিচয়, কিন্তু তার পরিচয়
তিনি নিজে ছাড়া আর কে দেবে বা দিতে পারে? এ সম্বন্ধে গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন,
‘মান্ত
বেদ ন কশ্চন।' ( ৭/২৬ ) অর্থাৎ হে অর্জুন,আমি ছাড়া আমাকে অপর কেউ জানে না। কারণ যুগে
যুগে ধর্ম সংস্থাপন শ্রীকৃষ্ণই করেছেন। নাম দিতে হলে প্রেম দিতে হয়, কিন্তু ভগবৎ
- প্রেম ভক্তের হাতে;সুতরাং জীবকে নাম প্রেম দান করার দায়ে শ্রীকৃষ্ণকে ভক্তভাব স্বীকার
করতে হয়েছে। মহাভাবের দ্বারা প্রভাবিত এই ভক্তভাব। এই ভাবটি অবলম্বন না করলে জীব আত্মভাবে
ভগবানকে পেতে পারে না। শ্রীকৃষ্ণ ভিন্ন ব্রজপ্রেম দানের অধিকার আর কারও নেই।এমন অবস্থায়
জীবকে ব্রজপ্রেম দিতে হলে কৃষ্ণের ভক্তভাব অঙ্গীকার করা ছাড়া উপায়ান্তর কোথায়?
নামের মাহাত্ম্য শুধু কলিযুগেই নয়, অন্য যুগেও
ছিল । বাস্তবিক পক্ষে নামকে আশ্রয় করেই শ্রুতির উদ্ভব , অন্য কথায় নামই শ্রুতির
প্রভবতত্ব ; কিন্তু অন্য যুগে নামের মাহাত্ম প্রকীর্তিত হলেও নামের মাধুর্য অব্যক্ত
ছিল। তা আত্মভাবে ব্যক্ত অথবা লীলা - মাধুর্যে প্রমূর্ত হতে পারেনি । শ্রীনামের
মাধুর্য এভাবে অব্যক্ত থাকায় অন্য যুগে নাম অনির্দেশ স্বরূপেই গৃহীত হয়েছে ।
কিন্তু অনির্দেশ্য বস্তুতে আসক্তি জন্মে না , সুতরাং সেক্ষেত্রে নামে প্রেম -
ভক্তি জীবচৈতন্যে লাবণ্য বিস্তার করে না । এই অবস্থায় নামে জীবের অন্তরে প্রেম
জাগে না । প্রেম প্রত্যক্ষতা চায় এবং সাধ্যতত্ত্ব যদি অনির্দিষ্ট এবং সমুর্দিষ্ট
থাকে তবে তত্ত্বের সাধনায় ঘনিষ্ঠতা জন্মে না । কলিযুগে নামী নামদাতা রূপে
আত্মমহিমা ব্যক্ত করে জীবের সঙ্গে নিজ সম্বন্ধটি মনন - মাধুর্যে প্রত্যক্ষ লীলায়
সঞ্চার করলেন । এর ফলে জীবের অবীর্য দূর হলো । নাম আর সাধনের অঙ্গ বিশেষ থাকল না,
সকল সাধনার অঙ্গী স্বরূপে প্রেম - তরঙ্গ বিস্তার করলেন । যিনি জীবের প্রাকৃত মনোবুদ্ধির
অগোচর তত্ত্ব নাম রূপে তিনি নিজে এসে জীবের কাছে ধরা দিলেন ; সুতরাং ভগবতজনের
ক্ষেত্রে উপায়ের আপেক্ষিকতা নিরাকৃত হলো । নামের আশ্রয়ে জীব সাক্ষাৎ সম্পর্কে
উপেয় যিনি অর্থাৎ যিনি জীবের সাধ্যতত্ত্ব সোজাসুজি তাকেই লাভ করল ।
এ জন্যই কলিযুগের এত মাহাত্ম্য । একারণেই ঋষিগণও
কলিযুগের বন্দনা করেছেন । কলি উপস্থিত হলো , এবার ‘ হরি ’ বল - নৈমিষারণ্যে
দীর্ঘসূত্রে অনুপ্রবৃত্ত ঋষিগণ প্রেমানন্দ পুলকে কলিকে এভাবে অভিনন্দন করেছেন ।
যদিও কলি অশেষ দোযের আকর, কিন্ত শ্রীনামের কীর্তন মহিমায় কলির সব দোষ গুণে পরিণত
হয়েছে । এ সকল শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত । ‘ষোল নাম বত্রিশ অক্ষর ' মহামন্ত্রটি
শ্রুতিতে উপদিষ্ট হয়েছে । ‘কলি সন্তরণোপনিষৎ’শ্রুতিরই অন্তর্গত কিন্তু
শ্ৰীমহাপ্রভুর আবির্ভাবের পূর্বে এই মহামন্ত্রাশয়ে ভজন অন্য কেউ প্রবর্তন করেননি
। বস্তুত শ্রীচৈতন্যদেবই যুগ - ধর্ম নাম - সংকীর্তনের প্রবর্তক।
কলিযুগে সকল সাধনের অঙ্গীস্বরূপ হবেন নাম অর্থাৎ
শ্রীনামের সংকীর্তন । এই নাম কীর্তন কৃষ্ণনাম প্রধান হবে। শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্তে
এও প্রতিপন্ন হয়। চৈতন্যদেব শ্রীভগবানের বিভিন্ন নামের মধ্যে কোনোরূপ বিভেদ
রাখেননি। নামাশ্রয় সম্বন্ধে তার শ্রীমুখের নির্দেশ এই , নামকে যিনি সর্বশক্তিমান
করেছেন অর্থাৎ অন্য সাধনাঙ্গের অনপেক্ষ ভাবে যাঁর বদান্য মহিমা নামে লাবণ্যলীলা
বিস্তার করেছে, কলিযুগে তিনিই সাধ্যতত্ত্ব। তার উক্তি হতে এমন তাৎপর্যটিও পাওয়া
যায় । কারণ সর্বশক্তি নামে বিভাগ করে দেওয়ার অর্থ এই যে জীব যেরূপ অবস্থাতেই
থাকুক না কেন , নামাশ্রয়ে নামের শক্তিতেই তার পরমার্থ সিদ্ধ হবে। প্রত্যুত
শ্রীনাম জীবের সাধন - ভজন সঞ্জাত শক্তির কোনো অপেক্ষা রাখেন না । নামকে আশ্রয়
করলে জীবকে উদ্ধার করার দায় ভগবানের উপরই গিয়ে পড়ে ।
জীবের
কর্ম-সাপেক্ষভাবে ভগবৎ কৃপার কুণ্ঠা নামের ক্ষেত্রে নেই। নাম করলেই শ্রীভগবানের প্রেমময়ী
শক্তি অবগুণ্ঠন খুলে জীবকে আলিঙ্গন করে নিতে ব্যগ্র হয়ে পড়েন । ফলত নাম অন্যযুগেও
ছিল । কলির যিনি যুগাবতার তিনি নামে সর্বশক্তি সঞ্চার করে অবতীর্ণ। তিনিই নামে প্রকাশ
- তত্ত্বে প্রমূর্ত। সর্বভাবে জীবোদ্ধারণ প্রভাবে জীবের স্বভাবে তিনি ব্যক্ত। নামের
অনুভূতি তার অযাচিত প্রেমরসে জীবের স্বরূপধর্ম সাক্ষাৎভাবে উজ্জীবনে সামর্থ্যসম্পন্ন।
এই হিসেবে নাম এবং নামী অভেদ।নামে বিভিন্নতা থাকলেও জীবের অনুভূতির ক্ষেত্রে নামীর
এই আত্মলীলাটি অব্যবহিত, নিত্য এবং জীবের পক্ষে সাধ্যাবধি সুনিশ্চয়ে পূর্ণতাপ্রাপ্ত।
প্রকৃতপক্ষে শ্রীভগবান বিভিন্ন নাম সৃষ্টি করেছেন, জীবের পক্ষে এটি মুখ্যভাবে বিচার্য
নয়। প্রত্যুত যিনি বিভিন্ন নাম সৃষ্টি করেছেন, নামে সর্বশক্তি সঞ্চারে তার সামর্থ্যসম্পন্ন
ব্যক্তিত্ব বা লীলার স্বীকৃতিতেই নামের মাধুর্য এবং বীর্য জীবের পক্ষে উপভোগ্য হতে
পারে। বাস্তবিকপক্ষে নামে অনুরাগ বা রুচি বা রতির ভাব এই স্বীকৃতি হতেই জীবের চিত্তে
সঞ্জাত হয় । নামে এই কেবল - তত্ত্বটি পরিস্ফুট করে যার উদয় কলিযুগে তিনিই উপাস্য
। যুগধর্ম পালন করতে হলে জীবকে তার লীলা হতে বিচ্ছুরিত এবং সেই লীলায় বহমান প্রেমের
বন্যায় ডুব দিতে হবে । এ যুগে জীবের প্রয়োজন শুধু নামাশ্রয়,নামই জীবকে উদ্ধার করে
নেবেন,সে দায় নামেরই। প্রেমের ধর্মই এই যে,সে অভীষ্টকে আপন করে পেতে চায়।অভীষ্টের
উপভোগ্য ভাবে নিজেকে সকল সম্বন্ধে স্বচ্ছন্দ করেই প্রেম বিলাস এবং প্রাচুর্যে পরিপূর্তি
লাভ করে।ভগবৎ - প্রেমের এই মাধুর্য জীবের সম্বন্ধে একাত্মতায় ব্যক্ত হবার সমধিক সুযোগ
পায় বলে নরলীলাতেই বিশেষভাবে খোলে এবং মেলে । কলির যুগাবতার প্রেমদাতা , প্রেমদাতা
বলেই গৌর অবতারে যুগাবতার স্বরূপে শ্রীভগবান অন্য লীলার অপেক্ষা জীবের সঙ্গে সমান্য
সম্পর্কে সর্বাধিক উজ্জ্বল।প্রকৃত প্রস্তাবে সাধকের সঙ্গে চিন্ময় আনন্দের রসোদয়ে
নিজ ভাবে সংশ্লিষ্ট বা ঘনিষ্ঠতাতেই নিত্য নাম পরম বীর্যের চাতুর্যে প্রত্যক্ষ আত্মমূর্তি
এবং ব্যক্ত।কিন্তু শ্রুতি নির্দিষ্ট ‘ষোল নাম বত্রিশ অক্ষর' মন্ত্রে কৃষ্ণনামের সঙ্গে
রাম নামটিও রয়েছে।শ্রীমৎ রূপ গোস্বামী এই মন্ত্রের মাহাত্ম কীর্তন করতে গিয়ে বলেছেন,
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর শ্রীমুখ হতে উদ্গীর্ণ হরে কৃষ্ণ' ইত্যাদি মন্ত্র 'তৎ' - সম্বোধক
অর্থাৎ মহাপ্রভুকে সাধ্যতত্ত্ব স্বরূপে সম্বোধন করে কীর্তনের ফলে বিশ্ববাসী প্রেম তরঙ্গে
নিমজ্জিত হয়। শ্রীচৈতন্য নাম কীর্তন সূত্রে রাম নামকে কৃষ্ণের নামের অঙ্গীভূত করে
নিয়েছেন , চৈতন্য লীলায় এই পরিদৃষ্ট হয় ।
‘রাম রাঘব রাম রাঘব রাম রাঘব রক্ষ মাম্
।
কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব পাহি
মাম্’।।
তাঁর
শ্রীমুখোচ্চোরিত নাম কীর্তনে এই সত্যটি পরিস্ফুট। প্রকৃতপক্ষে রাম এবং কৃষ্ণ এই দুই
নামের মাধুর্য ছড়িয়েই কলিতে প্রেমাবতারের প্রেম বিতরণ কার্য সম্পন্ন হয়েছে। চরিতামৃতে
বলা হয়েছে –
‘কৃষ্ণ নাম করে অপরাধীর বিচার ,
কৃষ্ণ নামে অপরাধীর না হয় বিকার’।
বাস্তবিকপক্ষে
গুরু পরিভব, মন্ত্র পরিভব এবং দেবতা পরিভব, কলিযুগে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মুখোচ্চারিত শ্রীনামের
শক্তিতে সাধন পথে এই নিতান্ত এবং একান্ত অন্তরায়সমূহ বিদূরিত হয়েছে। ভক্তাবতারের
সঙ্গে পূর্ণ - ভগবত্তা আত্যন্তিকভাবে সম্মিলিত হওয়াতে অব্যবহিত একাত্মতায় শ্রীনামের
প্রেম তরঙ্গ অভঙ্গ অনঙ্গলীলার মাধুর্যে অধম পতিত তাপিত জীবের পথ্যাত্মক জীব - কোষের
সকল অবীর্য নিঃশেষে নিরাকৃত হয়েছে । জীবের প্রাকৃত ইন্দ্রিয় সম্বন্ধগত অনুভূতির স্তরে
প্রেমময় দেবতার আদর অন্তঃকন্দলিতচ্ছন্দে হিন্দোলিত হয়ে ভাস্বর কৃষ্ণসেবার স্বরূপধর্ম
উদ্দীপিত করেছে। সুতরাং ঋষি করভাজোপদিষ্ট বন্দনাতে নাম - প্রেম দাতা। শ্ৰীমহাপ্রভুই
উপদিষ্ট হয়েছেন ।
রামায়ণে
দেখা যায় , মারীচ মৃগদেহ ধারণ করতে গিয়ে সীতাদেবীকে শ্রীরামচন্দ্রের পৌরুষ স্বরূপে
বন্দনা করেছিলেন।সে দিব্যগতি লাভ করে,এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু ‘ছাড়িয়া
এ দেহ তারা পেল দিব্যগতি, বেদ বিনা তাহা দেখে , কাহার শকতি'এ প্রশ্ন উঠতে পারে। শ্ৰীমহাপ্রভুর
কৃপাপ্রাপ্ত হয়ে জগাই - মাধাই বৃন্দাবন লীলায় পুতনা এবং অঘ,বক,তৃণাবর্তের সম্বন্ধে
এই প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। এর কারণ এই যে,একমাত্র গৌরলীলাতেই সৰ্বভাবে প্রেমবশ্যতাকে
স্বীকৃতি এবং সাঙ্গপাঙ্গসহ নাম প্রচারে সর্বাবস্থায় সর্বভাবে জীবকে অনুগতি প্রদান
করে প্রেম লীলার পরিপূর্তি । কলিযুগের যিনি ধ্যেয়, তিনিই কৃষ্ণ এবং রামচন্দ্র প্রভৃতি
রূপে যুগাবতারের তিনিই অবতারী । প্রেম – স্বরূপিণী রাধারানীর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে নিত্য
সংশ্লেষে গৌরহরির জীবোদ্ধারের প্রেম বিতরণে পরম পৌরুষ বীর্য এবং সামর্থ্যটি সত্য হয়েছে
।
শ্রীচৈতন্যের
শিক্ষাষ্টকে দেখা যায়,তার আটটি শ্লোকের ভেতর দুটি শ্লোকেই নামের মহিমা স্ফুট হয়েছে
। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্লোকে চৈতন্যদেব বলেছেন –
প্রথম শ্লোক
কৃষ্ণু সংকীর্তন মহিমা
চেতোদর্পণমার্জনং ভবমহাদাবাগ্নিনির্ব্বাপনং
শ্রেয়ঃ কৈরবচন্দ্রিকা বিতরণং বিদ্যাবধূজীবনম্।
আনন্দাম্বুধিবৰ্দ্ধনং প্রতিপদং পূর্ণামৃতাস্বাদনং
সৰ্বাত্মস্বপনং পরং বিজয়তে শ্রীকৃষ্ণ
সংকীর্তনম্।
অর্থাৎ , জয় হোক শ্রীকৃষ্ণ সংকীর্তনের । তা
চিত্তরূপ দর্পণকে মার্জিত করে এবং সংসার দাবানলকে নির্বাপিত করে । শ্রেয়গূঢ় রূপ
চন্দ্রকিরণ বিতরণ করে ; তাহলে বিদ্যারূপ বধূর জীবনের মতো । তাতে সদা সর্বদা
আনন্দের তরঙ্গ বৃদ্ধি পায় এবং পদে পদে পূর্ণ অমৃতের আস্বাদ পাওয়া যায় । তাতে
সর্বাত্মার পরিপূর্ণ সন্তোষ ও পুষ্টি ঘটে ।
দ্বিতীয় শ্লোক
নাম ও নামীর অভিন্নতা ।
নান্নামকারি বহুধা নিজসৰ্ব্বশক্তি ।
স্তত্রার্পিতা নিয়মিত ; স্মরণে ন কালঃ ॥
এতাদৃশী তব কৃপা ভগবন্মমাপি ।
দুর্দৈবমীদৃশমিহাজনি নানুরাগঃ ॥
অর্থাৎ হে ঈশ্বর তোমার পবিত্রনাম স্মরণের কোনো সময় অসময় নেই। ঐ নামের মধ্যেই নিহিত রয়েছে তোমার সর্বশক্তি। তোমার এত করুণা অথচ আমার এমনই দুর্দৈব সেই নামে আমার অনুরাগ হলো না ।
প্রথম শ্লোকে সংকীর্তনের জয় ঘোষণা করা হয়েছে।
শ্রীচৈতন্য স্বয়ং সংকীর্তনের প্রবর্তন করেন । সংকীর্তনের মধ্য দিয়েই তিনি
নবদ্বীপের ভক্তগণকে সমবন্ধ করেন। সংকীর্তনই বৈষ্ণব – অবৈষ্ণব নির্বিশেষে দেশের জনসাধারণের মধ্যে বৈষ্ণব ধর্ম
ও ভক্তিভাব জাগ্রত করেন । সংকীর্তনই যেন গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের কাছে ধর্মাচরণ, অন্যবিধ
পূজাপাঠ নয়। শিক্ষাষ্টকের প্রথম শ্লোকেই সংকীর্তনের মহিমা ব্যাখ্যা করে বলা
হয়েছে ( ১ ) সংকীর্তন মানবচিত্তের সর্ববিধ মলিনতা দূর করে তাকে উজ্জ্বল করে তোলে
। ( ২ ) সংকীর্তন সংসার বন্ধনের যে জ্বালা তা নির্বাপিত করে হৃদয়কে আলোক উজ্জ্বল
করে তোলে । ( ৩) সংকীর্তনের মধ্যেই রয়েছে সর্ববিদ্যার সার - পদার্থ । ( ৪ )
সংকীর্তনে সর্বদা আনন্দ তরঙ্গিত হচ্ছে এবং প্রতিক্ষণ তা বর্ধিত হচ্ছে । ( ৫ )
সংকীর্তনে রয়েছে পূর্ণ অমৃতের স্বাদ । এসব কারণে বৈষ্ণবদের কাছে সংকীর্তনই সাধনা
। মহাপ্রভু বলেছেন , সর্বাত্মার তুষ্টি ও পুষ্টিই হলো সংকীর্তনে ।
অপরদিকে , দ্বিতীয় শ্লোকে সংকীর্তনের মধ্যে নাম
সংকীর্তনের গৌরব প্রকাশ করা হয়েছে। নাম এবং নামী অভিন্ন অর্থাৎ কৃষ্ণনাম গান
করলেই কৃষ্ণকে পাওয়া যায় । কৃষ্ণ এই নামটি থেকে স্বয়ং কৃষ্ণ দূরে নন । মহাপ্রভু
বলেছেন, নাম স্মরণেই পূজার সীমা এবং নাম স্মরণেই স্থান কাল পাত্রের কোনো ভেদ নেই ।
ভগবান কৃষ্ণের জীবের প্রতি এত দয়া যে তার ভজন পূজনকে কত সহজ সরল ও সর্বত্র
সঞ্চারী করে রেখেছেন ।
শ্রবণ
- কীর্তনে শ্রীমন্ মহাপ্রভু নাম - শ্রবণ ও নাম - কীর্তনের বিশেষ প্রশংসা করেছেন। নাম
ও লীলা - কীর্তন উভয়ই সাধকের ধ্যানমন্ত্র। শ্ৰীমন্ মহাপ্রভু নিরপরাধে নাম নেবার নির্দেশ
দিয়েছেন।মানুষের মধ্যে একটা সহজাত প্রবৃত্তি লক্ষ্য করা যায়। আর তা হচ্ছে - এখন তো
অন্যায় আচরণ করে কার্যোদ্ধার করি,পরে হরিনাম নিয়ে পাপ খণ্ডন করব।এরূপ অভিসন্ধি এবং
আরও কয়েক প্রকার অপরাধ নামাপরাধ নামে পরিচিত।
অকপটে নাম নিতে হবে, শ্রীভগবানের প্রীতির জন্যই নাম নিতে হবে। অজ্ঞাতসারে নামাপরাধ
ঘটে গেলে, অপরাধ মুক্তির জন্য নামের নিকটেই প্রার্থনা করতে হবে। নামই মানব জীবনের পরম
গতি।
সহায়ক
গ্রন্থ
১।
শ্রী বীরেন্দ্র গোস্বামী ( ব্রহ্মচারী ) - “ হরের্ণামৈব কেবল গ্রন্থ , প্রকাশক : শ্ৰীসাল
সিং ব্রহ্ম, গুয়াবাড়ী, আসাম হতে প্রকাশিত ।
২।
শ্রী হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় - পদাবলী - পরিচয় , প্রকাশক : সুধাংশুশেখর দে , দে’জ পাবলিশিং
কোলকাতা , চতুর্থ সংস্করণ ; জুলাই ২০০৬ ।
৩।
বঙ্কিমচন্দ্র সেন- নাম - মাধুরী , প্রকাশক : পাতাবাহার পাবলিকেশনস প্রাইভেট লিমিটেড
, কোলকাতা , প্রথম পাতাবাহান্ন সংস্করণ : মাঘ ১৪১৯ ।
৪।
ড .শম্ভুনাথ গাঙ্গুলি ও অন্যান্য, বাংলার বৈষ্ণবদর্শন ও সাহিত্যে শ্রীরাধা, প্রকাশক:
পাঠকবন্ধু লাইব্রেরি , ৪ বাংলা বাজার , ঢাকা ( প্রথম প্রকাশ ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭)।
লেখক পরিচিতি –
রঘুনাথ ভট্টাচার্য-এর জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায় । ধামরাই কলেজ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন । বাংলায় স্নাতকোত্তর ও পিএইচ ,ডি । বিভাগীয় প্রধান , বাংলা বিভাগ , নবযুগ কলেজ , ধামরাই , ঢাকা ।
প্রকাশিত গ্রন্থ - ( ১ ) বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য ( ১৯২০-১৯৩০ ) । ( ২ ) সবুজপত্র গোষ্ঠীর সাহিত্য ভাবনা। ( ৩ ) প্রবন্ধ সংগ্রহ । ( ৪ ) ঈশ্বর ভাবনার বিবর্তন ও অন্যান্য প্রবন্ধ । ( ৫ ) বাংলার বৈষ্ণব দর্শন : সাহিত্যে রাধা ও কৃষ্ণের ক্রমবিবর্তন । এছাড়াও যৌথভাবে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ।