দুর্গাদেবীতি
বিখ্যাতং তন্মে নাম ভবিষ্যতি ॥
(শ্রীশ্রী চণ্ডী , ১১/৪৬ )
অর্থাৎ , আমি
সেই সময়ে দুর্গম নামক এক মহাসুরকে বিনাশ করব । সেজন্য লোকে আমার দুর্গাদেবী 'এই
বিখ্যাত নাম রাখবে।
দুর্গম নামক এক মহাসুরকে বধ করে মহাশক্তি ভগবতী দুর্গা দেবী 'নামে খ্যাত হয়েছেন । এই দেবী দুর্গার আরাধনা প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় সমাজজীবনে লক্ষণীয়। শরৎ ঋতুতে দুর্গা প্রতিমার যে পূজা অনুষ্ঠিত হয় তার প্রধান উপাস্য মহাদেবী দুর্গার মহিষাসুরমর্দিনী রূপ। এই রূপের কল্পনা অনুযায়ী দেবী সিংহের ওপরে বা পাশে দাড়িয়ে এক অসুরকে বধ করেন । দেবীর দশ হাতে ত্রিশূল সমেত নানা ধরনের অস্ত্র - শস্ত্র। দুর্গার বামে জ্ঞানের দেবী সরস্বতী ও দেবসেনাপতি কার্তিক,আর ডানে ধনের দেবী লক্ষ্মী ও সিদ্ধিদাতা গণেশ । প্রচলিত রীতি অনুযায়ী এই সব প্রতিমার পটভূমিকায় থাকে একটি চালচিত্র যা প্রাচীনকালের প্রতিমার পশ্চাৎপটের পরিবর্তিত রূপ। এর উপস্থিতি একই পাদপীঠের উপরে দেখানো দেব - দেবীদের এক পরিবারভুক্ত বলে যেন ইঙ্গিত করে। পরিবারের কর্তার অর্থাৎ দুর্গার স্বামী শিবের ছবিও চালচিত্রে আঁকা থাকে।
আজকাল অনেক ক্ষেত্রে, বিশেষত
বারোয়ারি পূজাগুলিতে,প্রতিমার এই রূপ কল্পনা থেকে কিছু
কিছু পার্থক্য চোখে পড়ে। যেমন সিংহ বা অসুরের বিভিন্ন ধরনের ভঙ্গিমা, চালচিত্রের
অনুপস্থিতি,পরিবর্তে অন্য বড় পটভূমির ব্যবহার ইত্যাদি ।
কিন্তু রকমফের যাই হোক সব প্রতিমা বা প্রতিমামণ্ডলী থেকে দুটি ধারণার পরিষ্কার
ইঙ্গিত পাওয়া যায় । দেবী রণ - রঙ্গিনী অসুরনাশিনী হলেও এক পরিবারের কত্রী,সন্তানদের
মা । মঙ্গলময়ী ভক্তদের বরাভয় দেন , তাদের
রক্ষা করেন,তাদের মনস্কামনা পূর্ণ করেন ।
মার্কণ্ডেয় পুরাণের ‘ দেবী মাহাত্ম অংশে বলা হয়েছে , মহিষ নামে অসুরদের রাজার নেতৃত্বে তাদের দ্বারা পরাজিত ও স্বর্গ হতে বিতাড়িত দেবতারা প্রজাপতি ব্রহ্মাকে সঙ্গে করে শিব ও বিষ্ণুর দ্বারস্থ হন । তাদের দুর্দশার কথা শুনে রাগান্বিত শিব ও বিষ্ণু এবং সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবতাদের শরীর থেকে বিনির্গত শক্তির সমন্বয়ে গড়ে উঠলেন এক মহাদেবী যার নাম চণ্ডিকা।
ধন,শস্য ও সুখ লাভ এবং দুঃখ ও শত্রুনাশের আশায় লোকে দেবী দুর্গার চণ্ডিকা বা মহিষমর্দিনী রূপের পূজা করে । কাটা মহিষ থেকে বেরিয়ে আসা অসুর অশুভ শক্তির প্রতীক । কোনো কোনো প্রাচীন প্রতিমায় দেবীকে দেখা যায় বলশালী এক মহিষকে,বা মহিষের মাথাওয়ালা এক অসুরকে হত্যা করতে। এই ধরনের মূর্তির প্রাচীনতম নিদর্শনগুলো মহিষাসুর রূপ কল্পনার বিবর্তনের গোড়ার দিকে । মহিষাসুর নিধনকারিণী দেবী এক অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারিণী । চণ্ডীর দুই চোখের উপরে কপালে আর এক চোখ এই অতিপ্রাকৃত ও মাহাত্মের ইঙ্গিত করে,যেমন করে তার দশ হাত। মহিষমর্দিনীর প্রাচীন প্রতিরূপ ও ধ্যানগুলি থেকে মনে হয় তার দুই,চার ,ছয় ,আট , দশ ,ষোলো ,আঠারো ও বিশ এমনকি বত্রিশ হাতের কল্পনা করা হয়েছে । কিন্তু ক্রমশ দশ হাতের কল্পনাই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। দেবীর এক নাম হয়েছে দশভুজা । মার্কণ্ডেয় পুরাণে লিখিত দেবীকে দেওয়া দেবতাদের উপহারের তালিকায় যুদ্ধের প্রয়োজনীয় ও নামোল্লেখিত অস্ত্রের সংখ্যাও দশ। আনুমানিক একাদশ শতাব্দীর কালিকাপুরাণে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার পূজনীয় যে মূর্তির বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তারও তিনটি চোখ ও দশ বাহু। দুর্গার সঙ্গে যেসব দেবদেবীদের দেখা যায় তারা প্রত্যেকেই এক এক স্বাধীন ধর্মবিশ্বাসের কেন্দ্রীয় দেব বা দেবী। বিভিন্ন কারণে এবং নানা বিশ্বাসের উদ্ভব ও বিবর্তনে এঁরা শিব - দুর্গার পরিবারভুক্ত হয়েছিলেন প্রাচীনকালেই । কিন্তু মহাদেবীর মহিষমর্দিনী মূর্তির সঙ্গে পরিজনদের সাধারণত মধ্যযুগের শেষভাগের আগে দেখা যায় না । অবশ্য নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত কিছু ভাস্কর্যে দেবীকে সাধারণভাবে ( অর্থাৎ মহিষমর্দিনীরূপে নয় ) কার্তিক ও গণেশ বা লক্ষ্মী ও সরস্বতীর সঙ্গে দেখানো হয়েছে । ষোড়শ শতাব্দীর মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখা কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে দশভুজা চণ্ডিকার ( অর্থাৎ দুর্গার ) মহিষাসুরমর্দিনী রূপ বর্ণিত হয়েছে । বাঙালির চিন্তা ও স্বভাবের গুণে মাতৃদেবী ,অসুর ও অশুভনাশিনী মঙ্গলময়ী দুর্গা হয়ে উঠেছেন এক পরিচিতা পরিবারকর্ত্রী ও পরিবার কন্যা । যাকে বছরে অন্তত একবার দেখতে যেকোনো বাবা - মাই পাগল। বাঙালির ঘরোয়া চিরন্তন চিন্তার ছাপ পড়েছে সপরিবার দুর্গা কল্পনায়। এখানে দুর্গা উমা বা ঘরের মেয়ে , যাকে ঘিরে রচনা হয়েছে বাৎসল্য রস সিঞ্চিত নানা আগমনী গান ।
পূজার সময় দুর্গা প্রতিমার পাশে বা সঠিকভাবে গণেশের মূর্তির পাশে নতুন পাতা সমেত সবুজ কলাগাছের একাংশ রাখা হয়। সঙ্গে বাঁধা হয় কচু ,হলুদ , জয়ন্তী ,বেল ,ডালিম ,অশোক, মান ও ধান্যফল,মূল বা শাখা । পূজাবিধি মতে এখানে কলা ব্রাহ্মণী এবং অন্যান্যগুলি যথাক্রমে কালিকা,দুর্গা,কার্তিকী ( কৌমারী ) ,শিবা,রক্তদন্তিকা,শোকরহিতা,চামুণ্ডা ও মহালক্ষ্মীর অর্থাৎ মহাদেবীর নয়টি বিভিন্ন রূপের প্রতীক। নতুন লাল পেড়ে শাড়িতে ঢাকা এই নবপত্রিকার ( বা চলিত ভাষার কলা বৌ - এর ) পূজা দুর্গাপূজা পদ্ধতির অন্যতম প্রধান ও প্রারম্ভিক অঙ্গ । একেই ইঙ্গিত করে কৃত্তিবাস লিখেছিলেন,“বন্ধিলা পত্রিকা নববৃক্ষের বিলাস ”। এই নবপত্রিকা মার্কণ্ডেয় পুরাণে উক্ত শাকসবজি ও শস্য দাত্রী মহাদেবীর শাকম্ভরী রূপের কথা আমাদের মনে করিয়ে দেয়।
এই আলোচনা থেকে মনে হয় ,শরতে দুর্গাপূজার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে ভক্তের নানা ধরনের কামনা সিদ্ধির আশা। দেবীর সার্থক পূজা ভক্তকে দেবে বিষয় ও ঐশ্বর্য। পৃথিবীকে করবে শস্যশালিনী এবং বছরে অন্তত একবার ভক্তের মেয়েকে আসতে দেবে তার বাপের বাড়িতে। শরৎ কাল পূজার পক্ষে ‘অকাল ’বলে কৃত্তিবাসী রামায়ণে লেখা হয়েছে । কিন্তু এই রচনার অনেক আগেই শরতে দেবীর বাৎসরিক পূজার কথা মার্কণ্ডেয় পুরাণে উল্লিখিত হয়েছিল। যে বসন্তকে কৃত্তিবাস পূজার “শুদ্ধিসময় 'বলেছেন,সেই সময় পরিজনসহ বাসন্তী দুর্গা দেবীর পূজা হয় । এই পূজার সময় দেবীর আর এক রূপ অন্নপূর্ণারও আরাধনা করা হয় । ক্ষেতের ফসল ঘরে তোলার শেষ মরশুম এবং একজাতীয় ধান বোনার সময় বসন্তের সঙ্গে দেবীর অন্নপূর্ণা রূপের ষোগ অন্য কোনো রূপের চেয়ে অনেক বেশি নিবিড়। বোধ হয় এই সম্পর্কের সূত্র ধরেই বসন্তকালেও মহিষমর্দিনীর পূজার প্রচলন হয়। প্রাচীনকালে মেধসমুনির আশ্রমে রাজা সুরথ এবং সমাধি বৈশ্য জগদম্বার যে মৃন্ময়ী মূর্তির পূজার প্রচলন করেন ,আজও তার ধারাবাহিকতা বহমান। পরিশেষে মায়ের কাছে আকুল প্রার্থনা –
সৰ্ব্বস্বরূপে
সৰ্ব্বেশে সর্বশক্তিসমন্বিতে।
ভয়েভ্যস্ত্রাহি নো
দেবি দুর্গে দেবি নমোহস্তু তে।
(শ্রীশ্রী চণ্ডী , ১১/২৩ )
অর্থাৎ তুমি সর্বস্বরূপিণী , সকলের ঈশ্বরী এবং সর্বশক্তিময়ী । হে দুর্গে দেবি । আমাদেরকে এই অসুর ভীতি হতে ত্রাণ কর । তোমাকে প্রণাম করি ।
লেখক পরিচিতি –
রঘুনাথ ভট্টাচার্য-এর জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায় । ধামরাই কলেজ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন । বাংলায় স্নাতকোত্তর ও পিএইচ ,ডি । বিভাগীয় প্রধান , বাংলা বিভাগ , নবযুগ কলেজ , ধামরাই , ঢাকা ।
প্রকাশিত গ্রন্থ - ( ১ ) বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য ( ১৯২০-১৯৩০ ) । ( ২ ) সবুজপত্র গোষ্ঠীর সাহিত্য ভাবনা। ( ৩ ) প্রবন্ধ সংগ্রহ । ( ৪ ) ঈশ্বর ভাবনার বিবর্তন ও অন্যান্য প্রবন্ধ । ( ৫ ) বাংলার বৈষ্ণব দর্শন : সাহিত্যে রাধা ও কৃষ্ণের ক্রমবিবর্তন । এছাড়াও যৌথভাবে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ।