জানা অজানা
এই ‘বেওয়ারিশ’ মহাকাশচারী অ্যাস্টারইয়ড,তারামাছ বা
গ্রহাণুপুঞ্জটি আবিষ্কৃত হয়েছিল ২২ বছর আগে ১১ই সেপ্টেম্বর,১৯৯৯ সালে।
“বেন্নু” হ’ল মিশরের পৌরাণিক গাথার কাল্পনিক দেবতা যিনি সূর্য,পৃথিবী আর
জন্মান্তরের অধীশ্বর-একটি পাখির আকার-অনেকটা বড় সারস পাখির মত গড়ন। এরই নামানুসারে
‘বেন্নু’ এই গ্রহাণুপুঞ্জটির নামকরণ করা হয়েছিল। এই বড় মহাকাশ-পিণ্ডটি আজ থেকে ১৪ বছর পরে ২০৩৫ এ পৃথিবীর
গায়ে ধাক্কা মারার প্রবল সম্ভাবনা আছে বলে বৈজ্ঞানিকরা অনুমান করছেন। তাই দেশে
দেশে গবেষণা চলছে কিভাবে এই প্রবল সম্ভাবিত দুর্যোগ এড়ানো যায়। এই দুর্যোগ ভীষণ
হতে পারে তার কারণ এই গ্রহাণুপুঞ্জটি খুব বিশাল না হলেও ব্যস ৫০০মিটার আর ওজন
৭৮০০কোটি কিলোগ্রাম। এটি প্রচণ্ড গতিতে একটি লাট্টুর মত আপন অক্ষের চারিদিকে ঘুরতে
ঘুরতে ৪৩৬ দিনে সূর্য প্রদক্ষিণ করে। প্রাপ্ত ছবি থেকেও দেখা যায় এটিকে একটি প্রায়
শুয়ে-পড়া একটি অতিকায় লাট্টুর মত মনে হয়। এখনকার হিসাব অনুযায়ী ২০৩৫-এ বেন্নু
পৃথিবীর ১লক্ষ ২৩ হাজার কিলোমিটারের মধ্যে আসবে। শুনতে ১লক্ষ কিলোমিটার হলেও এ
দূরত্ব কিন্তু মহাকাশ বিজ্ঞানের হিসাবে খুবই কাছে। চাঁদ আমাদের থেকে কত দূরে? তিন লক্ষ চুরাশি হাজার কিলোমিটার। তার মানে বেন্নু ওই
সময়ে চাঁদের চেয়েও এক তৃতীয়াংশ কাছে চলে আসবে। আর এতবড় একটা বস্তু এত কাছে এলে,ধাক্কা না
লাগলেও, তার একটা কুফল তো আমাদের গ্রহের উপর পড়বেই। বর্তমান
জ্ঞান আর হিসাব অনুযায়ী বেন্নু ২১৭৮ আর ২২৯০ এর মধ্যে পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা লাগার
সম্ভাবনা; আর সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা হ’ল ২৪শে সেপ্টেম্বর,২১৮২-তে। তাই
দেশে দেশে গবেষণা চলছে কিভাবে বেন্নুর প্রভাব থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করা যায়।
শুধু আমেরিকা,ইয়োরোপ আর
রাশিয়াই নয় চীন দেশও ‘বেন্নু’কে নিয়ে বিশেষ চিন্তিত। চীনের বিজ্ঞান সংস্থাও ‘বেন্নু’র
ধাক্কা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত। বেন্নুর সঙ্গে সংঘর্ষে আমাদের গ্রহের সাংঘাতিক ক্ষতির
সম্ভাবনা নিয়ে চীনও বিশেষ চিন্তিত। এই সংঘাতের সম্ভাবনা এড়াবার মানসেই চীনের জাতীয়
মহাকাশ-বিজ্ঞান কেন্দ্র প্রস্তাব দিয়েছেন যে যদি ‘লঙ মার্চ ৫’ - এর সুবিশাল আর ৯০০টন ভারী রকেট গুলি দিয়ে একের পর এক
২৩বার বেন্নু কে অঘাত করা যায় তাহলে বেন্নুকে পৃথিবীর কক্ষ থেকে ৫৫৯২ মাইল দূরে
সরিয়ে ফেলা সম্ভব হবে।কিন্তু এই রকেটগুলি পৃথিবী থেকে ছোঁড়ার পর বেন্নুর গায়ে
লাগার জন্য প্রয়োজন হবে প্রায় তিন বছর!
ওদিকে আমেরিকার বৈজ্ঞানিকদের
প্রস্তাব হল বেন্নুকে “হাতুড়ি-পেটা’ করা। ওই প্রজেক্ট এর নামই দিয়েছেন,”হ্যামার”। এই
প্রস্তাব অনুসারে অ্যাস্টারইয়েডটিকে মহাকাশ-যান বা এটমিক অস্ত্র দিয়ে ৩৪ থেকে
৫৩বার আঘাত করলে ওটার কক্ষপথ পরিবর্তিত হয়ে যাবে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে সারা
পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠী এব্যাপারে বিশেষ চিন্তিত এবং ‘কিছু একটা করতে হবে’
ভাবছেন।
এবারে বেন্নু সম্বন্ধে এখন
পর্যন্ত জানা কিছু তথ্য জানা যাক।
তথ্য গণনার হিসাব মতে ৪৫০কোটি
বছর আগে সৌর-মণ্ডলের সৃষ্টির সময়ে টুকরো-টাকরা ‘গ্রহ-কণা’ মাধ্যাকর্ষণের টানে একে
অন্যের সংগে মিছরির মত ‘দানা-বেঁধে’ই এটি তৈরি হয়েছিল। আবার কোন কোন বৈজ্ঞানিকের
মতে ধ্বংস হয়ে যাওয়া কোন তারকা বা “সুপার-নোভার”থেকেও এর সৃষ্টি হতে পারে। ‘বেন্নু’র সারা
‘শরীর’ শজারুর কাঁটার মত ছোট-বড় পাথর বা ‘বোল্ডার’এ ছেয়ে আছে। সবচেয়ে বড়
বোল্ডারটির উচ্চতা নাকি ১৯০ফুটের উপর। বৈজ্ঞানিকদের মতে এর গঠন সামগ্রীর সিংহ-ভাগ হ’ল
‘কার্বন’ জাতীয় পদার্থ-‘এমীনো-এসিড’ যা দিয়েই তৈরি হয় যে কোন প্রাণের সৃষ্টি। আর ‘বেন্নু’
সৃষ্টির প্রথম থেকে প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। তাই বৈজ্ঞানিক মহলের বিশ্বাস এই যে
বেন্নুর ধুলো-কণা বিশ্লেষণে হয়ত এ পৃথিবীর জীবন-সৃষ্টি রহস্য সম্বন্ধে সঠিক ইঙ্গিত
পাওয়া সম্ভব হবে। বেন্নু সম্বন্ধে এত বিস্তৃত গবেষণার এটাই একটি বিশেষ কারণ। আর এই
জন্যেই এত বিশাল ব্যয়ে একটি মাত্র গ্রহাণুপুঞ্জের গবেষণা চলছে দেশে দেশে। আশি কোটি
আমেরিকান ডলার খরচ করে ‘ও-সিরিস-রেক্স (OSIRIS_REx)’না
আমেরিকান বৈজ্ঞানিক সংস্থা ‘নাসা’
গত(২০২০) অক্টোবর মাসেও-সিরিস-রেক্স মারফৎ প্রচুর ছবি সংগ্রহ করেছে আর বেন্নুর
‘মাটি’তে নেমে লম্বা রোবট-হাত দ্বারা ওই ‘মূল্যবান’ সামগ্রী-আধ মুঠো ধুলো-মাটি
নাকি সংগ্রহও করে ফেলেছে। ওই ‘মহামূল্য’ সামগ্রী একটি বিশেষ ‘থলি’তে আটক করে
‘ও-সিরিস-রেক্স’ এবছরের ১০ই মে তারিখে বেন্নু থেকে উড়ে ঘরে ফেরার জন্য যাত্রা শুরু
করে, মানে পৃথিবীর উদ্দেশ্যে উড়তে শুরু করে দিয়েছে বলে জানা গেছে। বৈজ্ঞানিক হিসাব
অনুসারে ২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩এ ‘মিশন’ শেষে ‘ও-সিরিস-রেক্স’ পৃথিবীতে ফিরে আসবে
আর সেই মহামূল্য ‘থলি’টি একটি প্যারাসুটের সাহায্যে পৃথিবীর একটি বিশেষ স্থানে
নিরাপদে নেমে আসবে।
কিন্তু সেই ‘ভিলেন’ বেন্নু
কোথায় আছে এই মুহূর্তে?
মহাকাশে বৃহস্পতি আর মঙ্গলের
মাঝামাঝি একটি সুবিশাল বিস্তৃত স্থান আছে যার নাম অ্যাস্টারইয়ড বেল্ট (Asteroid Belt)। আর এই স্থানেই
জন্ম নেয় যত সব অ্যাস্টারইয়ড। এই স্থানেই বেশিরভাগ গ্রহাণুপুঞ্জের (Asteroids) অবস্থান। ওখান
থেকেই বেরিয়ে পার্থিব ৪৩৬ দিনে সূর্য প্রদক্ষিণ করে বেন্নু; এই প্রদক্ষিণের পথেই বেন্নু ইতিমধ্যেই পৃথিবীর কক্ষের
খুব কাছাকাছি আসতে আরম্ভ করেছে। বেন্নু প্রত্যেক ছ’বছর অন্তর আমাদের গ্রহের কাছ
দিয়ে চলে যায়। কিন্তু সবচেয়ে কাছে আসবে ২১৮২ এর ২৪ শে সেপ্টেম্বর, মনে আছে তো? ভাগ্যে আমরা যারা এই লেখা পড়ছি তারা কেউ সেইসময় বেঁচে
থাক’ব না। নাকি কেউ কেউ থাকবো? বলা ত যায়না-বিজ্ঞানের প্রগতি যে হারে চলছে তাতে কিছুই
আর ‘অসম্ভব’ বলে থাকবেনা।
লেখক পরিচিতি –
ডঃ তুষার রায় স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ। ওই সময়েই “শুকতারা”তে “অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু “Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পান।