কবিগুরু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( ১৮৬১-১৯৪১ )স্বয়ং যাঁকে বাংলা ‘শিশু সাহিত্যের ভগীরথ' আখ্যায়
আখ্যায়িত করেছিলেন তিনি হচ্ছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৫)। বহুমুখী প্রতিভার
অধিকারী উপেন্দ্রকিশোর শিশুসাহিত্যের অন্যতম রূপকারের পাশাপাশি চিত্রী, অলংকরণ শিল্পী,সংগীতজ্ঞ,গীতিকার,পত্রিকা
সম্পাদক,মুদ্রণ বিশেষজ্ঞ, সৌখিন জ্যোর্তিবিদ ইত্যাদি আরও কতোকী। এই প্রবন্ধে আমরা সঙ্গীতবেত্তা উপেন্দ্রকিশোরকে
তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
১৮৬৩
সালের ১২ মে অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহে জন্ম নেন উপেন্দ্রকিশোর। সেখানেই ম্যাট্রিক
পাশ করার পর এফ.এ পড়তে আসেন কলকাতায়। প্রথমে প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হলেও পরে মেট্রোপলিটন
(এখনকার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে স্নাতক হন।জীবনের শুরু থেকেই শিশুসাহিত্যের প্রতি উপেন্দ্রকিশোরের
আকর্ষণ ছিল। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি গান,ছবি আঁকা,বেহালা হারমোনিয়াম বাঁশি বাজানো
ইত্যাদির সঙ্গে বিশেষ করে ছোটোদের জন্যে লেখালেখিও শুরু করেন। ব্রাহ্মসমাজের প্রগতিশীল
আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উপেন্দ্রকিশোর আজীবন ব্রাহ্মধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন।
ভারতীয়
সঙ্গীতের ক্ষেত্রে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সুবিখ্যাত
'প্রবাস ' পত্রিকায় চারটি পর্বে ‘ভারতীয় সঙ্গীত' শিরোনামে তার যে চারটি মৌলিক রচনা
প্রকাশিত হয়েছিল সেখানে তাঁর সঙ্গীত বিশ্লেষণী মননের পরিচয় পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের'
প্রতিদিন তব গাথা' এবং 'প্রথম আদি তব শক্তি' গান দুটিকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে উপেন্দ্রকিশোর
লেখেন 'ডে বাই ডে, শ্যাল আই সিং দ্য সুইট সং' এবং 'দাই পাওয়ার ইজ ফ্রম অল টাইম'।গান
ছাড়াও তিনি বেহালা এবং অরগান সহ বিভিন্ন যন্ত্রসঙ্গীতে পারদর্শী ছিলেন।স্মর্তব্য,
১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী শোভাযাত্রায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে উপেন্দ্রকিশোর
বেহালা বাজিয়েছিলেন। 'হারমোনিয়াম শিক্ষা' এবং 'বেহালা শিক্ষা' নামে তিনি দু'খানি
মূল্যবান গ্রন্থও রচনা করেছেন।
ব্যক্তিজীবনে
উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন একজন খোলা মনের মানুষ।আর তার জন্যেই হয়তো তিনি শিশুদের জন্যে
খোলা মনেই লিখে যেতেন। যে লেখার মধ্যে শিশুদের কল্পনা আর অনুভূতি এক হয়ে যেতো।একজন
শিশু তথা কিশোর উপেন্দ্রকিশোর লেখা পড়তে পড়তে কখন যে কল্পনা থেকে বাস্তবের ডানা মেলে
উড়তে চাইতো তা তারা নিজেরাই বুঝতে পারতো না। এখানেই ছিল উপেন্দ্রকিশোরের অসামান্য
নৈপুণ্য যে নৈপুণ্য এক সঙ্গে কাজ করতো তাঁর সঙ্গীত সৃষ্টি, ছবি আঁকা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও।
যে ছবি,সংগীত এবং কবিতার সঙ্গে শিশুরা বারবার খুঁজে পেতো নিজেদের। আর বড়োরা খুঁজে
পেতো নিজেদের শৈশবকে। শিশুদের মনোরঞ্জনকেই উপেন্দ্রকিশোর জীবনের শ্রেষ্ঠ সাধনা হিসেবে
গ্রহণ করেছিলেন। শিশুদের শুধু পড়ানো নয়,সময়,পরিশ্রম,এমনকী অর্থব্যায় অকুণ্ঠিত ভাবে করেছেন।
তিনি পরম ধৈর্যে ও যত্নে ছোটোদের সংগীত শেখাতেন।
ছোটোদের জন্যে লিখে , বই ছেপে , এমনকী তাদের পড়িয়ে , গান শিখিয়েই তিনি তৃপ্ত
থাকেননি । তাদের কথা ভেবে ১৯১৩ সালে 'সন্দেশ ' পত্রিকাও প্রকাশ করেন । বলাবাহুল্য
, 'সন্দেশ ' পত্রিকা প্রকাশ করে তার আদৌ লাভ হয়নি, বরং নিজেরই অর্থব্যয় করতে
হয়েছিল । তা সত্ত্বেও তিনি আমৃত্যু(ডিসেম্বর, ১৯১৫)'সন্দেশ ' - এর সম্পাদনা
তথা প্রকাশনা চালিয়ে গিয়েছেন । এমনকি নানাবিধ প্রতিকূলতায় মাঝে মাঝে বন্ধ
থাকলেও ' সন্দেশ ' উপেন্দ্রকিশোর উত্তরসূরিদের দ্বারা শতবর্ষ অতিক্রম করে এখনও
(২০২১ ) চলমান রয়েছে । বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী উপেন্দ্রকিশোর সঙ্গীতবেত্তা
হিসেবেও অনন্য ছিলেন । হারমোনিয়াম বাজানোয় তাঁর দক্ষতা সুপ্রমাণিত । কিন্তু
পরবর্তী কালে তিনি বুঝেছিলেন যে , হারমোনিয়ামের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে ভারতীয়
সঙ্গীতের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে এবং হচ্ছে । এতে সংগীত সাধক উপেন্দ্রকিশোরের চিন্তার
স্বচ্ছতা এবং দূরদর্শিতা প্রমাণিত হয় । কেননা , একসময় ‘বেতার জগৎ ' এর শ্রদ্ধেয়
স্টেশন ডিরেক্টর জেড এ বোখারী বেতার শিল্পীদের হারমোনিয়াম ব্যবহারের পক্ষপাতী ছিলেন
না। উচ্চাঙ্গ শিল্পীদের মধ্যে স্বনামধন্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় , পঙ্কজকুমার
মল্লিক , শচীনদেব বর্মণ , আলাউদ্দীন খাঁ প্রমুখ মনে করতেন যে , বিনা হারমোনিয়ামে
সঙ্গীত পরিবেশন করা উচিত ।
পরিশেষে বলা যায় , উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সঙ্গীত বিষয়ক সংকলন ' ভারতীয় সঙ্গীত ’ একটি অমূল্য গ্রন্থ । গভীর অধ্যবসায় ও আন্তরিকতার সঙ্গে দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সম্পাদিত হয়ে গ্রন্থটির নতুন সংস্করণ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে । ভারতীয় সঙ্গীত ' গ্রন্থটিকে গভীর অভিনিবেশ সহকারে পাঠ করলে সঙ্গীতবেত্তা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর স্বরূপটা অনুধাবনে সুবিধে হয় সেটা বলাই বাহুল্য।
** ড. বাসুদেব রায়-এর অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক পরিচিতি –
ড.বাসুদেব রায়ের
জন্ম ১৯৬২ সালে। কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশিত বই
মানব' (কাব্যগ্রন্থ), দ্বিতীয় বই রক্তের বাঁধন (উপন্যাস)। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়
পদচারণা করলেও প্রবন্ধ সাহিত্যের দিকে তার ঝোঁক বেশি। তদুপরি গবেষণামূলক প্রবন্ধ
তথা বই লিখতে তিনি অধিকতর উৎসাহী। গবেষণামূলক বইয়ের পাশাপাশি সাধু-মহাপুরুষদের
জীবনী-গ্রন্থ, একাঙ্কিকা ইত্যাদি সম্পাদনাও করেছেন তিনি।
ড.বাসুদেব রায়ের
বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। হার উল্লেখযোগ্য গবেষণা গুলোর মধ্যে রয়েছে
মনসামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ', চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল
কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে
সমাজ-চিত্র ইত্যাদি। তাঁর যৌথ রচনা ও উপেক্ষণীয় নয়।
বিভিন্ন
পত্র-পত্রিকায় বাসুদেব রায় নিরলস ভাবে লিখে চলেছেন। এছাড়াও নতুন করে তিনি একক ও যৌথভাবে বেশ কয়েকটি
গবেষণামূলক কাজে হাত দিয়েছেন।