Advt

Advt

Opar Banglar Pujo by Nalinaksha Bhattacharya, Tatkhanik Bangla / Bengali e magazine Online Reading Free

Opar Banglar Pujo by Nalinaksha Bhattacharya, Tatkhanik Bangla / Bengali e magazine Online Reading Free


আখ আর চালকুমড়ো বলি দিয়েও দুর্গা পুজো হয় এ অভিজ্ঞতা হল এপার বাংলায় এসে। ওপার বাংলায় যে ছোট্ট শহরে (এখন আর সে শহর যে ছোট নেই তা জানতে পারি পুরনো বন্ধুদের কাছ থেকে) থাকতাম সেখানে পাড়ার পুজো পুরোপুরি শাক্ত মতেই হত পাঠা বলি দিয়ে। সপ্তমী, অষ্টমী আর নবমী মিলিয়ে অন্তত গোটা পনের পাঠা বলি হত আমাদের পুজোয়। সপ্তমীতে দু’একটি, অষ্টমী নবমীতে অন্তত পাঁচটি করে পাঠা বলি হত যার জন্য হাড়িকাঠ আগে থেকেই তৈরি করা থাকত। পুজো কমিটির তরফ থেকে অষ্টমীতে শুধু একটি পাঠা বলি হত বাকি সব উৎসর্গ করতেন পাড়ার গৃহস্থরা। পুকুর পাড়েই ছিল আমাদের স্থায়ী পুজো মণ্ডপ কাজেই প্যান্ডেল খাটিয়ে পুজোর কোন আয়োজন হতনা। কুমোররা এসে প্রায় একমাস ধরে মূর্তি তৈরি করতেন আর আমরা ছোটরা সুযোগ পেলেই মন্ডপ ঘুরে আসতাম মুর্তি কতটা তৈরি হল দেখতে। এরকম পরিস্থিতিতে পাড়ায় পুজোর আবহাওয়া তৈরি হয়ে যেত মহালয়ার আগে থেকেই। পুজোর চাঁদা পাঁচ দশ টাকার মধ্যেই সীমিত ছিল আর এই নিয়ে কোনদিন জোড়াজুড়ি বা ঝগড়া বিবাদ হয়েছে শুনিনি বা দেখিনি আমরা। আমাদের পুজোয় তেমন আড়ম্বর ছিলনা, ভিআইপি এসে ফিতে কেটে উদ্বোধন করতেননা বা স্টেজ বেঁধে নামি দামি শিল্পির গান বাজনা দিয়ে শ্রোতাদের আনন্দ-বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতনা সে সময়। নিয়ম নিষ্ঠা মেনে পূজার্চনা, আরতি, অঞ্জলি, চন্ডীপাঠ এসবই হত আর পাঠাবলি এই পুজার একটি বিশেষ অঙ্গ ছিল যা এপার বাংলায় এসে দেখতে পাইনি আমি।

পাঠা বলির সময় মহিলারা সাধারণত মন্ডপে থাকতেননা, কিন্তু আমরা ছেলেরা মন্ডপ ঘিরে দাঁড়িয়ে যেতাম এই অভিনব দৃশ্য দেখতে। অন্তত শ’ খানেক লোক ভিড় করতেন পাঠা বলি দেখতে। পুকুরে স্নান করিয়ে মাথায় লাল তিলক দিয়ে, মন্ত্র পড়ে  মায়ের নামে উৎসর্গ করে পাঠাগুলোকে যখন হাড়িকাঠের কাছে নিয়ে আসা হত তখন ওরা ঠিক বুঝতে পারত ওদের অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমাদের পাড়ার রামবাবু ছিলেন পাঠা বলিতে ওস্তাদ। মালকোঁচা দিয়ে ধুতি পরে, পুরুতের দেওয়া লাল তিলক আর মন্ত্রপূত রামদা নিয়ে যখন রামবাবু এসে দাঁড়াতেন তখন ঢাকে বলির বাদ্য বেজে উঠত বেশ জোরে, পাঠার ভ্যা ভ্যা আওয়াজ আর শুনতে পাওয়া যেতনা। পাঠা হাড়িকাঠে ফেলার পর মাথাটা শক্ত করে ধরতেন পুরুতমশাই আর পা ধরতেন আর একজন বলশালী পাড়ার যুবক। দু’জনের টানাটানিতেই পাঠার প্রাণ চলে যাবার যোগাড় হত, কাজেই রামবাবুর রামদা কচু কাটার মত পাঠার গলা কেটে বেড়িয়ে আসত। রক্তের ছিঁটে এসে লাগত দু’একজানের গায়ে। বলির পরে একেকটি পাঠার রক্ত এক একটি মাটির সরায় কলার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হত। পাঠার মুন্ডগুলোও সাজিয়ে রাখা হত প্রতিমার সামনে পুজোর জন্য। পাঠার মাথাগুলো পুরহিতের প্রপ্য ছিল। পুজোর পরে রক্তমাখা, মন্ত্রপূত কলা খাওয়ার জন্য পাড়ার দাদাদের মধ্যে রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যেত কেননা ওই কলা খেলে নাকি শরীরে অসুরের শক্তি আসে। পাঠা ছাড়াবার কাজ করত ঢাকি, পাঠার চামড়াগুলো তারই প্রাপ্য আর ওই চামড়া দিয়েই ঢাক তৈরি হত। বলির পাঠার অর্ধেকটা  পাঠিয়ে দেয়া হত যিনি পাঠা উৎসর্গ করেছেন তার বাড়িতে, আর বাকি অর্ধেকটা টুকরো করে প্রসাদী মাংস হিসেবে পাড়ার সব বাড়িতে বিলি করার কাজটা করতাম আমরা। প্রতি ঘরে চার পাঁচ টুকরো মাংস বিতরণ করতাম আমরা। বাজার থেকে মাংস এনে প্রসাদী মাংসের সঙ্গে মিশিয়ে ঘি গরম মশলা দিয়ে রান্না করে পুজোর মাংস খেতেন সবাই।

শুধু মাংস বিতরণ নয়, প্রত্যেক বাড়ি থেকে নারকেলের ছোবড়া সংগ্রহ করার কাজটাও করতাম আমরা ছোটরা। সন্ধ্যার সময় আরতির পর পাড়ার দাদা-দিদিরা ধুনুচি নৃত্য করতেন, আমাদের কাজ ছিল মালশাগুলোকে ছোবড়া ঠেসে তৈরি করে দেওয়া আর নৃত্য করবার সময় মাঝে মাঝে ওগুলোতে ধুপ ছড়িয়ে দেওয়া। নবমীর দিন সন্ধের দিকে নাচ খুব জমে উঠত, কেউ কেউ মুখে একটার উপর একটা তিন চারটি ধুনুচি সাজিয়ে, দু হাতে আরও চারটি ধুনুচি নিয়ে অদ্ভুত নৃত্য করতেন মনে পড়ে। ছোটখাট অগ্নিকান্ড যে কখনো ঘটতনা তা নয়, তবে বড় রকম কোন দুর্ঘটনা ঘটতে দেখিনি কোনদিন। এই নৃত্যের মধ্যে সমবেত দর্শকদের বিশেষ আনন্দ দিতেন আমাদের নান্টুদা যাকে দাদারা লাফিং গ্যাস খাইয়ে নামিয়ে দিতেন নাচের আসরে আর নান্টুদা হা হা হু হু করে হেসে যেতেন ঘণ্টা দুয়েক।

পুজোয় বাজি পটকা ফাটাতাম আমরা তবে আর্থিক কারণেই তা অনেকটা সীমিত ছিল এখনকার তুলনায়। পাড়ার পুজোতে ব্যস্ত থাকতাম আমরা কাজেই পুরো শহর ঘুরে পুজো দেখে বেড়ানোর কোন আগ্রহ ছিলনা আমাদের। তবু সপ্তমী বা অষ্টমীতে  অন্য পাড়ায় গিয়ে একদুটো ঠাকুর  দেখে আসতাম আমরা। দেখতে দেখতে পাঁচটা দিন কেটে যেত কিভাবে টের পেতামনা। দশমীর রাতে পাড়ার পুকুরেই প্রতিমা বিসর্জন হয়ে যেত রাত আটটার মধ্যে। শান্তি জল এবং বিজয়ার কোলাকুলি, নমস্কার ইত্যাদি শেষ হয়ে যাবার পরে মন্ডপের কাছেই একটা বাড়ির ছাতে মাইক লাগিয়ে ‘বিসর্জন’ শ্রুতি নাটক করতেন বড়রা যা পাড়ার সবাই ঘরে বসেই শুনতে পেতেন। পরের দিন সকাল থেকেই বিজয়া করতে বেরিয়ে পড়তাম আমরা নাড়ুর লোভে। এখনকার মত নিমন্ত্রণ করে বন্ধু বা প্রতিবেশিদের বিজয়ায় মিস্টি খাওয়াবার কোন রেওয়াজ ছিলনা ওপার বাংলায়। বাইরে থেকে কেনা মিস্টি কেউ কাউকে খাওয়াতেননা বিজয়াতে কেননা সবার বাড়িতেই তখন প্রচুর নাড়ু আর মুড়ি এবং খইয়ের মোয়া তৈরি হত।

ষাট বছর আগে দেখা ওপার বাংলার দুর্গা পুজার যে বর্ণনা দিলাম এখানে তা এখনও অব্যাহত আছে কিনা তা বলতে পারবেন শুধু তাঁরাই যারা এখনও ওপারেই রয়ে গেছেন।

 

 লেখক পরিচিতি

জন্ম এবং শিক্ষা কলকাতায়; কর্মজীবন দিল্লিতে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রালয়ে। গল্প লেখার শুরু ষাটের দশকের শেষ দিকে। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে আসছেন গত পঞ্চাশ বছর ধরে। ইংরেজিতে দেশে এবং বিদেশে ওঁর কিছু গল্প এবং তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। বিবিসি থেকেও ওঁর কয়েকটি গল্প প্রচারিত হয়েছে। বাঙলায় একটি উপন্যাস এবং একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দেশ, আনন্দবাজার, সাপ্তাহিক বর্তমান, নবকল্লোল, কালি ও কলম(বাংলাদেশ) এবং দিল্লি ও কলকাতার অনেক সাহিত্য পত্রিকায় গল্প লেখেন উনি। তাৎক্ষণিক ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত গল্প লেখেন। দিল্লি থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা ‘ কলমের সাত রঙ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত আছেন।