জানা অজানা
কাজ করছিলাম ব্যাঙালুরুর একটি আধুনিক ল্যাবরেটরিতে।
রাডারের অ্যান্টেনাকে স্ক্যানিং করাতে হয়, যাতে সে অনেকটা জায়গা নিয়ে তথ্য বা সিগন্যাল সংগ্রহ এবং বিতরণ করতে পারে। রাডারের চোখ ( অ্যানটেনা ) যাতে সেই কাজ করতে পারে সে জন্য মানুষের মাথা ঘোরানোর মতো অ্যনটেনাকেও ঘোরাবার ব্যবস্থা রাখা হোত। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম,তখন ঘোরাবার কাজটা ইলেট্রো-মেকানিক্যালিই করতে হোত। কিন্তু পরে ইলেক্ট্রনিক্যালি স্ক্যানিংও করানো সম্ভব হয়েছিল। মাইক্রোস্ট্রীপ অ্যারে ব্যবহার করে অ্যারেগুলোকে পর্যায়ক্রমে সুইচিং অন এবং অফ করে ওই কাজটি করা হোত। ওই সুইচিং-এর সময়ে খুব কম সময়ের জন্য একটা সার্জ সৃষ্টি হোত। সেই সার্জের জন্য সমস্ত ব্যাপাটায় ত্রুটি এসে যাবার সম্ভাবনা ছিল। সে জন্য যে ইলেক্ট্রনিক কম্পোনেন্টটি সুইচিং করানোর জন্য ব্যবহার করা হোত, সেটিকে ঘিরে পাহারাদার কম্পোনেন্ট বসানো হোত।
আমার কাজটা ছিল (১) ওই অ্যান্টেনা বানানো, (২) সুইচিং কম্পোনেন্টকে ঘিরে পাহারাদার কম্পোনেন্ট বসানো, (৩) ওই অ্যান্টেনাতে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন পাঠিয়ে অ্যান্টেনা কী রকম অর্থাৎ কতটা কম ত্রুটিতে কাজ করছে পরীক্ষা করা। নানা ফ্রিকোয়েন্সিতে বিভিন্ন পাওয়ারের রেডিয়েশন পাঠাবার ব্যবস্থা ছিল বলেই এক সপ্তাহের জন্য গিয়েছিলাম ওই ল্যাবরেটরিতে। রোজই কাজ শেষ করতে রাত নটা বেজে যেতো। কিন্তু তা হলেও কাজটা আমার কাছে সেই সময় সম্পূর্ণ নূতন ধরণের ছিল। তাই আমার উৎসাহও খুব বেশিই ছিল। উৎসাহ এখনও আছে। কিন্তু এই বৃদ্ধকে-কে আর কাজে লাগাবে ?
সেদিনও রাত আটটা বেজে গিয়েছিল। আমার যে বন্ধু রেডিয়েশন দিচ্ছিল, সে আর আমি মিনিট দশেকের জন্য কফি কর্নারে গিয়েছিলাম। তারপর ফিরে এসে বন্ধু ল্যাবরেটরির এক পাশে দাঁড়িয়ে যন্ত্রপাতি সাজাচ্ছিল। আমি ঠিক তার উল্টোদিকের দেওয়ালের কাছে গিয়ে বন্ধুর দিকে পিছন ফিরে আমার বানানো অ্যান্টেনাটা সেট করছিলাম। হঠাৎই....
আমার বন্ধুটি ঠাট্টা করেই আমার মাথায় মেরেছিল এক বিরাশি সিক্কার চাঁটি। সমবয়স্ক বন্ধু ! চাঁটি তো মারতেই পারে ! কিন্তু এতো জোরে ! চাঁটি আমাকে বিষম চটিয়ে দিয়েছিল। আমি ওর দিকে ফিরে ওকে কিছু কড়া কথা বলতে গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম - ও দেওয়ালের দিকে মুখ করে রেডিয়েটর সাজাচ্ছে। আমি সবই বুঝেছিলাম। আমার মাথায় চাঁটি মেরেই আমার দিকে পেছন ফিরে যন্ত্র সাজাবার ভান করছে।
আমি ওর কাছে গিয়ে বলেছিলাম - রেডিয়েশন না পাঠিয়ে চাঁটি মারলে
কেন ? আর অ্যান্টেনা ফেলে আমার মাথাতেই বা কেন ?
আমার কথা শুনে বন্ধুটি আমার দিকে মুখ ফিরিয়েছিল।
অত্যন্ত বিস্ময়ের সঙ্গেই জিজ্ঞেস করেছিল - কী হয়েছে ?
বন্ধুর মুখে দুষ্টুমির কোনো চিহ্নই ছিল না। ছিল গভীর বিস্ময়।
ওকে চাঁটির কথা বলেছিলাম।
দুজনে অনেক খুঁজেও চাঁটির উৎসকে গ্রেপ্তার করতে পারিনি। শেষে
দুজনেই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম - ভূতের কাণ্ডই হবে। ঘাড় মটকাবার সাহস হয়নি,
চাঁটি মেরে ভয় দেখিয়েছে। খুঁজে যাতে না পাই তাই আমাকে চাঁটি মেরেই বাইরের
কোনো গাছে উঠে বসে বসে মজা দেখছে।
সেই রাতে কাজ শেষ হতে সাড়ে নটা বেজে গিয়েছিল। বেরিয়ে আসবার আগে যন্ত্রপাতির সুইচ অফ করতে করতে হঠাৎই বন্ধু থেমে গিয়েছিল।
আমাকে বলেছিল - এই যে আমাদের ভূত !
আমি তাড়াতাড়ি ওর কাছে গিয়েছিলাম।
তারপর দুজনে মিলে অনেকক্ষণ ধরে ভূত বাবাজিকে দেখেছিলাম। হ্যাঁ, সত্যই সে রাতে আমরা দুই বন্ধু সচক্ষে ভূত দেখেছিলাম।
বন্ধু একটি হাই পাওয়ার মাইক্রোওয়েভ রেডিয়েটরের দিকে আঙুল তুলেছিল।
রেডিয়েটরের পাওয়ার কর্ডের টপটা প্লাগে লাগানোই ছিল। পাশের সুইচটা
কফির নেশায় অফ করতে ভুলে গিয়েছিল বন্ধু। ফলে হাই ফ্রিকোয়েন্সির হাই পাওয়ার
রেডিয়েশন হয়েই যাচ্ছিল। ওই যন্ত্রের অ্যানটেনার ডাইরেক্টিভিটির মধ্যেই আমি ছিলাম।
ফলে ওই হাই পাওয়ার মাইক্রোওয়েভ এসে আমার মাথায় ধাক্কা দিয়েছিল। সেটাকেই আমি
'চাঁটি' ভেবেছিলাম।
সে রাতে আমরা দুজনে হাসতে হাসতেই ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে
এসেছিলাম।
বলে রাখা ভালো - এর পরে দিন সাতেক আমার মাথায় যন্ত্রণা ছিল।
কিন্তু আমি কাজ করবার একটা নূতন এলাকার সন্ধানও পেয়েছিলাম। ভূত আমাকে যন্ত্র-রেডিয়েশনের পরিমণ্ডল থেকে টেনে নিয়ে গাছ-রেডিয়েশন আর মানুষ-রেডিয়েশন - ওই পথের মুসাফির বানিয়েছিল।
এখন মাঝে মাঝে ভাবি - চাঁটি মেরে নতুন কিছু শেখবার পথে ঠেলে দিয়েছিলেন যিনি, সেই ভূত-মশায় যখন মানুষ ছিলেন, তখন কি শিক্ষকতা করতেন?
লেখক পরিচিতি -
তরুণকুমার দে নরেন্দ্রপুরের রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক কলেজের পদার্থ
বিজ্ঞানের স্নাতক।পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রনিকস অ্যাণ্ড টেলি-কম্যুনিকেশন বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী এবং বায়োলজিক্যাল এফেক্টস অব ইলেকট্রিক অ্যাণ্ড ম্যাগনেটিক ফিল্ডসে পি এইচ ডি অর্জন করেছেন। তিনি প্রায় তিন
দশক ধরে সাধারণ মানুষের কাছে বাংলাভাষায় প্রযুক্তির তথ্য পরিবেশন করছেন, যে প্রচেষ্টার একটি ফসল তাঁর ‘অজানা
দূষণ’ গ্রন্থ।
যাত্রার বিশিষ্ট
পালাকার ব্রজেন্দ্রকুমার দে-র কনিষ্ঠ পুত্র। ছেলেবেলা থেকেই গল্প, প্রবন্ধ ও নাট্যজাতীয় রচনায়
আগ্রহী।
প্রকাশিত গ্রন্থ : বধূ বিনোদিনী, অজানা দূষণ, পালাকার অঘোরচন্দ্র কাব্যতীর্থ, পালাকার ব্রজেন্দ্রকুমার দে, যাত্রা নাটক প্রসঙ্গ, প্রসঙ্গ : ব্রজেন্দ্রকুমার দে।
অভিনীত যাত্রাপালা: বধূ বিনোদিনী, সুলতান মামুদ, চাঁদ সদাগর, নসীব, আলোর সারথি (ব্রজেন্দ্র-জীবনী)।