যূথিকা চক্রবর্ত্তী-র আগের লেখাটি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
সীতাপুরে পৌছে প্রথম কাজ হল বাড়ীতে একটা খবর পাঠান । কিন্তু মোবাইলের টাওয়ার পাওয়া গেল না । ততক্ষণে আমি সবার মাসীমা হয়ে গেছি এবং খুব সপ্রতিভ , সাহসিনী ও স্বাবলম্বী । সুতরাং আমার নম্বর দিয়ে দিলাম , ওদের খবর পৌছলে আমার খবরও পৌছে যাবে । সীতাপুরে রাত কাটিয়ে পরদিন সকাল ৭ টায় রওনা হলাম উত্তর কাশীর পথে এবার পথের সঙ্গী অলকানন্দা — দুধগোলাজল নিয়ে নাচতে নাচতে বয়ে চলেছে । রাস্তায় যেতে যেতে দুবার আমাদের বাস ছোট দুটো ঝরণার জলের উপর দিয়েই গেল । পথের বাঁ ধারে পাহাড় ঘন দেওদার আর পাইনে ছাওয়া। ডানদিকে গভীর খাদ তাও ঘন সবুজে মোড়া । গাড়ী পড়লে গাছে আটকাবে, তবে পড়ে কাজ নেই , বাবা ! পাহাড়ের ঢালে ঢালে থাক কেটে কেটে সবজীর চাষ । মনে হচ্ছে যেন সাজান । কিন্তু বুঝতে কিছুমাত্র অসুবিধা হয়না যে কি পরিমাণ পরিশ্রম আর প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে গাড়োয়ালীরা নানান রকমের ফল আর সবজীর চাষ করে । এপথে বাস যাত্রা একটুও বিরক্তিকর নয় । সুন্দরী অলকানন্দার নাচ দেখতে দেখতে চলেছি । ইতিমধ্যে কথা হল যোশীমঠ পৌছবার ৪ কিলোমিটার আগে অন্য রাস্তায় গিয়ে আউলি যাওয়া হবে । সেজন্য সবাইকে ৩০ টাকা বেশী দিতে হবে । সবাই রাজী হল । সুতরাং এলাম আমরা আউলিতে কেবলকার চড়ব বলে । ৩.৯ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ বসেছে যোশীমঠ আউলির মাঝে । এই কারে যেতে যেতে দেখা যাবে যদি কুয়াশা না থাকে অনেক শৃঙ্গ । তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নন্দাদেবী , মানা , নর , কামেট , নীলকণ্ঠ ইত্যাদি । ' কার ’ - এর ভাড়া সে সময় ৩০০ টাকা করে ছিল। আর গেলেই চড়া যাবেনা । যারা তখন যাচ্ছে বা ওপারে— পৌঁছে গেছে তারা ফিরবে এবং প্রতি বারেই ২৫ জন হতে হবে কম হলেও হবে না বেশী ত চলবেই না । আমি প্রথম বারেই যেতে সুযোগ পেলাম । দেওদারে ছাওয়া আউলির পাহাড়ীঢালে মানুষের বসতি যেমন তেমনই ধাপ কেটে চাষ এবং দামী দামী সব ফলের গাছ এখানে ।
আউলি পর্ব মিটিয়ে আমরা যোশীমঠে এলাম সন্ধ্যে ৭ টার সময়ে । তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে ।
তখন সেখানে । যোশীমঠে রয়েছেআদিগুরু শঙ্করাচার্যের গড়া চারমঠের একমঠ জ্যোতির্মঠ - এখানে আছে নৃসিংহের মন্দির – শীতে , বদরীর পুজাও হয় এই মন্দিরে ।
নবদুর্গার অষ্টভূজ গনেশের মন্দির আছে — আর
আছেস্ফটিক শিবলিঙ্গও ২৪০০ বছরের পুরাণ কল্পবৃক্ষ। আউলিতে সারা বিকেল কাটাতে গিয়ে
দেরী হল যোশী মঠে পৌঁছতে । তার
উপর বৃষ্টি । উৎসাহী দু'একজন তারমধ্যে হাওড়ার বিশ্বনাথ
আঢ্য ও মিনতি আঢ্য ছাতা মাথায়
বের হলেন কিন্তু আমার তো কোন উপায় নেই । যদিও শঙ্করগুম্ফা দেখার আমার
খুবই ইচ্ছা ছিল ।
পরদিন সকালেই বৃষ্টি । স্নান খাবার সেরে একটা ছাতা জোগাড় করে
ম্যানেজারকে বলে একজন গাইড যোগাড়
করে বেড়িয়ে পড়লাম। এজীবনে আর তো আসা হবে না তাই যেভাবে যতটুকু পারি দেখে নেব । বৃষ্টি থামলেই বাস
ছাড়বে – ম্যানেজারের হুশিয়ারী মাথায় নিয়ে বেড়িয়ে
গেলাম । কেবল বড়বড় ধাপের সিঁড়ি তায় পিছল শ্যাওলাধরা ।তবু কষ্ট করে করে গাইডের হাত ধরে আস্তে আস্তে পথ চলে যা যা দেখার সব
দেখেই ফিরেছি । বৃষ্টি ধরে গেছে । একে একে সবাই বাসে উঠছে আমিও উঠে বসলাম । শাড়ীর
প্রায় হাঁটু পর্যন্ত ভেজা এবং কাদামাখা। তবে গাইড আমাকে
টেনে টেনে চড়াই পথ গুলোতে
তুলেছে বলেই সব দেখতে পেলাম। এবারে আর ম্যানেজারের বকুনি নয় – বিধ্বস্ত চেহারা দেখে হেসে বলল – ধন্যবাদ মাসিমা , সব দেখেছেন। বাস খুব আস্তে
আস্তে চলতে লাগল চড়াই এবং পিছল পথ । প্রায় ৮ টার সময় আমরা বালানন্দ স্বামীর
অতিথি নিবাসে বদরীনাথজীর মন্দিরের পাশেই পৌছালাম । পৌছে ঘর পেতে পেতে রাত ৯ টা
বেজে গেল তাই সে রাতে আর দেবদর্শন হল না । রাতে আমাদের পান্ডাজী । এলেন । এরা
বাঙ্গালী – তিনপুরুষ ধরে এখানে পান্ডার কাজ করছেন । তার
সাথে সব কথা হল পূজার টাকা দিয়ে দিলাম।
পরদিন সকালে উঠে কুন্ডেস্নান করব বলে বেড়িয়ে পড়লাম । প্রথমে
গেলাম মেয়েদের যেটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সেখানে
গেলাম। সেখানে ঢুকে খুব দুর্গন্ধ পেলাম,
যারা স্নান পৃথক কুন্ডে করছিল তাদের দেখেও ইচ্ছা হলনা এখানে স্নান করার। বাইরে
বেড়িয়ে দেখি ছেলেদের স্নানের কুন্ড প্রায় ফাঁকা ।
পাড়ে জামাকাপড় রেখে ( যতটা সম্ভব নজর রেখে ) নেমে পড়লাম কুন্ডের জলে। বেশ গা
ডুবিয়ে ডুবিয়ে আরামে স্নান করলাম । বেশীক্ষণ থাকতে নেই জানি কারণ জলে সালফার আছে , তাই তিনটে ডুব দিয়েই উঠে
পড়লাম । উঠব তো কিন্তু কি করে ? নামার সময় তো সহজেই নেমেছিলাম কিন্তু কেউ হাত
না ধরলে ওঠা যে অসম্ভব । অসহায়ের মত দাড়িয়ে আছি। ‘কৌইবাত
নেহি , আইয়ে মাতাজী ’ – বলে
একজন হাত বাড়ালেন । হাত ধরে উঠে পড়লাম । জামাকাপড় কুন্ডের পাড়েই রেখেছিলাম ।
পরে নিলাম সব কিন্তু শালটা পেলামনা । যা যাবার তা যাবে ও নিয়ে কোনদিনই আমি বিচলিত
হইনা তাই এখনও হলাম না । ইতিমধ্যে মিনতি ও বিশ্বনাথ স্নানে এল। ওদের স্নান হলে ওদের
সঙ্গে মন্দিরে গেলাম দর্শন করব বলে । পুজা তো পান্ডাজীর
হাতদিয়ে আগেই পাঠিয়েছি। কী প্রচন্ড ভীড় মন্দিরের ভিতরে বাইরে । ভীড় ঠেলে
ঢুকলাম কোনরকমে ভিতরে কিন্তু মিনতিদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম । আমি ছোটখাট মানুষ ভীড়ে
আমার খুব ভয় । এখানেই হল ভিড়ের চাপে দেবস্থানে পৌছে , ধূপের ধোয়ায় আচ্ছন্ন চারদিক , হাত
বাড়ালাম হাতে কে যেন কি দিল মুঠো করে প্রণাম জানিয়ে বাইরে আসার চেষ্টা করতে
লাগলাম । এত চাপ , তায় ধূপের ধোয়া প্রাণ যায় আর কি
। অতি কষ্ঠে হাতড়ে হাতড়ে দেয়াল পেলাম একটা তাই ধরে ধরে দরজাও পেলাম একসময়ে মনে
হল কেউ যেন হাত ধরে টেনে বের করে আনল । বাইরে এসে অতি ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লাম । কিছুক্ষণ বসে থেকে আস্তে আস্তে
উঠে মন্দির পরিক্রমা করলাম । অপূর্ব জায়গা । প্রাঙ্গণে কিছু সামান্য জিনিসের
কয়েকটা দোকান,সেখানে পূজার উপকরণই প্রধান। কষ্ট
হলেও আস্তে আস্তে ঘুরে ঘুরে সব দেখে বাইরে এলাম । এতক্ষণে খেয়াল হল হাতের মুঠিতে
কি যেন আছে । মুঠি খুলে দেখি একটা খেজুর আর একটা হরিতকি । মাথায় ঠেকিয়ে খেজুরটা
খেয়ে নিলাম আর হরিতকিটা ব্যাগে রেখে দিলাম । কিন্তু মনে শান্তি নেই দেবদর্শন তো হয় নি । এবার অলকানন্দা পার হয়ে বাইরে বেড়িয়ে
এসে মন্দিরের দিকে মুখ করে পথের ধারে একটা পাথরের উপরে বসলাম । মন্দিরের দিকে তাকিয়ে
প্রাণভরে গেল । অপূর্ব দৃশ্য । ৩১৫৫ মিটার উঁচুতে বদরীক্ষেত্র । মন্দিরের পেছনেই
নীলকণ্ঠ পাহাড়ের পাদদেশে ঋষি গঙ্গা ও অল কানন্দার সঙ্গম বদ্রীনাথে । শ্বেত শুভ্র
কিরীটশির নীলকণ্ঠ পাহাড় ,মন্দিরের দুপাশে প্রহরীর মত
দাঁড়িয়ে নর ও নারায়ন দুইপর্বত । প্রবাদ – মহাভারতের
কৃষ্ণ ও অর্জুন পূর্বজন্মে নারায়ণ ও নর ঋষিরূপে এখানে তপস্যা করেন । এমন সুন্দর
প্রাকৃতিক পরিবেশে মন্দিরটি , যে মুগ্ধ হয়ে বসে বসে অনেকক্ষণ
দেখলাম ।
বর্তমানের মন্দিরটি গাড়োয়ালের রাজার প্রতিষ্ঠিত পরে
রানী অহল্যাবাঈ মন্দিরের শিখর সোনায় মুড়ে দেন ।
এখান থেকে যাওয়া যেতে পারে ভবিষ্য বদরীতে । তবে
দুরূহ সে চড়াই । যাওয়া হবে ৩৫০৬ মি. উঁচুতে পাথরের গায়ে রূপ নিচ্ছে ভবিষ্যবদরী
। প্রবাদ – কলির শেষে বদরী বিশাল যেদিন চাপা
পড়বে নর ও নারায়ণ পর্বতে,তখন দেব
পূজা হবে এখানে । নানান কিংবদন্তী আছে বদরী বিশালকে নিয়ে । অতীতের কেশবপ্রয়াগ আজ
হয়েছে বদরিকাশ্রম । দেবী লক্ষ্মী স্বয়ং বদরী অর্থাৎ কুলগাছ হয়ে ছত্রাকারে ছায়া
দেন নারায়ণকে । এখানেই আছে পঞ্চশীলা আর মন্দিরকে ঘিরে পঞ্চতীর্থ –ঋষি গঙ্গা , কুর্মধারা , নারদকুন্ড , প্রহ্লাদিধারা ও তপ্তকুন্ড । বসে বসে দেখছি আর মন কোথায় কোথায় চলে যাচ্ছে
যেখানে এই প্রায় ভগ্ন শরীরটা যেতে পারবেনা । সন্ধের পর আর একবার চেষ্টা করলাম মন্দিরে প্রবেশের কিন্তু তখন
যেন আরও ভীড় । সেদিন ভারতের
বিভিন্নপ্রান্তের অগণিত যাত্রী সমাগমে মন্দির প্রাঙ্গণ মুখরিত। দুশ্চিন্তা নিয়ে আশ্রমে ফিরলাম । দেখলাম আমাদের দলের দু’জন ভদ্রলোক আলোচনা
করছেন ৮টার পরে নাকি ভিড় কমতে পারে।শুনে আমি বললাম, “আমি যাবো আপনাদের সাথে । ওরা রাজী হলেন , বললেন “৮টার মধ্যে তৈরী হয়ে ধর্মশালার গেটে থাকবেন, আমরা
ডেকে নেব।” আমি
৭ টা থেকেই গেটে দাঁড়িয়ে আছি আর ভাবছি দুপুরের সেই ভীড়ের কথা । তবু যাই হোক
অপেক্ষায় আছি যদি দেবতাপ্রসন্ন হন তবে দর্শণ কি পাব ? রাত ৯ টার পরে দেখলাম ওরা দুজন ফিরছেন । আমি বললাম আমাকে ডাকলেন না ,আমি কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি । ওরা বললেন – “ খুব ভীড় আমরা ঢুকতেই পারিনি ।
সত্যিমিথ্যা ভগবান জানেন — তবে সেটা ঠিক যে সেদিন অসম্ভব ভীড়
ছিল । আমি কিন্তু হাল ছাড়বার পাত্রী নই । ওদের ব্যবহারে কেন জানি খুব অপমান বোধ হল। এ জীবনে আর আসা হবে না সুতরাং দর্শনের কী উপায়
হবে ? রাত্রি ১০ টার সময় বিষণ্ণ বদনে Reception -এই বসে
আছি এমন সময়ে পান্ডাজী এলেন । ওনাকে বললাম আমার মনোবাসনা। দেব দর্শন না করেই ফিরে যেতে হবে ? দুঃখের কথা শুনে উনি বললেন- মা , শান্ত হন । দর্শন হবে , নিশ্চয়ই হবে , তবে কষ্ট করতে হবে । ভোর ৪ টার
সময়ে মন্দিরের চারদিকের দরজাই খুলে দেওয়া হয় । সেইসময়ে যদি যেতে পারেন তবে
দর্শন হবে খুব ভাল । শুনে মন শান্ত হল। তখনই বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে নিলাম কিভাবে
মন্দিরে যাব । সদর দরজা দিয়ে যেতে হলে অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হবে । আমাদের আশ্রম
থেকে মন্দিরের স্থান অনেকটা নীচে । রাস্তা পার হয়ে সরাসরি যদি নেমে যেতে পারি তবে
সোজা নেমে যাব মন্দির প্রাঙ্গণে। দরজা খুলুক আর নাই খুলুক । তবে সিঁড়িও রয়েছে তিনধাপ – প্রত্যেক
ধাপে পাঁচ-ছটা করে সিড়ি। ব্যস আর কিছু
চিন্তা নাকরে ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম । কেদারে রাত জেগেছি , ভোর ৪ টায় লাইনে দাঁড়াতে হবে বলে , এখানেও রাত জাগব ভোর ৪ টায়
দেব দর্শন পাব বলে । তবু একটু তন্দ্রামত এসেছিল । রাত ৩ টায় ঘুম ভেঙে গেল সংগীতের
সুরে । উঠে জানলায় দাঁড়ালাম । আকাশে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে চাঁদ এক আধটু দেখা যাচ্ছে । আলোছায়া পরিবেশ দেওদার
গাছের জন্য । আরও কতরকম গাছপালা , তার মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে ডানদিকে
নীলকণ্ঠ পাহাড় , আর ভেসে
আসছে উদাত্ত সুরে বেদগান সমবেত কণ্ঠে । কী অপূর্ব আবহ আর পবিত্র পরিবেশ । জানলায়
দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম সেই সুর আর দেখছিলাম নীলকণ্ঠ পাহাড়ের বুকে চাঁদের আর মেঘের লুকোচুরি খেলা । মন্ত্রমুগ্ধের মত
দাঁড়িয়ে থাকলাম জানলায় কিছুক্ষণ । মনে এল সুরদাসের প্রার্থনা , “ তোমারে হেরির আমার দেবতা ,হেরিব আমার হরি – তোমার আলোকে জাগিয়া রহিব অনন্তবিভাবরী । ”
পৌনে ৪ টেয় বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে নিঃশব্দে ।
আশ্রমটি তিনতলা এবং কতদিকে যে কত
সিড়ি ভেঙ্গে নামতে উঠতে হয় তা দুদিনেও ঠিক করতে পারিনি । যা হোক নিশুতি
রাত্রিশেষে এ সিঁড়ি ওসিঁড়ি করে একতলায় নেমে এলাম । এমন সময়
হুড়মুড়িয়ে ঢুকলো
একবাস ভর্তি ভিনদেশী
যাত্রী । সেই সুযোগে খোলা গেট
দিয়ে বাইরে এসে গেটের পাশে দাঁড়ালাম । রাস্তায় বৃষ্টির জমা জল এখানে ওখানে আলো
আছে কিন্তু রাস্তা মনুষ্যহীন ,ভয়ে ভয়ে একবার পা বাড়াই আবার
পিছিয়ে আসি। এই করে মনে জোর এনে বেরিয়েই গেলাম । রাস্তা পার হয়ে ওপাশের ঢালে আর
সিড়ি দেখতে পাইনা আলো আঁধারিতে । শেষে বসে বসেই ছেচ্ড়ে ছেচ্ড়ে নেমে গেলাম খানিকটা । তারপর মাঝের সিড়িটা পেলাম । নামলাম সিড়ি বেয়ে
তারপর আর তৃতীয় সিঁড়িটা না পেয়েই আবার ছেচ্ড়ে নেমে গেলাম । মন্দির
প্রাঙ্গণের সীমানার মধ্যে । সামনে এসে দেখি ৫ জন এর মধ্যেই লাইনে দাঁড়িয়ে গেছেন
আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম । ক’মিনিটের মধ্যে পৌছে গেলাম মন্দিরের
দরজায় । বহুমূল্য রত্নশোভিত এবং ফুলমালায় সুসজ্জিত লক্ষ্মী গোবিন্দ । আলোয় আলোময় হয়ে আছে ঘরটা ।গোবিন্দের গলার তুলসীপাতার গোঁড়ের মালাটি মুৰ্ত্তির পা পর্যন্ত কী যে সুন্দর দেখাচ্ছে
। প্রাণভরে বেশকিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম । ১০/১৫ মিনিটের মধ্যেই মন্দির
পরিক্রমা সেরে নিচে নেমে এলাম – সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলাম । তখন
বুঝলাম দুপুরে যেখানে পূজা দেওয়া হয়েছে এবং ভিড়ের চাপে যেখানে পৌছেছিলাম
নিশ্চয়ই সেখানে দেবশীলায় পুজা হয়েছে । এখানে লক্ষ্মী গোবিন্দের আলাদা মুর্তি। এবার
ফেরার পালা – দর্শনের আগ্রহে আসার সময়ে যেখান
দিয়ে পেরেছি নেমে এসেছি এখন ওভাবে তো ওঠা যাবে না । তবে এখন আর একটু পরিষ্কার হয়েছে – সিঁড়ি গুলোকে খুঁজে নিতে হবে । একে ওকে
জিজ্ঞেস করে এগিয়ে চললাম – আর ডানদিকে খুঁজছি সিঁড়ি । আসলে সিড়িটা ছেড়ে এসেছি , বৃষ্টি পড়া আরম্ভ হয়েছে । একজনকে আবার জিজ্ঞেসতেই কি যে বলল ঠিক বুঝলাম না ।
তবে মনে হল এই এত ভোরে
পিছনদিকের সিড়ি পথ খুঁজছি কেন? যা হোক দূরে একটা লোককে দেখিয়ে
বলল ওর পিছন পিছন যাও ‘ আশ্রমমে পৌছ যাওগে । বেশ
তাড়াতাড়ি লোকটার পিছন নিলাম – দেখলাম লোকটা সিঁড়িতে উঠে যাচ্ছে । সিঁড়ির কাছে এসে দেখি লোকটা উধাও । টিকটিকি নাকি রে বাবা। এত তাড়াতাড়ি তিন ধাপ সিঁড়ি টপকে উপরের রাস্তায় হাওয়া হয়ে গেল ! যাক গে , পথ যখন পেয়েছি ধীরে সুস্থেই যাই । কিন্তু আবার বাঁধা । কী করে বুঝব এতটা
খাড়া চড়াইভাঙ্গা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না । একটা করে সিঁড়িতে উঠি আর বুকের মধ্যে হৃদপিন্ডটা যেন মনে হচ্ছে
ফেটে যাবে । এত কষ্ট হতে লাগল । অনেকটা সময় নিয়ে একটু একটুকরে অবশেষে একসময়ে
উপরে উঠে এলাম উপরে উঠে জলকাদার রাস্তার মধ্যেই শুয়ে পড়লাম । এক পাও চলবার
ক্ষমতা নেই আমার । আসলে স্থানীয় লোকেরা এভাবে সহজেই ওঠানামা করে আমার পক্ষে তো সেটা সম্ভব নয় কোনমতেই। সেটা নামার সময়ে টের পাইনি— পাবার কথাও নয় । একটু বিশ্রাম নিয়ে কোনরকমে রাস্তা পার হয়ে গেট দিকে ঢুকে
ডানদিকের বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলাম – যদিও জানিনা কার ঘর । দরজা খুলতেই দেখি ম্যানেজার । কোন কথা না বলে রাধুনীরা
চৌকিতে শুয়েছিল সেখানে পায়ের দিকে শুয়ে পড়লাম । শুধু বললাম মন্দিরে গেছিলাম – সিড়ি দিয়ে উচুতে উঠে এসেছি বলে হাঁফ ধরে গেছে । একটু বিশ্রাম নিয়ে তিনতলায়
নিজের ঘরে যাব। কাউকে কিছু বলবেন না , প্লীজ !
কিছুক্ষণ পরে উঠে নিজের ঘরে গিয়ে কার্ডিগানটা খুলে ফেললাম , রইল ফুলহাতা ব্লাউজটা , শালটা ও আগেই গেছে । বাসে সবাই উঠে গেছে – দেরি করা যাবেনা তাই সুটকেশটা নিয়ে আর আধা ভেজা কার্ডিগান হাতে নিয়ে বাসে এসে বসলাম । গাড়ী ছাড়বে এমন সময় একজন স্থানীয় লোক শাল বেচতে এল । সাদা শাল গরম খাঁটী উলের । বিশ্বনাথ নিল একটা আমি নিয়ে গায়ে জড়িয়ে বসলাম একটা । দরকষাকষি বিশ্বনাথ চালাতে লাগল শেষে রফা হল । টাকা দিয়ে নিশ্চিত হলাম । জয় বদরী বিশালজী কি জয় ! এর মধ্যেই জানাজানি হয়ে গেছে ভোর ৪ টের সময় আমি একাকী মন্দিরে গিয়ে দর্শণ সেরে এসেছি । সেই ভদ্রলোক দুজন এসে মাথা নীচু করে বললেন ' অপরাধে ভুগছি , মাফ করে দেবেন । আমরা দর্শণই পাই নি , আপনি কি করে জানলেন ওই সময়ের কথা ? বললাম – “ মাফ চাইবার কিছু নেই , মাথাও নীচু করতে হবে। আমি বাড়ী থেকে একাই বেড়িয়েছি – কেউ আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে তবে আমার দেবদর্শন হবে এমনটা ভাবিনি । সুতরাং আমার মনে কোন ক্ষোভ নেই । বিশ্বনাথ,মিনতিরা অভিমানভরে বলল – 'মাসীমা আমাদের জানাতে পারতেন তাহলে আপনার সঙ্গে আমরাও যেতে পারতাম । ' বললাম “ তোমরা কত নম্বর ঘরে আছ তা তো জানিনা , পন্ডাজীর থেকে আমি রাত দশটা নাগাদ জানতে পেরেছি যে ভোর ৪ টেয় মন্দিরের দরজা খুলে দেয় । দর্শন করতে না পেরে মন খারাপ করে বসেছিলাম Reception –আর তখনই পাণ্ডাজীর সাথে সব কথা হয়েছে । তোমাদের কাউকে পেলে তো আমরও ভালো লাগত পাকদন্ডীর পথে ওঠার কষ্টটাও পেতে হত না । তবে দর্শন আমার খুব ভালো হয়েছে সবই তার কৃপা ।
লেখিকার পরিচিতি –
যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।