সুকুমার রায়
স্বনামখ্যাতের বহমান ধারা
ড. বাসুদেব রায়
স্থান ময়মনসিংহ ( বর্তমান বাংলাদেশ ) -এর মসুয়া গ্রাম । এই গ্রামে সাধক সূপণ্ডিত লোকনাথ রায়ের নিবাস ছিল । তার পুত্র উদার তেজস্বী স্বাধীনচেতা কালীনাথ রায় । তিনিও সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত ছিলেন । সংস্কৃত , আরবি , পারসি ভাষা ছিল তার দখলে । প্রাত্যহিক দেবার্চনাদিতে তিনি স্বরচিত স্তোত্রাদি ব্যবহার করতেন । কায়স্থ হয়েও তিনি স্বীয় পাণ্ডিত্যগুণে ব্রাহ্মণের বিচার - সভায় মধ্যস্থের আসন লাভ করতেন । কালীনাথ রায় লোকসমাজে মুন্সি শ্যামসুন্দর 'নামে সমধিক পরিচিতি অর্জন করেছিলেন । কালীনাথ তথা শামসুন্দরের পাঁচ ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় ছেলের নাম ছিল কামদারঞ্জন । তৎকালীন ময়মনসিংহের প্রসিদ্ধ উকিল জমিলার স্বধর্মনিরত আচারনিষ্ঠ হরিকিশোর রায়চৌধুরী কামদারঞ্জনকে পাঁচ বছর বয়সের সময় দত্তক ছেলে হিসেবে গ্রহণ করেন । সম্পর্কে হরিকিশোর কামদারঞ্জনের জ্ঞাতি কাকা ছিলেন । হরিকিশোরের দত্তক ছেলে হিসেবে গৃহীত হওয়ার পর কামদারঞ্জন রায়ের পরিবর্তিত নাম হল উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
বাংলা শিশুসাহিত্যের কালজয়ী পুরুষ তথা ছোটদের পত্রিকা ' সন্দেশ ' - এর স্রষ্টা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মেজছেলে হচ্ছেন সুকুমার রায় । স্মর্তব্য, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক তথা ফেলুদার স্রষ্টা সত্যজিৎ রায় ছিলেন সুকুমার রায়ের ছেলে । সত্যজিৎ রায়ের ছেলে সন্দীপ রায় পিতা - পিতামহের যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে বর্তমানে বাংলা সহিত্য - সংস্কৃতি জগতে পদচারণা করেছেন ।
সুকুমার রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর কলকাতায় । রসায়ন বিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি ১৯০৬ সালে বি.এস.সি. পাশ করেন । বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও সংগীত , নাটক , সাহিত্য ইত্যাদির প্রতি সুকুমার রায়ের দুর্নিবার আকর্ষণ ছিল । তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ‘ গোড়ায় গলদ ” নাটকে অভিনয় করেছিলেন । স্নাতক হওয়ার পর সুকুমার রায় ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন সাহিত্যে উচ্চশিক্ষার জন্যে । কিন্তু তা আর হল না । ১৯১৩ সালে তিনি ভারতে ফিরলেন ফটোগ্রাফি ও হাফটোন প্রিন্টিং - এ শিক্ষা নিয়ে । ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ফটোগ্রাফি অর্থাৎ ছবিতোলা এবং বই ছাপার নতুন এক পদ্ধতি ' হাফটোন প্রিন্টিং ' সম্পর্কে সুকুমার রায় এতটাই জ্ঞান অর্জন করেন যে , পরবর্তীকালে লন্ডনের নানী পত্রিকা ' পেনরোজ ইন্টারন্যাশনাল ’ - এ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো সম্পর্কিত তার অনেক লেখা ছাপা হয় ।
সুকুমার রায় যে বছর ইংলান্ডি থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন , সেবাই অর্থাৎ ১৯১৩ সালে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছোটদের জন্য 'সন্দেশ'পত্রিকা প্রকাশ করেন ।
প্রকাশনার নানা কাজসহ অন্যান্য বিষয়ে সুকুমার রায়ই ছিলেন পিতা উপেন্দ্রকিশোরের ডান হাত । 'সন্দেশ ' পত্রিকার প্রয়োজনে সুকুমার রায় লিখলেন একের পর এক ছড়া , গল্প , নাটক ইত্যাদি । পাশাপাশি সমকালীন সমস্যা , চিত্রশিল্প , বিজ্ঞান , জীবনী , বিদেশি সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধ ও লেখেন । তিনি অনেক বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ ও করেছেন।
স্মর্তব্য,মাত্র আট বছর বয়স থেকেই সুকুমার রায় লেখালেখি শুরু করেন । সে বয়সেই তার ‘ননী’নামে কবিতাটি ছোটদের পত্রিকা 'মুকুল'- এ ছাপা হয়েছিল । মাত্র ন’বছর বয়সে তিনি ইংরেজি ‘নার্সারি রাইন’ ‘হিকরি ডিকরি উক ' থেকে বাংলা অনুবাদ করেছিলেন 'টিক টিক টং '। লেখা ,ছবি আঁকা ,গান গাওয়া , সুর দেওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন গুণে গুণান্বিত ছিলেন সুকুমার রায় । মহাকাশ বিজ্ঞান সম্পর্কেও তার যথেষ্ট আগ্রহ ছিল ।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর মৃত্যু ঘটে ১৯১৫ সালে । পিতার মৃত্যুর পর ' সন্দেশ ' - এর সব দায়িত্ব সুকুমার রায় নিজের কাঁধে তুলে নেন । সেসময় তিনি তার বিশিষ্ট বন্ধুদের (সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত,চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় , সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যয় , প্রশান্ত চন্দ্র মহলানণীশ প্রমুখ ) নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘মন্ডা ক্লাব'বা ‘মান্ডে ক্লাব'(Monday Club)। ক্লাবের সদস্যরা বিভিন্ন মজার মজার ছড়া , গল্প ইত্যাদি লিখতেন । মন খুশি করে দেওয়া কাণ্ডকারখানার আখড়া ছিল ক্লাবটি ।
১৯১৯ সালে সুকুমার রায় সুপ্রভাদেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । ১৯২১ সালে ' ব্লাক ফিভার ” নামক জটিল রোগে আক্রান্ত হন সুকুমার রায় । দু'বছর ওই দুরারোগ্য রোগে ভোগার পর ১৯২৩ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তার অকালমৃত্যু ঘটে । তখন পুত্র সত্যজিৎ রায়ের বয়স মাত্র আড়াই বছর। মৃত্যুর এক বছর আগে ( ১৯২২ ) লন্ডনের রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটি সুকুমার রায়কে সদ্যসপদ দিয়েছিল । সুকুমার রায়ের মৃত্যুর সঙ্গে ' সন্দেশ ' - এরও আপাত মৃত্যু ঘটে । অবশ্য , পরবর্তীকালে (১৯৬১) সত্যজিৎ রায়ের মাধ্যমে ' সন্দেশ ' পুনর্জীবিত হয় ।
সুকুমার সমগ্রে তিনটি সংকলন রয়েছে - ‘ আবোল তাবোল ’, ‘খাই খাই ' এবং “ অন্যান্য কবিতা। এইসব কবিতার অধিকাংশই সন্দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল । কবিতাগুলো বাংলা শিশুসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ । সুকুমার রায় সমাজসচেতন শিল্পীর মত সামাজিক বিষয়গুলোকে সুনিপুণ তীক্ষ্ণ রসিকতার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন এইসব কবিতায় ।
প্রসঙ্গক্রমে আবোল তাবোল ' কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় সুকুমার রায়ের বর্ণনার অংশবিশেষের উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে । তিনি লিখেছলেন,“যাহা আজগুবি, যাহা। উদ্ভট , যাহা অসম্ভব , তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার । ইহা খেয়াল রসের বই , সুতরাং সে রস যাহারা উপভোগ করিতে পারেন না , এ - পুস্তক তাহাদের জন্য নহে । ”
সুকুমার রায়ের এই স্বীকারোক্তি যথার্থ এই কারণে যে, তিনি উদ্ভট , আজগুবি বিষয় কিংবা সামাজিক বৈষম্যের উপাদানকে যেভাবে ব্যঙ্গের কশাঘাতে নাস্তানাবুদ করেছেন , তা সম্যক উপলব্ধি করার মনমানসিকতা থাকা প্রয়োজন ।
সুকুমার রায় ছড়া - কবিতার পাশাপাশি নাটক , গল্প , প্রবন্ধ ইত্যাদি যথেষ্ট পরিমাণে । রচনা করেছেন । বলাই বাহুল্য , তার অধিকাংশ রচনা শিশু - কিশোরদের উপযোগী । তার লেখা নাটকগুলোর মধ্যে রয়ছে – ‘ঝালাপালা ','লক্ষ্মণের শক্তিশেল‘ ,‘অবাক জলপান ', শব্দকল্পদ্রুম’, ‘ভাবুকসভা’ইত্যাদি। তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গল্প হল–‘হযবরল’,‘পাগলা দাশু’, ‘দ্রিঘাংচু’,'উকিলের বুদ্ধি ’,‘বোকা বুড়ী','রাগের ওষুধ','বুদ্ধিমানের সাজা' ইত্যাদি। জীবনী বিষয়ক লেখার মধ্যে রয়েছে 'কলম্বাস',‘ফ্লরেন্সনাইটিঙ্গেল’,সক্রেটি, ‘দানবীরকর্নেগী','আর্কিমিডিস’,‘গ্যালিলিও',' উপেন্দ্রকিশোর রায় ইত্যাদি । চিত্রশিল্প সম্পর্কিত সুকুমার রায়ের প্রবন্ধগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি –‘ভারতীয় চিত্রশিল্প ','ফটোগ্রাফি ’, ‘শিল্পে অত্যুক্তি ইত্যাদি । সমকালীন ধর্ম ও সমাজ সম্পর্কেও তিনি উদাসীন ছিলেন না । তার লেখা ‘ ব্রাহ্ম ও হিন্দু প্রবন্ধের প্রতিবাদ। ব্রাহ্ম হিন্দু সমস্যা - ১, ‘ব্রাহ্ম হিন্দু সমস্যা- ২ ' ইত্যাদি প্রবন্ধগুলো এ বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করে ।
পরিশেষে বলা যায় । সুকুমার রায়কে বাংলা শিশুসাহিত্যের একজন অন্যতম লেখক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে থাকে । তিনি ছোটদের জন্য গদ্য - পদ্য রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন । শিশু সাহিত্যিক তথা শিশুকবি হিসাবে তার খ্যাতির কারণ । বিষয়গুলোর অনন্য পরিবেশন নৈপুণ্য । এই নৈপুণ্য যেকোন শিশুকে মোহাবিষ্টের মত টেনে নিয়ে যায় । শিশুসাহিত্যের ব্যাপারটা তিনি পিতা উপেন্দ্রকিশোরের কাছ থেকে প্রত্যক্ষভাবে লাভ করে পরবর্তীকালে পরোক্ষভাবে পুত্র সত্যজিৎ এবং পৌত্র সন্দীপ - এর মধ্যে তা সঞ্চারিত করেন । সেজন্যে সুকুমার রায়কে ‘স্বনাম খ্যাতের বহমান ধারা ’ অভিধায় অভিহিত করলে বোধ করি সেটা অত্যুক্তি হবে না ।
লেখক পরিচিতি –
ড.বাসুদেব রায়ের জন্ম ১৯৬২ সালে। কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশিত বই মানব' (কাব্যগ্রন্থ), দ্বিতীয় বই রক্তের বাঁধন (উপন্যাস)। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা করলেও প্রবন্ধ সাহিত্যের দিকে তার ঝোঁক বেশি। তদুপরি গবেষণামূলক প্রবন্ধ তথা বই লিখতে তিনি অধিকতর উৎসাহী। গবেষণামূলক বইয়ের পাশাপাশি সাধু-মহাপুরুষদের জীবনী-গ্রন্থ, একাঙ্কিকা ইত্যাদি সম্পাদনাও করেছেন তিনি।
ড.বাসুদেব রায়ের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। হার উল্লেখযোগ্য গবেষণা গুলোর মধ্যে রয়েছে মনসামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ', চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সমাজ-চিত্র ইত্যাদি। তাঁর যৌথ রচনা ও উপেক্ষণীয় নয়।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বাসুদেব রায় নিরলস ভাবে লিখে চলেছেন। এছাড়াও নতুন করে তিনি একক ও যৌথভাবে বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক কাজে হাত দিয়েছেন। নিয়মিত বিভিন্ন e magazine-এ লেখেন।