আমি হেসে
বললাম, “সাড়ে চুয়াত্তর
নয় ভাই-সাড়ে তেইশ”। বেচারা বুঝতে না পেরে
আরও অসন্তুষ্ট হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
বুঝতে
পারলাম স্কুলের ভূগোলে পড়া ‘ঋতু-পরিবর্তনের’ পরিচিত ছবিটা ভুলে গেছেন।
আপনাদের মনে
করিয়ে দি “ওই নীল গোলকের” আলোচনায় দেখেছিলাম যে আমাদের পৃথিবী নামের এই গোলকের
অক্ষ আপন সূর্য-প্রদক্ষিণের কক্ষপথের সঙ্গে সাড়ে তেইশ (আসলে, ২৩.৪৪ ডিগ্রি) ডিগ্রি হেলে সূর্য প্রদক্ষিণ করে।
পৃথিবীর
অক্ষের এই হেলে থাকার কারণেই আমাদের এই ‘গোলকে’র জীবন এত বৈচিত্র্য-ময়। যত কিছু গোলমাল ওই সাড়ে ২৩ ডিগ্রির জন্যে। এই গ্রহ যখন প্রথম জন্ম নিলো তখন
কিন্তু এ লাট্টুর মতন সোজাই ঘুরত।
কিন্তু
বার বার (বৈজ্ঞানিকদের মতে ১০ বার) মহাকাশে ভাসমান বিভিন্ন বস্তুর সঙ্গে ধাক্কা
খাবার ফলে এর অক্ষ হেলতে আরম্ভ করে। শেষবার ‘থেইয়া’ (Theia) নামক মহাকাশের ভাসমান বস্তুর আঘাতে এই গ্রহের অক্ষ সূর্য-প্রদক্ষিণের
কক্ষের সমতলের তুলনায় ২৩.৪৪ ডিগ্রি হেলে গেল। আবার কোটি কোটি বছর তীব্র গতিতে
ঘুরতে ঘুরতে আমাদের এই গ্রহ ধীরে ধীরে অনেকটা শান্ত হয়ে গতি কমে গেল (এখন,প্রতি ঘণ্টায়
১৬৭৪ কিলোমিটার) আর সেই কারণেই পুরানো পৃথিবীর পাঁচ-ঘণ্টার দিন-রাত এখন হয়ে দাঁড়াল
২৪ ঘণ্টার আর এইভাবে প্রচণ্ড গতিতে ঘুরতে ঘুরতে তিন’শ চৌষট্টি দিন ছ’ ঘণ্টায় একবার
সূর্য প্রদক্ষিণ করে আসে।
এই আহ্নিক আর বার্ষিক গতির ফলেই আমাদের এই পৃথিবীতে দিন-রাত্রি আর চারটি (কোথাও বা ছ’টি) ঋতু হয়- এ কথা আমরা জানি। আরও জানি কিভাবে বারে বারে শীত (৮৯দিন),বসন্ত (৯২দিন ১৯ ঘণ্টা),গ্রীষ্ম (৯৩দিন ১৭ঘন্টা),হেমন্ত(৮৯দিন ২০ঘন্টা) হ’তে থাকে;আবার উত্তর গোলার্ধে আর দক্ষিণ গোলার্ধে ঋতুর পরিবর্তন হতে থাকে। আমাদের দেশের কয়েকটি অঞ্চলে আর নিউজিল্যান্ডে আবার ছ’টি ঋতুও স্পষ্টরুপে দেখতে পাওয়া যায়। এই দু’টি বাড়তি ঋতু হ’ল-বর্ষা আর শরত। আমরা কেউ কেউ ভুল ধারণা করতে পারি যে পৃথিবী সূর্য-প্রদক্ষিণের কক্ষপথে যখন সূর্যের কাছাকাছি আসে তখনই পৃথিবীতে গ্রীষ্মকাল নেমে আসে। ধারনাটা সম্পূর্ণ ভুল। আসলে পৃথিবী সূর্যের সবচেয়ে কাছে আসে জানুয়ারি মাসে-৩’রা জানুয়ারি যখন উত্তর গোলার্ধে নেমে আসে ‘শীত-লহর’।
এইসব
‘উল্টো-পাল্টা’ ব্যাপার গুলো ঘটে ওই সাড়ে ২৩ ডিগ্রির জন্য। আসুন ব্যাপারটা ভেবে দেখা যাক। পৃথিবীর অক্ষ
ওই সাড়ে ২৩ ডিগ্রি হেলে থাকার ফলে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে সূর্য কিরণ পৃথিবীতে আসে
তেরছা ভাবে আর সূর্য কিরণকে যেতে হয় অনেক বেশি আর ঘন বায়ু-স্তর ভেদ করে। এই ঘন আর দীর্ঘ বায়ুস্তর পার করার কারণেই সূর্যের এত কাছে থাকা সত্ত্বেও
উত্তর গোলার্ধে হয় তখন শীত ঋতু আর দক্ষিণ গোলার্ধে হয় গ্রীষ্ম কাল। তাহলে আমরা দেখলাম যে উত্তর গোলার্ধে যখন শীতকাল দক্ষিণ গোলার্ধে তখন
গ্রীষ্মকাল;আর উত্তরে
যখন গ্রীষ্মকাল, দক্ষিণে তখন
শীতকাল। এমনটা কেন হয়? এটা হয় এই কারণে যে গ্রীষ্ম বা শীতে আমাদের এই গ্রহের
একটা অংশ (উত্তর বা দক্ষিণ) সূর্যের বেশি মুখোমুখি
থাকে আর বেশি মুখোমুখি থাকা মানেই বেশি সূর্যকিরণ পাওয়া।
বছরের
প্রায় অর্ধেক সময় (২০ মার্চ থেকে ২২
সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) উত্তর গোলার্ধ সূর্যের
সোজা মুখোমুখি থাকে।সবচেয়ে বেশি থাকে ২১ শে জুন তারিখে। তাই ওই তারিখের কাছাকাছি হয় উত্তর গোলার্ধ সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত আর দক্ষিণ
গোলার্ধ হয় সবচেয়ে কম উত্তপ্ত,অর্থাৎ
সবচেয়ে ঠাণ্ডা।
বছরের দুটি
দিন-২৩ শে সেপ্টেম্বর আর ২১শে মার্চ যাকে আমরা সংক্রান্তি বলি ওই দুই দিনকে
বিজ্ঞানের ভাষায় ‘ইকুইনক্স’ বলা হয়। এই দুই দিন বিষুবরেখার
উপরে দুপুরে সূর্য ঠিক মাথার ওপরে থাকে,তাই ওই দু’দিন দুই
গোলার্ধেই দিন রাত্রির পরিসর সমান হয়। ওই দুটি দিনই
পৃথিবীর দুই গোলার্ধ যেন ‘মুখোমুখি’ দাড়ায়-এই দুই দিনের পরই শুরু হয় সূর্যের
‘উত্তরায়ণ’ বা ‘দক্ষিণায়ন’।
সবশেষে দেখা
যাক নব-জাত পৃথিবী যেমন ছিল অর্থাৎ সোজা ঘূর্ণমান লাট্টুর মত মানে ওই সাড়ে ২৩
ডিগ্রির হেলান যদি না থাকতো তাহলে কি হ’ত? বিশেষ কিছু হতোনা-কেবল পৃথিবীতে কোথাও কোন ঋতু পরিবর্তন
হ’ত না,দিন রাত্রির
পরিমাপ সর্বত্র সমান হ’ত আর বিষুব-রেখা অঞ্চল হতো সর্বদা খুব গরম আর মেরু অঞ্চল
সর্বদা ভীষণ ঠাণ্ডা। আর মেরু অঞ্চলে এখনকার
ন্যায় অসমান দিন রাত্রি থাকতো না। ওখানেও বছরের প্রত্যেক দিন ২৪ ঘণ্টার দিন রাত্রি
হতো।
কি মনে হয়
এমনটি হ’লে ভাল হ’ত?
লেখক পরিচিতি –
ডঃ তুষার রায় স্কুলে থাকতেই শুরু
হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ। ওই সময়েই “শুকতারা”তে “অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ
ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে
লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা।
কিন্তু “Need
to have and Nice to have”
এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন
এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল
ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পান।