দম্পতি
নন্দিতা সাহা
দেখতে
দেখতে একটি ঘণ্টা কেটে গেল,ঠায় বসে আছে
করিডোরের চেয়ারে। মাঝে অবশ্য দু-একবার একটু উঠেছিল, রিসেপশনের ছেলেটাকে
জিজ্ঞেস করেছে আর কতক্ষণ লাগবে? ডাক্তারবাবু কি হাসপাতালে পৌঁছেছেন,রাউন্ডে আছেন?
কোনও সদুত্তর মেলেনি । হবে হয়তো কোন এমার্জেন্সি কেসে ফেঁসে আছেন। পলাশের চোখেমুখে অসম্ভব বিরক্তি, ভেবেছিল, রমাকে কোনরকমে ডাক্তার দেখিয়ে অফিসে দৌড় দেবে। তা আর আজ হয়তো হলো না । পলাশের বিরক্তি চোখ এড়ায়নি রমার, তবে রমার তাতে কিছু এসে যায়না। পলাশের খিটখিটে মেজাজ ওর কাছে নতুন কিছু নয় ।
শরীর কিছুদিন ধরে তেমন যুতসই নয়। তাই ডাক্তার দেখাতে আসা । বেশ কিছুদিন বিছানায় ছিল রমা ।পলাশই খাবার-দাবার রেখে যেত, সবই করত তবে পলাশের মুখ দেখেই ওর মনের ভাষা পড়ে ফেলত রমা। ঠিক যেন, নিজে কিছু করবেও না আবার অন্যকে কিছু করতেও দেবেনা, এমন একটা ভাব পলাশের রমাকে নিয়ে । থার্মোমিটারে নিজের তাপ মাপতো রমা। ইচ্ছে হতো পলাশ একবার ওর কপালে হাতটা রাখুক, একটু স্পর্শ করুক। সে গুড়ে বালি। একটিবারও কপালে হাত রাখেনি পলাশ ,একবার হাতের নাড়ি পর্যন্ত টিপে দেখেনি । একবার যদি পলাশ এসে রমার পাশে বসতো, রমার হাতদুটো নিজের হাতে নিত! সেই স্পর্শই রমার শরীরের যন্ত্রণা অনেক কমিয়ে দিতে পারত। ,
আজকাল বড় একা লাগে। সারাটা জীবন এমন ভাবে হাত দুটো শক্ত করে কেউ ধরল না। ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে, একাই বড় হওয়া। বাবা মেয়ে একসাথে থাকতো। বাবা-তো কাজ নিয়েই ব্যস্ত । বিয়ের পর মেয়ে রূপসা ও ছেলে তাপসকে হাত ধরে অনেক কিছু শিখেছে রমা। তারপর অবাক করে দিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য একদিন দুই ভাইবোন হাত ছেড়ে ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর মত উড়ে চলে গেল।
রুমা এখন একাই থাকে। প্রতিবেশী বা বন্ধু বা আত্মীয় সবাই যেন কেমন পাল্টে যাচ্ছে ! চেনা পৃথিবী আজ বড় অচেনা মনে হয়! সেই হইচই আড্ডা খুনসুটি হাসি-তামাশা কিচ্ছুটি নেই। রকে বসে আড্ডা সে তো কবেই সমাজ থেকে বাতিল হয়ে গেছে । মানুষও বদলে যাচ্ছে। সহজ ভাবে কথা বলা গল্প করা মোটেই হয়ে ওঠেনা। সকলেই খুঁতখুঁতে। মেপে মেপে খুব সাবধানে কথা বলতে হয় ।একটু এদিক-সেদিক বলেছ কি একেবারে সাপের মতো ছোবল মারতে উদ্যত। মানুষ এখন যান্ত্রিক। যন্ত্রের ভাষায় কথা বলে। রাইট এন্ড রং, উচিত-অনুচিত, সুড-সুডনট ----! এই নিয়মের বাইরেও যে কিছু কথা আছে ভালোলাগা আছে মানুষ সেসব ভুলতে বসেছে। বড় জটিল এই জীবন। কেবল ম্যানারিজম।
রুমার নিজের স্বামী বা কি এমন কথা বলে। কিছু বললেই উল্টো মানে ধরে। যাহ! কথাই প্রায় বন্ধ। মিষ্টি বাংলা ভাষা টা ভুলে যাবে না তো? রুমার বড় ক্লান্ত লাগে। কি আর এমন বয়স ! মাঝ বয়েসী। কত শখ আহ্লাদ মনের মাঝে লুকিয়ে আছে।
আগে জীবন ছিল ঝরনার মত উচ্ছল । এলোমেলো এঁকে-বেঁকে বাঁধনহারা ছুটে বেড়াত এদিক-সেদিক। এখন নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছে রমা। ভাবে পৃথিবীটা হয়তো ঠিকই আছে, মানুষও একই আছে।হয়ত রমা নিজেই বেমানান।
পাশে বসে পলাশ খিচির মিচির করেই যাচ্ছে ,কখনও ডাক্তারকে কথা শোনাচ্ছে কখনো রিসেপসনিস্ট কে কখনো নিজের কপাল কে গালমন্দ করছে।
ওপিডি তে কত লোকের ভিড়! কত রকম রোগী ! স্ট্রেচারে করে নিয়ে গেল এক বয়স্ক মহিলাকে,উল্টোদিকে চেয়ারে মায়ের কোলে দুই আড়াই বছরের ফুটফুটে ছোট্ট একটি মেয়ে । আহা বড্ড শরীর খারাপ হয়তো ! চোখ মেলে তাকাতেই পারছে না। সবাই কেবল ডাক্তারের পথ চেয়ে বসে আছে ।
বড় অপরাধ বোধ হচ্ছে রুমার। কেন যে মরতে পলাশকে নিয়ে এলো? একাই ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে আসতে পারতো ।শুধু শুধু কাজের মানুষটিকে বিরক্ত করা !
ছোট্ট একটি বাচ্চা তারস্বরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে গেল ,না ইনজেকশন সে কিছুতেই নেবে না ! রূপসাকেও জোর করে ইনজেকশন দিতে হত,বড্ড ভীতু ছিল মেয়েটা ।
হঠাৎ একটি কাপল সবার নজর কাড়ল। দুজনেরই আশির কোঠায় বয়স হবে। মহিলা বেশ দুর্বল, সামনের দিকে ঝুঁকে ঝুঁকে হাঁটছে ,টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ কপালে লাল টিপ শোভা বাড়াচ্ছে । এক হাতে লাঠি অন্য হাতটি ভদ্রলোক নিজের মুঠির মধ্যে ধরে রেখেছে । টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার স্ত্রীকে । ভদ্রলোক অনেক বেশী শক্ত পোক্ত,লম্বা চওড়া একেবারে রয়াল চেহারা। বোঝাই যায় যৌবনে কি আগুন ছিল তাদের চেহারায়। ভদ্র মহিলা মাথা নিচু করে ঝুঁকে ঝুঁকে ধীরে ধীরে এক পা, দু’ পা করে হেঁটে চলে গেলো ।তার দুর্বল হাতটি স্বামী র বজ্রমুঠিতে ধরা।অপলক তাকিয়ে রইলো রমা। কি সুন্দর ভালোবাসা ,শ্রদ্ধা ,পারস্পরিক বোঝাপড়া, বন্ধুত্ব,সত্যি এরই নাম জীবন সাথী। বৃদ্ধ দম্পতি দৃষ্টির আড়াল হলো।
মন ছুঁয়ে গেল। মনোরম দৃশ্যটা রমা আরেকবার মনে মনে ঝালিয়ে নিচ্ছে ।হঠাৎ তাকাল পলাশের দিকে। চোখে চোখ পড়ল, পলাশ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে রমার দিকে। বড় অদ্ভুত লাগল সেই দৃষ্টি! পলাশের দুই চোখে এক অজানা ভাষা, অচেনা ভাষা। এ তো সেই চিরকালের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাষা নয়! বিরক্তির ভাষা নয়? তবে এ কোন ভাষা।
বৃদ্ধ দম্পতিকে দেখে পলাশের মনেও এক ভাবাবেগ তৈরি হয়েছে। পলাশ ধীরে ধীরে হাতটা বাড়িয়ে দিলো ,রমার শীর্ণকায় হাত নিজের মুঠির মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরল। রমার বুকে সুখের কান্নার ঢেউ উথলে উঠল ,শরীরে শিহরণ জাগল। এই, এই ভালবাসার স্পর্শ টুকুই যে সে চায়, চেয়ে এসেছে এতকাল। শরীরের কষ্ট এক মুহূর্তে অনেকটা যেন কমে গেল। উধাও হয়ে গেল ক্লান্তিকর একঘেয়ে জীবনের কাতরতা । আর চিন্তা নেই এবার রমা ঠিক সুস্থ হয়ে যাবে। এবার দুইজনের একসাথে পথ চলা, ছুটে বেড়ানো ,এলোমেলো এদিক-সেদিক।
ডাক্তার এসে পৌঁছল । এখনি রমার ডাক পড়বে। আরকি যাবার দরকার আছে? ওষুধ তো পেয়েই গেছে । তবুও একবার রোগীর সিটে গিয়ে বসবে । এক হাজার টাকা দিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট
নিয়েছে যে! উশুল করতে হবে না! আজ অবশ্য অনেকটাই উশুল হয়েছে।
রমার মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠল। পলাশের প্রশ্ন, কি হল, হাসছো যে?
রমা পলাশের হাত শক্ত করে চেপে ধরল,পলাশের বুকে আলতো করে মাথাটা এলিয়ে দিল।
বৃদ্ধ দম্পতি জানতে ও পারল না, তাদের দেখে প্রেমের জোয়ার ভেসে গেল আরও দুটি প্রাণ।
লেখিকার পরিচিতি -
জন্ম পশ্চিমবঙ্গ-র কুচবিহার শহরে। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। প্রথম কবিতার বই ' সুখের ঠিকানা', গল্প সংকলন 'চিরন্তন'। ইংরেজি কবিতার বই 'Bouuet of Poems' বিভিন্ন পত্রিকায় লেখেন। বেশকিছু কিশোর সংকলনে গল্প প্রকাশিত হয়েছে।
স্টেটস্ম্যান, সুখবর, সকালবেলা ইত্যাদি খবরের কাগজে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। প্রসাদ, সারথি পত্রিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন। 'Times of India'-তে বেশ কয়েকবার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনের শুরু।বর্তমানে কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গল্প লিখতেই বেশি ভাল বাসেন । বহু e magazine এ লেখেন।