প্রখ্যাত দার্শনিক মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ উনিশ শতকের এক আলোচিত ব্যক্তিত্ব ।
দর্শন ও যোগশাস্ত্রের এই বিশিষ্ট পণ্ডিত ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৭ই সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলার ধামরাই থানার কায়েতপাড়া
গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন । তার পৈতৃক নিবাস টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর
থানার দান্যা গ্রামে এবং পিতার মাতুলালয় কাঁঠালিয়া গ্রামে।
পিতা বৈকুণ্ঠনাথ ছিলেন দর্শন
শাস্ত্রে পণ্ডিত এবং প্রখ্যাত দার্শনিক ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের সহপাঠী । রামেন্দ্রসুন্দর
ত্রিবেদী ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ
বন্ধু। মাতা সুখদাসুন্দরী শৈশবে অন্যগৃহে লালিতপালিত হন। গোপীনাথ কবিরাজ শ্রীশ্রী
যশোমাধব বিগ্রহ ও মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা সেবায়েত রামজীবন রায় মৌলিকের বংশধর রেবতী
রায় মৌলিক ও নিখিল রায় মৌলিকের ভাগ্নে। নিখিল রায় মৌলিক
স্বদেশি আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন । গোপীনাথ কবিরাজ বারেন্দ্র শ্রেণির
ব্রাহ্মণ,
কৌলিক উপাধি বাগচি '। 'কবিরাজ’ নবাবি আমলের খেতাব।
তাঁর পিতৃভূমি দান্যার
সঙ্গে সম্পর্ক খুব বেশি ছিল না । স্কুল জীবনের বেশির ভাগ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কাঁঠালিয়া ও ধামরাইতেই অতিবাহিত হয় । ধামরাইয়ের কথা প্রসঙ্গে গোপীনাথ
কবিরাজ ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর সুশীল রায়কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে
বলেছিলেন –
“কিশোর
- জীবনের উপর যে ছাপ রেখে গেছে ধামরাই ,আজ জীবনের এই প্রদেশেও সে ছাপ
সামান্যতম অস্পষ্ট হয়নি । এখানকার রথ বিখ্যাত রথ । চৌষট্টি চাকার বিরাট রথ এখনকার
। পুরীর জগন্নাথ - ক্ষেত্রের আনন্দবাজারে যেমন ভোগ বিক্রি
হয় ,এখানেও
তেমনি হয় । এ স্থানটি অতি প্রাচীনকালে একটি বৌদ্ধবিহার ছিল , বৌদ্ধদের
তীর্থস্থান ছিল । এর নাম আগে ছিল ধর্ম-রাজিকা, সেই নাম
এখন হয়েছে ধামরাই । এখন এটি পূর্ববঙ্গের একটি বৈষ্ণব তীর্থস্থান । এখানকার প্রধান
দেবতা যশোমাধব - চতুর্ভুজ নারায়ণ - মূর্তি ।
গোপীনাথ কবিরাজের পিতা ১৮৮৫
খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে সংস্কৃত
অনার্সসহ বি.এ. পাশ করেন । এরই বছর দুই পরে অকালে মারা যান । পিতৃহীন গোপীনাথ
ঢাকার জুবিলি স্কুল থেকে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে এনট্রান্স পাশ করে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় পড়তে যান । রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী তাকে কলকাতায় পড়ার
পরামর্শ দেন। কিন্তু ম্যালেরিয়ার ভয়ে তিনি জয়পুর স্টেটের প্রধানমন্ত্রী রাও
বাহাদুর সংসারচন্দ্র সেনের দুই নাতির প্রাইভেট টিউটার হয়ে সেখানে থাকেন এবং
মহারাজা কলেজে ভর্তি হন এবং এই কলেজ থেকেই বি.এ. পাশ করেন । কলেজের ভাইস -
প্রিন্সিপাল ছিলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা মেঘনাথ ভট্টাচার্য।
১৯১০ খ্রিস্টাব্দে কাশীর কুইন্স কলেজে গোপীনাথ সংস্কৃত সাহিত্যে এম.এ. শ্রেণীতে ভর্তি
হন। অধ্যাপক বামাচরণ ন্যায়াচার্যের কাছে তিনি পাঠ গ্রহণ করেন। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রথম
বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি নতুন ইতিহাস রচনা করেন।
এম.এ. পাস করে এক বছর গবেষণাবৃত্তি লাভ করে তিনি কাশীর কুইন্স কলেজেই থাকেন।
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে কুইন্স কলেজে
গ্রন্থাধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত হন।এ সময়ে কলেজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরস্বতী-ভবন গঠিত হয় । এই লাইব্রেরিকে রত্নভাণ্ডার বলা হয় । কুইন্স কলেজের ইংরেজি ও সংস্কৃত বিভাগের প্রিন্সিপাল পদ
থেকে অধ্যাপক ভেনিস অবসর করার পর গোপীনাথ সংস্কৃত বিভাগ ও সংস্কৃত গ্রন্থাগারের
প্রধানরূপে নিযুক্ত হন।এরপর তিনি এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত
ও পালি'-র
রীডার পদে যোগদান করেন।প্রায় তিন বছর এই
পদে কাজ করেন । অন্যদিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
গোপীনাথকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের জন্য দু'বার অনুরোধ
জানিয়েছিলেন । তাছাড়া লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জ্ঞানেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীও
তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের জন্য আহ্বান জানান । কিন্তু গোপীনাথ কাশীর এই
প্রন্থাগার ত্যাগ করে অন্য কোথাও যেতে চাননি । ১৯২৩
খ্রিস্টাব্দে তিনি সংস্কৃত বিভাগের প্রিন্সিপাল পদে যোগদান করেন এবং সেইসঙ্গে
উত্তর প্রদেশের সংস্কৃত স্টাডিজের সুপারিন্টেন্ডেন্ট ও সরকারি সংস্কৃত পরীক্ষা
সমূহের রেজিস্ট্রার নিযুক্ত হন । এই গুরুত্বপূর্ণ প্রিন্সিপালের পদে তিনি তেরো বছর একটানা কাজ করেন । আরো দীর্ঘকাল তিনি এই পদে বহাল থাকতে
পারতেন । কিন্তু এবার তার জীবনে প্রয়োজন হল নিভৃতির । একাকী বসে নিবিড়ভাবে সাধনা করার অভিপ্রায় হল তার । তিনি তাই এই পদ থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন ১৯৩৭
খ্রিস্টাব্দে ।
গোপীনাথ কবিরাজ যৌবনেই ১৯১৮
খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত তান্ত্রিক ও দার্শনিক যোগী বিশুদ্ধানন্দের
কাছে দীক্ষা নেন । অর্থাৎ তখন থেকেই মন সাধন - পথে চলে যায় , ১৯৩৭
খ্রিস্টাব্দে অবসর নিয়ে সাধনায় নিমগ্ন হন । পালি ভাষায়ও তার ব্যুৎপত্তি ছিল ।
কাশীতে গ্রন্থাগারিক থাকার সময়ে বিখ্যাত অধ্যাপক ড . ভেনিসের কাছে ‘ এপিগ্রাফি
’ ও
প্রাচীন সভ্যতার “
চিহ্ন'গুলি উদ্ধার করতে শেখেন ও প্রাচীন
ইতিহাসের রহস্যমোচনে কয়েক বছর ড .
ভেনিসের অধীনে গবেষণাও করেন । সরস্বতী ভবন গ্রন্থাগারে কাজ করার সময় সেখানকার
ধর্ম ও দর্শন বিষয়ক অনেকগুলি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন । সেসব গ্রন্থে পাণ্ডিত্যপূর্ণ
যেসব ভূমিকা লিখেছিলেন সেগুলি তখনকার পণ্ডিতমহল কর্তৃক প্রশংসিত হয় । ভারতীয়
ধর্মশাস্ত্রের ও দর্শনের সমস্ত শাখায় ও বৌদ্ধদর্শনে তার অসাধারণ ব্যুৎপত্তি ছিল।
পরিণত বয়সে তিনি নবাবিষ্কৃত
কাশ্মীরী শৈবতন্ত্রের গ্রন্থে ভারতীয় জীবন – দর্শনের
সার খুঁজে পান - যাতে সমস্ত ভারতীয় দর্শনের শিক্ষা প্রতিফলিত
হয়েছে । তিনি ওইসব দর্শন ও তত্ত্বকে তন্ত্রের ব্যবস্থার
মধ্যে সমন্বিত করার চেষ্টা করে সর্বমানবের মুক্তির সাধনা করেন।তিনি আত্মবিশ্লেষণের মধ্যদিয়েই ব্রহ্মলাভ করার
পক্ষপাতি ছিলেন । গোপীনাথ কবিরাজের পাণ্ডিত্য প্রসঙ্গে
শান্তিনিকেতনে বসবাসরত তাঁর মামা জ্যোতিষচন্দ্র বিশ্বাস বাগচী বলেন :
“বিশ্বভারতী
বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড . মঞ্জুমোহন মুখার্জী গবেষণার কাজে গোপীনাথের সাথে দেখা করতে তার বেনারসের বাড়িতে
যান । সেখানে গিয়ে ড . মুখার্জী দেখতে পান বেনারসের সব রথী - মহারথীরা চাটাইয়ের
উপর বসে আছেন আর গোপীনাথ বসে আছেন বই পরিবেষ্টিত হয়ে ।
অধ্যাপক মুখার্জী ওঁর গবেষণার ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন সেসব বিষয়
গোপীনাথ কবিরাজকে অবহিত করেন । গোপীনাথ কবিরাজ সমস্যাগুলি
অতি সহজেই সমাধান করে দেন । তখন ড . মুখার্জী গোপীনাথের মেধা ও স্মৃতিশক্তি দেখে
বিস্মিত হন। “
গোপীনাথ কবিরাজ স্কুল জীবনেই
বিভিন্ন পত্র - পত্রিকায় লিখতেন । তাঁর প্রথম জীবনের রচনা প্রধানত তদানীন্তন বাংলা কাব্য , সাহিত্য ও
দু '-একজন তখনকার
লোকপ্রিয় ইংরেজ কবিকে উপলক্ষ করে রচিত । তাঁর রচনাগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন দুটি রচনা ইংরেজ কবি বায়রন ও ব্রাউনিং অবলম্বনে রচিত হয়েছিল । সেই দুটির মধ্যে প্রথমটি ( বায়রন )
ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘প্রতিভা ' নামক
পত্রিকায় ভাদ্র ১৩১৮ বঙ্গাব্দে এবং
দ্বিতীয়টি ( ব্রাউনিং ) সুপ্রসিদ্ধ 'প্রবাসী’ পত্রিকাতে
ঐ বছরেরই কিছু আগে - পরে দুই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল । ‘ব্রাউনিং’শীর্ষক
প্রবন্ধটি লেখার ব্যাপারে প্রেরণা দেন আর এক শ্রুতকীর্তি
মনীষী ও দার্শনিক আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল । আর ‘বায়রন’ সম্বন্ধে তিনি প্রেরণা
পেয়েছিলেন তার শ্রদ্ধাস্পদ অধ্যাপক নবকৃষ্ণ রায়ের নিকট হতে ! অধ্যাপক নবকৃষ্ণ রায় জয়পুর
মহারাজ কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন । গোপীনাথ কবিরাজ তাঁর কাছেই (
১৯০৬-১৯১০ ) শিক্ষা গ্রহণ করেন।
গোপীনাথ কবিরাজ বাংলা সাহিত্য
সম্বন্ধে সমালোচনামূলক প্রবন্ধও লেখেন । তিনি প্রতিভা ' ও ' প্রবাসী’ ছাড়াও ‘প্রবাসজ্যোতি ' , উত্তরা
' , ' অলক
' , ' বঙ্গসাহিত্য
' , ' পন্থা '
, ' ভারতবর্ষ’ , ‘উদ্বোধন ’
, ‘ বিশ্ববাণী , ' উৎসব ' , ' দেবযান
', সুদর্শন
ইত্যাদি পত্রিকায় সাহিত্য ও ধর্মতত্ত্ব নিয়ে নিয়মিত লিখতেন । তাছাড়া ‘সংস্কৃত রত্নাকর',অমরাবতী ' প্রভৃতি
পত্রিকাতে সংস্কৃত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় । এলাহাবাদ থেকে প্রকাশিত গঙ্গানাথ ঝা
রিসার্চ ইন্সটিটিউট জার্নালে ও মডার্ন রিভিউতেও তার চিন্তাগর্ভ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে উত্তর প্রদেশ
হিস্টরিকাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় । এর জার্নালে তিনি অনেক ঐতিহাসিক প্রবন্ধ
লিখেছেন । এছাড়া হিন্দিতে রচনাও তার আছে । গোরক্ষপুর গীতা প্রেস থেকে প্রকাশিত
হিন্দি মাসিক পত্র কল্যাণে বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ত্রিশ - চল্লিশটি প্রবন্ধ
প্রকাশিত হয়েছে ।
কেবল অধ্যাপনা ও অধ্যয়ন নয় , সাধনা ও
রচনাতেও তিনি তার জীবন ডুবিয়ে রেখেছিলেন । সেই কারণেই তাঁর এত বিভিন্ন রকমের রচনা বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত
হয়েছে ।
গোপীনাথ কবিরাজের ছাত্র ও শিষ্যদের মধ্যে খ্যাতনামা কয়েকজন হলেন
বারাণসীর সংস্কৃত বিদ্যাপীঠের আচার্য নরেন্দ্র দেব ও অখণ্ড মহাযোগ সঙ্গের পণ্ডিত সীতারাম।
বিখ্যাত যক্ষ্মারোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ রাম অধিকারী তাঁর শিষ্য ছিলেন। ভারতীয় দর্শনের সকল
বিভাগে অগাধ পাণ্ডিত্যের কারণে জীবৎকালেই গোপীনাথ একজন প্রবাদপুরুষে পরিণত হন। পাণ্ডিত্যের
স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বিভিন্ন সময়ে নানা মূল্যবান উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ভার সরকার তাঁকে ‘মহামহোপাধ্যায়”, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে
এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডি.লিট’,১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার পদ্মভূষণ
', ১৯৬৫
খ্রিস্টাব্দে উত্তর প্রদেশ সরকার ‘সাহিত্য – বাচস্পতি’ এবং ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতী
বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’উপাধি দেন। দেশে ও বিদেশে তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি
ছিল। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুন এই কৃতী দার্শনিক পরলোক গমন করেন ।
গোপীনাথ কবিরাজ রচিত গ্রন্থসমূহ –
শ্রীশ্রী বিশুদ্ধানন্দ - প্রসঙ্গ । পাঁচ খণ্ড, অখণ্ড মহায়োগ,তান্ত্রিক সাধনা,ভারতীয়
সাধনার ধারা, শ্রীকৃষ্ণ প্রসঙ্গ,
মৃত্যু বিজ্ঞান ও কর্মরহস্য,সাহিত্য চিন্তা,সাধুদর্শন ও সম্প্রসঙ্গ,যষ্ঠ খণ্ড,কাশীর সারস্বত সাধনা,পত্রাবলী,জ্ঞানগঞ্জ,সূর্য বিজ্ঞান,Saraswati Bhawan Studies ( 5 Vols), Aspects
of Indian Thought।
সম্পাদিত গ্রন্থাবলী –
কিরণাবলী ভাস্কর ( বৈশেষিক ) পদ্যনাভ – কৃত,কুসুমাঞ্জলি
- বোধিনী ( ন্যায় ) – উদয়ন –
কৃত,রসসার ( বৈশেষিক ) - বাদীন্দ্র – কৃত, যোগিনীহৃদয়দীপিকা ( শাক্ত আগম ) । দুই খণ্ড - অমৃতা - নন্দ – কৃত,ভক্তিচন্দ্রিকা (
ভক্তিশাস্ত্র ) – নারায়ণতীর্থ – কৃত,সিদ্ধান্তরত্ন ( গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন )
- বলদেবকৃত
সংকলিত সম্পাদিত গ্রন্থ –
A
Descriptive Catalogue of Mimansa Mass in Govt . - Sanskrit Library , Banaras.
Annual Catalogue of MSS acquired for - Saraswati - Bhavana , Banaras.
গোরখ সিদ্ধান্ত সংগ্রহ
অন্যের লিখিত গ্রন্থের ভূমিকা
গঙ্গানাথ ঝা কৃত
বাৎস্যায়ন ভাষ্যের ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকা,গঙ্গানাথ ঝা কৃত
তন্ত্রবার্তিকের ইংরেজি অনুবাদের ভূমিকা ,দুর্গাচৈতন্য ভারতী কৃত দেবীযুদ্ধে চিন্তনীয় গ্রন্থের ভূমিকা,তারামোহন বেদান্তরত্ন কৃত অগস্তচরিত নামক গ্রন্থের ভূমিকা,পার্বতীচরণ ভট্টাচার্য
কৃত ব্রহ্মচর্য - শিক্ষা নামক গ্রন্থের ভূমিকা,বলদেব
উপাধ্যায় কৃত বৌদ্ধদর্শন নামক গ্রন্থের ভূমিকা,শ্রীমদ্ভাস্করানন্দজীর গুরুদেব রচিত উপেন্দ্রবিজ্ঞান সূত্রের ভূমিকা,মেহের পীঠের সর্ববিদ্যাচাৰ্য সর্বানন্দ রচিত সর্বোল্লসতন্ত্রের প্রক্কথন,হারাণচন্দ্র
শাস্ত্রী - রচিত কালসিদ্ধান্তদর্শিনী নামক গ্রন্থের ভূমিকা, উমেশ মিশ্র রচিত Conception of Matter নামক
গ্রন্থের ভূমিকা,গুরু প্রিয়াদেবী রচিত অখণ্ডমহাযজ্ঞের
ভূমিকা,রাজবালাদেবী রচিত শ্রীশ্রী সিদ্ধিমাতা প্রবন্ধ নামক
গ্রন্থের ভূমিকা, নাথমল টাটিয়া রচিত studies in Jain
Philosophy
গ্রন্থের ভূমিকা, হরদত্ত শর্মা
সম্পাদিত শ্রী শঙ্করাচার্য কৃত সাংখ্যকারিকার জয়মঙ্গলা টীকার ভূমিকা।
গোপীনাথ কবিরাজ তাঁর জীবনদর্শনে যে
কথাটি স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন তা হল সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মুক্তি তথা সমস্ত
মানবের মুক্তি । 'অখণ্ড
মহাযোগ ’ গ্রন্থে
তিনি মানবের প্রচলিত অধ্যাত্ম সাধনার ধারা হতে একটি সুমহান পরিণতির দিকে ইঙ্গিত
করেছেন । তিনি সাধনার খণ্ড খণ্ড ধারাকে অতিক্রম করে অখণ্ড যোগ ধারাকে প্রবর্তন করতে চান এবং তার দ্বারা নিখিল বিশ্বের সমস্ত
ভূতবর্গের কল্যাণ সাধনে তৎপর হয়ে চরম লক্ষ্য পরা মুক্তি বা পরা সিদ্ধি লাভে
উদ্যোগী হয়েছেন । ব্যক্তিগত মুক্তির আদর্শ যা কৈবল্য , মোক্ষ
, নির্বাণ
ইত্যাদি নামে প্রসিদ্ধ তা জগতের সমষ্টিগত দুঃখ - দুর্দশা , দৈন্য , পীড়া দূর
করতে পারেনি । তাই তার কাছে ব্যক্তিগত মুক্তি নয় , সমগ্র
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মুক্তিই হলো সারকথা । সেই অখণ্ড যোগেরই সাধনায় তিনি নিমগ্ন
ছিলেন ।
মানবমুক্তি তথা জীবকে ভগবদুন্মুখ করা প্রসঙ্গে অখণ্ড মহাযোগ গ্রন্থে তিনি বলেছেন - “বিশুদ্ধানন্দের
সেই মহাস্বপ্ন আজ কার্যে পরিণত হইতে চলিয়াছে । বিশুদ্ধ সত্তার মহিমা জগতে কেহই
অবগত নহে । বিশুদ্ধ সত্তা অংশরূপে বিশুদ্ধানন্দ নামে মর জগতে আবির্ভূত হইয়া এবং
নিজে নরদেহ গ্রহণ করিয়া নরের মর্যাদা বাড়াইয়াছেন । যোগী ,ঋষি এবং মুনিগণ ঐশ্বরিক চিন্তা লইয়াই জীবন অতিবাহিত করেন এবং সংসারক্লিষ্ট
জীবকে ঈশ্বর - সন্নিধানে যাওয়ার পথ নির্দেশ করেন ,অথবা
নিজবলে তাহার নিকট লইয়া যান । এই জন্যই তাহারা মহনীয় ও সকলের প্রাতঃস্মরণীয় ।
ভগবানের গুণগান করা ,তাহার লীলা ও কীর্তি জগতে প্রচার করা এবং জগৎ
হইতে জীবের মনকে নানা উপায়ে প্রত্যাহৃত করিয়া ভগবদুন্মুখ করা – ইহাই
তাহাদের জীব - সেবা । তাহারা জানেন ,দেহ অনিত্য ,সংসার অনিত্য,
মনুষ্যের জীবন ও জাগতিক ভোগ্যসম্ভার ক্ষণভঙ্গুর। এই সকল জড় পদার্থ অথবা জড়মিশ্র পদার্থ
পরম চৈতন্যরূপ ভগবৎ বস্তুকে প্রাপ্ত হইবার পথে অন্তরায় স্বরূপ। এইজন্য তাঁহারা দেহ
ও জগতের নশ্বরতা চৈতন্যের নিত্যতা শিক্ষাদান পূর্ব্বক জগতের দিকে বৈরাগ্য উৎপাদন করিয়া
চৈতন্যের দিকে জীবের মনের আকর্ষণ বাড়াইবার চেষ্টা করেন। লোকের মন বিচিত্র, বাসনা বিচিত্র
এবং ধারণা শক্তি বা অধিকার বিচিত্র। তাই মহাজনগণ ভগবানের অধিকারভেদ অবলম্বন পূর্ব্বক
ত্রিতাপ-পীড়িত জীব সকলকে কর্ম মার্গ, ভক্তি মার্গ, জ্ঞান মার্গ এবং বিভিন্ন প্রকার
যোগ মার্গের উপদেশ দিয়া থাকেন। মহাজনগণ উপাসক এবং জীবকে সে উপাসনা শিক্ষা দিয়া থাকেন।“
এই বিশুদ্ধসত্তাকে জানতে হলে
কর্মের প্রয়োজন । বিশুদ্ধানন্দ বিশুদ্ধ সত্তারূপে প্রতি জীবনের মধ্যে বিরাজমান ।
আর এই বিশুদ্ধসত্তা হচ্ছে সকলের আধারের সার সত্তা । এ প্রসঙ্গে অখণ্ড মহাযোগ গ্রন্থে বলা হয়েছে –
“বিশুদ্ধসত্তা
চতুর্দশ ভূবনের উর্দ্ধে ,অর্থাৎ
ব্রহ্মলোকের উর্দ্ধে বিরাজমান । পূর্ণসত্তা হইতে একটি কণামাত্র ,বিশাল অগ্নিরাশি হইতে নির্গত একটি
ফুলিঙ্গের ন্যায় ,নিসৃত
হইয়া মরজগতে উহাকে অবতীর্ণ হইলেন । সাধারণ জীবের জন্ম , অর্থাৎ
চৈতন্য অথবা প্রাণ হইতে যে সৃষ্টি হয় তাহা ক্ষরণরূপী
। উহাকে পরাশক্তির ক্ষরণ বলে । এই প্রকার জন্মে পুরুষ ও প্রকৃতির দৈহিক সংযোগ আবশ্যক
হয় । বিশুদ্ধ সত্তার জন্ম চৈতন্য হইতে নহে , কিন্তু অন্ধকারের বিরাট মন
হইতে । ”
অন্যদিকে তিনি জন্মান্তরের প্রচলিত
প্রথাকে পরিহার করে নিজের সাধনালব্ধ জ্ঞানকে প্রকাশ করে
অখণ্ড মহাযোগ গ্রন্থে বলেছেন –
“নিজেকে
খুঁজিয়া না পইলে,জন্মান্তর
না মানিয়া উপায় নাই। কর্ম্মের উদ্যাপন হইয়া গেলে আর
জন্মান্তরবাদ থাকে না । দেহধারণই জন্মান্তর নহে । চৈতন্যেরও
উদয়অস্ত আছে – তাহাও একপ্রকার জন্মান্তর । কিন্তু বাস্তবিক
পক্ষে জন্মান্তর কোথাও নাই । ”
গোপীনাথ কবিরাজ মনুষ্যত্ব লাভ
সম্পর্কে গতানুগতিক ধারণা থেকে সরে এসে বলেছেন –
“বিরাট
শক্তি নিজের বলে আসিয়া কাহাকেও বলপূর্বক মনুষ্যত্ব দান করিতে পারে । মনুষ্যত্ব
লাভ করিতে হইলে ,
মনুষ্যের ন্যায় কৰ্ম্ম করা উচিত । স্ব - কৰ্ম্ম ব্যতীত
মনুষ্যত্ব আসিলেও তাহার সহিত যোগ হইতে পারে না । অনেকেই মনকে বাদ দিয়া তাহাদের
কর্ম করেন ,
কিন্তু সে ধারণা তাহাদের নাই । যে মন কালে লীন হইয়া থাকে , তাহাকে
পাইবার চেষ্টা অনেকেই করেন না । কিন্তু তাহার জন্য উদয়োন্মুখ বিজ্ঞান প্রতীক্ষা
করিতে পারে না । বিজ্ঞান উদিত হইয়া কালের মনকে না পাইলে স্বভাবের অভাব থাকিয়া
যাইবে । তখন জীবের আত্মগ্লানি আসিবে ও উদ্ধারের পথ পাওয়া কঠিন হইয়া উঠিবে । অপরোক্ষ
শক্তি আয়ত্ত হওয়া চাই । চৈতন্য - ভূমি হইতে উৎকর্ষ লাভ করা ও ব্যষ্টি ভূমি হইতে
কাল সমাপ্ত করা আবশ্যক ।
এভাইে গোপীনাথ কবিরাজ তার
জীবনদর্শনে সমগ্র মানবের মুক্তি কামনা করছেন। মানব মনকে সকলের উর্ধ্বে ষে তিনি স্থান দিয়েছেন। তাঁর মতে , বিচিত্র
মনকে আয়ত্তে আনতে না পারলে জীবের মুক্তি সম্ভব নয় । আর
এক্ষেত্রে কর্মের মধ্য দিয়েই তা সম্ভব । কারণ কর্মের ভেতর দিয়েই মানুষ
বিশুদ্ধসত্তা তথা পরমব্রহ্মকে আনতে পারে । আর এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন মনুষ্যত্ব
অর্জন ।
পরিশেষে বলা যায় - গোপীনাথ কবিরাজ
তাঁর বিরল প্রতিভা ও মনীষার জন্যে জীবিতকালেই ‘কিংবদন্তী
’ - তে
পরিণত হন । যদিও তিনি স্থান - কাল - পাত্রের উর্ধ্ব ,
তবু আমাদের গ্রামে জন্মগ্রহণকারী , আমাদের
নিকট আত্মীয় প্রাতঃস্মরণীয় গোপীনাথ কবিরাজের জন্য আমরা বিশেষ ভাবে গর্বিত সেটা
বলাই বাহুল্য ।
তথ্য নির্দেশ –
( ১ ) স্মরণীয় ,সুশীল
রায় , ওরিয়েন্ট
বুক কোম্পানী ,
কলকাতা , প্রকাশকালঃ সেপ্টেম্বর । ১৯৫৮ , পৃষ্ঠা
-২৩৪ ।
( ২ ) অখণ্ড মহাযোগ , শ্রী
গোপীনাথ কবিরাজ ,
প্রাচী পাবলিকেশনস , কলকাতা , প্রথম
প্রকাশ : বইমেলা ২০০৬ ( একত্রিতভাবে ) , পৃষ্ঠা ১০৪-১০৫ ।
( ৩ ) ঐ , পৃষ্ঠা -১০৭
।
( ৪ ) ঐ , পৃষ্ঠা
-১২৫ ।
( ৫ ) ঐ , পৃষ্ঠা
-১২৪ ।
লেখক পরিচিতি –
রঘুনাথ ভট্টাচার্য-র জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায় । ধামরাই কলেজ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন । বাংলায় স্নাতকোত্তর ও পিএইচ ,ডি । বিভাগীয় প্রধান , বাংলা বিভাগ , নবযুগ কলেজ , ধামরাই , ঢাকা ।
প্রকাশিত গ্রন্থ - ( ১ ) বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্য ( ১৯২০-১৯৩০ ) । ( ২ ) সবুজপত্র গোষ্ঠীর সাহিত্য ভাবনা। ( ৩ ) প্রবন্ধ সংগ্রহ । ( ৪ ) ঈশ্বর ভাবনার বিবর্তন ও অন্যান্য প্রবন্ধ । ( ৫ ) বাংলার বৈষ্ণব দর্শন : সাহিত্যে রাধা ও কৃষ্ণের ক্রমবিবর্তন । এছাড়াও যৌথভাবে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ।