যৌবনে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
(১৮৩৮-১৮৯৪) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) - এই তিন জনের দ্বারা বিশেষ ভাবে
প্রভাবিত হন। তাইতো তিনি জমিদারি অত্যাচার, জাতিগত ভেদাভেদ ইত্যাদির
বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেন। গ্রামের সমাজসেবক সমিতির উদ্যোগে মুষ্টিভিক্ষাসংগ্রহ ও অগ্নিনির্বাপণের কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। অর্থাৎ, জমিদার
বংশের সন্তান হয়েও তিনি নিজেকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন।
বীরভূম জেলার লাভপুরের এক ক্ষয়িষ্ণু
জমিদার বংশে ১৮৯৮ সালের ২৩ জুলাই (৮ শ্রাবণ,১৩০৫ বঙ্গাব্দ) তারাশঙ্কর
বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মাতা
প্রভাবতী দেবী। তিনি পিতা-মাতার জ্যেষ্ঠ সন্তান। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি তাঁর
তন্ত্রসাধক পিতাকে হারান। এই সময়ে তিনি তাঁর মা ও স্বামী-সন্তানহারা পিসিমা
শৈলজাদেবীর তত্ত্বাবধানে মানুষ হতে থাকেন।
১৯৩০ সালে কংগ্রেসের আইন-অমান্য আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্যে তারাশঙ্কর গ্রেফতার হন। ছ'মাসের
জন্যে তাঁকে কারাগারে থাকতে হয়। কারাগারে বসেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
নির্ধারণ করেন তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের গতিপথ। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি অনুভব করেন - আর
রাজনীতি নয়,
সাহিত্য-ই তাঁর স্বভূমি। কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি
প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন - সাহিত্য সেবার পথেই দেশের সেরা করবেন।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জন্মভূমি
বীরভূমের লাভপুর এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যেই বিশ্ব-মানব দর্শন করেন।
এখানকার অভিজ্ঞতা ও সামাজিক সমস্যাকে তিনি বিশ্বের অভিজ্ঞতা ও সামাজিক সমস্যা বলে
মনে করেন। বলা যায় - তিনি বিন্দুর মধ্যে সিন্ধু দর্শন করেছেন। তাঁর গল্পে, উপন্যাসে
বীরভূমের গেরুয়া মাটির রহস্যময় ছায়া, উঁচু-নিচু জমি, প্রকৃতির
রুক্ষ ধূসর রূপ ফুটে উঠেছে।
মাত্র উনিশ বছর বয়সে কাব্যগ্রন্থ 'ত্রিপত্র'-র মাধ্যমে
তারাশঙ্করের লেখালেখির জগতে প্রবেশ ঘটে। কিন্তু, বাংলা
সাহিত্যে তাঁর পরিচিতি কবি হিসেবে নয়, কথাসাহিত্যিক হিসেবে। তাঁর প্রথম
ছোটগল্প 'স্রোতের
কুটো' প্রকাশিত
হয় ১৯২৭ সালে। তারাশঙ্করের প্রথম উপন্যাস 'চৈতালী ঘূর্ণি' প্রকাশিত
হয় ১৯৩১ সালে।
বাংলা সাহিত্যে অপরাজেয় কথাশিল্পী
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮)-এর পরেই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্থানটি
স্থায়ী হয়ে রয়েছে। সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি 'শরৎচন্দ্র
স্বর্ণপদক',
'রবীন্দ্র পুরস্কার', 'সাহিত্য
অকাদেমি পুরস্কার',
'জ্ঞানপীঠ সাহিত্য পুরস্কার' ইত্যাদিতে
ভূষিত হন। ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর (২৮ ভাদ্র, ১৩৭৮
বঙ্গাব্দ) কলকাতায় মানবদরদী সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনাবসান
ঘটে।
সারাজীবন ধরে প্রচুর লিখেছেন
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখালেখির মূল ক্ষেত্র - উপন্যাস ও ছোটগল্প ছাড়াও
তিনি বেশ কিছু কবিতা, গান, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা
ইত্যাদিও লিখেছেন। তাঁর রচিত প্রায় ষাটটি উপন্যাসের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকটি হলো - 'গণদেবতা'(১৯৪২), 'পঞ্চগ্রাম'(১৯৪৪), 'কবি'(১৯৪৪), 'হাসুলি
বাঁকের উপকথা'(১৯৪৭), 'আরোগ্যনিকেতন'(১৯৫৩), 'যোগভ্রষ্ট'(১৯৬০), 'গন্নাবেগম'(১৯৬৫)
ইত্যাদি। তাঁর গল্পগ্রন্থের সংখ্যা ৩৫ । উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো - 'ছলনাময়ী'(১৯৩৬), 'জলসাঘর'(১৯৩৭), 'রসকলি'(১৯৩৮), 'বেদেনি'(১৯৪৩), 'যাদুকরী'(১৯৪৪)
ইত্যাদি। উল্লেখ্য,
তাঁর অনেক গল্প, উপন্যাস চলচ্চিত্রে স্থান পেয়ে
সাফল্য লাভ করেছে।
লেখক পরিচিতি –
ড.বাসুদেব রায়ের জন্ম ১৯৬২ সালে। কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশিত বই মানব' (কাব্যগ্রন্থ), দ্বিতীয় বই রক্তের বাঁধন (উপন্যাস)। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা করলেও প্রবন্ধ সাহিত্যের দিকে তার ঝোঁক বেশি। তদুপরি গবেষণামূলক প্রবন্ধ তথা বই লিখতে তিনি অধিকতর উৎসাহী। গবেষণামূলক বইয়ের পাশাপাশি সাধু-মহাপুরুষদের জীবনী-গ্রন্থ, একাঙ্কিকা ইত্যাদি সম্পাদনাও করেছেন তিনি।
ড.বাসুদেব রায়ের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। হার উল্লেখযোগ্য গবেষণা গুলোর মধ্যে রয়েছে মনসামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ', চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সমাজ-চিত্র ইত্যাদি। তাঁর যৌথ রচনা ও উপেক্ষণীয় নয়।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বাসুদেব রায় নিরলস ভাবে লিখে চলেছেন। এছাড়াও নতুন করে তিনি একক ও যৌথভাবে বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক কাজে হাত দিয়েছেন।