নান্দী:
'মহাভারত'-এর একটি
পার্শ্বচরিত্র একলব্য। অত্যন্ত অল্প সময়ের জন্যই মহাকাব্যে
ছিল তার উপস্থিতি। ( 'শ্রীমদ্ভাগবত'-এ
জরাসন্ধের অন্যতম সেনাপতি একলব্যকে দেখা গিয়েছিল। 'খিল হরিবংশ'-এও পৌণ্ড্র বাসুদেবের সামন্ত নিষাদরাজ
একলব্য যাদবদের বিপক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। 'wikipedia' মতে ডান হাতের বুড়ো আঙুল হারিয়েও সে
উল্লেখযোগ্য যোদ্ধা হয়েছিল। আসন্ন কুরু-পাণ্ডব যুদ্ধে দুর্যোধনের শক্তিবৃদ্ধির
আশঙ্কায় কৃষ্ণ আগেই একলব্যকে বধ করেছিলেন। মহাভারতে ওই অল্প
সময় মুখ দেখিয়েও সে যেন তার ব্যক্তিত্বে অর্জুন, দুর্যোধন,
কৃষ্ণ সবাইকেই ছাপিয়ে
গিয়েছিল। তাঁর সমকক্ষ ছিল কেবল মাত্র কর্ণ এবং দ্রৌপদী। বঞ্চনা এদের তিনজনেরই
হয়েছিল। একলব্যের শূদ্রত্ব, কর্ণের বর্ণসঙ্করত্ব এবং
দ্রৌপদীর দ্বিতীয়-লিঙ্গত্বই ছিল উচ্চবর্ণ-পুরুষ-শাসিত সমাজের কাছ থেকে তাদের পাওয়া
অবহেলা ও নিষ্ঠুরতার মূলে। তবু দ্রৌপদী তার লাঞ্ছনাকারীদের শোচনীয় পরিণতি দেখেছিল।
কর্ণের মৃত্যু অন্যায় যুদ্ধে
হলেও, সে দুর্যোধনের কাছ থেকে সদ্ব্যবহার ও মর্যাদা
পেয়েছিল। একলব্য কিন্তু কোনো স্বীকৃতি বা প্রতিষ্ঠা পায়নি। সে সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হতে পারতো, তাকে
উচ্চবর্ণের মানুষ পঙ্গু করে দিয়েছিল। পরশুরাম কর্ণকে শিক্ষা অসমাপ্ত অবস্থায়
একালের ভাষায় 'rusticate' করেছিলেন।
দ্রোণাচার্য তাকে প্রতিযোগিতায় 'ineligible' ঘোষণা করেছিলেন।
দ্রৌপদীকে প্রথমে হতে হয়েছিল বহুভর্তৃকা, তারপর সইতে হয়েছিল
বস্ত্রহরণের লাঞ্ছনা এবং সব শেষে পেতে হয়েছিল (পাঁচ+) পুত্রশোক।[১] একলব্য এসেছিল
'নিচের মহল' থেকে। নিজের চেষ্টায়
অস্ত্রচালনায় শ্রেষ্ঠ হবার পরে চক্রান্তের বলি হয়ে তাকে আবার অবহেলিত অত্যাচারিত
অবজ্ঞাতদের মধ্যেই ফিরে যেতে হয়েছিল কার্যত 'জয়হীন চেষ্টার
সঙ্গীত, আশাহীন কর্মের উদ্যম' নিয়ে 'শূন্য পরিণাম'-এর ভাণ্ডার হাতে। বস্তুত, রবি ঠাকুরের কর্ণের মতোই
যেন 'নিষ্ফলের হতাশের দলে' মিশে যাবার
জন্য।
মহাভারতের প্রথম দিকে এই কাহিনি পড়ে আমাদের দু:খ হয়।
এই কাহিনি খুব স্বাভাবিক ভাবেই যাত্রা ও নাটকে ব্যবহৃত হয়েছে বারবার নানাভাবে।
বিগত শতাব্দীতে রচিত ড. শঙ্কর শেষের 'আউর এক দ্রোণাচারিয়া', জয় সেনগুপ্তের 'একলব্য',অচিন্ত্য চৌধুরীর 'একালে একলব্য', রাধারমণ ঘোষের 'গুরুদক্ষিণা', অমল
রায়ের 'দ্রোণাচার্য' এবং আরও বহু নাটকে
একলব্য ও দ্রোণাচার্য প্রসঙ্গ নাট্যঘটনা অথবা সংলাপে বারবার এসেছিল। গ্রুপ থিয়েটার
প্রায় সব সময়েই প্রচলিত ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করেছিল। যাত্রার ক্ষেত্রে প্রচলিত
মতের বিরুদ্ধতা করা বা স্রোতের বিপরীতে হাঁটা কঠিন ছিল। কারণ পেশাদার যাত্রায়
ব্যবসা বাদ দেওয়া অসম্ভব । আর সখের যাত্রা আর গ্রুপ থিয়েটার দুইয়ের মধ্যেও সাধারণত
আদর্শগত তফাৎ অনেকখানি। ঐতিহ্যকে নস্যাৎ করে, আবহমান কাল ধরে
পুরান ও ইতিহাসকে যে দৃষ্টিতে দেখা হতো, মুখ্যত গ্রুপ
থিয়েটার সে ভঙ্গিটাই পালটে দিয়েছিল। এইটাই সকলের
জানা ছিল। কিন্ত 'অভিনয়' এবং সুদাম রায়
'মহেঞ্জোদড়ো'-র স্তূপ থেকে তুলে এনে
উপহার দিয়েছিলেন বিস্মৃত ওই কাব্যনাট্য। নূতন করে জানা গিয়েছিল 'মহৎ উদ্দেশ্য যবে একসাথে মিলে সবে'-র কবি কামিনী
রায়কে। যশ মান সম্পদহীন গ্রুপ থিয়েটারের কর্মীরা হৃদয়ে শক্তি পেয়েছিলেন এই ভেবে যে,
'ওরে ক্ষুদ্র, অবজ্ঞাত,
ওরে শূদ্র ভাই,
দেবত্বের পথে যেতে কারো বাধা নাই।'
নাট্যদ্বন্দ্বঃ মহাভারতের কাহিনিতে একলব্য ছিল
বঞ্চিত। তার বর্ণই ছিল কারণ। কামিনী রায়ের সৃষ্টিতে অনেকটাই ক্ষমতাবান ব্রাহ্মণ-
ক্ষত্রিয়- বৈশ্যের সঙ্গে শূদ্র তথা নিপীড়িত শ্রেণীর দ্বন্দ্ব এসেছিল। কামিনী রায়
একলব্যকে বর্ণসঙ্কর রূপে এনেছিলেন। দ্রোণাচার্যের কাছে সে নিজের পরিচয় দিয়েছিল এই
বলেঃ '
'জননী আমার
ক্ষত্র- কন্যা, কিংবা ক্ষত্র
গৃহে প্রবর্ধিতা,....'
দ্রোণাচার্য একলব্যের বর্ণ উল্লেখ
করে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, একলব্যের
ক্ষত্রিয় রাজকুমারদের সঙ্গে 'একাসনে' বসবার
যোগ্যতা নেই। এমন কি দূরে দাঁড়িয়ে শিক্ষাদান পদ্ধতি দেখবার অনুমতিও তাকে দেননি
তিনি। কারণ তাঁর ধারণায় 'নিষাদ
তনয়, / ঊর্ধনেত্রে, পাশহস্তে, পক্ষী ধরিবারে, / বিচরিবে বনে বনে; সামান্য আয়ুধে, / ক্ষুদ্রপ্রাণ মৃগকুল করিবে নিধন;.... ' দ্রোণের
চিন্তায় এটা আসেনি যে, একলব্যের উদ্দেশ্য 'যে শক্তি তাদের(ক্ষত্রিয়দের) আছে, আমাদের(নিষাদ তথা
শূদ্রদের) নাই,' সেই অস্ত্রবিদ্যা অর্জন করা।
এখানে একটি প্রশ্ন একলব্যের মুখে কবি প্রয়োগ করেননি।
ছান্দোগ্য উপনিষদে আছে সত্যকাম জাবালের মুখে তাঁর মায়ের বক্তব্য 'বহ্বহং চরন্তী
পরিচারিণী যৌবনে ত্বামলভে সাহমেতন্ন বেদ যদ্গোত্র স্ত্বমসি ' ('বহু পরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে, জন্মেছিস ভর্তৃ
হীনা / গোত্র তব নাহি জানি।') ব্রাহ্মণ শিক্ষাবিদ গৌতম
বলেছিলেন - 'উপ ত্বা নেষ্যে। ন সত্যাদ্গা ইতি ' ('তুমি
দ্বিজোত্তম, তুমি
সত্যকুলজাত।') সামান্য আগেই একলব্যকে পরামর্শ
দেওয়া হয়েছিল - 'ক্ষত্র বলি দিও পরিচয়, / তাহলে পূরিতে পারে মনোরথ তব।' একলব্যকে দেখে
দ্রোণাচার্যও ক্ষত্রিয় ভেবেছিলেন। কিন্তু একলব্যের আত্মমর্যাদাবোধ এবং নিজের
শ্রেণীর প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য ছিল খাদহীন। সে মিথ্যা বলেনি। ('তার সংলাপ
স্মরণীয় - 'নিষাদেরা অনার্য যদ্যপি / তথাপি অসত্য বাক্য ঘৃণা
করে তারা।') দ্রোণাচার্যের প্রত্যাখ্যানও তার ইচ্ছায় সমাপ্তি
এনে দেয়নি। তার জানা ছিল যে, দ্রোণাচার্যের শিষ্যদের মধ্যে
শ্রেষ্ঠ অর্জুন। একলব্য প্রতিজ্ঞা
করেছিল - 'এক সাথে বসি /যার সনে যোগ্য নহি
শিক্ষা লভিবারে,/তার চেয়ে হব আমি যোগ্যতর....' তারপর সে দ্রোণাচার্যের মৃন্ময় মূর্তি বানিয়ে তার সামনে সম্পূর্ণ নিজের
সাধারণ জ্ঞান ও বুদ্ধি প্রয়োগ করে অস্ত্র চালনা অভ্যাস করেছিল এবং এক সময়ে সে
সত্যই অর্জুনকে (দ্রোণাচার্য এবং তাঁর গুরু পরশুরামকেও কি নয় ?) অতিক্রম করেছিল কোনো পথপ্রদর্শক ছাড়াই।
এখানেও মনে পড়ে ঐতরেয় উপনিষদের স্রষ্টা মহিদাসকে। বলা হয় যে, মহিদাস
উচ্চবর্ণের মানুষ ছিলেন না। আরও বলা হয় যে, তাঁর মা ইতরাও
নিম্নবর্ণের মানুষ ছিলেন। মহিদাসের পিতৃপরিচয় সত্যকামের মতই অজ্ঞাত ছিল। তিনি
নিজের চেষ্টায় জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। ঐতরেয় উপনিষদের
তিনিই স্রষ্টা। একলব্যও নিজের মেধার সঠিক প্রয়োগের
সাহায্যে দ্রোণাচার্যকেও বিস্মিত করেছিল। তাঁর সব থেকে প্রিয় শিষ্য অর্জুন পর্যন্ত
অভিমানের সঙ্গে গুরুকে প্রশ্ন করেছিল - 'হেন শিক্ষা গুরুদেব
দিয়াছ আমায় ?' দ্রোণাচার্যের
আত্মজ অশ্বত্থামাও বিরক্তির সঙ্গে বলেছিল - 'চুরি করিয়াছে
বিদ্যা তব।' ভীম আরও গভীর ভবিষ্যতের চিন্তা করেছিল - 'দুর্যোধন নীচাশয়, ইহারেও ডাকি বন্ধু বলে আলিঙ্গন
দিবে,....'
অস্ত্র পরীক্ষার সময় কর্ণ এসে প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ
করতে চেয়েছিল। সে ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় নয়, - এই অজুহাতে
কর্ণকে বাতিল করেছিলেন গুরু। দুর্যোধন কর্ণকে
নিজের অধিকারে থাকা অঙ্গ রাজ্য দান করে আভিজাত্যে ভূষিত করেছিলেন। দুজনের মিত্রতা
পাণ্ডবদের চিন্তা বৃদ্ধি করেছিল। ওই জুটির সঙ্গে একলব্য যোগ দিলে পাণ্ডব-বিরোধী
পক্ষ অসীম শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে - ভীম এই কারণেই একলব্যকে হত্যা করবার জন্য
বারবার গুরুকে অনুরোধ জানিয়েছিল।
দ্রোণাচার্যও শঙ্কিত হয়েছিলেন প্রিয় শিষ্য অর্জুনের পরাজয় সম্ভাবনায়। সেক্ষেত্রে
তিনিও শ্রেষ্ঠ (অস্ত্র)শিক্ষকের খ্যাতি হারাতেন। ( তাঁর সেই আশঙ্কাই হয়েছিল
একলব্যের স্বশিক্ষা তথা self learning-এর উৎকর্ষ
দেখে।) ড. শঙ্কর শেষ তাঁর বিখ্যাত 'আউর এক দ্রোণাচারিয়া' নাটকে দ্রোণাচার্যের মুখে একটি
সংলাপ বসিয়েছিলেন - 'ও প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে আমার সহায়তা
ছাড়াও মহান ধনুর্ধর হওয়া যায়।'
কামিনী রায়ের নাটকের দ্রোণাচার্য একলব্যের প্রতি
সহানুভূতিশীল হলেও তার বর্ণের পরিচয় ভুলতে পারেন নি। একলব্য যে অস্পৃশ্য সে কথা
তাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। তাকে বলেছিলেন - 'নিরর্থক করিয়াছ
মানব দুর্লভ / জ্ঞান আহরণ, বৃথা শকতি সঞ্চয় / অযোগ্য
আধারে.... ' উত্তরে শিষ্য জানিয়েছিল - 'অস্পৃশ্য আছিনু / স্পৃশ্য আমি আজি.... '
সেই সময়ে অর্জুন মনে করিয়ে দিয়েছিল যে দ্রোণাচার্যকে
যে অপমান করেছিল, সেই দ্রুপদের রাজত্ব ধ্বংস করতে অর্জুনই
পারবে, সম্বলহীন একলব্য নয়। ক্ষত্রিয় অর্জুন এবং ব্রাহ্মণ
অশ্বত্থামা - দুজনেই একলব্যের অস্ত্র দক্ষতাকে,
আরও ভালো করে বললে, শিক্ষাকে বৃহত্তর পটে
বিশ্লেষণ করেছিল। অশ্বত্থামা মনে করিয়ে দিয়েছিল - 'শূদ্র
তপস্বীর কথা- / রামরাজ্যে অমঙ্গল এনেছিল কত ?'
অর্জুন বলেছিল - 'পরাভবি ক্ষত্রিয়
কুমার / অর্জুনেরে, ইতিমধ্যে করিল সাধন / জীবহিত....' অর্থাৎ একলব্যের
উত্থানের সঙ্গেই উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় (এবং বৈশ্যের) প্রাধান্য এবং অধিকারের
অবসানের সূচনা হবে - এই ছিল তাদের আশঙ্কা। ভীম সেজন্যই চেয়েছিল একলব্যের মৃত্যু।
দ্রোণাচার্য যাকে কোনো শিক্ষাই দেননি, তার কাছ থেকে ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল দক্ষিণা নিয়েছিলেন। দ্রোণাচার্য
ভেবেছিলেন, একলব্যকে তিনি জীবন্মৃত করে রেখে যাচ্ছেন।
একলব্যের মা-ও সেই রকমই ভেবেছিলেন। ('হারালে দক্ষিণ বাহু অঙ্গুলির সাথে।') কিন্তু একলব্য
পরাজয় স্বীকার করে নিতে অনিচ্ছুক ছিল। তার শ্রেষ্ঠ রথী হবার স্বপ্ন উচ্চবর্ণের
চক্রান্তে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হলেও, সে তার অস্ত্র জ্ঞান সবর্ণ
ব্যাধ-কিশোরদের দিয়ে যাবার সঙ্কল্প করেছিল।
নূতন আলোয়ঃ - 'তারপরেই আসে
মহাভারত উৎকলিত দুটি দৃশ্য, যেখানে ঘটে মূল অভিমন্যুর বধ ও
তার প্রতিশোধ-অঙ্গীকারে অস্ত্র তুলে নেয় মহাবিক্রম অর্জুন। হঠাৎ মঙ্গল পাঁড়ে,
ডিমিট্রভ ও ভ্যানত্রয়ের কাহিনী-সূত্র ধরে আমরা উপনীত হই
ব্রিটিশ-শাসন-বিরোধী সিপাহী-বিদ্রোহের ভারতবর্ষে,.... ' - লিখেছিল
"অভিনয়'। ড. শঙ্কর শেষের নাটকের কৃপী তাঁর দয়িত
ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অস্ত্রগুরুকে ধিক্কার দিয়েছিলেন - 'তুমি
চুপ করে থেকে অন্যায় হজম করার পরম্পরা
দিয়েছ' । 'অভিনয়' আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছিল - 'বিশ্বের একলব্য
শ্রেণীর জাগরণ মন্ত্র উচ্চারণ করে এ নাটক [৮] একলব্য শ্রেণীর প্রাণে প্রাণে
সংগ্রামী প্রেরণার সঞ্চার করে দেয়।'
বিগত শতাব্দীর শেষার্ধে অপেশাদার
নাট্যগোষ্ঠী গুলো মানব-মননে এক অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল।
সেই দীপ্তি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় লিখে রাখবার চেষ্টা করেছিল 'অভিনয়'। একলব্যের মতোই অর্থ যশ প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেনি 'অভিনয়'। সত্য প্রতিষ্ঠা এবং নাট্যজগতের 'দুর্গম পথের দুর্ধর্ষ অভিযাত্রী'দের উৎসাহ দিয়ে গেছে
দধীচির মতো নিজেকে নি:শেষ করে।
উপসংহারঃ কামিনী রায় 'একলব্য' নাটকটি লিখেছিলেন ১৮৯১-৯২ খ্রিস্টাব্দে। ১৮৯৯-তে মুদ্রিত ও প্রকাশিত
হয়েছিল এটি। নাটকটি অপরিচিত থাকবার কারণ নাটকটির বক্তব্য
রচনাকালকে অতিক্রম করেছিল। প্রাবন্ধিক সুদাম রায়ের ভাষায় 'এ
নাটক ঊনবিংশ শতাব্দীর রচনা হয়েও একেবারে সাম্প্রতিক কালের বিষয়বস্তু এবং
চিন্তাধারাকে ব্যক্ত করবার সামর্থ রাখে।' আমার বক্তব্য,
সুদাম রায়ের মন্তব্য প্রকাশের পরে প্রায় সাড়ে চার দশক অতিক্রান্ত
হলেও এই নাটক আজও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। অনভিনীত এবং স্বল্প পরিচিত এই নাটকটির
প্রতি পাঠককে আগ্রহী করে তুলেছিলেন "মুখবন্ধ'- রচয়িতা
সুদাম রায়। ১৯৭৪-এর সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর সংখ্যায় বিশেষ
গুরুত্ব আরোপ করে প্রকাশ করেছিল 'নাট্য কর্মীদের
সংগ্রামী মুখপত্র' অধুনালুপ্ত 'অভিনয়'। সীমিত সাধ্য নিয়ে দৃঢ় সংকল্প ডেভিড 'অভিনয়'
প্রাতিষ্ঠানিক দৈত্য গলিয়াথকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গিয়েছিল। আয়ু ছিল
স্বল্প। বুদ্ধিজীবিরা অধিকাংশই বিরূপ ছিলেন। ক্ষমতাসীনরা তো 'দুষ্ট-গ্রহ'
ভাবতেন। কিন্তু একের পর
এক 'জতুগৃহ', 'বিদ্রোহী চার্বাক',
'প্রিয়দর্শী'- র মতো অসংখ্য নাটক উপহার
দিয়েছিলেন ওই পত্রিকা-গোষ্ঠী। প্রমাণ করেছিলেন, অসির চেয়ে
মসী বেশি শক্তিশালী। সেই ঋজু মেরুদণ্ডের বিদ্রোহী 'অভিনয়'
এখন শুধুই স্মৃতি। কয়েক দশক আগের উল্কাকে আজ কবি
কামিনী রায়েরই সনেট দিয়েই নমস্কার জানানোই বোধহয় সঙ্গতঃ
'দরিদ্র আছিল তারা, ছিল
না সম্বল
প্রস্তরের এত বোঝা জড় করিবার,
তাদের রাজত্ব হের
অক্ষুণ্ণ কেমন
কালস্রোতে ধৌত নাম নিত্য সমুজ্বল।'
--------------------------------------------------------
তথ্য সূত্রঃ
* কামিনী রায়ের "একলব্য' রচনার প্রায় আড়াই দশক পরে ড আম্বেদকরের কন্ঠ এবং কার্যক্রম সোচ্চার হয়েছিল
'অস্পৃশ্য'দের শিক্ষার দাবি নিয়ে। তিনি
বুঝেছিলেন যে, 'অস্পৃশ্য'দের দাসত্ব
বন্ধন ছিঁড়ে ফেলতে হবে, কারণ ওই দাসত্ব অমানবিক। একদল 'অস্পৃশ্য' শিক্ষালাভ করে অন্যদের শিক্ষার দায়িত্ব
নিক, এই ছিল তাঁর ইচ্ছা।
* কবি কামিনী রায় 'অম্বা'
এবং 'দ্রোণ-ধৃষ্টদ্যুম্ন' নামে আরো দুটি নাট্যকাব্যের স্রষ্টা। শেষ রচনাটির নাম পেয়েছি wikipedia-য়।
* বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে একলব্যের কাহিনী
নিয়ে রচিত তিনটি যাত্রানাটকের সন্ধান পেয়েছি।
(ক) 'দক্ষিণা' -মন্মথনাথ মুখোপাধ্যায়; (খ) 'একলব্য' - ফণীভূষণ
মুখোপাধ্যায় বিদ্যাবিনোদ / বড় ফণী এবং (গ) 'একলব্য' -
বিনয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়
পাঁচকড়ি চট্টোপাধ্যায় কৃষ্ণযাত্রা 'একলব্যের
গুরুদক্ষিণা' লিখেছিলেন।
* আর এক দ্রোণাচার্য - অনুবাদঃ অশোককুমার
সরকার; নাট্যদর্পণ, সেপ্টেম্বর ১৯৭৭
* গ্রীক পুরাণে অ্যারেণি
এবং প্রজ্ঞার দেবী এথেনার একটি কাহিনী আছে। প্রতিযোগিতায় পরাজিত হয়ে এথেনা অ্যারেণিকে
অভিশাপ দিয়ে মাকড়সায় পরিণত করেছিলেন।
লেখক পরিচিতি -
তরুণকুমার দে নরেন্দ্রপুরের রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক কলেজের পদার্থ
বিজ্ঞানের স্নাতক।পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রনিকস অ্যাণ্ড টেলি-কম্যুনিকেশন বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী এবং বায়োলজিক্যাল এফেক্টস অব ইলেকট্রিক অ্যাণ্ড ম্যাগনেটিক ফিল্ডসে পি এইচ ডি অর্জন করেছেন।
তিনি প্রায় তিন দশক ধরে সাধারণ মানুষের কাছে বাংলাভাষায় প্রযুক্তির তথ্য পরিবেশন করছেন, যে প্রচেষ্টার একটি ফসল তাঁর ‘অজানা
দূষণ’ গ্রন্থ।
যাত্রার বিশিষ্ট
পালাকার ব্রজেন্দ্রকুমার দে-র কনিষ্ঠ পুত্র। ছেলেবেলা থেকেই গল্প, প্রবন্ধ ও নাট্যজাতীয়
রচনায় আগ্রহী।
প্রকাশিত গ্রন্থ : বধূ বিনোদিনী, অজানা দূষণ, পালাকার
অঘোরচন্দ্র কাব্যতীর্থ, পালাকার
ব্রজেন্দ্রকুমার দে, যাত্রা নাটক
প্রসঙ্গ, প্রসঙ্গ :
ব্রজেন্দ্রকুমার দে।
অভিনীত যাত্রাপালা: বধূ বিনোদিনী, সুলতান মামুদ, চাঁদ সদাগর, নসীব, আলোর সারথি (ব্রজেন্দ্র-জীবনী)।