তীর্থযাত্রীদের স্বর্গরাজ্য উত্তর
প্রদেশ । নগাধিরাজ ভারত ছড়িয়ে বিশ্ববাসীকে আকর্ষণ করছে । তেমনই আকর্ষণ করছে হিন্দু
পুরাণের চার পুণ্যধাম কেদার , বদরী ,
গঙ্গোত্রী , গোমুখ , যমুনোত্রীকে । নানানজনে গাড়োয়ালকে মর্তভূমির স্বর্গও বলে থাকেন । হিমালয়ের সবস্থানই তপঃপূত । তাই ত দেবতাত্মা বলা হয় হিমালয়কে
। ফলে ফুলে ভরা সবুজে ছাওয়া প্রকৃতি নন্দনকাননসম । পাহাড় ছেড়ে মর্তে নেমেছে স্বর্গের
নদীগঙ্গা । পুরানে জানা যায় সুরনদী ধূর্জটির জটাজাল ভেদ করে স্বর্গ হতে নেমেছিলেন
পৃথিবীতে । বেগ সংহত করার জন্য গঙ্গা হিমবাহের আকার ধারণ করেন এবং ক্রমে প্রবাহিত হয়েছিলেন
ত্রিধারায়। একধারা ভাগীরথী গঙ্গা , অন্য দু'ধারা মন্দাকিনী গঙ্গা ও অলকানন্দ গঙ্গা। শতপন্থ হিমবাহ হতেই এই তিনটি ধারা
তিনদিক দিয়ে নির্গত হয়েছে ।
ভারত তীর্থদর্শনের সহায়তায় অবশেষে
আমার কেদার বদরী গঙ্গোত্রী,যমুনোত্রী - এই
চারদর্শনের সুযোগ হল । মনের গোপনে ছিল এইবাসনা কিন্তু বাস্তবে কোনদিন সার্থক হবে এমনকথা
কল্পনাতে আসেনি । তাই যেদিন ডাক পেলাম দ্বিধাহীন চিত্তে একাকী যাটোর্ধ বয়সে বেরিয়ে
পড়লাম । রাত ৮ টায় দুন এক্সপ্রেসে আমরা রওনা হলাম । মালদা থেকে আরও তিনজন সহযাত্রী
ছিলেন কিন্তু তারা আমার নিতান্তই অপরিচিত । ট্রেনে আমার বার্থউপরে । খাওয়া সেরে আমি
আমার জায়গায় উঠতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম আমার উপরের বার্থে ওঠাটা অনেকেইলক্ষ্য করছেন।
কম্পার্টমেন্টে সবাই তীর্থযাত্রী , তবে সবাই ভারততীর্থ দর্শন
- এর নয় । হৈ,হট্টগোলের মধ্যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা
। ভোর ছ'টায় ঘুম ভাঙ্গল , দেখি ট্রেন
গয়া ষ্টেশনে দাড়িয়ে আছে । আপার বার্থে ওঠাটা যেমন দেখার ছিল , তাইনামাটাও যাতে দর্শনীয় না হয় সেজন্য সবার ওঠার আগেই নামলাম । মুখহাত
ধুয়ে বসে আছি চায়ের আশায় । গতকাল রাতে একটা ছোট্ট ঘটনা ঘটেছিল । ছোট্ট হলেও খুব
আকর্ষক । তাই উল্লেখ না করে পারলাম না । কর্তাগিন্নী তীর্থ দর্শনে চলেছেন সঙ্গে সহকর্মিরাও
গিন্নিসহ বিরাট দল । গাড়ীতে তুলে দিয়ে কাজ আছে বলে চলে গেল হাইকোর্টে প্র্যাকটিসকরা
মেয়ে । এরা সব অফিস পাশ-এ যাচ্ছেন । মেয়ে চলে যাবার পর কর্তা
খেয়াল করলেন যে মেয়ে ‘ পাশ ’
- এর জেরক্স কপিটা দিয়েছে । আসলটা সে ভুলে রেখে দিয়েছে। পরিস্থিতিটা ভাবা যায় না । আর দশমিনিটের মধ্যে গাড়ী ছেড়ে দেবে । দু'এক মিনিটের মধ্যে সবাই মোবাইলসহযোগে ব্যাপারটা মেয়েকে জানাতে সক্ষম হতেই
ওরা হাটে বাজারে ধরে ব্যান্ডেলে পৌছে যায় আমাদের পৌছনোর একটুআগে । সঠিক কাগজ হাতে
পেয়ে স্বস্তি সবারই । জয় মোবাইল - এর জয় ।
সকালে ৮ টার সময়ে ব্রেকফাস্ট পেলাম
— দুটো বাটি কেক , ১ টা কলা ,
১ টা ডিমসেদ্ধ,একটা তালশাঁস সন্দেশ । ডিম
আর কেকসহ যাত্রীদের একজনকে দিয়ে দিলাম –আমি ডিম মাংস খাইনা । ঘন্টাখানেক তার সাথে আলাপ করে নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম
। ঘুমিয়ে পড়লাম – ঘুম ভাঙ্গল বেলা ১২ টায় । দুপুরের খাবারে
ছিল সুসিদ্ধ গরমভাত , আলু - উচ্ছে ভাজা , আলুপটলের তরকারি , মাছের ঝোল এবং চাটনি । বেশ
ভালই খেলাম । যদিও কথা হয়েছিল
আমাকে আলুছাড়া খাবার এবং চিনিছাড়া চা দেবে । এতক্ষণ নীচের দিকে খেয়াল করিনি। এখন
বাতাস আগুনগরম , প্রায় সব পুরুষেরা উর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত করেছেন । কেউ কেউ শালীনতা বজায় রাখার জন্য গেঞ্জিটা গায়ে রেখেছেন
। মহিলাদের গায়ে ভিজা গামছা জড়ান সঙ্গে হাতপাখার বাতাস চলছে । আপার বার্থে আমি আরামেই
আছি , উপরের পাখার হাওয়া এখনও তেমন গরম হয়নি – হলেই বা কি করব ! গরম এবং ঠান্ডা দুটোর বোধই আমার একটু কম অনেকের চাইতে । জানিনা দিনশেষে কতটা গরম
সহ্য করতে হবে ।
বিকেলে অনেকের সাথে আলাপ করলাম ।
ক্রমে জানতে পারলাম আমি যে একা । এটা অনেকেরই দৃষ্টিআকর্ষণ করেছে । আলাপ হতেই সকলের
প্রশ্নে জর্জরিত হতে হল । বললাম আমার স্বামীর শ্বাসকষ্ট আছে তাই উচ্চতা জনিতকারণে উনি
আমার সঙ্গী হতে পারলেন না । তবে মেয়ে আর বাবা অনেক চিন্তা ভাবনা করে আমাকে একাই যাবার
অনুমতি যে দিয়েছে তাতে আমি তাদের কাছে যারপরনাই কৃতজ্ঞ ।
যাইহোক , রাতের খাবার খেয়ে আবার শোয়ার আয়োজন । পরদিন সকালে ৯ টা নাগাদ হরিদ্বারে
পৌঁছলাম । হরিদ্বারে এই নিয়ে আমার দ্বিতীয়বার আসা । হিমালয়ের প্রবেশদ্বার হল হরিদ্বার
। সবার লাগেজ সামলে সুমলে নিয়ে ম্যানেজার এবং অন্যান্যদের সঙ্গে স্টেশনলাগোয়া শিবমূর্তি
, হোটেলে উঠলাম । নিজের নিজের ঘর আর লাগেজ বুঝে নিয়ে স্নানের
জন্য তৈরী হলাম । একটা জিনিস লক্ষ্যরলাম ভাল ঘর পাবার জন্য এবং পছন্দমত ঘর না পাবার
জন্য যাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভের অন্ত নেই । আমার ওসবে কোন ভ্রুক্ষেপ ছিলনা । যাই হোক
স্নান সেরে নিলাম । আমার ঘরে আরও দুই মহিলার স্থান হয়েছে , বুঝলাম এদের সঙ্গেই আমার সারাটা পথকাটাতে হবে । কারুর সাথেই আমার কোন অসুবিধা
হবার কথানয় যদিনা অনিবার্য কারণে কোন অসুবিধা ঘাড়ের উপর এসে পড়ে । এখানে আমার ঘর
সঙ্গিনীদের একটুবর্ণনা দিই। একজন আমার চাইতেও বয়স্কা কিন্তু
যেই শুনলেন আমি চাকুরী হতে অবসর প্রাপ্ত তাই ওনার বয়স সঙ্গে সঙ্গে আমার থেকে অনেক
কমে গেল । বললেন আমি আপনার থেকে ছোট ৫৪/৫৫ হব । অপরজনের চুলের
রঙ ঘঘারতর লাল এবং স্নান করেনা । আমি শুনে হতভম্ভ । এরা দুইবোন তুতো। বড়জন বিবাহিতা ছোটজন অবিবাহিতা । বয়স যে কত তা নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর কোন প্রয়োজন মনে করলাম না । দুজনে মিলে জেরায় জেরায় অস্থির করে তুলল
। কেন আমি একা এসেছি । বললাম, আমার
স্বামী এ্যাজমার পেসেন্ট –তাই ওনার এত উঁচুতে আসা সম্ভব নয়।
-বাবা আসেনি মেয়ে ত ’ আসতে পারত !
– বললাম মেয়ে দিল্লীতে কর্মরতা,আমার সঙ্গে আসবে তেমন দীর্ঘছুটি পাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয় । এবারে আমি
একটু বিরক্তি প্রকাশ করাতে তবে ওরা রেহাই দিল । আমি কিন্তু
ওদের কোন ব্যক্তিগত প্রশ্নই করিনি । বিশেষ করে লালচুলো বিবাহিতা
না বিধবা না কুমারী কোন প্রশ্ন করেই আমি ওদের বিব্রত করিনি । আমার স্বভাবও ওরকম নয়
। আমি খুব কম কথা বলি । বিকেলে অবশ্য আমরা তিনজন একসাথে গঙ্গা দর্শনে গেছিলাম । আরতি
দেখে একাই ফিরে এসেছি । ভিড়ে ওদের খুঁজে পাইনি ।
পরদিন সকালে স্নান সেরে জল খাবার
খেয়ে বাসে করে রওনা হলাম সীতাপুরের উদ্দেশে ।
দেবপ্রয়াগে এসে দশমিনিটের জন্য বাস থেকে নেমে সঙ্গমে গেলাম । মন্দাকিনী ও অলকানন্দার
মিলিত ধারায় ভাগীরথীর মিলন ঘটেছে দেবপ্রয়াগে । অপূর্ব সে সৌন্দর্য । উদার উন্মুক্ত
পরিবেশে পাহাড় বনভূমির প্রেক্ষাপটে দুই পাহাড়ী নদীর সঙ্গম যে কি অপরূপ তা আমার পক্ষে
সম্ভবই না ভাষায় প্রকাশ করা । শুধু মুগ্ধ ও স্তব্ধ বিস্ময়ে দুচোখ ভরে দেখেছি ।
বিশাল খাড়া পাহাড়ের গা ঘেষে আমাদের
বাস চলেছে । অপরদিকে গভীর খাদ । মনে হচ্ছিল উপর থেকে যদি কোন পাথর গড়িয়ে নামে বাসের
মাথায় ! বাস চলেছেই । পথ ভালো , ভাঙ্গা চোরা নয় । দুটো বাস পাশাপাশি উঠতে নামতে
পারে এতটা চওড়া,যদিচাকা পিছলোয়
তাহলে আর ভাবতে হবে না । বেলা একটা নাগাদ পথের ধারে একটা হোটেলে আমরা খাওয়া সেরে নিলাম
। আমাদের নিজস্ব রাঁধুনীরাই রাতজেগে সব রান্না করে সঙ্গে নিয়ে নেয় পথে সুবিধামত জায়গায়
আমরা খেয়ে নেই । আমাদের রাধুনি খুব ভাল রান্না করে চেটেপুটে খেয়ে নিই । তবে আলুনিয়ে অভিযোগ করিনা । পথের অসুবিধা সহ্য করে নিতে হয় অযথা অভিযোগ
করলে উপায় কি। অশান্তি কোনরমেই কাম্য নয় তবে আগাগোড়াই ওরা আমাকে চিনিছাড়া চা খাইয়েছে
। খেতে দিল ভাত , ডাল , আলুচুর ডালনা
। ( একদম ধোকার ডালনার মত দেখতে ) আর আলু পোস্ত। সবখাবারই
খেতে ভাল। কোন ব্যাপারে আমার কোন অভিযোগ ছিলনা তাছাড়া আমার সদাহাস্যমুখ ওরা খুব পছন্দ
করত । মাসিমার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা যাচ্ছেনা বলে দুঃখিত হলেও আমি ওদের নিষেধ করতাম
-বলতাম আমার কোন অসুবিধা হচ্ছেনা তোমরা নিশ্চিন্তে থাক।
খাবার পর আবার বাস । কিছুক্ষণ যাবার
পর বাস থামল রুদ্র প্রয়াগে যেখানে স্বর্গের মন্দাকিনী মিলিত হয়েছে অলকানন্দার সাথে
। তাদের মিলিত ধারা বয়ে চলেছে কলকল ছলছল অনুপম ছন্দে । পাহাড়ের বুকে যে কোন দুটো
পাহাড়ী নদীর মিলনদৃশ্যই অপূর্ব । পাহাড় ফাটিয়ে , আকাশ কাঁপিয়ে নদী উৎস থেকে ঝাপিয়ে পড়ে ছুটে চলে বাঁধনহারা হয়ে । এ চলায়
বন্যতা আছে, তবু যেন ছন্দহারা নয় । রুদ্রপ্রয়াগের মিলনস্থলকে
পিছনে ফেলে আমাদের বাস চলেছে মন্দাকিনীকে বাঁদিকে রেখে তার উৎসের দিকে । বহুক্ষণ ধরে
বহু বাঁক ঘুরে বিভিন্নরূপে মন্দাকিনীকে দেখতে দেখতে চলেছি
। ভাগ্যক্রমে আমার জায়গা ছিল জানলার ধারে । হালকা সবুজাভ রঙের এই জলধারা ক্ষুদ্র বৃহৎ
, অতি বৃহৎ উপল খন্ডের সাথে কি যে খেলা করে চলেছে তা অপূর্ব
। আমার উপযুক্ত ভাষার অভাব তাই যথার্থ বর্ণনা করতে পারলাম না । একটানা বাস যাত্রা খুবই
বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে প্রায় সবার কাছেই । অবশেষে বিকেল ছ'টায় আমরা পৌছলাম সীতাপুরে । বাস থেকে নেমে লাগেজ নিয়ে সবাই অসহিষ্ণু কার কোথায় কেমন ঘর জুটবে এই নিয়ে হুড়োহুড়ির অন্ত থাকেনা। সবার শেষে যখন
ম্যানেজার ডাকদেন মাসীমা আপনার দোতলার ৪ নম্বর ঘর,তখন উঠে যাই চুপচাপ , আমাদের লোকেরাই লাগেজ নির্দিষ্ট ঘরে পৌঁছে দেয় । হাতপা ধুয়ে বারান্দার রেলিঙে ভর
দিয়ে চা চিড়াভাজা খাচ্ছি আর শুনছি সকলের কথাবার্তা । সবাই ব্যস্ত বাড়ীতে খবর পাঠাবার
জন্য । আমি ভাবছি সন্ধ্যার এই অন্ধকারে PC0 খুঁজতে বেরনো ঠিক হবে কিনা। সকালেই খবর দেব ভাবলাম যদি সময় পাই । খুব অভিমান হয়েছিল
যখন আমাকে Cellphone , ক্যামেরা ,
বাইনোকুলার , নিদেন একটা চর্টও দেওয়া হলনা
দেখে । কেননা আমার কিছুই গুছিয়ে নেবার অভ্যাস নেই সবই হারিয়ে ফেলব । মেয়ে শেষমুহুর্তে
বলেছিল মা টাকাগুলো যেন সামলে রাখতে পার ও গুলো হারালে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে, তোমার তীর্থে
যাওয়াই ব্যর্থ হয়ে যাবে । মন থেকে সব অভিমান সরিয়ে নিয়েছিলাম।যেতেত মত দিয়েছে- এটাই আমার অনেক ।
পরদিন সকাল ছ'টার মধ্যে রওনা হতে হবে কিন্তু যা হবার অর্থাৎ বেরুতে বেরুতে সেই ৭ টা নাগাদ
বাসযাত্রা শুরুহল সীতাপুর থেকে গৌরী কুন্ডের পথ মাত্র তিন
কিলোমিটার । এক কিলোমিটার মত যাবার
পর বাস থেমে গেল । Law and order - one way হওয়ার জন্য বাস
ঘোরানোর জায়গা নেই –সুতরাং গৌরীকুন্ডে হেঁটেই যেতে হবে ।
অনেকেরই মুখ শুকিয়ে গেল । আমি কিন্তু ভয় পাইনি । আমার ঘরসঙ্গী
দুইমহিলা হাঁটাপথে গৌরীকুন্ড থেকে কেদারধামে যাবে – ওরা সেভাবেই
তৈরী হয়েছে । ওদের আলাপ আলোচনা শুনে আমারও মনে হচ্ছিল - হেঁটেই
যাই , ১৪ কিলোমিটার তো পথ । সঙ্গে সঙ্গে এও ভেবেছি যে কিছুটা হাঁটার পর যদি না পারি সবটা পথ হাঁটতে,তবে মাঝপথে তো কিছুই
পাব না । কাজেই মন ঠিক করে নিলাম হাঁটব না । আমার সঙ্গে ৩৬ জন সহযাত্রী আছেন বটে তবে
আমার তো কেউ নেই । এখন যখন গৌরীকুন্ডের জন্য হাঁটতেই হবে তাতে
পরীক্ষা হয়ে যাবে আমার ক্ষমতা কতটুকু । একটু অভিজ্ঞতা হোক । হাঁটা শুরুলাম,১০/১২ মিনিট পরেই দেখি , আমার ধারে কাছে কোন সহযাত্রীই
নেই সবাই এগিয়ে গেছে । আমি যে কতখানি অথর্ব তা বুঝতে দেরী হল না ।এখনতীর্থ দেবতাইসম্বল । গলদঘর্ম হয়ে একসময়ে গৌরীকুন্ডে পৌছলাম । প্রথমেই
বলে রাখি গৌরীকুন্ডকে প্রথমদর্শনেই আমার নরককুন্ডমনে হয়েছিল । হয়ত রাতে কিছুবৃষ্টি
হয়ে থাকবে , জলে থিকথিকে কাঁদা তাতে
ঘোড়ার পুরীশ আর প্রস্রারের উৎকট দুগর্ন্ধ । ওরই মধ্যে চলছে
ঘোড়া , খচ্চর , ডান্ডি কান্ডি ডুলি
নিয়ে নানান্ ভাষায় নানান সুরে দরকষাকষি । যাত্রীরা দেশের
নানান প্রান্ত থেকে এসেছেন , তাদের নিজের নিজের ভাষায় চিৎকার
চেঁচামেচিতে কান ঝালাপালা । ম্যানেজার ভদ্রলোককে বলেছিলাম আমাকে একটা ঘোড়া ঠিক করে দেবার জন্য । তিনিই আমাকে ঘোড়া ঠিকরে দিলেন যার সহিস একটি বাচ্চা ছেলে। ওর সাহায্যেই ঘোড়ার পিঠে চড়লাম
ও চলতে শুরু করে দিলাম। এখানে বলে রাখি এখানে যেগুলিকে ঘোড়া বলে চালাচ্ছে সেগুলি ঘোড়া
নয় । ঘোড়ার চাইতে একটু নীচু আর বড় বড় কান -এগুলিই বুঝি
খচ্চর । সবাই রওনা হয়ে গিয়েছে আমিই পিছনে । বাচ্চা সহিসকে বললাম , তুমি এত ছোট , পারবে তো আমাকে নিয়ে যেতে ? ও বলল “ ও খুব ভাল ভাবেই আমাকে নিয়ে যাবে । নির্দেশমত চড়াইয়ের সময়ে একহাতদিয়ে
পিছনের আংটা ধরে চিৎ হয়ে আর উৎরাইয়ের সময় দুহাতে সামনের আংটা ধরে ঝুঁকে পড়ে প্রাণীটার
সঙ্গে শরীরের ভারসাম্য রক্ষাকরে চলতে হচ্ছিল । নাম জিজ্ঞেস
করলাম সহিসকে – নাম বলল গাড্ডু । আরও বলল,সিজনের সময়ে ওদের পরিবারের প্রায়
পুরুষই এইকাজ করে রোজগার করে । গাড্ডুর পরিচালনায় যেতে যেতে
আমি ৩/৪ বার পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি ওরই সাহায্যে । দোষ আমার
আমি পথের দিকে মোটেই খেয়াল রাখছিলাম না । বাঁদিকের পাহাড়ের দেওয়াল থেকে জায়গায়
জায়গায় পাথর বেরিয়ে আছে । খেয়াল না করলে সেগুলোতে গুঁতো খেতেই হচ্ছে । আমার সহিস গাড্ডুও আকাশমুখো- এইবার
প্রথমও কেদারধাম যাচ্ছে যাত্রী নিয়ে ও মসগুল চারদিকের বিশাল বিশাল পাহাড় বন আকাশ
দেখতে দেখতে যাচ্ছে । এবার মাথার ওপর একটা পাথর ঝুলন্ত অবস্থায়
আছে যেটা আমার বুকপর্যন্ত ওর তলায় আমার বাহনঢুকে পড়েছিল প্রায় । আমার চিৎকারে গাড্ডু প্রাণপন টেনে প্রাণীটাকে বের করে বলে মহাবিপদ থেকে বেঁচে গেলাম । আমার
বাহনটিও হাড় জিরজিরে অতি দুর্বল প্রাণী । যতবার মার খাচ্ছে ততবারই একটু তাড়াতাড়ি
চলছে তারপরেই আবার ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলা । আর চড়াই ,উৎরাই-এর ফলে আমার অন্যভ্যস্ত শরীর যে কষ্ট পাচ্ছে
তা বোঝান যাবেনা । কাঁধের ঝোলায় এরাত কাটানোর মত টুকিটাকি
দু'একটা জিনিস । দুইহাতে শক্ত করে লোহার আংটা ধরে থাকতে হচ্ছে এবং উৎরাই আসামাত্র একটা হাত দিয়ে পেছনের আংটা
ধরে চিৎ হতে হচ্ছে এই অবস্থায় কাঁধের ঝোলটা কাঁধে রাখতে খুবই
অসুবিধা হচ্ছে । ওতে টাকা আছে তাই গাড্ডু ওটা ছোঁবেনা –
ওদের বিশ্বস্ততা অকল্পনীয় আজও। প্রচন্ড চড়াই , অজস্র বাঁক উপর থেকে নেমে আসা যাত্রীদের চাপ কাজেই পথের কষ্ট খুবই কিন্তু
এসব বাদ দিলে যা থাকে তা যে এ জীবনে কখনও মনের থেকে মুছে যাবেনা । সীতাপুরে পৌছনোর আগে পর্যন্ত মন্দাকিনীর অনুপম নৃত্যছন্দে বিশাল বিশাল সবুজ পাহাড়ের পটভূমিকায়
মুগ্ধ ছিলাম । কিন্তু এখানে ? দুধারে কাছে দূরে বিশালাকৃতি
বনময় পাহাড় তার মাঝখানে দিয়ে বয়ে চলেছে মন্দাকিনী -- আর তারই পাশে পাশে সঙ্কীর্ণ
পাহাড়ী পথে আমরা চলেছি অগণিত তীর্থযাত্রী ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের । কতজন তো হেঁটেই চলেছেন লাঠি ঠুকে ঠুকে পথের ধার ঘেষে । পথের বাঁদিকে পাথরের দেওয়াল – সেদিকটা বেশ নোংরো । ওরই মধ্যে জায়গায় জায়গায় ঘোড়াদের জল খাবার জায়গা । ভারতের সর্বপ্রান্তের
মানুষ চলেছেন কেদারেশ্বরের চরণপ্রান্তে পৌঁছেদর্শন স্পর্শন করে পুজা করে কৃতার্থ চিত্তে ভক্তির অর্ঘ দেবার আশায় । কতজনের কত প্রার্থনা , কত দুঃখ
ভারাক্রান্ত জীবনের মুক্তির আশা আমার মন প্রাণ কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ যে আমার স্বামী ও কন্যা
আমাকে অনুমতি দিয়েছে । আমাকে একাই আসতে দিয়েছে। ঈশ্বরের অহৈতুকী
কৃপার জন্যই আমি আজ চলেছি এই পথে । কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে
গেছে - দুচোখে নেমেছে জলের ধারা । দুহাত বন্ধ – শুধু চারদিক চেয়ে চেয়ে দেখছি। মন্দাকিনী কি বিপুল জলরাশি কি বিরাট বিরাট
প্রস্তর খন্ড প্রতি মুহূর্তে সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে করতে বয়ে
চলেছে কলকল ছলছল নয় বিপুল গর্জন করতে করতে। সমস্ত পথটাই অনির্বচনীয় সৌন্দর্য নিয়ে প্রকৃতি সেজে রয়েছেন
।
সকালবেলাই আমাদের
হাতে দুপুরের খাবারের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছিল । পথে চটিতে বিশ্রাম
নেবার সময়ে খেয়ে নেবার জন্য । পথে কেউ কারোর খবর রাখবেনা যে যার মত চলেযাবেন —
ম্যানেজাৱের নির্দেশ। সত্যিই তো এপথে কে কাকে দেখবে – এ যেন মহাপ্রস্থানের পথ ।
রামওয়াড়া চাটিতে নেমে দেখলাম অনেকেই খেয়ে নিচ্ছেন । আমিও ভাবলাম এখানেই খেয়ে নিই। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার ব্যাগের কোথাও সাবানটা পেলামনা মানে নিতে ভুলে গেছি । যাত্রীরা কেউ আমাদের দলের বলে মনে হল না । তাই সাবান দিয়ে না ধোওয়া হাতে খাবার খেতে প্রবৃত্তি হল না – দিয়ে দিলাম গাড্ডুকে । আমি দোকান থেকে একটা ঠন্ডাপানীয় কিনে খেলাম । তখন মাথার উপর রোদ বেশ গরম লাগছিল । গরীব মা-বাবার সংসারে গাড্ডুরা সবাই ঘোড়া কিংবা খচ্চর ভাড়া নিয়ে বেড়িয়েছে উপার্জনের জন্য , ও ওর টিফিনের পয়সাটা বাঁচিয়ে আমার খাবারটা খেতে পেয়ে খুব খুশী । ওরা গাড়োয়ালী খুব পরিশ্রমী ও খুব বিশ্বস্ত । ১৫ মি . বিশ্রাম নিয়ে আবার পথ চলা শুরু । যথাস্থানে পৌছে সহিসই বলে দেবে নেমে পড়তে,তখন সামনের পথ বেয়ে এগিয়ে গেলেই মন্দির – মন্দিরের পাশেই গায়েত্রীভবনে আমাদের রাতের আশ্রয়। একথা বলে দিয়েছিলেন ম্যানেজার । কেউ যেন পিছনে না তাকায় , কেননা পেছনে তাকাতে গেলেই পড়ে যাবেন তাও মনে পড়ল । ম্যানেজারের সব নির্দেশ মনে আছে কিন্তু গরুর চটি পেরুলেই বাঁদিকে পেছনে মন্দিরের স্বর্ণকলস দেখা যাবে – সেইজন্য অনবরত মাথা ঘোরাচ্ছিলাম বলে গাড্ডু, যে গাড্ডু সেভেনে পড়া একটা পুচকে সেও আমাকে ধমকে উঠল।সওয়ারী পড়ে গেলে ওর দুর্নাম হবে –বাজার খারাপ হবে ইত্যাদি । সত্যিসত্যি যখন সেই স্বর্ণশিখর দেখতে পেলাম সুনীল আকাশতলে ঝলমল করছিল তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম । ' জয় কেদারনাথের জয়’ ধ্বনি দিয়ে বাকী পথটুকু সতর্ক হয়ে চলতে লাগলাম । প্রায় পৌনে ৩ টে নাগাদ ঘোড়া থামিয়ে গাড্ডু বলল – “ আ গেয়ী উৎরাইয়ে আন্টিজী'— বলে আমার পায়ের বাঁধন খুলে দিল । নেমে পড়লাম । টাকা পয়সা মিটিয়ে দিয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে চলতে শুরু করলাম মন্দিরের দিকে। সবাই যেদিকে যাচ্ছে আমিও চলেছি সেদিকে । এই জায়গাটা বেশ চড়াই - একটুপর পরই দুচারটে বড় বড় সিড়ি । সামান্য হেঁটেই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লাম –এতটাই যে পা তুলতেই পারছিলাম না । একটু অবাকই হলাম এরকমটা কেন হচ্ছে যে এক পাও সামনের দিকে এগুতে গেলে কষ্ট হচ্ছে অসম্ভব । শেষে পথের ধারে বসে পড়লাম । সামনেই মন্দাকিনীর সেতু । হঠাৎ মনে হল উচ্চতা জনিত কারনেই এরকম অচল হয়ে পড়েছি । কী করি ভাবছি – হঠাৎ দেখি আমাদের দলের এক তরুনী মা আর তার ছেলে আমাকে খুঁজতে এসেছে । ওদের চেষ্টায় দুজনে দুপাশে ধরে আমাকে নিয়ে রেষ্ট হাউসে পৌছে দিল। কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল । ওরা তিনজন মা , বাবা ও ছেলে । ভদ্রলোক ভেটেবিনারি সার্জন । সেই থেকে ওদের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা হল। কিন্তু ওদের ঠিকানা রাখিনি তাই পরবর্ত্তীতে আর যোগাযোগ করতে পারিনি। পথের পরিচয় পথেই শেষ হয়ে গেছে। ঘরে পৌছে দিয়ে ওরা তো চলে গেল,এদিকে তখন আমি খাবি খাচ্ছি । প্রায় জ্ঞানহারা হতে চলেছি – একজনকে দেখতে পেয়ে বললাম আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে এক কাপ চা অথবা গরম জল দেবার কথা একটু বলুন আর ম্যানেজারকে খবর দিন । চায়ের কাপ হাতে একটু পড়ে স্বয়ং ম্যানেজার এলেন । রাস্তায় খাওয়া হয়নি শুনে খুব বকাবকি করলেন । আর অনুরোধ করলেন যাতে ওনাকে নাম ধরে ডাকি কেননা মাসীমা আমি আপনার ছেলের মত আমার নাম তরুণ, আপনি তরুন বলেই ডাকবেন । চা,পকোড়া খেয়ে মন্দিরে চলে আসুন আরতি শুরু হয়ে যাবে , ৬ টার পর মন্দির বন্ধ হয়ে যাবে । চা খেলে আশা করি আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন ” এই বলে তরুণ মন্দিরে চলে গেল । একটু পরেই উঠে দেখলাম রাঁধুনীরা ছাড়া আর কেউ নেই সেখানে।ওদের কাছ থেকে পথনির্দেশ নিয়ে মন্দিরে পৌছে গেলাম । দেখলাম সবাই লাইনবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে । আমিও দাঁড়ালাম মনের মধ্যে তোলপাড় করে উঠল । কী সুন্দর করে সাজিয়েছে । প্রদীপ হাতে পুরোহিত আরতি করছেন। কী অপূর্ব দৃশ্য । ছবিতে দেখা – টিভিতে দেখা সেই শ্রীশ্রী কেদারনাথের মন্দির । আরতি শেষ হয়ে গেলে লাইনবেঁধে সকলে একবার করে মন্দিরের দরজার সামনে যেতে পারছে,প্রনাম সেরে পরের জনকে সুযোগ দিতে দরজা ছেড়ে যাচ্ছে ।
পাহাড়ের পটভূমিকায় ৩৫৮৪ মি . উঁচুতে
কেদারধাম ত্রিকোনাকৃতি প্রকান্ড মালভূমি । চিরতুষার মন্ডিত পৰ্বতমালা বেষ্টিত শান্তিও
গাম্ভীর্যপূর্ণ স্থান । স্থানের উচ্চতার জন্য শ্বাসকষ্ট অনুভূত হয় । কেদারনাথ অতি
জাগ্রত দেবতা ।স্মরণমাত্রই আশুতোষ ভক্তদের প্রতি প্রসন্ন
হন । এখানে বহুতীর্থের সমাবেশ । পঞ্চপান্ডব মহাপ্রস্থানের পথে কেদার ধামে এসেছিলেন
। এই পুণ্যধামে এসে মনপ্রাণ ভরে যায় একদিব্য আনন্দে । কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার
পর মন্দির প্রাঙ্গণে একা একাই এদিক ওদিক দেখছি । মন্দিরের পিছনের দিকে সারিবদ্ধ বসে
আছেন রুদ্রাক্ষশোভিত জটাজুটধারী কয়েকজন সন্ন্যাসী। সাহসকরে
একজনের সঙ্গে কথা বলতে গেলাম আমার হিন্দি ইংরাজী মিশ্রিত ভাষা শুনে উনি পরিস্কার ইংরাজীতে
জানালেন আমার প্রশ্নের উত্তরে,যেটানে উনি এপথে এসেছেন সেটান কেউ অগ্রাহ্য করতে পারেনা । কোথায় আমার শেষ আমি
জানিনা।'ওনার কাছে জানতে চাইলাম শঙ্করাচার্যের সমাধির কথা
। উনি অঙ্গুলি নির্দেশে দেখিয়ে দিলেন আর বললেন ভোর ৪ টায় সময়ে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি মন্দিরে প্রবেশ করে নিজের হাতে পূজা করতে পারবো। শঙ্করাচার্যের সমাধির পাশে নতজানু হয়ে বসলাম । শঙ্করাচার্য আমার অন্তরের আনন্দ । ওঁর কথা ভাবলেই মনে ভেসে ওঠে গেরুয়াধারী নগ্নপদ দন্ডক
করমন্ডলু হাতে একসুদর্শন অষ্টমবর্ষীয় বালক সন্যাসী চলেছেন দুর্গম নর্মদাতটে
গুরুর সন্ধানে।
পরদিন ভোর ৪ টায় লাইনে দাঁড়িয়েছি
৭ টার সময় মন্দির খুললেই যাতে প্রথম দিকে পূজা দিতেপারি । গায়ত্রীভবনের একতলার একেবারে
শেষের ঘরে জানালার ধারে আমার বিছানা । পাশ দিয়েই মন্দাকিনী বয়ে চলেছে হুড়মুড় শব্দ
করতে করতে – সে শব্দে কার ঘুম আসবে!ইচ্ছে হচ্ছিল জানলা খুলে দেখি কিন্তু এত ঠান্ডা যে নড়তে পারছিলাম না । সকাল ৭ টায় মন্দিরে ঢুকেছি। পান্ডাজীর থেকে ঘি,মধুনিয়ে মাখালাম সেই প্রস্তর খন্ডে । প্রস্তর খন্ডই বটে । প্রচলিত শিবলিঙ্গ
নয় যেন কোন মহিষের পেছনের অংশ । হতে ফুল বেলপাতা নিয়ে পান্ডা ঠাকুর কি মন্ত্র বললেন
সেসবে আমার আর হুঁস নেই । দু’হাত
দিয়ে জড়িয়ে ধরে চোখের জলে ধুয়ে দিতে লাগলাম সেই ,পাথরের
দেবতাকে । দেবতা যদি শুধু পাথর খন্ডই হন তবে কেন এত আকুতি,কেন এত চোখের জল!খরখরে প্রস্তর ,মসৃন নয় । নিজেকে কিছুটা সংযত করে মন্দির গৃহের চারদেওয়ালের দিকে তাকিয়ে
দেখতে লাগলাম । ভেতরের দেওয়ালে নানা দেবদেবী মূর্ত হয়েছেন । আর বেশীক্ষণ ভেতরে থাকা গেল না । পরবর্তী দর্শনার্থীদের জায়গা ছেড়ে দিতে হবে । আবার একবার মাথা
ঠুকে প্রণাম করে সকলের মঙ্গলকামনা করে বাইরে বেরিয়ে এলাম । মন্দির প্রদক্ষিণ করে সাষ্টাঙ্গে
প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই চোখ চলে গেল আকাশে – হাঁ করেতাকিয়ে
আছি । ওরা কারা ? কি দেখছি ? নীলকান্তমণির
মত সুনীল ঝকঝকে আকাশের বুকে গলান রূপোর চাদর মুড়ে দাঁড়িয়ে
আছে শিখরের পর শিখর । রৌদ্রকরোজ্জ্বল হিমশীর্ষ হিমালয় এত সুন্দর দেখতে। কাকে ছেড়ে
কাকে দেখি । নয়নলোভন এই সুন্দর আকাশের দিকে অবাক হয়ে
তাকিয়ে থাকলাম । সম্বিত ফিরতেই ঘড়িতে দেখি সাড়ে ন’টা। মনে
পড়ল ম্যানেজার বলেছিলেন সাড়ে ন’টার মধ্যে সবাইকে রওনা হতে হবে। জয় কেদারনাথজী ধ্বনি
দিয়ে গেট দিয়ে বেরতে যাব – পেছন ফিরে একবার মন্দির দর্শন করে পথের ধুলি মাথায় তুলে
নিলাম – ‘এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় ধরণীর ধুলি।‘
দৌড় লাগালাম গায়ত্রীভবনের দিকে
। ভেতরে ঢুকে দেখি যাত্রীরা কেউ নেই,আর রাধুনীরা খাচ্ছে। আমার খাবার দেখিয়ে দিয়ে বলল খেয়ে নিন,ম্যানেজার আপনার জন্য ঘোড়াস্ট্যান্ডে অপেক্ষা
করছে । তাড়াতাড়ি যা পারি কয়েক গ্রাস খিচুড়ি খেয়ে রওনা হলাম।দেখি ঘোড়া স্ট্যান্ডে ম্যানেজার দাঁড়িয়ে আছে
আমার জন্য রাগত ভাবে । বললাম তরুণ,তুমি তো বকবে বলে দাঁড়িয়ে আছ, তা বকো, আমি একটুও
আমি একটুও মনখারাপ করবো না । এ জীবনে তার
তো আসা হবে না তাই একটু দেরী হয়ে গেল । তরুণ বলল – আপনার এই বয়সে এই দুর্গমে একাকী যাত্রী হতে সাহস দেখে অবাক হয়েছি ,তার ওপর খামখেয়ালীপনা । সবাই রওনা হয়ে গেছে । ভয়ে ভয়ে বললাম , রাধুনীরা আছে তুমি আছ । আমরা সবাই হেটে নামবো -
শুধু এই ঘোড়াটা আছে , আপনি ঘোড়ায় চড়তে না পারলে আমাদের সঙ্গে হাঁটতে হবে , পারবেন?
আমি বললাম , 'খচ্চরে আমার অসুবিধাই হচ্ছিল , আমি দিব্যি ঘোড়ায় চড়তে
পারব।‘ বলে একটা উঁচুমত জায়গায়
দাঁড়ালাম, সহিস আমার বাঁ পা-টা পাদানীর সঙ্গে
বেঁধে দিল আমি ডান পা ছড়িয়ে লাফ মেরে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলাম
। হাসিমুখে তরুণকে বললাম , ধন্যবাদ । ' ‘Best of Luck ' বলে ওরাও রওনা দিল ।
এবার ফেরার পালা তায় আবার সেই চড়াই
উৎরাই , তবে উৎরাই - ই বেশী । ঘোড়াও চলেছে ঘরমুখো
দ্রুতগতিতে । অনবরত হাত সামনে পেছনে করে চলেছি , চোখ রয়েছে আকাশের স্বর্ণকলস কখন দেখব সেদিকে । এবার তো সামনে তাই গরুর চটীর কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেলাম
ঝকঝকে স্বর্ণশীর্ষ । সেটা পেছনে চলে গেলে এবার দুপাশে তীক্ষ্ণ নজর ব্লেক লিলি দেখতে পাই কিনা । পেলাম – অবিকল
গোখরো সাপের মত ফণা তোলা - সাদা লম্বা লিকলিকে গর্ভদণ্ডটি জিভের মত হাওয়ায় দোল খাচ্ছে না । না
জানা থাকলে ওটাকে ফুলবলে কেউ সহসা বিশ্বাস করতে পারবে না । সহিসকে
বললাম অন্তত একটা ফুল ছিড়ে এনে দাও – বকশিস দেবো। কিন্তু
গাছটা মন্দাকিনীর খাড়াই ঢালের গায়ে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে । একেবারে কিনারায় গিয়ে
শুয়ে পড়ে তবে নাগাল পাওয়া যাবে । সহিস চেষ্টা করল খানিকটা কিন্তু পারল না বলল “তোড়না মানা হ্যায় ' । অদ্ভুতফুল এই স্লেক লিলি
— এখানে অর্থাৎ এই ধরণের উচ্চতাতেই ফোটে । নানান ফুলের সাথে
ফোটে ব্রহ্ম কমল ।
ঘোড়া নামছে কিন্তু খুব দ্রুত গতিতে
কোন কোন সময়ে লাগাম টেনে রাখতে হচ্ছে । অবিলম্বেই পৌছে গেলাম গৌরীকুন্ডে । দেখি সবাই
পৌছে গেছে বাসের অপেক্ষায় একটা ঘরে বসে আড্ডা
দিচ্ছে।পুরুষেরা বাইরে ঘোরাঘুরি করছে । আমি মেয়েদের ঘরে ঢুকে
জিজ্ঞেস করলাম – আপনারা কেউ গৌরীকুন্ডে গেছেন কি ?
এখন যাবেন আমার সাথে ? সবাই আমার কথা শুনে
শিউরে উঠল । সরু সিড়ি কোন পাতালে চলে গেছে কে জানে –
আমরা কেউ যাইনি । আপনিও অতটা সাহস দেখাবেন না । প্রথমে বিরক্ত হলাম
। তারপর ভাবলাম সহযাত্রী তো , তাই
রাগ প্রকাশ করলাম না কিন্তু হেসে বললাম – সাহস আমার বেশী নেই
কিন্তু সবাই যা দেখতে এতদুর আসে তা না দেখেই চলে যাব ? আমার
সঙ্গে আমার বাড়ীর কেউ আসেনি ঠিক আছে কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি হঠকরিতা করবো।অবশ্য এটাও ঠিক যে কেউ আমাকে শাসন করবে সেটাও মেনে নেবনা যতটুকু পারি নামব
– না পারলে ফিরে আসব । আমার এই কথা সবার মনঃপুত হবে না জানি
তাই সেদিকে না তাকিয়ে এগিয়ে গেলাম কুন্ডের দিকে । সরু সিঁড়ি নেমে গেছে— সাহস করে
দেওয়াল ধরে নামতে লাগলাম গুনে দেখিনি কটা সিঁড়ি , কেননা শেষ পর্যন্ত পারব কিনা নামতে সেটাই ছিল মাথায় তাই নেমেও গেলাম ।
জলে হাত দিয়ে দেখি আরামদায়ক গরমজলের কুন্ড । একটু নেমে বসলে শরীর ডোবে এমনভাবে বসেই ছিলাম। পাড়েই ছিল একটা কারুর ফেলে
যাওয়া ছোট বালতি,তাই দিয়ে দিব্যি আরামে স্নান করলাম। কী আরাম যে লাগল ! গরম জামা সালোয়ার কামিজ সব
পাড়ে খুলে রেখে রাতপোষাক পড়ে স্নান সেরে নিতে পেরে যারপরনাই
তৃপ্তি পেলাম । পাড়েই গৌরী দেবীর ছোট্ট মন্দির । এইখানে নাকি গৌরীদেবী শিবের জন্য
তপস্যা করেছিলেন । উঠে এলাম উপরে উঠতে একটুকষ্ট হচ্ছিল । যাহোক্, বাস তখনি এল,সবার আগে গিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে
বসে পড়লাম। হাতেভিজা জামাটা প্লাষ্টিকে পোটলা করে নিয়েছি
। আবার কানাকানি কিছু কিছু কানে এসেছিল কিন্তু নিজে চুপচাপই ছিলাম । শুধু তরুণ যখন
জিজ্ঞেস করল আমি গৌরীকুন্ডে নেমেছিলাম কিনা সেটা জানার পর
প্রশংসাই করল । বলল আমি সবাইকেই বলেছিলাম যাবার জন্য কেউ গেলনা । জায়গাটা ভালই। সন্ধে ৬ টা নাগাদ আমরা সীতাপুরে পৌছে গেলাম । যে যার ঘরে ঢুকেছি এবং এতক্ষণ পরে
আমার ঘরসঙ্গী দুই মহিলার সঙ্গে দেখা । জিজ্ঞেস করলাম ওদের অভিজ্ঞতার কথা । উঠতে বা
নামতে কষ্ট কতটা হয়েছে । বলল - “যে জন্য আসা তাই হয়নি ওঠা
নামাই সার । ' রাত ৮ টার সময় ওরা কেদারে পৌছে বন্ধ প্রাঙ্গণের সামনে প্রণাম সেরেছে, আবার
ভোরে ৬ টার সময়ে বন্ধ মন্দিরদ্বারে দেবতার উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে নেমে এসেছে
- “ কেন যে হেঁটে যাবার কথা ভেবেছিলাম -
দেবদর্শনই হল না । আপনি বলুন আপনার কাছ থেকে শুনি । ‘ বললাম
আমার কথা শুনে বলল আপনার সঙ্গ আর ছাড়ব না । কোথাও ’। আমি হাসলাম
।
লেখক পরিচিতি –
যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।