লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
-না , আজ যা ঘটল মেনে নেওয়া যায় না
। এত অপমান সহ্য হয় না । একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে । চন্দ্রিমা দেবী ভেতরে ভেতরে
ফুঁসছেন । কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না । রাগে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে । আসুক ছেলে
- বৌমা , সাপের পাঁচ
পা দেখেছে । বলা নেই কওয়া নেই যখন যা খুশি করবে , হুট করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে
যাবে ! বাড়িতে গার্জিয়ান রয়েছে অথচ অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না । নাকের
ডগা দিয়ে শ্বশুর - শাশুড়িকে অগ্রাহ্য করে হনহন করে বেরিয়ে গেল
। এত বড় আস্পর্ধা । রাগে গজগজ করছেন ।
ব্যাপারটা খোলসা করে বলি ।
চন্দ্রিমা দেবীর একমাত্র সন্তান অনল , ব্যাঙ্কের অফিসার । বছর খানেক আগে বিয়ে দিয়েছেন । ভালোবাসা
বা প্রেম করে বিয়ে নয় , রীতিমত দৈনিক খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে । দেখাশোনা করেই
বিয়েটা হয় । বাড়ির সকলেই দেখেছেন । তাছাড়া নিকট আত্মীয় - স্বজন যেমন মামা -
মামি , পিসি -
পিসেমশাই এমনকি তুতো দাদা - বোন কেউই বাদ যায়নি । এক বাক্যে
সবার পছন্দ । পরিবারটিও ভদ্র , শিক্ষিত । চাকরি করা মেয়ে । কলেজে পড়ায় , একদিকে ভালোই , দুজনের রোজগার মন্দ কি । বিয়ে তো
হল , প্রথম দিকে
ঠিকই ছিল । শ্বশুর - শাশুড়িকে মান্যগণ্যও করত । শাশুড়ির কন্ট্রোলে ছিল । যা বলত
শুনত। শাশুড়িমা যদি বলেন,বৌমা আজ কলেজে যাওয়ার দরকার নেই ।
তথাস্তু , বলত ঠিক আছে
মা , বলছেন যখন
যাব না । যদি বলা হয় , বৌমা আজ রান্নাটা তুমিই করো । তাতেও রাজি । ঠিক আছে মা, চিন্তা করবেন না , আমিই করছি বলে হেঁসেলে ঢুকে যেত
। ওমা , ওটা তো
অভিনয় । প্রথম প্রথম পাক্কা অভিনয় করে গেছে । কত ছলা - কলাই না জানে বাপু ! বছর
ঘুরতে না ঘুরতেই অন্য মূর্তি । মুখের উপর বলে দিচ্ছে , আজ কলেজ কামাই করা যাবে না , ইম্পর্টেন্ট ক্লাস আছে ।
অজুহাতের শেষ নেই , বলে দেবে
ছুটি নেই । এখন আবার ছুটির দিনগুলোতেও হেঁসেলে ঢুকবে না । নানা বাহানা
। খাতা দেয়া আছে , সময় নেই , যা হোক একটা বানিয়ে বলে দিলেই হল । পেটের
ছেলেটিও হয়েছে তেমন , রা-টি করবেনা। বেশি বললে,বলবে ওর কাজের ইম্পর্টেন্স আমি বুঝবো কী করে ? খাতা দেখা তো ওর ডিউটি ।
সবসময় বৌমার দিকে কোল টেনে কথা বলবে । বলবে ভালো পড়তে গেলে
নিজেকেও পড়তে হয়, তাই তোমার বৌমা রাতে পড়াশোনা করে । ও তুমি বুঝবে না ।
আদিখ্যাতা । আমরা যেন পড়াশোনা করিনি । ওর
মতো অনার্স , এম.এ. , পি.এইচ.ডি , না হয় করিনি। কলেজে তো গেছি , বি.এ. পাশটাতো করেছি । না-তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে , আমরা গণ্ডমুর্খ , কিছুই বুঝি না । পেটের শক্র
বলছে , কাকে আর দোষ
দেব । আজ আবার কলেজ থেকে ফিরে সাজুগুজু করে দু'জনেই বেরিয়ে গেল । একবার বলারও প্রয়োজন বোধ করল
না । সন্ধে হয়ে গিয়েছে । চন্দ্রিমা দেবীর এখন ঠাকুর ঘরে যাওয়ার
সময় , কিন্তু আজ
মুড নেই । মন চঞ্চল । এই সময়টা ঠাকুর ঘরে কিছুক্ষণ থাকেন । সন্ধ্যা - আরতি করেন ।
আজ একটা ধূপকাঠি জ্বেলে দিয়ে চলে এলেন । ভেতরে ভেতরে গজরাচ্ছেন । ঠাকুর পুজো
মাথায় উঠেছে ।
পরিতোষ বাবু অর্থাৎ চন্দ্রিমা দেবীর স্বামী ,তিনি কিন্তু খোশ মেজাজে আছেন । ভাবখানা এমন , আমি কারও সাতে - পাঁচে নেই , এসব মেয়েলি ব্যাপারে থাকার ইচ্ছেও নেই । কেউ যদি নালিশ করতে আসে ,যাহা ন্যায় তাকে ন্যায়ই বলব , অন্যায় হলে স্পষ্ট বলে দেব— ইহা অন্যায় । বাস্তবে কিন্তু অন্য কথা বলে । সব ক্ষেত্রে অবশ্য নয় , যতদিন চাকরি করেছেন বা বন্ধু বান্ধবদের মধ্যেও সবাই জানে , পরিতোষ স্পষ্ট কথার মানুষ । তবু গোঁড়ায় গলদ । নিজের গৃহিনীর কাছে কিন্তু স্পষ্ট কথা বলতে পারেন না । অন্যায়কে ন্যায় বলতে নাকি বাধ্য হন । যদিও কখনও সখনও বলে ফেলেন কদাচিৎ ,পরক্ষণেই হার নিশ্চিত জেনে মৌনই থেকে যান ।
পরিতোষবাবুর ব্যাখ্যা অবশ্য অন্য রকম , সংসারের শান্তি বজায় রাখার জন্যই নাকি ‘ না ’ কে হ্যাঁ, হ্যা-কে কে না বলেন । আর নিজের স্ত্রীর কাছে আবার ছোট বড় কি ? তারা তো জিতবেই । চিরকাল জিতেই থাকেন । যুক্তি তর্কের ধার ধারেন না । জেতাটাই আসল । ক্ষতি কি ? তাতে যদি সংসারের মঙ্গল হয় সেই পথ অনুসরণ করাই তো উচিত । সবচেয়ে বড় কথা তারাই তো সংসারটাকে আগলে রাখেন , তাই নয় কি ? তাতে তাদের দু - চারটে অন্যায়কে ঘাড় কাত করে হ্যাঁ, বলতে অসুবিধাটা কোথায় ! ইদানিং অবশ্য পরিতোষ বাবুর পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে । এখন অন্যায়কে সহজে ঘাড় বেঁকিয়ে হ্যাঁ, বলেন না । প্রতিবাদ করেন , সংযত ভাবেই বলেন । এটা হয়েছে বাড়িতে পুত্রবধূ আসার পর । পুত্রবধু গিন্নির মত নয় । যুক্তি - তর্ক বোঝে , ন্যায় - অন্যায় বোধজ্ঞান আছে । এহেন ক্ষেত্রে পুত্রবধূকে সমর্থন করতে তিনি বাধ্য না হলে তার শিক্ষা দীক্ষা রুচিতে প্রত্যাঘাত করবে ।
আর তাতেই হয়েছে সংসারের
অশান্তির সূত্রপাত । হুকুম ,পুত্রবধূকে কোনমতেই সমর্থন করা যাবে না । এই অবস্থায়
দুদিকে ভারসাম্য বজায় রাখা খুবই বিপদজনক । কোনদিকে যাবেন তিনি । প্রথমে ঠিক করলেন
, সংসারের খুঁটিনাটি ব্যাপারে
তিনি থাকবেন না । কিন্তু না থেকে উপায় নেই যে , হেড অফিসের সর্বময় বেগম সাহেবা
। তার কাছেই যে নালিশ করতে আসে । সমাধান যে তাকেই করে দিতে হবে । মৌনব্রত পালন
করলেও চলবে না । আর এখন ‘হ্যাঁ’ কে না আর ‘ না ’ কে হ্যাঁ, করাও যাবে । সেই প্রাচীন
প্রচলিত প্রথা এখানে খাটবে না । উভয় সংকট । কাকে সন্তুষ্ট করবেন তিনি ? তাই অনেক গবেষণা করে ভেবে
চিন্তে ঠিক করলেন ,সত্যের পথে
চলাই শ্রেয় । চলা শুরুও করে দিয়েছেন । ফলে পরিণাম যা হওয়ার ছিল তাই হচ্ছে ।
বৃদ্ধ বয়সে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে কোথায় একটু শান্তিতে থাকবেন তা নয় , উল্টে গৃহিনীর অহরই মুখ ঝামটা, কটুক্তি শুনেই দিন কাটাতে হচ্ছে
। তার দিকে নজরটাই কমে গেছে । এই যেমন এখন সন্ধে বেলা তিনি এককাপ চিনি ছাড়া চা
খান । দীর্ঘদিনের অভ্যেস । চায়ের নেশায় উসখুশ করছেন । কিন্তু কই!
স্ত্রীর তো ওর দিকে খেয়ালই নেই । সাধারণত বৌমাই চা - টা করে । আগে এককাপ চিনি
ছাড়া করে পরিতোষ কে দেয় । তারপর বাকি সবার জন্য আলাদা ভাবে করে । আজ বৌমা নেই, ওকে বলেই গেছে , নন্দনে একটা নাটক দেখবে । কদিন
আগেই বলে রেখেছিল । সেই মত অনলও অফিস থেকে সকাল সকাল চলে আসে ।
চায়ের নেশা বড় নেশা , না হলেই নয় । বাধ্য হয়েই স্ত্রীকে
বললেন ,“এক কাপ চা
হবে তো ?” স্ত্রী
চন্দ্রিমা তেলে - বেগুনে জ্বলে উঠলেন , “কেন তোমার আদরের বৌমা কোথায় ? বৌমার হাতে ছাড়া তো তোমার চা রোচে
না । আসুক বৌমা তারপর খাবে । ” স্ত্রীর এমন রণচণ্ডী ভাব দেখে ভেতরে ভেতরে বেশ মজাই
পাচ্ছেন পরিতোষ । বৌমা,শাশুড়ির ঠান্ডা - গরম লড়াই সর্বক্ষণ
ওয়াচ করেন তিনি । মনে মনে বৌমাকেই সাপোর্ট করেন তিনি । মুখে কিছু না বললেও আকার
ইঙ্গিত , হাবভাবে
বুঝিয়ে দেন— আছি তোমার
সঙ্গে । যেহেতু আজকের ঘটনার কোন অভিযোগ পরিতোষের কাছে পেশ করা হয়নি । তাই প্রকাশ্যে
কারও পক্ষ নেওয়া যাবে না। মুখে কিছু বললে তো লঙ্কাকান্ড বেধে যাবে । পরিতোষ বললেন
, “ওদের তো আসতে রাত দশটা হয়ে
যাবে , অতক্ষণ চা না
খেয়ে থাকা যাবে ?”
দশটা বাজবে কেন ? হুট করে বেরিয়ে যায় , কিছু বলতে পার না , আরে ওরা তো নাটক দেখতে গেছে
নন্দনে । খুব ভালো নাটক ।
—নাটক যাত্রা দেখেই বেড়াক । আর আমি কিছু বললেই বলবে কাজ আছে
। নানা অজুহাত । বাহানা । গুরুজনের পারমিশান নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেনা । ইচ্ছা
হল তো চলে গেলাম , কাউকে কিছু
বলারও তোয়াক্কা করে না ।
—কি বলছো তুমি ? আমাকে তো বলেই গেছে , আমিও তো গুরুজন নাকি ?
- রাখো তোমার গুরুজন ! তেমাকে বললেই হয়ে গেল ? আর কেউ নেই বাড়িতে ? এমন বেলেল্লাপনা কত দেখতে হবে
কে জানে ?
-এসব কি বলছো তুমি ? আরে সঙ্গে তো আমাদের খোকাও গেছে
,নাকি । একা তো যায়নি ? - খোকাটা তো হয়েছে একটা ভেড়া ।
ওটা আর মানুষ আছে নাকি । বউয়ের কথায় ওঠে বসে , বউয়ের আঁচল ধরা। বউ যা বলবে
তাই বেদবাক্য ।
পরিতোষ মুচকি হেসে বললেন ,“তা ঠিক । ভেড়ার সন্তান ।
ভেড়াইতো হবে । সব জিন ঘটিত ব্যাপার । অন্যকিছু হলে
আশ্চর্য হতাম । ”
—কি ! কি বললে তুমি ? চন্দ্রিমা রেগে অগ্নিশর্মা ।
পরিতোষ মোলায়েম সুরে বলতে লাগলেন , “ সেটাতো ভালোই বুঝতে পারছো । আমি তো তোমার কথা বরাবর
বেদবাক্য বলে মেনে এসেছি। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি দু'বছর হয়ে গেল এখনও তার নড়চড় হয়নি । ”
বিজ্ঞরা বলেন , দুপক্ষ উত্তেজিত হলে সংঘাত ঘটার সম্ভাবনা , বিশেষ করে স্বামী - স্ত্রীর মধ্যে যদি বাদ - বিতন্ডা শুরু হয় তখন একপক্ষ অর্থাৎ একজন নরম না হলে সমূহ বিপদ , কতদূর গড়াবে কেউ বলতে পারে না । আইন - আদালত করতেও পিছপা হন না । তখন বয়স কোন ফ্যাক্টর নয় । বৃদ্ধবয়সেও এমন নজির অনেক আছে । রাগের বসে বুদ্ধিভ্রমে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন ।
এক্ষেত্রে এতটা ঘটার সম্ভাবনা
হয়ত নেই । চন্দ্রিমাদেবীর রাগের যে বহিঃপ্রকাশ , যে ছটফটানি তা কিন্তু পরিতোষ
বাবুর নেই । তিনি অত্যন্ত শান্ত মেজাজে নরম সুরে বলে চলেছেন । এখন কথা হলো সুর নরম
হলেও তার থেকে যে কী হারে হুল ফুটছে তা কিন্তু উভয়েই টের পাচ্ছেন । উত্তেজিত না
হয়েও তার এই ক্ষুরধার কথার জ্বলুনী অনেক বেশি মারাত্মক । পরিতোষ উপলব্ধি করছেন ,এবার স্ত্রীকে শান্ত করা দরকার ।
স্ত্রী বললেন ,“তুমি তো এখন এসব কথাই বলবে ।
সারাক্ষণ বউ - কে আশকারা দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলছ ।
কাউকে গ্রাহ্যই করে না , যখন যা খুশি ইচ্ছেমত করে চলেছে । ” — তুমি ভুল করছো চন্দ্রা । মৌমিতা
খুব ভালো মেয়ে । ভদ্র , সভ্য , রুচিশীল লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে । সামান্যতম অহংকার
নেই । এত পড়াশুনা করেছে , চাকরি করছে , ওর তো সংসারের কিছুই করার কথা নয় । এর মধ্যেই কলেজ করে
বৌমা সংসারের টুকটাক যা করে এতেই তোমার ধন্য হওয়া উচিৎ।
—আদিখ্যেতা । তোমাকে কি তুক করেছে জানি না বাপু । খালি সুখ্যাতি । কারণে অকারণে শুধু সুখ্যাতি । দেখে গা পিত্তি জ্বলে যায় । খোকাকেও বলিহারি । বৌ বলল ,চল নাটক দেখে আসি , অমনি ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলল । মুখের উপর না বলার মুরোদ নেই । পরিতোষ বিজ্ঞের মত ঘাড় নেড়ে বলল, তা ঠিক , তা ঠিক , বাপকা বেটা । ” চন্দ্রিমা আরও রেগে গেলেন , “ আবার ঐ এক কথা ! তুমি আমার কথায় উঠতে - বসতে ? আমি কবে তোমায় নাটক দেখার জন্য বায়না ধরেছি ? এমন বেআক্কেলে আবদার কখনও করিনি । ”
– নাটক দেখার কথা অবশ্য বলনি । তা ঠিক । তবে সিনেমার কথা মাঝে
- মধ্যেই বলতে । নিয়েও যেতাম । একদিনের কথা মনে আছে , অফিস থেকে ঠিক সময়ে ফিরতে
পারিনি বলে সেদিন সিনেমা দেখতে যাওয়া হয়নি । কী অশান্তি করেছিলে ,মনে আছে ? সারা রাত ঘুমোতে দাও নি । তোমার হয়ত মনে নেই । আমি কিন্তু
ভুলিনি ।
– দেখো বাজে কথা বলো না । কবে দু'চারটে সিনেমায় নিয়ে গেছ ,আমার মনেও পড়ে না । যদি গিয়েও থাকি সংসারের সব
কাজকর্ম করে,রীতিমত গুরুজনদের অনুমতি নিয়ে তবেই গেছি । -ছেড়ে দাও ওসব কথা । একটু মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা কর চন্দ্রা । দিনকাল
পাল্টাচ্ছে । ওদেরকে নিজেদের মত থাকতে দাও । শান্তি পাবে ।
-এবার শুরু করবে বৌমার গুণকীর্তন , যা চন্দ্রিমার শুনতে অসহ্য লাগে
। তাই রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন । স্বামীর চিনি ছাড়া চা-টাতো করে দিতেই
হয় ।
শাশুড়ি বৌমার মধ্যে এমন একটু
হয়েই থাকে । আবহমান কালের ধারা । তারপর যদি বৌমা নিজের শাসনে না থাকে , কথা না শোনে,সেখানে তার
প্রশংসা কোন শাশুড়ির ভালো লাগবে ? নিরপেক্ষভাবে দেখলে শাশুড়িমায়ের
যা ভাবনা তাতে কোন অন্যায় নেই । হয়ত আধুনিক কালের সঙ্গে তা মিলবে না ।
চন্দ্রিমার মা এবং শাশুড়িমায়েদের কাছ থেকে যেমন শিক্ষা পেয়েছেন তেমনি তার
পুত্রবধূকে শেখাতে চান । যাতে সংসারটাকে ধরে রাখতে পারে । সংসারের প্রতি মায়া -
মমতা থাকে । একমাত্র পুত্র , পুত্রবধূ — তাদেরইতো সংসার । ভবিষ্যতে যাতে তারা সুখ - শান্তিতে থাকে
মায়েরা তো তা চাইবেনই । সেই ভাবেই মনের মতো গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তার পুত্রবধূকে
। কেউ বুঝলো না ,বাড়ির সকলে
তার বিপক্ষে ,এমনকি তার
নিজের স্বামী পর্যন্ত । কেউ তার মনের ইচ্ছেটা বোঝার চেষ্টা করল না । সেই
আক্রোশে যেমন ফুসছেন তেমনি ভেতরে ভেতরে কষ্টও পাচ্ছেন ।
পরিতোষের চিন্তাধারা আবার একটু
অন্যরকম । তিনি মনে করেন এসব শিখতে হয় না । শিক্ষিতা,বুদ্ধিমতি মেয়ে ; সংসারের খুঁটিনাটি সমস্যা যখন
ঘাড়ে এসে পড়বে তখন ঠিকই সামাল দিতে পারবে । তা নিয়ে এখনই অত ভাবার কি আছে । সবে
বিয়ে হয়েছে , একবছরও কাটে
নি । এখনই কেন এসব ভাববে । জীবনের শখ - আহ্লাদ কবে করবে ? সবকিছু আমাদের আমলের মতো ভাবলে
হবে ? এসব
চন্দ্রিমা কেন যে বোঝেনা । বোঝালেও বুঝবে না, সেকেলে ধ্যান - ধারণা নিয়ে বসে
আছে । মনের মত করে নাকি গড়ে তুলবে , যেন বাচ্চা শিশু যা শেখাবে তাই
শিখবে । অনেক বুঝিয়েছেন চন্দ্রিমাকে ,পরিতোষের কথায় কর্ণপাতই করেনি । বাড়ির কারো কথাই বিশ্বাস
করছেন না । উল্টে সকলের প্রতি একটা বিরূপ মনোভাব পোষণ করে চলেছেন । ফলে এই ছোট্ট
পরিবারে কারো মনে কোন শান্তি নেই । সংসারে চারটি মাত্র প্রাণী । আরেকজন কাজের
মহিলা অবশ্য আছে ,সকাল থেকে
রাত আটটা পর্যন্ত থাকে । সংসারের টুকিটাকি সব কাজই করে। দীর্ঘদিন ধরেই আছে ।
চন্দ্রিমাকে হাতে হাতে সাহায্য করে । কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে ঐ মহিলাই সংসারের পুরো
রান্নাটা করছে । চন্দ্রিমার কেমন গা - ছাড়া ভাব । হেঁশেলে ঢোকে না , সংসারে মন নেই কেমন নির্লিপ্ত
উদাসীন মনোভাব ।
******
ঠিক এক বছর পরের ঘটনা । পরিতোষ
বাবুর সংসারের কিছু কিছু মুহূর্ত তুলে ধরছি । এতে পাঠক উপলব্ধি করতে পারবেন
বর্তমান সংসারের হাল - হকিকত কেমন । এক রবিবারের দুপুর । ছুটির দিন । মধ্যাহ্ন ভোজনের
সময় পরিতোষ এবং পুত্র অনল সবে খেতে বসেছে । স্ত্রী মৌমিতা, শাশুড়িমাতাকে
বলল , “ মা তুমি বসে
পড় , আমি খেতে
দিচ্ছি । ”
শাশুড়িমাতা বললেন , “ না বৌমা , তুমি বসো , আমিই খেতে দিচ্ছি । ”
– না, না, আমিই দিই ।
তুমি বসো ।
– না না বৌমা তা হয়না । তুমি ছোট , তোমার অতক্ষণ না খেয়ে থাকার
অভ্যেস নেই । তুমি বসে পড় আমিই দিই ।
কিছুক্ষণ এভাবে চলল । শাশুড়ীমা বলছেন
আমি দিই , বৌমা বলছে না
আমি দিই ।
তখন পুত্র অনল বলল , আরে তোমরা অমন করছো কেন ? খাবার - দাবারগুলো ডাইনিং
টেবিলে নিয়ে চলে এসো না , চারজনে । একসঙ্গেই বসে পড়ি ।
তখন শাশুড়ীমাতা বললেন , “ হ্যাঁ, হ্যাঁ, বৌমা সেই ভালো খাবারগুলো
টেবিলেই নিয়ে নিই । দরকার মতো বাঁ হাতে নেওয়া যাবে । ”
তারপর চারজনে একসঙ্গে খাওয়া
শুরু হলো । গল্পগুজবের মধ্যে ভোজনপর্ব চলছে । বৌমা শাশুড়িমাতাকে বলল , “ মা আজ খেয়ে - দেয়ে দুপুরে ঘুমোবে
না । আমরা কিন্তু ঠিক দুটোর মধ্যে বেরিয়ে যাব । ”
পরিতোষ বললেন , “ সেকি বৌমা , তোমার মা-র তো দীর্ঘদীনের
অভ্যাস , দুপুরে না
ঘুমিয়ে কী পারবেন ? কেন ? দুটোর সময় কোথায় যাবে ?
সেকি বাবা , আপনাকে বলেছিলাম না , আজ আমি আর মা তিনটের শো’য়ে একটা নাটক দেখতে যাব ?
– ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলেছিলে বটে , তা তোমার মা কি যেতে রাজি
হয়েছেন ?
শাশুড়িমাতা বললেন , “ কি বলবো বলো , বৌমা বলল তাই না করতে পারলাম না
। যাই ঘুরে আসি।”
পরিতোষ বললেন ,“ হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাও । না করবে কেন ? দেখে এসো ভালো লাগবে । ”
আরেক দিনের ঘটনা । সেদিন ছিল সম্ভবত বুধবার । মোটকথা ছুটির দিন নয় । সকাল সাতটায় বৌমা হেঁসেলে ঢুকলো । শাশুড়িমাতাকে বলল , - “ মা আমি রান্না করব । দুটো স্পেশাল ডিস বানাবো , আজ তুমি বিশ্রাম নাও । ”
- সেকি বৌমা তোমার কলেজ নেই ? সে যদি ইচ্ছে
হয় ছুটির দিনে …।
– না মা,কলেজ যাব না , আজ আমি ছুটি নিয়েছি ।
– সে ছুটি যখন নিয়েছে , বিশ্রাম নাও । রোজ তোমাকে বেরোতে
হয় , যাও শুয়ে
বসে কাটাও। আমিই রান্নাটা করছি ।
– না মা তুমি তো রোজই রান্না করো , তুমি বরং বিশ্রাম নাও । আমি আজ
রান্না করবোই ।
অগত্যা শাশুড়িমাতা বেরিয়ে এলেন । বৌমা যখন এত করে বলছে করুক রান্না।
****
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগাটা
স্বাভাবিক, হঠাৎ এত পরিবর্তনের রহস্যটা কী ? যেখানে শাশুড়ি - বৌমার মধ্যে
রেষারেষি ভাব ছিল তা উধাও হয়ে গিয়ে এত মিলমিশ কী করে হয় ? এর মূলে রয়েছেন এক তৃতীয়
ব্যক্তির পরামর্শ , চন্দ্রিমার
এক পিশতুতো দিদি । দিদি হলেও ওরা বন্ধুর মত । এক পাড়ায় বাড়ি ছিল । স্কুল কলেজে
একসঙ্গে পড়াশুনা করেছে । বয়সের ফারাক বেশি নয়, মাত্র দেড় মাসের ছোটবড় । সেই
দিদি এলেন চন্দ্রিমার বাড়িতে বেড়াতে । দুদিন থাকলেন এবং এই দু'দিনেই এদের সংসারের চাকাটা সচল করে দিয়ে গেলেন ।
তিনি যা বুঝিয়ে গেলেন তার সারমর্ম এইরকম :
আজকালকার শিক্ষিতা আধুনিক
মেয়েকে কখনো শাসন করে অর্ডার দিয়ে কোন কাজ করা যায় না,যাবে না । তাতে হিতে বিপরীত হয় । তার উপর চাকরি করা
মেয়ে , সে তো আরও
শুনবে না। তাদেরকে কাছে টানতে গেলে নিজেকেও কাছে যেতে হবে । তাদের মন বুঝতে হবে ।
আপন করে নিতে হবে । ভুলত্রুটি দূরে সরিয়ে রেখে অল্প কাজেও প্রশংসা করতে হবে
আন্তরিক ভাবে । তার সুখ - দুঃখতে নিজেকেও সুখ -দুঃখ পেতে হবে । সহমর্মিতা প্রকাশ করতে হবে । তবেই না সে তোমাকে
আপন ভাববে!
-ভালোবাসলেই কথা শুনবে ? আপন ভাববে ?
-অবশ্যই শুনবে । শুনতে বাধ্য । মানুষ ভালোবাসার কাঙাল ।
পাষান মানুষও ভালোবাসার কাছে নত হয়ে যায় । হতেই হবে । তুই চেষ্টা করে দেখ।
কথাগুলো চন্দ্রিমাদেবীকে নাড়া দিয়েছে । কয়েকদিন চুপচাপ তার কথাগুলোই ভেবেছেন । মনের ইগো ছেড়ে বেরোতে পারছিলেন না । সংকোচ হচ্ছিল । বৌমার কাছে ছোট হবে । একদিন সমস্ত সংকোচ ঝেড়ে ফেলে মনকে পরিবর্তন করলেন । বৌমা সংসারের যেটুকু কাজ করতো তার অনেকটাই নিজে করে বৌমার প্রশংসা করতে লাগলেন । কারণে - অকারণে বৌমার সুখ্যাতি , হাসিমুখে গল্পগুজব শুরু করে দিতেন । ম্যাজিকের মত কাজ হতে লাগল । এখন সত্যিই উভয় উভয়কে মা - মেয়ের মত ভালোবাসেন । এখন সময় - অসময়ে দু'জনে খুশিমত এখানে সেখানে বেড়াতে যান । বেশ খোশমেজাজেই আছেন । এখন চন্দ্রিমার মনে হয় বৌমা আসার আগে বোধহয় এত আনন্দে ছিলেন না ।
আর এদিকে পরিতোষ ! এদের
কান্ডকারখানা দেখেন আর মনে মনে । হাসেন বেশ আছে দু'টিতে।
লেখক পরিচিতি:
জন্ম পৈত্রিক বাড়ি
বর্ধমান জেলার কাটোয়া-র পানুহাট-এ। পড়াশুনা কাটোয়া কলেজ। বর্তমান নিবাস হুগলী
জেলার চুঁচুড়ায়। পেশায় কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মী ছিলেন। তাঁর প্রথম গল্প---চেতনা।
প্রকাশিত হয় ছোটদের পত্রিকা "শুকতারা"য়, ১৯৯৬ এপ্রিল সংখ্যায়। তারপর বড়দের পত্রিকা--দেশ, কালি ও কলম, শিলাদিত্য, শুভমসাময়িকী,
তথ্যকেন্দ্র, উৎসব, কথাসাহিত্য,
কলেজ স্ট্রিট, দৈনিক স্টেটসম্যান, যুগশঙ্খ, একদিন,সুখবর, সংবাদ নজর, খবর ৩৬৫ দিন এবং লিটল ম্যাগাজিন-এ নিয়মিত
লেখেন। তিনটি গল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। " শতানীক"
(ষাণ্মাসিক) সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন। সাহিত্য ও
সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকাটি সম্পাদনা করেন।