দুপুর বারোটা। স্নান সেরে মল্লিকা
সবে রান্নাঘরে ঢুকেছে। আজ একটু শখের রান্নাবান্না করবে। সুদীপ্ত আজ অফিস ছুটি নিয়েছে।
অনেক দিন পর ছুটি নিলো। একটু আয়েশ করবে । অবশ্য খুব বেশি দিন আর নেই চাকরির । রিটায়ারের
সময় প্রায় হয়ে এলো বলে । আজ দুপুরে একটু পাঁঠার মাংস,পোলাও, ছোলার ডাল খেতে চেয়েছে সুদীপ্ত। মন্দ কি!
একটু জমিয়ে খাওয়া যাক।
রান্নাঘরের কাজে হাত দিতে না দিতেই বাইরে গেটে কে যেন ধাক্কা মারলো।
- " মা জী, মা- জী, দরজা খুলুন ।
-" কে!
কান খাড়া করল মল্লিকা। ঐতো অনবরত
ঠাস ঠাস করে ধাক্কা দিয়েই যাচ্ছে। ঠিক লতা! লতা আর সময় পেলো না ! যেই কাজে হাত লাগাবে
মল্লিকা ,সেই মুহূর্তে এসে হাজির । এদিকে সুদীপ্তও
বাড়ি আছে। খুব বিরক্ত হয় সুদীপ্ত ওদের দেখলে। রেগে টঙ হয়, আর মল্লিকার ওপর রাগটা ঝাড়ে । বলে, কেন এদের ঢুকতে
দাও ? এদের কোন ভরসা আছে! কখন কোন জিনিস পত্র নিয়ে চম্পট
দেবে! তুমিও একেবারে একা বাড়িতে। কত রকম ঘটনা ঘটে ! মল্লিকা বোঝে সুদীপ্ত র কথা একেবারেই
ফেলে দেওয়ার মতো নয়। তবুও লতাকে ও ভালো করে জানে । বেশ ক'বছর হল প্রায়ই আসে। মন্দ নয় মেয়েটি। মল্লিকা গেট খুলে দিতেই , আরে বাপরি! কিতনা গরম , বহুত গর্মি ,করতে করতে মাথায় বিশাল ঝাঁকা নিয়ে এসে ঢুকলো লতা ।
-আজ নয়া নয়া জিনিস এনেছি মা-জী। দেখলেই পসন্দ হয়ে যাবে ,বলতে বলতে খোলা বারান্দায় চলে এলো । সাথে ওর ছেলে ,এই আট-ন বছর বয়স হবে। মা ছেলে মিলে মাথা থেকে ঝাঁকা নামালো, তারপর পা ছড়িয়ে বসল বারান্দায় একেবারে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে, আরাম করে । লতা নতুন বাসন নিয়ে আসে। স্টিলের থালা, বাটি ,গ্লাস, কত রকম কৌটো, আরও কত কি । মল্লিকা পুরনো শাড়ি, ব্লাউজ ,নাইটি, বিছানার চাদর, সোয়েটার দিয়ে নতুন বাসনগুলো রাখে। পুরনো জিনিস গুলো কোথায় ফেলবে! এতে কিছু নতুন কাপ-প্লেটও ঘরে ঢোকে ,আবার আলমারিগুলোও খালি হয়ে যায়।
লতা, মল্লিকার দিকে চেয়ে বলল, –-- এক গ্লাস পানি। মল্লিকা জল আনতে ভেতরে গেল । আজ বিরক্ত লাগছে মল্লিকার । ভাবল লতা কে না করে দেবে। সুদীপ্ত-র সামনে এইসব কাজ ঠিক নিজের মত করা যায়না। কিন্তু বাইরে যেমন চোখ ধাঁধানো রোদ ,চলে যেতেই বা বলে কি করে? অন্য দিন তো কত কথা বলে দুই জনে। আজ ঠিক----!
মল্লিকা জলের বোতল নিয়ে এসে দাঁড়াল ,সাথে বিস্কুট। আহা বেচারা এর মধ্যেই শরীর ছেড়ে দিয়েছে,একেবারে ঘুমিয়ে পড়েছে প্রায়। বারান্দায় ঝাঁপরা মাধবীলতার ছায়া । মল্লিকা এতক্ষণে ভালো করে নজর করলো লতার দিকে। সে কি ! মেয়েটা এই অবস্থায় এসেছে! নাহ! ওকে ফেরানো যাবে না । লতার ছেলে মাকে ধাক্কা দিয়ে তুলতে গেল, মল্লিকা ফিসফিস করে উঠল, থাক থাক , ঘুমোক। আমি ততক্ষণে পুরনো জিনিস গুলো গুছিয়ে নিয়ে আসি ।
ঘরে ঢুকতেই যথারীতি খেঁকিয়ে উঠলো সুদীপ্ত , --আমার কোন পুরনো জিনিস কিন্তু ওকে দেবে না ।
--আহা তোমার চারটি পুরনো প্যান্ট
আছে। কি করবে ওগুলো দিয়ে? কোথায় ফেলবে ?পুরনো জিনিসে আলমারি দিনদিন বোঝাই হচ্ছে! সে খেয়াল আছে? সুদীপ্তর কথায় কান না দিয়ে সব নিয়ে এলো মল্লিকা ।
লতা ততক্ষণে উঠে বসেছে, জল বিস্কুট ও শেষ।
মল্লিকা জিজ্ঞেস করল ,"
--কিরে, এই শরীর নিয়ে এসেছিস!
- কি করব ! মেরি তো কামাই এটাই আছে
মা জী।
- তোর বর ঠ্যাংয়ের উপর ঠ্যাং তুলে
ঘুমোচ্ছে!
- আরে নেহি, নেহি। ওতো বেড়িয়েছে অন্য রাস্তায় । পেট বড়ছে মা জী। কামাই তো করতেই হবে।
উঠে দাঁড়াল লতা। বেশ কটা মশলার
কৌটো, আর চায়ের কাপ রাখল। লতার ছেলে মায়ের
মাথায় সযত্নে ঝাঁকাটা বসিয়ে দিল। ওরা চলে গেল। এদিকে এক ফাঁকে কখন যে সুদীপ্ত এসে
ওদের দেখে গেছে! মল্লিকা ঘরে ঢোকার সাথে সাথে সুদীপ্ত একরাশ বিরক্তি প্রকাশ করল,
আবার পেট বানিয়েছে, আর শোধরাবে না এরা!
-আহা এভাবে কেন বলছো । ওদের কি মানসম্মান
নেই।!তুমি এমন ভাষায় বলো----!!
-ওদের কিস্যুই নেই। টাকা পয়সা, বুদ্ধি শুদ্ধি ,কিছুই নেই । ভগবান ও ফিরে তাকায়
না। ভিখিরি সব।
মল্লিকা রান্না ঘরে এসে ঢুকলো। রান্না ঘরের জানালা দিয়ে বড় রাস্তাটা পরিষ্কার দেখা যায়। লতা ওর ছেলের হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে ,মাথায় বাসন ভর্তি ঝুড়ি। , একটা দীর্ঘশ্বাস মল্লিকার বুক চিরে বেরোল। লতা ভিখারি কেন হবে! ওর তো একটা পূর্ণ সংসার আছে। ঈশ্বর ওর কোনও দিকেই তো শূন্যতা রাখেন নি। কিন্তু আজ তিরিশ বছর হয়ে গেল ,মল্লিকার ঘর ভরে উঠলো না শিশুর কলতানে। সন্তানের মিষ্টি আবদার নেই, খেলার পুতুল নেই, ছোট্ট ছোট্ট পায়ের ছোটোছুটি নেই, নেই শেখানো, পড়ানো। নেই স্কুল ব্যাগে বই গোছানোর পাট, নেই রাশি রাশি নালিশ, নেই অভিমানে ফুলো ফুলো গাল! নেই দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরবার কেউ। একটি পূর্ণ সংসারজীবনের পূর্ণতা আনতে পারল না মল্লিকা । সুদীপ্তর ও অনেক শখ বাকি রয়ে গেল। এত ডাক্তার, মন্দির-মসজিদ, পীর বাবার কাছে ছুটোছুটি করেও মল্লিকার কোল শূন্য! কে তবে ভিখারি! লতার স---ব আছে। মল্লিকা নিজেই যে ঈশ্বরের কৃপা থেকে বঞ্চিত। আর মান অপমান বোধ! সুদীপ্ত রেগে গেলে কতবার মল্লিকাকে বাজা মেয়েছেলে বলে। এ কি অপমান নয়? মল্লিকা তবু চুপ করে থাকে। মল্লিকার চোখের কোনে জল চিকচিক করে উঠল। চোখ মুছে আরেক বার বড় রাস্তার দিকে তাকাল। একটু হাসল। নিজের মনেই ভাবল এবার লতা র ঠিক একটি মেয়ে হবে। পুত্র-কন্যা দুই ই থাকবে লতা র। আমার আশীর্বাদ রইল।
লেখিকার পরিচিতি -
স্টেটস্ম্যান, সুখবর, সকালবেলা ইত্যাদি খবরের কাগজে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। প্রসাদ, সারথি পত্রিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন। 'Times of India'-তে বেশ কয়েকবার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনের শুরু।বর্তমানে কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গল্প লিখতেই বেশি ভাল বাসেন ।