রম্য গল্প
ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি
দীপক কুমার মাইতি
সবে লিখতে বসেছি দুমদাম পা ফেলে
গিন্নি এসে বলে, “তোমার সংসারে খেটে খেটে হাড়-মাস কালি
হয়ে গেল। শ্মশানে গেলে তবেই শান্তি পাব।”
আমি বলি, “শ্মশানে গেলেই শান্তি পাবেই তার কোন গ্যারেন্টি আছে কী?”
গিন্নি বলে, “শোননি, ‘সুখ সপনে শান্তি শ্মশানে’।’’
-“মরার পর স্বর্গে ঠাঁই পেলে তবে তো শান্তি
পাবে?”
রেগে গিন্নি বলে, “আমি তোমার মতন পাপী নই। আমি ঠিক স্বর্গে যাবই।”
-“তোমাকে পাপী বলার বুকের পাটা কার আছে?
অনেক বাধা পেরিয়ে স্বর্গে প্রবেশাধিকার পাওয়া যায়। তাই ভাবছিলাম।”
-“বাধা আবার কী? মরবো আর সোজা স্বর্গে যাব।”
-“মরার পর পঞ্জিকা মতে তোমার একপাদ বা দ্বিপাদ
বা ত্রিপাদ দোষ লাগবেই। দোষ খণ্ডন করতে হবে। বিশাল খরচের হ্যাপা। তোমার সন্তান মানে
বাবন সেই হ্যাপা সহ্য না করলে তোমার স্বর্গবাস আটকে যাবে।”
গিন্নির ক্রুদ্ধ দৃষ্টি দেখে বলি, “না! না! তোমার বাবন হ্যাপা সহ্য করবে। কিন্তু স্বর্গে যেতে হলে খরস্রোতা
বৈতরণী নদী পার হতে হয়। তার জন্য পারানি লাগে। শ্রাদ্ধের দিন তোমার বাবনকে সবৎসা কৃষ্ণা
গো বা মূল্য, বস্ত্র, গামছা,
তিন কাহন কড়ি বা মূল্য সহ ভোজ্য কোন সৎ ব্রাহ্মণকে দান করতে হবে।
তবেই স্বর্গে যাওয়ার পারানি পাবে। তোমার মাতৃভক্ত বাবন সব খরচ করবে। কিন্তু সৎ ব্রাহ্মণ
তো সোনার পাথরের বাটি। তাই তোমাকে বৈতরণী পাড়ে দাঁড়িয়ে ওপারে স্বর্গ দেখতে হবে।
এও এক অশান্তি তাই না?”
গিন্নি বলে, “কেন? আমাদের হরি বামুন আছে না? একেবারে খাঁটি সৎ বামুন।”
-“ তা ঠিক, হরি
বামুন মন্দ নয়। মনে রাখবে স্বর্গ কিন্তু ফাইভ স্টার হোটেল নয়। আবার স্বর্গের বাসিন্দারা
বড়ই স্বার্থপর। কেউ কাউকে কিছু দেয় না। তাই শ্রাদ্ধে ষোড়শদানের বিধান আছে। হরি বামুন
যদি ফর্দ লিখতে ভুল করে বা তোমার বাবন যদি কিনতে ভুল করে, তবেই চিত্তির। সেই জিনিসের অভাবে তোমার স্বর্গবাস অশান্তির হবেই।”
-“তুমি কিন্তু বাবনের নিন্দা করছো। বাবন
আমার খুব দায়িত্বশীল। ওর কোন কাজে কোন খুঁত দেখেছ? একটা কিনতে
বললে দুটো কেনে। তোমার মতন হাড় কিপটে নয়।”
-“তা অবশ্য তুমি ঠিক বলেছ। এই বাধা তুমি
সহজে পেরিয়ে যাবে। মনে রেখ প্রথম এক বছর স্বর্গে তোমার প্রোবেশন পিরিয়ড। কারণ শাস্ত্রমতে
এক বছর পর বাৎসরিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করতে হবে। তবেই তোমার স্বর্গবাস কনফার্ম হবে। মানে
তুমি স্বর্গের স্থায়ী সদস্য হওয়ার ছাড়পত্র পাবে। তাই প্রথম বছর এই চিন্তায় একটা
অশান্তি তো থাকবেই। তাই প্রথম বছর স্বর্গে থেকেও শান্তি পাবে না।”
-“বাবন আমার তোমার মতন কর্তব্য জ্ঞানহীন
নয়। তাই আমার এ ব্যপারে কোন অশান্তি হবে না। শান্তিতেই স্বর্গে থাকব।”
- “তোমার কথা মানছি। স্বর্গে স্থায়ী বাসিন্দা
তুমি হবেই। তবুও একটা কিন্তু আছে।”
রেগে গিন্নি বলে, “তোমার তো নরকবাস হবেই। তাই বুঝি হিংসেতে কিন্তু খুঁজছ?”
-“তা কেন? স্বর্গবাসের
স্থায়ী সদস্যদের প্রতি বছর সদস্যপদের পুনঃনবিকরণ করতে হয়। তা না হলে সদস্যপদ খারিজ
হয়ে যায়। আবার পুনঃনবীকরণ তোমার হাতে নেই। তার জন্য তোমার বাবনকে প্রতিবছর তোমার
মৃত্যু তিথিতে কোন সৎ ব্রাহ্মণকে সবস্ত্র ভোজ্য ও দক্ষিণা দান করতেই হবে। তোমার NRI বাবন কী প্রতি বছর করতে পারবে?
বা বিদেশে সৎ ব্রাহ্মণ পাবে? মানে একটা অশান্তি
তোমার নিত্য সঙ্গী হবে।”
দেখি গিন্নি চোখ লাল করে আমার দিকে
তাকিয়ে আছে। ভাবলাম, প্রেসারের রোগী কিছু হলে
আমাকেই ছোটাছুটি করতে হবে। তাই বলি, “রাগ করছো কেন?
আমি শুধু সম্ভাবনার কথাই বলছি। দেখ সদস্যপদ পেলেই হবে না। কুলীন সদস্য
হতে হবে। যেমন রাজনৈতিক দলের সব সদস্য প্রাথমিক, ব্রাঞ্চ,
লোকাল, জেলা, রাজ্য
স্তর পেরিয়ে পলিটবুরোর বা হাইকমান্ডের সদস্য হয়ে কুলীন সদস্য হয়। কুলীন সদস্য না
হলে মধুভাণ্ড নাগালের বাইরে থেকে যাবে। তেমনি তুমি কুলীন সদস্য না হলে দেবরাজ ইন্দ্রের
সভায় নৃত্যগীতের আসরে ঢোকার অনুমতি পাবে না। মানে আবার অশান্তি নয় কী?”
-“আমার পুণ্যফলেই আমি ঠিক কুলীন সদস্য হব।”
-“না না এর জন্য তোমার পুন্যফল কোন কাজে
লাগবে না। মহাভারতে মহারাজ পাণ্ডু কুলীন সদস্যপদের জন্য নারদকে যুধিষ্ঠিরের কাছে পাঠিয়ে
ছিলেন। যুধিষ্ঠীরকে রাজসূয় যজ্ঞ করতে বলেছিলেন মনে নেই? সেই
রকম তোমার বাবনকে গয়ার বিষ্ণু পাদপদ্মে,ফল্গুনদীতে,
এলাহাবাদের ত্রিবেনী সঙ্গমে, হরিদ্বারের
গঙ্গায় ও বদ্রীনাথের ব্রহ্ম কপালিতে তোমার পিণ্ডদান করতে হবে। অবশ্য তোমার কর্তব্য
পরায়ণ বাবন তোমার কুলীন সদস্যপদের জন্য এইটুকু করবে। কী বল?”
-“তবে? আমার শান্তির
স্বর্গবাস কে আটকাবে? আমার হিরের টুকরো ছেলে থাকতে?”
-“ তা ঠিক। তুবুও একটা কিন্তু আছে। কুলীন
সদস্য তো শেষ কথা নয়। পার্টির সর্বোচ্চ পদ চাই। সভাপতি বা সেক্রেটারী হতে সবার মনে
বাসনা জাগে। তোমারও জাগতে পারে। তার জন্য তোমার ছেলেকে আকাশ পথে তোমার চিতাভষ্ম বড়
বড় নেতাদের মতন ছড়াতে হবে। কিন্তুটা তো এখানেই। তোমার বাবনের বা আমার সেই রেস্ত নেই।
অর্থাৎ তোমার অশান্তি দূর হবে না। এরপরও কী বলবে ‘শান্তি শ্মশানে’?”
খানিক আমার দিকে চেয়ে গিন্নি বলে, “ তোমার সঙ্গে বিয়েতে আমার ঘোর অমত ছিল। মাস্টার মানেই বাজে বকবক করার অভ্যাস।
বাবা শুনলো না। তোমাকে গলায় ঝুলিয়ে দিল। তাই বিয়ের দিন থেকে অশান্তি আমার নিত্যস্নঙ্গী।
স্বর্গবাস যে অশান্তির হবে এ তো জানা কথা।” বলেই ফোসফোস করতে করতে চলে যেতে চায়।
আমি বলি, “ আহা রাগ করো কেন বিধুমুখি? সব রোগের ওষুধ আছে।
শুনেছি যাদের মৃত্যুর পর গোর দেওয়া হয় তাদের এত হ্যাপা নেই। তারা নাকি মাটি ভেদ করে
সোজা স্বর্গে চলে যায়। চির শান্তিতে সেখানে বাস করে। তাই বলছিলাম তুমি যদি……” কথা শেষ
করার আগেই গিন্নি ক্রোধান্বিত দৃষ্টি হেনে কিছু না বলে দুমদাম পা ফেলে চলে যায়। আমি
শুধু গিন্নির কান এড়িয়ে চুপিচুপি বলি, “ওঁ শান্তি ওঁ
শান্তি………।”
১৯৫০ সালের ৩রা ডিসেম্বর পশ্চিম
মেদিনীপুরের বেলদায় জন্ম। রাসায়ন নিয়ে পড়াশুনা করে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু।
খেলাধূলায় পারদর্শীতার জন্য পরে শারীর শিক্ষায় গোয়ালিয়র থেকে এমপিএড করেন। NCC OFFICER Training নিয়ে দীর্ঘ দিন স্কুলের NCC র দায়িত্বে ছিলেন।
স্কুল জীবন থেকে সাহিত্য চর্চা শুরু।
সাহিত্য চর্চা ও পাহাড়ে ট্রেকিং করা নেশা। মুলত গল্পকার। আণুগল্পও লেখেন। বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি ছাড়া নিজে ‘দিশারী’ নামে ষাণ্মাসিক সাহিত্য পত্রিকা
সম্পাদনা ১৯৭৪ সাল থেকে করে আসছেন। ‘ডব্লুটি’ নামে একটি আণুগল্পের সংকলন ও ‘দিনের শেষে চন্দ্রস্নান’ নামে একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত
হয়েছে। এ ছাড়াও 'সাতে পাচে'নামে একটি রম্যারচনা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে