লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
উনিশ শতকের আগে বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারে শিশুসাহিত্য সংযোজিত হয়নি বললেই চলে ।
বাংলা শিশুসাহিত্যের উন্মেষলগ্নে রয়েছে - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ( ১৮২০-১৮৯১ ) বোধোদয,'বর্ণপরিচয়
” এবং
“ কথামালা
' অক্ষয়কুমার
দত্তের ( ১৮২০-১৮৮৬ ) চারুপাঠ', মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ( ১৮১৭-১৮৫৮ ) ‘শিশুশিক্ষা’ ইত্যাদি । তাঁরা মূলত শিশুদের শিক্ষাদান তথা
নীতিশিক্ষা দেওয়ার জন্যে লিখতেন । শিশুদের ভালো লাগার দিকে লক্ষ রেখে রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরই ( ১৮৬১-১৯৪১ ) প্রথম লিখতে আরন্ত করলেন । তার সমকালে যারা ছোটদের ভালো
লাগার লেখা লিখতে লাগলেন তাঁরা হলেন – উপেন্দ্রকিশোর
রায়চৌধুরী (১৮৬৩-১৯১৪ ) , যোগীন্দ্রনাথ সরকার ( ১৮৬৬-১৯৩৭ ) , অবনীন্দ্রনাথ
ঠাকুর ( ১৮৭১-১৯৫১ ) , দক্ষিণারঞ্জন মিত্রমজুমদার ( ১৮৮৭-১৯২৩ ) , কাজী
নজরুল ইসলাম ( ১৮৯৯-১৯৭৬ ) প্রমুখ । পরবর্তীকালে ( এমনকি অদ্যাবধি ) অনেক কবি -
সাহিত্যিকই বাংলা শিশুসাহিত্যের বহমান ধারটিকে সঞ্জীবিত করে রেখেছেন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং
যাকে বাংলা ‘শিশুসাহিত্যের
ভগীরথ ' অভিধায়
অভিহিত করেছিলেন তিনি হচ্ছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী । বলা যায় – ভগীরথ
যেমন অনেক সাধনা ,
ত্যাগ - তিতিক্ষার মাধ্যমে সর্বসাধারণের কল্যাণের জন্যে পুণ্যতোয়া গঙ্গাকে ধরণীতে বহমান করেছিলেন ,তেমনি
উপেন্দ্রকিশোর বাংলা শিশুসাহিত্যে ‘ভগীরথ ’ - এর
ভূমিকা পালন করেছিলেন ।
উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম ১২ মে ১৮৬৩
খ্রিঃ বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার মসুয়া গ্রামে । এই গ্রামে সাধক
সুপণ্ডিত লোকনাথ রায় বসবাস করতেন । তার পুত্র উদার তেজস্বী স্বাধীনচেতা কালীনাথ
রায় । সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত কালীনাথ রায় প্রাত্যহিক দেবার্চনা দিতে স্বরচিত
স্তোত্রাদি ব্যবহার করতেন । তার পাঁচ ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় ছেলের নাম ছিল
কামদারঞ্জন । সমকালীন ময়মনসিংহের প্রসিদ্ধ উকিল ও জমিদার স্বধর্মনিরত আচার নিষ্ঠ
। অপুত্রক হরিকিশোর রায়চৌধুরী কামনারঞ্জনকে পাঁচ বছর বয়সের সময় দত্তক পুত্র
হিসেবে গ্রহণ করেন । সম্পর্কে হরিকিশোর কামদারঞ্জনের জ্ঞাতি কাকা ছিলেন
। হরিকিশোর রায়চৌধুরীর দত্তক পুত্র হিসেবে গৃহীত হওয়ার পর দত্তক পিতার নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কামদারঞ্জন রায়ের পরিবর্তিত নাম হলো উপেন্দ্রকিশোর
রায়চৌধুরী।
বাল্যকাল থেকে কামদারঞ্জন তথা
উপেন্দ্রকিশোর অসাধারণ মেধা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন। তার শিক্ষার প্রথম পাঠ শুরু হয় ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে । ১৮৮০ সালে তিনি
উক্ত স্কুল থেকে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন । এরপর উপেন্দ্রকিশোর
কলকাতায় এসে প্রেসিডেন্সি কলেজে এফ এ পড়া শুরু করেন । ১৮৮৪ সালে কলকাতার
মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউট থেকে তিনি বি.এ. পাশ করেন । কলকাতায় আসার পর উপেন্দ্রকিশোর
প্রগতিবাদী ব্রাহ্ম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন । সেসময় তিনি ব্রাহ্মসমাজের
সর্বজনশ্রদ্ধেয় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ( ১৮১৭-১৯০৫ ) সঙ্গে পরিচিত হন ।
সেইসুত্রে ঠাকুরবাড়িতে তার যাতায়াত এবং দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেছিল । উপেন্দ্রকিশোর ব্রাহ্ম সমাজে দীক্ষিত
হয়ে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের অন্যতম পুরোধা দ্বারকানাথ
গঙ্গোপাধ্যায় - এর কন্যা বিধুমুখীকে বিয়ে করেন । এর ফলে তিনি আত্মীয় - স্বজনের
কাছে নিন্দিত হয়েছিলেন । কেননা , তাঁর জন্মদাতা পিতা কালীনাথ রায় এবং দত্তক পিতা হরিকিশোর রায়চৌধুরী উভয়েই হিন্দুধর্মে প্রবল
নিষ্ঠাবান ছিলেন ।
১৮৮৩ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতা
থেকে শিশুদের উপযোগী পত্রিকা 'সখা ' - র
আত্মপ্রকাশ ঘটে । প্রমদাচরণ সেন সম্পাদিত 'সখা '- র
প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল উপেন্দ্রকিশোরের সচিত্র লেখা 'মাছি '। এর
মাধ্যমেই তিনি লেখক হিসেবে প্রথম যাত্রা শুরু করেন । 'সখা ' - র
দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যায় 'সহজে কি বড়োলোক হওয়া যায়’ শীর্ষক তার আরেকটি লেখা প্রকাশিত হয় । উপেন্দ্রকিশোরই প্রথম শিশুদের
জন্যে চলিত ভাষায় লিখেছিলেন । অবশ্য , সাধুভাষাতেও
তাঁর রচনা রয়েছে । তাঁর লেখা ছেলেদের রামায়ণ ' (১৮৯৬
) , “ সেকালের
কথা ' ( ১৯০৩
) ছেলেদের মহাভারত '
( ১৯০৮ ) , মহাভারতের গল্প ' ( ১৯০৯
) , টুনটুনির
বই ' ( ১৯১০
) ইত্যাদি বাংলা শিশুসাহিত্যকে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর করেছে ।
যোগীন্দ্রনাথ সরকার ১৮৯৬ সালে
কলকাতায় ‘সিটি
বুক সোসাইটি 'নামে
একটি প্রকাশনা সংস্থা গড়ে তোলেন । এই প্রকাশনা সংস্থা থেকেই উপেন্দ্রকিশোরের
ছেলেদের রামায়ণ '
এবং ‘ছেলেদের মহাভারত'প্রকাশিত
হয় । ভারতবর্যের আত্মাসদৃশ এই দুটি মহাকাব্যকে উপেন্দ্রকিশোর শিশুমনের উপযোগী করে
পরিবেশন করেন । শতাধিক বছর পরেও গ্রন্থ দুটি সমভাবে জনপ্রিয় ও সুখপাঠ্য । বাংলা
সাহিত্যে যে সময় শিশুসাহিত্য হামাগুড়ি দিচ্ছে , সেসময়
তাকে শক্ত মাটিতে দাঁড় করানোর কৃতিত্ব উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর । প্রখ্যাত কবি
ও সাহিত্য সমালোচক বুদ্ধদেব বসু ( ১৯০৮-১৯৭৪ ) উপেন্দ্রকিশোরের রচনা সম্পর্কে
যথার্থই লিখেছেন । “ছন্দের
আনন্দ,কবিতার
উন্মাদনা জীবনে প্রথম যে বইতে আমি জেনেছিলুম সেটি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘ছোট্ট রামায়ণ’ ছোট্ট , সচিত্র , বিচিত্র , বিচিত্র -
মধুর সে বই ছিল আমার প্রিয়তম সঙ্গী । ……. কী ভাল লাগত আমার , সেসব নদী , বন -
পাহাড় , পঞ্চবটী
, চিত্রকুট
– ছবির
মতো এক একটি নাম - ছবির মতো , গানের মতো
, মন্ত্রের
সম্মোহনের মতো । "
১৯১৩ সালে উপেন্দ্রকিশোর প্রকাশ করলেন শিশুদের উপযোগী সচিত্র মাসিক পত্রিকা । - 'সন্দেশ '।
বলাবাহুল্য ,তিনি
ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী । শিশুসাহিত্যের অন্যতম রূপকারের পাশাপাশি চিত্রী , অলংকরণ শিল্পী , সংগীতজ্ঞ , গীতিকার , পত্রিকা সম্পাদক , মুদ্রণ বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি আরও কত কী! 'সন্দেশ ' পত্রিকা
প্রকাশের কয়েক বছর আগেই উপেন্দ্রকিশোর গড়েছিলেন নিজস্ব মুদ্রণ সংস্থা ‘ইউ রায় অ্যান্ড সন্স '। এটি সমকালীন ও মুদ্রণ শিল্পে
যুগান্তর ঘটিয়েছিল । উপেন্দ্রকিশোরের লেখা “টুনটুনির বই ' প্রকাশের
( ১৯১০ ) মধ্য দিয়ে তার প্রকাশনা সংস্থার যাত্রা শুরু হয়েছিল । তিনি যখন
শিশুপত্রিকা 'সন্দেশ
' প্রকাশ
করেন তখন কলকাতার শিশুপত্রিকাগুলোর ( 'সখা ', 'সখা
ও সাথী ',
'মুকুল ' ইত্যাদি ) দিন ফুরিয়েছে । সেই
সময় উপেন্দ্রকিশোর রঙিন ছবি যুক্ত 'সন্দেশ 'পাঠকসমাজে
বিশেষ করে শিশুদের দরবারে উপস্থাপন করেন । ১৩২০ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ ( এপ্রিল , ১৯১৩ ) ' সন্দেশ
পত্রির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় । প্রথম সংখ্যার ভূমিকায় সম্পাদক উপেন্দ্রকিশোর
লিখেছিলেন,'আমরা
যে সন্দেশ খাই ,
তাহার দুইটি গুণ আছে । উহা খাইতে ভালো লাগে আর উহাতে শরীরে বল হয় । আমাদের এই যে পত্রিকাখানি সন্দেশ নাম লইয়া সকলের নিকট
উপস্থিত হইতেছে – ইহাতেও যদি এই দুটি গুণ থাকে অর্থাৎ ইহা
পড়িয়া যদি সকলের ভালো লাগে আর কিছু উপকার হয় তবেই ইহার সন্দেশ নাম সার্থক হইবে
। ” বলা
বাহুল্য , উপেন্দ্রকিশোরের
স্বপ্ন সফল হয়েছিল । কালক্রমে 'সন্দেশ ' ছোট - বড়
নির্বিশেষে সকলের ‘কাছে
আদরণীয় এবং গ্রহণীয় হয়ে ওঠে । তাঁর মৃত্যুর পর ( ১৯১৫ ) প্রথমে তার পুত্র
সুকুমার রায় ( ১৮৮৭-১৯২৩ ) এবং পরবর্তীকালে তাঁর পৌত্র সত্যজিৎ রায় । (
১৯২১-১৯৯২ ) 'সন্দেশ
' - এর
সম্পাদনা তথা প্রকাশ করতে থাকেন । বর্তমানে তাঁর প্রপৌত্র সন্দীপ রায়ের
সম্পাদনায় 'সন্দেশ' প্রকাশিত
হচ্ছে । নানাবিধ প্রতিকূলতা ,প্রতিবন্ধকতাকে দূরে ঠেলে রেখে পত্রিকাটি শতবর্ষ অতিক্রম করার দুর্লভ কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছে ।
পরিশেষে বলা যায় - শিশুদের ছোটদের মন - মেজাজ , তাদের চাহিদা সম্পর্কে উপেন্দ্রকিশোরের ধারণা ছিল গভীর এবং সুস্পষ্ট । তিনি তার লেখার বিষয়ও নির্বাচন করেছেন সেভাবে । বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বাংলার শিশুমনে এক নতুন জগৎ সৃষ্টি করে গেছেন ,সে জগতে তিনিই ছিলেন অধীশ্বর । বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে বাংলা শিশুসাহিত্যে তার নামটি চিরকাল জ্বলজ্বল রতে থাকবে সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায় ।
লেখক পরিচিতি –
ড.বাসুদেব রায়ের
জন্ম ১৯৬২ সালে। কবিতার মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে আত্মপ্রকাশ। প্রথম প্রকাশিত বই
মানব' (কাব্যগ্রন্থ), দ্বিতীয় বই রক্তের বাঁধন (উপন্যাস)।
সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় পদচারণা করলেও প্রবন্ধ সাহিত্যের দিকে তার ঝোঁক বেশি।
তদুপরি গবেষণামূলক প্রবন্ধ তথা বই লিখতে তিনি অধিকতর উৎসাহী। গবেষণামূলক বইয়ের
পাশাপাশি সাধু-মহাপুরুষদের জীবনী-গ্রন্থ, একাঙ্কিকা ইত্যাদি সম্পাদনাও করেছেন তিনি।
ড.বাসুদেব রায়ের
বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। হার উল্লেখযোগ্য গবেষণা গুলোর মধ্যে রয়েছে
মনসামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ', চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল কাব্যে দেবদেবীর স্বরূপ, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সমাজ-চিত্র ইত্যাদি। তাঁর যৌথ রচনা ও উপেক্ষণীয়
নয়।
বিভিন্ন
পত্র-পত্রিকায় বাসুদেব রায় নিরলস ভাবে লিখে চলেছেন। এছাড়াও নতুন করে তিনি একক ও যৌথভাবে বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক কাজে হাত দিয়েছেন।