আগের ‘জানা-অজানায়’ আমরা মোটামুটি
ভাবে জেনেছি, মেঘ কি ভাবে হয় আর মেঘ জমাট বেঁধে
কিভাবে বৃষ্টি হয়। এবার দেখা যাক বরফের বৃষ্টি বা ‘শিলাবৃষ্টি’ কিভাবে হয়। ‘বজ্র-বিদ্যুৎ’ নিয়ে লেখায় জানিয়েছিলাম, বিশাল বড় ‘কিউলো-নিম্বাস’মেঘ কেমন করে
হয় আর তা কিভাবে বজ্র-মেঘে রূপান্তরিত হয়ে যায়। এই কিউমুলাস বা কিউলোনিম্বাস মেঘের
বিশেষত্ব এই যে এর অন্তঃস্থলে ভীষণ গতিতে বায়ু উপর-নিচে হতে থাকে। ঊর্ধ্ব-গামী
গতিকে বলা হয় ‘আপ-ড্রাফট’ আর নিন্ম-গামী
গতিকে বলে ‘ডাউন-গ্রাফট’। ‘ফুলকপি’ আকারের
মেঘগুলিতে ঊর্ধ্বগতি আর নিন্মগামী গতি ভীষণ বেশি হয়ে থাকে। আমরা জানি,জলীয় বাষ্প আশে-পাশের শুকনো হাওয়ার তুলনায় হাল্কা,তাই তারা
সহজেই পেঁজা তুলোর মত উপরে উঠে যায়। ওপরে উঠেই
শীতল বায়ুর সংস্পর্শে এসে সুশীতল (Super-cooled Water droplets) জল-কণাতে
রূপান্তরিত হয়ে যায়। এই সুশীতল জলকণা বাতাসের ঊর্ধ্বগামী গতির ফলে আরও উপরে উঠে
যায় আর আরও বড় আকার নেয়। এইভাবে সুশীতল জল-কণা বড় হয়ে বরফের টুকরো হয়ে যায়। ঊর্ধ্বগামী
বাতাসের প্রভাবে উপরে উঠার সময় সেই বরফের টুকরো আরও বড় হতে থাকে। এইভাবে বড় হতে
হতে একসময় বরফ-টুকরোটি ভারী হয়ে যাওয়ার ফলে আর ভাসতে পারেনা। তখন মাধ্যাকর্ষণ এর
টানে নেমে আসে। আবার খানিকটা বরফ গলে হালকা হলে আবার উঠতে থাকে। এইভাবে অজস্র বার
উপর-নিচে করতে করতে সেই শিলা বেশ বড় আকার ধারণ করে আর প্লবতা ওকে ধরে রাখতে পারেনা;তখন সেই বরফের
টুকরাটি মাধ্যাকর্ষণের টানে ভীষণ গতিতে নেমে আসে।
শিলাবৃষ্টির খণ্ডকে
সোজাসুজি কাটলে ঠিক পেঁয়াজের মত স্তর পাওয়া যাবে।এর কারণ ওই বার বার ওঠা-নামার সময়ে গায়ে লেগে থাকা জল জমে শিলাটির আকার বেড়ে যাওয়া। সাধারণভাবে
আমরা যে শিলাবৃষ্টি দেখি সেই সব শিলা আধ ইঞ্চি থেকে পৌনে এক ইঞ্চি পর্যন্ত ব্যাসের
হয়। এই শিলাগুলি ঘণ্টায় ১৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে নেমে আসে মাটির উপর। আর এর থেকে
বড় আকারের (১ থেকে ১.৭৫ ইঞ্চি) শিলাগুলি ধেয়ে আসে আরও বেশি ৪০ থেকে ৬৫ কিলোমিটার
বেগে !
বাঙলা দেশের গোপাল-গঞ্জ
জেলায় একবার এক একটি শিলা ১.০২ কিলোগ্রাম ওজনের শিলাবৃষ্টি হয়েছিল বলে রেকর্ড করা
আছে। আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় শিলা পাওয়া গিয়েছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-ডাকোটা
প্রদেশের ভিভিয়ান নামক স্থানে। সবচেয়ে বড় শিলা গুলির ব্যাস ছিল ৮ ইঞ্চি বলে রেকর্ড
করা আছে। এই ঘটনাটি ঘটে ছিল ২০১০ এর ২৩শে জুলাই তারিখে। অনেকের ধারণা শিলা বৃষ্টি
মাঠে-ময়দানে,খেত-খামারে ফসলের ক্ষতি করে বা রাস্তায় দাঁড়ানো গাড়ির
ক্ষতি করে, মানুষের ক্ষতি হয়না। ধারনাটা ঠিক নয়। ভেবে দেখুন এক
কিলো ওজনের অথবা ৮ ইঞ্চি ব্যাসের শিলা ৬৫ কিলোমিটার বেগে এসে কারও মাথায় পড়লে কি
ভয়ানক ব্যাপার হতে পারে। উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদে ৩০শে এপ্রিল,১৮৮৮ সালে এক
ভীষণ শিলাবৃষ্টিতে ২৪৬জন প্রাণ হারিয়েছিলেন বলে রেকর্ড রয়েছে;শিলাগুলি কমলা
লেবু আর ক্রিকেট বলের আকারের ছিল বলে জানা যায়।
খ্রিস্টীয় নবম শতকে,আজকের উত্তরাখণ্ডের রূপ-কুণ্ড অঞ্চলে ক্রিকেট বলের আকারের এক বিশাল শিলাবৃষ্টির ফলে প্রায় ৬০০ যাযাবর উপজাতি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বলে জানা যায়। আমেরিকাতে শিলাবৃষ্টির ফলে বছরে ১০০ কোটি ডলার ক্ষতি হয় আর গত ২০ বছরে কম করে ৪ জন শিলাবৃষ্টিতে প্রাণ হারিয়েছেন বলে জানা যায়।
আফ্রিকা মহাদেশের কেনিয়ায় কেনছো নামক স্থান শিলাবৃষ্টির জন্য প্রসিদ্ধ। সেখানে বছরে গড়ে ৫০ দিন শিলাবৃষ্টি হয়। এক বছরে আবার ১৩২ দিন শিলাবৃষ্টি হয়ে রেকর্ড স্থাপনও করেছিল কেনছো। কেনছো নিরক্ষরেখার নিকটে আর সমুদ্রতল থেকে ৭২০০ফুট উপরে অবস্থিত। তাই বিশেষজ্ঞদের উপদেশ হলো শিলাবৃষ্টিকে মোটেই উপেক্ষা করা বা হালকা ভাবে নেওয়া উচিত নয়। শিলাবৃষ্টি হচ্ছে দেখা মাত্র কোন ছাদের নিচে আশ্রয় নেওয়া উচিত তবে গাছের নিচে কখনও নয়। কেননা,বজ্র-বিদ্যুতের ভয় থাকবে। গাড়িতে থাকলে গাড়ি থামিয়ে জানালার কাঁচ উঁচু করে মাথা বাঁচিয়ে বসে থাকাই নিরাপদ। খোলা মাঠে-ময়দানে থাকলে শরীরকে ছোট করে হাঁটুর মধ্যে মাথা-গুঁজে হাতের তালুতে মাথা বাঁচিয়ে জানালা থেক দূরে বসে থাকা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ।আর গাড়িকে এমনভাবে দাঁড় করানো যাতে শিলা জানালার কাঁচে আঘাত না করে সামনের কাঁচে আঘাত করে। কেননা,সামনের কাঁচ অন্যান্য কাঁচের তুলনায় বেশি শক্ত।
শিলাবৃষ্টির সময় গাছ থেকে ১৫-২০ ফুট দূরে থাকাই শ্রেয়। মধ্যযুগীয় ইয়োরোপে শিলাবৃষ্টির প্রকোপ কমাবার জন্য বৃষ্টির সময় গির্জার ঘণ্টা বাজানো অথবা কামান দাগার রেওয়াজ ছিল বলে জানা যায়। আমাদের দেশে যেমন ভূমিকম্পের সময় শাঁখ বাজানোর রেওয়াজ ছিল বা এখনও আছে। এটা অবশ্য, পৌরাণিক কথার উপর ভিত্তি করে বাজানো হয়, কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে বলে শুনিনি। আধুনিক কালে উড়োজাহাজ বা কামানের সাহায্যে মেঘকে “সিডিং” (Cloud Seeding) করে দেওয়াও কোন কোন দেশে চালু আছে। এই ‘সিডিং’ এ “ড্রাই-আইস” বা সাধারণ নুন মেঘের উপর আর গায়ে ছড়ানো হয়। এতে করে মেঘ তাড়াতাড়ি গলে গিয়ে শিলা মুক্ত-হয়ে বৃষ্টির আকারে নেমে আসে-শিলাবৃষ্টি হতে দেয়না।
লেখক পরিচিতি –
ডঃ তুষার রায় স্কুলে থাকতেই শুরু হয়েছিল গল্প আর মহাকাশের উপর প্রবন্ধ। ওই সময়েই “শুকতারা”তে “অসীমের অন্বেষণে” প্রকাশিত হয়েছিল। সীমাহীন বলেই বুঝি মহাকাশের আকর্ষণ ছিল অসীম। জ্যোতিঃশাস্ত্রের ছোটখাটো বই পড়ে কম দামী বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে চলতে লাগল নক্ষত্রদের সংগে নীরব বার্তালাপ। ইচ্ছা ছিল জ্যোতিঃশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করা। কিন্তু “Need to have and Nice to have” এর কলহে সেটা হতে পারেনি। কিন্তু নেশা আর পেশায় দ্বন্দ্ব কখনও হয়নি। তাই এখন এই পরিণত বয়সেও মহাকাশের আর বিজ্ঞানের অনন্ত রহস্য নতুন করে জেনে ও জানিয়ে সহজ সরল ভাষায় পরিবেষণ করে আনন্দ পান।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আর আই. আই. টি, দিল্লি থেকে পড়াশুনা ও গবেষণা,কিছুদিন অধ্যাপনা,তারপর সরকারী বৈজ্ঞানিক দপ্তরে কার্যকালে পৃথিবীর কয়েকটি দেশেও কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে।
পঞ্চাশটিরও বেশি প্রবন্ধ নামী বৈজ্ঞানিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে (ইন্দোর) আমন্ত্রিত প্রবন্ধ পাঠ করার গৌরবও ভাগ্যে ঘটেছে। বিগত দেড় বছর করোনার প্রকোপে ছাপাখানা বন্ধ থাকার কারণে অনেক ই-ম্যাগাজিনে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে।
দিল্লি থেকে প্রকাশিত বহুল জনপ্রিয় ই-ম্যাগাজিন, “তাৎক্ষণিক”এর ‘জানা-অজানা’ কলমে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ টি জনপ্রিয়-বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি “দেশ” ওয়েব-সাইটে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে এবং বিশেষ প্রশংসিত হয়েছে।