নান্দী:-
'কি করলে বাবা, আমাদের মহেশ যে মরে গেল।' দশ বছরের আমিনার আর্তনাদে আমাদের বুকে ঝড় ওঠে না ?
'তোকে বিক্রী করতে পাঠিয়েছিলাম বলে - তুই অভিমান করে চলে গেলি?' বৃদ্ধ মুখোপাধ্যায় মশায়ের কাঁদতে কাঁদতে আদরিণীকে বলা কথা কি সবার চোখেই জল নিয়ে আসে না ?
'তোকে কসাইখানায় নিয়ে যাবে ?' কালাচাঁদকে দেখে চিনু মণ্ডলের নিরুপায় হাহাকারে কি পাঠক/পাঠিকার হৃদয় তোলপাড় করে না ? উদ্দিষ্ট মহেশ একটি অনাহারক্লিষ্ট ষাঁড়, আদরিণী একটি স্ত্রী হাতি এবং কালাচাঁদ একটি বৃদ্ধ কঙ্কালসার বলদ। এরা যথাক্রমে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'মহেশ', প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের 'আদরিণী' এবং তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের 'চিনু মণ্ডলের কালাচাঁদ' কাহিনির উল্লেখযোগ্য চরিত্র। এরা তিনজনেই মানুষের ভাষায় পশু। কিন্তু এরা বরেণ্য স্রষ্টার কলমে মানুষকে আপন করে নিয়েছিল, মানুষও তাদের আপনজনের মতো কাছে টেনে নিয়েছিল। বরেণ্য স্রষ্টারা এদের কথা শোনাতে শোনাতে আমাদের সচেতন করে দিয়েছেন যে, পৃথিবী শুধুমাত্র মানুষের উপভোগ্য নয়, পশু-পাখি-সরীসৃপ-কীট-পতঙ্গ-উদ্ভিদ সবারই এই বাতাস-মাটি-জল-ফল-শস্যে সমান অধিকার আছে। সকলেরই নিজের বেঁচে থাকবার সঙ্গে অন্য প্রজাতিকেও বাঁচবার সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। নইলে পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে বিপর্যয় আসবে। সেদিন এলে অন্য সব প্রজাতির সঙ্গে মানুষের অস্তিত্বও বিপন্ন হবে।
কাজী নজরুল ইসলামকে আমরা 'বিষের বাঁশী'-বাদকরূপে জানি।
চিনি 'রুদ্রমঙ্গল'-এর আবাহনকারীর সাজে। 'বাঁধনহারা' ওই মহান স্রষ্টাকে
যত দেখি, ততই অবাক হয়ে থাকি। তাঁর সঙ্গে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই:
'কাণ্ডারী হুঁশিয়ার !' কিন্তু তিনি যে
সরীসৃপকেও বাৎসল্যের বাঁধনে আনবার ইঙ্গিত করেছিলেন, আমরা ভুলে যাই।
ভাবতেও চাই না যে, ওরাও বাঁচতে চায় - ভালবাসা চায়। কাজী নজরুল ইসলামের একটি স্বল্প-পরিচিত গল্প 'পদ্ম-গোখরো'। প্লট অত্যন্ত
সরল। চরিত্রগুলো সবই আমাদের চেনা। জটিল মনস্তত্ত্ব নেই, নেই থ্রিলারের
গতি। আখ্যান জমাবার জন্য অতি নাটকীয়তাও
অনুপস্থিত। কাহিনির থিম অপ্রচলিত ভালবাসা, যাকে গল্পপাঠের
পরে একেবারেই অস্বাভাবিক মনে হয় না। মনে জেগে ওঠে বহুদিনের চাপা-পড়া অনুভূতি: ব্যক্তিস্বার্থ
ছাড়িয়ে সংকীর্ণতা কাটিয়ে স্নেহের চোখে তাকালে এই পৃথিবীর সবই অপরূপ মাধুর্যে পূর্ণ
হতে পারে।
কাহিনি:-
রসুলপুরের মীরের ঠাকুর্দার ছিল জমিদারি এবং অপরিমিত অর্থ। কিন্তু অতিরিক্ত বিলাসিতা এবং ভোগের ফলে তাঁর মৃত্যুর পরেই তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম নিদারুণ অনটন ভোগ করতে থাকে। ওই পরিবারের এক যুবক ছিল আরিফ। তার সঙ্গে সাদী হয়েছিল এক সৈয়দ পরিবারের মেয়ে অপরূপ রূপবতী জোহরার। জোহরার বাবা ছিল খুবই দরিদ্র। সেজন্যই আরিফের তুলনায় কোনো ধনীর সন্তান জোহরাকে সাদী করবার জন্য এগিয়ে আসেনি। অবশ্য আরিফও ছিল অত্যন্ত সুপুরুষ। (এই দম্পতির সম্পর্কে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন - 'যেন চাঁদে চাঁদে প্রতিযোগিতা।')
জোহরা একদিন শ্বশুরবাড়ির ভগ্নপ্রায় প্রাসাদের পরিত্যক্ত এক জায়গায় একটি ফাটলের খোঁজ পেয়েছিল। সেই জায়গায় অনুসন্ধান করে আরিফ বাদশাহী আশরফিতে পূর্ণ একটি কলসী পেয়েছিল। সেই সঙ্গে অবশ্য বেরিয়ে এসেছিল দুটি জীবন্ত প্রাণী: সরীসৃপ গোত্রের দুটি বড় 'দুগ্ধ-ধবল' গোখরো, যাদের মাথায় ছিল লাল রঙের চক্রের চিহ্ন। গোখরো সাপ দেখে পরিবারের সবাই আতঙ্কিত হলেও জোহরা নির্ভয়ে তাদের সামনে দুধের বাটি ধরেছিল। হিংস্র-রূপে চিহ্নিত গোখরোরাও নিতান্ত শান্ত হয়েই সেই দুধ পান করেছিল। সামান্য আগে জোহরার যমজ সন্তান হয়ে মারা গিয়েছিল। সন্তানহারা জোহরা পরম স্নেহে ওই পদ্ম-গোখরো দুটিকে কাছে টেনে নিয়েছিল। তারা রান্নাঘরে জোহরার পায়ের কাছে এসে শুয়ে থাকতো। জোহরার দেওয়া 'দুধ-কলা' দিয়ে পান-ভোজন সারতো। (সাপ কি সত্যই দুধ-কলা খায় ?) শিশু যেমন মায়ের বুকে মুখ রেখে ঘুমোয়, ওই সাপ দুটিও তেমনি রাতে জোহরার বুকে আশ্রয় নিতে চাইতো। জোহরার শাশুড়ী ভয়ে চেঁচিয়ে উঠতেন, আরিফ সাপের দংশনের ভয়ে অন্য জায়গা শুয়ে থাকতো। সকলের তিরস্কার শুনে জোহরা সাপদুটিকে ধমকালে তারা 'ভীত সন্তানের মত....তাহার পায়ে লুটাইয়া লুটাইয়া যেন কি মিনতি জানায়।' জোহরা তখন বাড়ির সকলকে জলভরা চোখে বলতো - 'ওরা আমার ছেলে।' শেষে বাড়ির সবাই পরামর্শ করে জোহরাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়েই সাপ-সন্তানের বিচ্ছেদ-বেদনায় জোহরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আরিফ জোহরাকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
কলকাতায় চিকিৎসার জন্য যাবার আগের রাতে আরিফ জোহরার বাপের বাড়িতেই ছিল। বাদশাহী মোহর পাবার পরে আরিফরা
ব্যবসা শুরু করেছিল। ব্যবসায় প্রভূত লাভও হয়েছিল। জোহরা পেয়েছিল প্রায় বিশ হাজার
টাকার গয়না। সেই গয়না জোহরা সঙ্গেই এনেছিল এবং একটি ট্রাঙ্কে রেখেছিল। সেই রাতে ঘুম
ভেঙ্গে যেতে আরিফ এক অচিন্ত্যনীয় দৃশ্য দেখেছিল। তার মাথার কাছে
জোহরার বাবা তরোয়াল হাতে দাঁড়িয়েছিল এবং শাশুড়ী ট্রাঙ্ক ভেঙে গয়না নিচ্ছিল। রাতে আরিফ
তলোয়ারের ভয়ে সাড়া দেয়নি। কিন্তু দিনের আলো দেখা দিতেই শ্বশুর-শাশুড়ীকে বুঝিয়ে দিয়েছিল
যে, রাতে সে সবই দেখেছে। আরিফ জোহরাকে নিয়ে যখন চলে যাচ্ছিল, তখন তার শ্বশুর-শাশুড়ী
অনেক চোখের জল ফেলে তাকে কিছু খেয়ে যাবার জন্য রাজি করিয়েছিল। জোহরা অবশ্য কিছুই খেতে রাজি হয়নি। খাবার পরেই আরিফের একটানা
বমি শুরু হয়েছিল। বমি করতে করতেই আরিফ শ্বশরবাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। জোহরা তখন বাপের
বাড়িতেই অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে ছিল। জ্ঞান হবার পরে জোহরা অনশন শুরু করেছিল। কিছুতেই খাওয়াতে
না পেরে তাকে তার শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এদিকে আরিফ হাসপাতালের চিকিৎসায়
ভালো হয়ে উঠেছিল। মীর-বাড়িতে আবার তাদের দুজনের মিলন হয়েছিল। তাদের কেউই গয়না-চুরি
বা খাবারের সঙ্গে বিষ দেবার ঘটনা প্রকাশ করেনি। জোহরা প্রকাশ্যে না বললেও এসেই তার সেই পদ্ম-গোখরো 'খোকা দুই জন'-এর কথা ভাবছিল।
রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে তাদের নিজের মৃত যমজ সন্তানদের কবরের উপরে খুঁজে পেয়েছিল।
গোখরোরা বহদিন পরে 'তাদের মা'-কে পেয়ে আবার তার বুকেই আশ্রয় নিয়েছিল। ওদিকে কলেরা হয়ে জোহরার মা,মারা গিয়েছিল। জোহরার বাবা অনুতপ্ত হয়ে সবার দৃষ্টি এড়িয়ে জোহরাকে শেষবারে মতো দেখতে এসেছিল। বাড়ির কাছে আসতেই জোহরার গোখরো-সন্তানরা তাকে কামড়াতে শুরু করেছিল। বিষে জর্জরিত হয়ে মারা যাবার আগে সে-ও সাপদুটিকে শেষ করে গিয়েছিল। 'খোকা দুই জন'-এর অপঘাত মৃত্যুর খবর শুনে জোহরাও (সম্ভবত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে) ওইখানেই মারা গিয়েছিল।
কিছু কথা:-
সাপ দুটির কামড়ের ভয়ে সবাই সদা-সন্ত্রস্ত ছিল। কিন্তু প্রথমে চুরি, পরে খাবারে বিষ দিয়ে জামাইকে হত্যার চেষ্টা করেছিল আরিফের বাবা-মায়ের সমান জোহরার বাবা-মা। সাপ নয়, বিষ ঢেলেছিল মানুষ; পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব। সাপ দুজন বিষ ঢেলেছিল তাদের 'মানুষ-মা'-য়ের শত্রুর দেহে। নিজেদের প্রাণ দিয়েও তারা জোহরার স্নেহের প্রতিদান দিয়েছিল। জোহরার মা-বাবার পাশাপাশি সাপ দুটিকে বিচার করলে স্তম্ভিত হতে হয়।
সাপ ইতর প্রাণী। সাপকে কখনো বিশ্বাস না করতেই উপদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এই গল্পে বিশ্বাসহন্তা কে বা কারা? মানুষ প্রাণীজগতে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। সাপ বা বাঘ কিংবা ঈগল মানুষের তুলনায় অল্প বুদ্ধির অধিকারী। এমন কি ওরাং ওটাং-এর বুদ্ধি ও স্মৃতির পরিসরও মানষের মতো নয়। পক্ষান্তরে মানুষ অনেক কিছু ভাবতে পারে, তার স্মৃতির পরিসীমা বিস্তৃত। ওই চিন্তাশক্তির বলেই কেউ হয় খলনায়ক,কেউ বা দেবতা। পিঁপড়ে যে সঞ্চয় করে তাতে অন্যের কতটুকু ক্ষতি হয় ? তার সঞ্চয় শুধু দু:সময়ে বেঁচে থাকবার জন্য। কোনো কোনো মানুষ পুরুষানুক্রমে ভোগ করবার জন্য ভাণ্ডার পূর্ণ করে। কারও হয়তো উত্তরপুরুষ থাকে না, তবু.... তা সত্ত্বেও প্রায়ই সে অন্যদের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় বস্তু থেকে অন্যায় ভাবে বঞ্চিত করে নিজের ভাণ্ডার পূর্ণ করে।
অত শক্তিমান গরিলা তার এবং তার পরিবারের খাবার আর শোবার জায়গা পেলেই খুশি থাকে। আক্রান্ত বা বিরক্ত না হলে সে কাউকে আঘাত করে না। সে তো নিরামিষাশী। আফ্রিকার সিংহ ক্ষিধে মেটানোর জন্য জেব্রা বা হরিণ শিকার করে ঠিকই, কিন্তু পেট ভরে গেলে তার পাশ দিয়ে খাদ্য-জন্তু হেঁটে গেলেও তাকায়ও না। বিরক্ত বা আক্রমণ করলে অবশ্য অন্য কথা। অথচ কিছু মানুষ গরিলা, চিতা, সিংহ বধ করে কেবল মাত্র সখে অথবা বীর-শিকারী নাম কেনবার জন্য।
শরাঘাতে মরণাহত মহাবীর বালী বুঝতেই পারে নি যে, সে যার খাদ্য নয়, যার সঙ্গে তার শত্রুতা দূরে থাক, পরিচয়ই নেই, তার অস্ত্র কেন তাকে মৃত্যু দিচ্ছে। ডোডো পাখির মাংস সুস্বাদু। তাই পৃথিবীতে তার জায়গা হলো না। পরিণামে ক্যালভেরিয়া মেজর গাছ নির্বংশ হবার পথে পৌঁছে গিয়েছিল। ডোডো ওই গাছের ফল খেয়ে পুরো হজম করতে পারতো না। মলের সঙ্গে যে বীজ থাকতো, তার খোসা নরম হয়ে যেতো। তাতেই হতো অঙ্কুরোদ্গম। ডোডো নিশ্চিহ্ন হবার পরে বীজের শক্ত খোসা ফুটে অঙ্কুরোদ্গম হতো না। আর তাই এক সময়ে একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কোনো শিশু বা যুবা ক্যালভেরিয়া মেজর গাছ ছিল না, সবই ছিল ওই গাছের পরিণত (দেড়শো-দুশো বছর বয়সী) নমুনা।
আমার এক বন্ধুর বাড়ি উত্তর ২৪ পরগণার এক আধা-গ্রাম আধা-শহরে। প্রায় চল্লিশ বছর আগে বেশ কিছু মানুষ সেখানকার সব পুকুর থেকে ব্যাঙ ধরে নিয়ে যেতো। বন্ধু শুনেছিল, কারা নাকি ভালো দাম দিয়ে ব্যাঙ কিনতো। কিছুদিনের মধ্যেই ওই অঞ্চলে মশার উপদ্রব খুব বেড়েছিল। মাঝে মাঝে পুকুরের কাছাকাছি মাঠগুলোতে সাপের চলাফেরাও বেড়ে গিয়েছিল।
শতকরা পঁচানব্বুইটি সাপেরই বিষ নেই। কিন্তু মানুষ সাপ দেখলেই আঁতকে ওঠে। বন্ধুর পাড়ার যে সব বৃদ্ধ প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত মাঠে বসে স্মৃতি রোমন্থন করতেন, তাঁরা ভয়ে মাঠ বর্জন করেছিলেন। ব্যাঙ কমে যাওয়ার সঙ্গে সাপের খাদ্যাভাব এবং মশাবৃদ্ধি সরাসরি যুক্ত ছিল বলেই কেউ কেউ বলেছিলেন। কিছুদিন পরেই অবশ্য ব্যাঙের চাহিদা হ্রাস পেয়েছিল। ফলে ব্যাঙ আবার আগেকার সংখ্যায় পৌঁছেছিল। আর তাই বোধহয় জলার সাপের দল মাঠ-ভ্রমণও বন্ধ করেছিল। বৃদ্ধরাও আবার মাঠমুখো হয়েছিলেন।
সম্প্রতি জানা গেছে, আমাদের প্রতিবেশী এক দেশে শষ্য খেয়ে নেবার অপরাধে একদা চড়াই পাখির গণ-প্রাণদণ্ড জারি করা হয়েছিল। সামান্য পরেই পোকার উপদ্রবে সেখানকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। দ্রুত ওই প্রাণদণ্ডাদেশ বাতিল করতে হয়েছিল। মানুষসহ জীবজগৎ, উদ্ভিদ, মাটি-জল-বাতাস সবই অদৃশ্য একটি মালার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার থেকে একটা ফুল(!) ছিঁড়ে নিলে মালাটিই অকেজো হয়ে যায়। কুৎসিত-দর্শন (জীব-জন্তুর) মৃতদেহভুক শকুন নিশ্চিহ্ন হবার পরে ভাগাড়ের পাশের শর্ট-কাট করবার রাস্তাগুলোয় হাঁটার কষ্ট কতটা বেড়েছে বলুন তো !
উপসংহার:--
আমি জানি, সাপ শুনতে পায় না। গল্পটিতে এ বিষয়ে বিদ্রোহী কবির দেওয়া তথ্য সঠিক নয়। কবি প্রচলিত প্রবাদকেই ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু তিনি তো সায়েন্স ফিকশন লেখেন নি, একটি স্নেহ-নিষিক্ত গল্পের মাধ্যমে আমাদের চেতনাকে মানবিকতায় সম্পৃক্ত করতে চেয়েছিলেন। আর ওই ভুল তো স্যার আর্থার কোনান ডইলও করেছিলেন তাঁর 'The Adventure of the Speckled Band'-এ। সেই কাহিনির শেষে বিশ্বের বিস্ময় শার্লক হোমস ব্যাখ্যা করেছিলেন - 'Then I thought of the whistle. Of course he must recall the snake....' ওই গল্পে খল চরিত্র ড. গ্রিমস্বি রয়লট আর তার পোষা সাপ সম্পর্কে বলা হয়েছিল - 'He had trained it, probably by the use of milk....' ডইল হোমসের বুদ্ধিমত্তার আবহে রহস্য গল্পের ভক্তদের রসবোধকে তুষ্ট করেছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলাম স্নেহ-ভালোবাসাকে মানুষ ও মনুষ্যেতর প্রাণীর সংযোগস্থলে পৌঁছে দিয়েছিলেন। মানুষের হৃদয়ের গভীরে নাড়া দিয়ে বলতে চেয়েছিলেন - এরাও এই পৃথিবীর সমান অংশিদার। 'বৃহদারণ্যক উপনিষদ'-এ প্রজাপতি যথাবিধি ব্রহ্মচর্য পালনের পরে দেবতা, মানুষ এবং অসুরকে উপদেশ দিয়েছিলেন - '....দ দ দ ইতি দাম্যত দত্ত দয়ধ্বমিতি....' (দেবতাকে) দমন (মানুষকে) দান এবং (অসুরকে) দয়া করতে বলেছিলেন। দেবতা অজানা স্বর্গের আর অসুর অদেখা পাতালের বাসিন্দা তো নয়। তারা তো আমাদের মধ্যেই রয়েছে। লোভ দমন করা, পাশে থাকা সর্বজীবকে ভালোবাসা আর প্রতিবেশীর সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত না হওয়া হওয়াই তো দেবত্বে অভিষিক্ত হবার সোপান। মহামারণাস্ত্রের যুগে এখন ঘুন্নি (প্রবোধকুমার সান্যাল), বুধি (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়), ফিরিঙ্গী (অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত), ভালু (হেমেন্দ্রকুমার রায়), মরকেতু (সুকুমার দে সরকার), Djali (ভিক্টর হুগো), Crusoe (ব্যালান্টাইন), Nightingale (অ্যাণ্ডারসন), White Fang (জ্যাক লণ্ডন) - সবাই একসঙ্গে মানুষের শুভবুদ্ধির দরোজায় আবেদন জানাচ্ছে - হে শক্তিমান, আমাদের বাঁচতে দাও।
লেখক পরিচিতি -
তরুণকুমার দে নরেন্দ্রপুরের রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক কলেজের পদার্থ
বিজ্ঞানের স্নাতক।পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রনিকস অ্যাণ্ড টেলি-কম্যুনিকেশন বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী এবং বায়োলজিক্যাল এফেক্টস অব ইলেকট্রিক অ্যাণ্ড ম্যাগনেটিক ফিল্ডসে পি এইচ ডি অর্জন করেছেন। তিনি প্রায় তিন
দশক ধরে সাধারণ মানুষের কাছে বাংলাভাষায় প্রযুক্তির তথ্য পরিবেশন করছেন, যে প্রচেষ্টার একটি ফসল তাঁর ‘অজানা
দূষণ’ গ্রন্থ।
যাত্রার বিশিষ্ট
পালাকার ব্রজেন্দ্রকুমার দে-র কনিষ্ঠ পুত্র। ছেলেবেলা থেকেই গল্প, প্রবন্ধ ও নাট্যজাতীয় রচনায়
আগ্রহী।
প্রকাশিত গ্রন্থ : বধূ বিনোদিনী, অজানা দূষণ, পালাকার অঘোরচন্দ্র কাব্যতীর্থ, পালাকার ব্রজেন্দ্রকুমার দে, যাত্রা নাটক প্রসঙ্গ, প্রসঙ্গ : ব্রজেন্দ্রকুমার দে।
অভিনীত যাত্রাপালা: বধূ বিনোদিনী, সুলতান মামুদ, চাঁদ সদাগর, নসীব, আলোর সারথি (ব্রজেন্দ্র-জীবনী)।