Advt

Advt

সিমলা ভ্রমণ - যূথিকা চক্রবর্তী, Simla Vramon (Travel) - Juthika Chakraborty, Tatkhanik Bengali Magazine Online Reading Free

 

Simla Vramon (Travel) - Juthika Chakraborty, Tatkhanik Bengali Magazine Online Reading Free

সালটা ছিল ২০০৭ । দিল্লিতে তখন দু’ডিগ্রী তাপমাত্রা চলছে। সে সময় খবরে জানতে পারলাম সিমলায় বরফ পড়ছে। সিমলায় বরফ পড়া মানেই দিল্লীতে শীতের দাপট বৃদ্ধি  । অতিরিক্ত বরফ পড়ায় কুলুমানালী সহ আরও সব পাহাড়ী পথ রুদ্ধ । কম্বলমোড়া বিছানায় বেলা ১০ টার সময় বসে আছি যত কিছু গরমপোষাক বাড়ীতে পরে থাকা যায় । সেসব সমেত কম্বলমুড়ি দিয়ে বসে বসে মেয়ের গোছগাছ দেখছি । দিল্লীর অতিরিক্ত দাবদাহ আর লাগামছাড়া শীত - সবই এদের সহ্য হয়ে গেছে । আমার তো তা নয় । আমি বলছি -

তোরা সিমলা যা , আমি যাব না । কুলুমানালীতেই যখন যেতে পারব না তখন এই শীতে আমি বিছানা ছেড়ে নড়ছিনা , নড়ব না ।

মেয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলল - দেখ মা , আমরা তো ছুটি পাই না । রবিবার নিয়ে পাঁচটা দিন ছুটি , মানালী না যেতে পারি কুফরিতে যাব ; সিমলায় বরফ পড়াত দেখতে পাব । সেটাই বা কম কি বল ? আর তুমিইতো বল শীতে নাকি তুমি মাটেই কাবুনও । তাই বাবাকে শীতকাতুরে বলে , নিজে চলে এলে দিল্লিতে সিমলাকুল মানালী যাবে বলে কুলু মানালীতে তো আরও ঠান্ডা ।

আর সহ্য হল না বড় দুর্বল জায়গায় ঘা দিয়েছে । লাফ মেরে উঠে পড়লাম । নিজের স্যুটকেশ গুছিয়ে নিলাম মোটে দুখানা শাড়ী আর ওষুধপত্র , আর কিছুনা । শীতের জামাকাপড়তো পড়েই থাকব – – ওগুলোতেই চলবে ২/৩ টে দিন । স্যুটকেসে জায়গা রাখলাম । কেনাকাটা করব না বুঝি ?

চললাম মহাহিমবন্ত হিমালয়ে , দেবভূমি হিমালয়ে । পন্ডিতেরা বলেন এর বয়স ছয়কোটি বছর এবং এখনও পর্যন্ত হিমালয়ের ২/৩ ভূগর্ভে । এর শাখা প্রশাখার শুরু ব্রহ্মদেশে । চীন , তিব্বত , অসম , বাংলা , নেপাল , কুমায়ুন , পাঞ্জাব , কাশ্মীর হিন্দুকুশ আফগানিস্তান হয়ে মধ্যপ্রাচ্যের প্রান্ত পর্যন্ত এর বিস্তার । হিমালয়ে যে একবার যায়, হিমালয় তাকে বারে বারে টানে। আমিও বুঝি সেই টানের অলক্ষ্য বাঁধনে বাঁধা পড়েছি । বাইরের আয়োজন কিছু না অন্তরে ডাক আসে বুঝি , তখনই শুরু হয় প্রস্তুতি আকস্মিকভাবেই । এ অভিজ্ঞতা আমার বার বার হল । এবার আমাদের যাত্রা হিমাচল প্রদেশে হলেও বরফে পথবন্ধ থাকার জন্য কতটুকু দর্শন করতে পারব জানি না ।

দেবমাহাত্মে হিমাচল অনন্য । দেবাদিদে মহাদেবকাশ্মীরের অমরনাথ ছেড়ে আশ্রয় নেন হিমাচলের মণিমহেশে । এমনকি তুষারের শিবলিঙ্গও আবিষ্কৃত হয়েছে হিমাচলের সোলাং উপত্যকায় । আমরা চলেছি কালকা মেলে কালকা ।ভোর ৫ টায় পৌছে , ন্যারোগেজ লাইনের খেলনা ট্রেনে চলেছি সিমলার পথে । পথের সৌন্দর্য্য তেমন মুগ্ধ করেনি তবে চমকপ্রদ একটার পর একটা টানেল পেরিয়ে যাওয়া । যত এগুচ্ছি , বেলা বাড়ছে , বুঝিনি শীতের কামড় কাকে বলে । বেলা পড়ে যাবার সাথে সাথে শীতও বাড়তে থাকল । কোটের উপর প্রথমে পশমী চাদর মুড়ি , শেষে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে রইলাম ট্রেনের কামরায়, কী শীত রে বাবা ! যেখানেই ট্রেন থামে সেখানেই চা কিম্বা কফি নিই । না করার উপায় নেই কেননা ট্রেন থামা মাত্রই সুমন কফি জোগাড় করে ধূমায়িত কাপ মুখের সামনে ধরে ।  এত কফি খাওয়া আমার উচিৎ নয় ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে । সঙ্গীদের সাথে হাসি ঠাট্টায় আর অন্ধকার টানেল পেরুতে পেরুতে একসময়ে সিমলা ষ্টেশনে পৌঁছান গেল । পাহাড় চড়তে আমার বুকে হাফ ধরে , মেয়ে সান্ত্বনা দিয়ে রেখেছিল । ষ্টেশন থেকে আমরা ট্যাক্সি করে সোজা কালীবাড়ীর দরজায় পৌঁছে যাব । যাই হোক , ট্রেন থেকে নামলাম যে যার লাগেজ নিয়ে ষ্টেশন চত্বরে , ষ্টেশনটি ছোটর মধ্যে বেশ ভালই দেখতে । কিন্তু ষ্টেশনে নামবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন চারদিক থেকে হুপ হাপ করে বানর লাফানর মত ঝুপঝুপিয়ে শীত এসে পড়তে লাগল ঘাড়ে পিঠে । ওরে বাবা রে , কী ঠান্ডা রে ! আরও ঠান্ডায় প্রায় জমে যেতে বসলাম বিশেষ করে যখন কুলিরা বলল আজ ' চাক্কাজাম ' কোন গাড়ী মিলবে না । আঙ্গুল তুলে দূরে অনেক উঁচুতে লালরঙের বাড়ীটা দেখিয়ে বলল ওটা পোষ্ট অফিআর ওর উপরে কালীবাড়ী । পায়দলসেই যানা পড়েগা ! কুলিরা পিঠে মালপত্র বেঁধে নিতে লাগল। ওদের পোষাকগুলিও অদ্ভুত মনে হল যেন বড়সড় একখানা কম্বলের মাঝখানটা ফুটো করে সেখানে মাথা গলিয়ে বাকীটা দিয়ে সারা শরীর ঢাকা । হেঁটেই যখন যানা পড়ে গাতখন চল হাঁটি । সবাই আমরা ধীরে ধীরে ঢালুরাস্তা ধরে উপরে উঠতে লাগলাম চারিদিক দেখতে দেখতে । খানিকটা যাই আর উপরে তাকাই-- আর কতদূর ! যত কাছাকাছি । আসতে লাগলাম দুপাশে দোকান হোটেল রেষ্টুরেন্টের সংখ্যা বাড়তে লাগল । আর বাড়তে লাগল বাঁদরের সংখ্যা । চারিদিকে বিশেষ করে দোকানের আশে পাশে গিজগিজকরছে । অসংখ্য বাদর । আমরা নির্বিকার উঠে যেতে লাগলাম । ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে । এক সময় পথের শেষ কালীবাড়ীর দোর গোড়ায় এসে পৌছুলাম । ভিতরে সিঁড়ি ভেঙে উঠে আবার সিড়ি ভেঙে তবে ঘর পেলাম । ম্যানেজার নেই , যেহেতু বুককরা ছিল । তাই ঘর পেতে বিলম্ব হল না । অসময় তাই বিরাট আবাস নির্জন । আমাদের ঘরটা বড় । ৫/৬ জন অনায়াসে শোওয়া যাবে , সাথে বাথরুম। এখন গরম জল পাওয়া যাবেনা শুনে মাথায় হাত । ঘন্টাখানেকের মধ্যে জানাতে হবে রাতের খাবার খাব কিনা এখানে । চা কিংবা গরম জল ম্যানেজার আসলে বলবেন । সাফ জবাব দিয়ে কর্মচারিটি কেটে পড়তেই আমরাও ক্ষোভে ফেটে পড়লাম। এই দারুণ ঠান্ডায় হাত পা জমে যেতে বসেছে সেই সকাল থেকে জার্নি করছি একটু হাতমুখ না ধুতে পারলে চলবে কেমন করে? তার উপর এই বিশাল বাড়ী একেবারে নির্জন । ভয়ও করতেলাগল এখানে রাত কাটাব কিনা । আমি আর সুমন একমত হলাম বললাম - এখানে থাকবনা । কালীবাড়ী ঢোকার মুখেইকত হোটেল তাদের উপেক্ষা করে এখানে থাকাটা ঠিক হবে না । কিন্তু আমার মেয়ের মাথা সাফ এবং ঠাণ্ডা বলল -  এটা বাঙ্গালীর আস্তানা , ম্যানেজারও বাঙালী , তিনি আসুন তার সাথে কথা বলে দেখি কাল গরমজল পাব কিনা । বাঙালীর আস্তানা ছেড়ে বিজাতীয় হোটেলে বাঙালি খাবার পাব না, তাছাড়া দামও নেবে গলা কাটা, তখন খুব মুস্কিল হবে। এখানে ঘরতো আমরা তিনদিনের জন্য বুক করেছি - সেটাও ভাবতে হবে তো । চল সুমন , আমরা রান্নাঘর থেকে একটা বালতি জোগাড় করে নীচের চায়ের দোকান থেকে অন্তত এক বালতি গরমজল কিনে আনি । ভেবে দেখলাম কথাগুলি যুক্তিপূর্ণ । বললাম

-যা তবে , দেখ, গরমজল পাস কিনা !

সারাদিন পর হাত মুখ না ধুয়ে বিছানায় উঠিই বা কি করে ? ওরা বেরিয়ে গেল । পাঁচ মিনিটের মধ্যে লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকে বলল আমাদের এই ঘরের কোনার বারান্দায় ডানদিকে একটা চায়ের দোকান আছে । বলল ১০ টাকা দিলে বড় এক বালতি গরম জল দিবে ওরই বালতি । ভরসা পেলাম । আধঘন্টা পরে ঐ গরমজলটুকুই ভাগাভাগী করে ৪ জনে পরিষ্কার হয়ে নিয়ে দুই সহচরী বিছানায় আরাম করে বসলাম । ছেলে মেয়ে দুটো চা - ওলা সমেত এক কেটলী চা ও গ্লাস নিয়ে হাজির । চা - ওলা ৮ টার মধ্যে চলে যাবে আবার সকাল ৮ টার সময় আসবে । কাজেই আমাদের চা গরম জলের দুঃশ্চিন্তা কাটল । কম্বলে পা মুড়ে বসে সংগের বিস্কুট দিয়ে আরাম করে চা খেলাম । শরীরের আড়ষ্টতা যেন এতক্ষণে কাটল । রাত ৮ টার সময় ম্যানেজার এলেন , তার সাথে কথা বলে ভালই লাগল । বললেন রাতে ডাল , ভাজা , তরকারি মাছের ঝোল পাবেন গরম গরম , সকালে ৯ টা থেকে ১০ টা ১ ঘন্টা গীজার অনকরব তখন স্নান সেরে নেবেন। অন্যসময় গরমজল পাবেন না । এবার অস্বাভাবিক বরফ পড়ার জন্য অনেক বুকিং বাতিল হয়ে গেছে , তবে আগামীকাল দু – একজন আসবে। আপনাদের নিরাপত্তর অভাব এখানে হবেনা

সারাদিন শুধু চা,কফি আর বিস্কুট খেয়েছি । সকাল বেলা কালকা ষ্টেশনে সামান্য কিছু । খেয়েছিলাম তারপর সারাদিন ভারী কিছু খাইনি । এখন ক্ষিদেও পেল প্রচন্ড । শ্রী অর্থাৎ আমার মেয়ে আর সুমন মানে আমার জামাই দুজনে গেল খাবার আনতে । পাউরুটি ডিমসেদ্ধ কিংবা পরোটা রকারী পাওয়া যায় । আমি আর বেয়ান শিখা ( শিখা বাধ্য করেছেওকে ওর নাম ধরে ডাকতে আমিও বেঁচে গেছি ) গল্পসল্প করছি । কোল্ড ক্রিম মাখলাম , হাতে পায়ে মশ্চারাইজার লাগাচ্ছি । প্রায় ঘন্টা দেড়েক পরে সুমন ঢুকল কালো  মুখ আরও কালো করে আর শ্রী ঢুকলো হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে । আমরাও হতভম্ব ! কি হল কাঁদছিস কেন ইত্যাদি জিজ্ঞেস করছি । সুমন বলল ওরা খাবারের দোকানের থেকে বের হতেই ৮/১০ টা বাঁদর শ্রীর উপরে ঝাপিয়ে পড়ে । জ্যাকেটের আড়ালে পরোটার গোছ চেপে আমার পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে বসে পরে আর আমরা দুজনেই বাঁচার জন্য হাতের ব্রেডআর ডিমসেদ্ধর প্যাকেট বাঁদরদের দিয়ে দিই নইলে আমাদের আঁচড়ে কামড়ে যা তা করে দিত। শ্রী খুব ভয় পেয়েছে । দেখ এখনও কাঁদছে ।

ওদের শরীরে কোথাও আঁচড় টাঁচড় লেগেছে কিনা দেখে ডেটলে তুলো  ভিজিয়ে মুছিয়ে দিলাম । তারপর ধীরে সুস্থে শুধু জ্যাম দিয়ে পরোটা খেলাম । শ্রী চোখে জল নিয়ে হাসতে হাসতে বলছে , তবু পরোটাগুলো কে তো বাঁদরের হাত থেকে বাঁচিয়েছি বল । বেশ ঘন্টাখানেক মোটা মোটা  লেপের তলায় নিজের নিজের কম্বল মুড়ি দিয়ে আরামে শুয়ে থাকার পর সাড়ে আটটায় খাবার ডাক এল । গরম গরম ডাল,তরকারী,ভাজা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে যে যার মত শুয়ে পড়লাম । বিকেল থেকেই বরফ পড়ে চলে সারারাত । ভাবছিলাম কাল সকালে তবে যাব কেমন করে বাইরে কালইতো যাব কুফরী । প্রকৃতি যদি বিরূপ হয় , বৃষ্টি পড়ে , তবেতো হয়ে গেল । অন্য কোথাও তো যাওয়া যাবে না জেনেই এসেছি । শুধু সিমলাও ঘুড়তে পারব না ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমের দেশে চলে গেছি ।

ঘুম ভাঙ্গলো  সুমনের চিৎকারে ওমা ওঠ , সকাল হয়ে গেছে, রোদ উঠেছে । জানালার ওপরের কাঁচের ফালি দিয়ে রোদ দেখে মন চনমনে হয়ে উঠল । তাড়াতাড়ি সবাই উঠে মুখহাত ধুয়ে বেশ ভালো করে গরম জলে স্নান করে তৈরী হয়ে নিলাম । ডাইনিং রুমে গিয়ে ব্রেকফাষ্টচা খেয়ে বাইরে এলাম। তখন ভালো  করে চারিদিক তাকিয়ে দেখলাম ভেতরে যাতে বাঁদর না ঢুকতে পারে তার জন্য সমস্তফাক ফোকড় গুলো লোহার শক্ত জাল দিয়ে বন্ধ করা । চারিদিকে ধুপধাপ শব্দ আর বাঁদর বাচ্চাদের কিচির মিচির ডাক । আমরা ছিলাম টপ ফ্লোরে । ছাতে কালী মন্দির প্রথমে সেখানেই গেলাম । শ্যামলাদেবীর পূজা হয় এই মন্দিরে । দেবীর নাম থেকেই পাহাড়ের নাম হয়েছে সিমলা । আর আছেন জয়পুর থেকে আনা দেবী কালী ও দেবী চন্ডী । সিমলার দুর্গাপুজাও হয় এই কালী বাড়ীতেই । মা কালীকে প্রণাম করে বাইরের ছাতে বেরিয়ে এলাম । দেখলাম সমস্তবাড়ীর ছাত বরফে ঢাকা , গাছপালা লতাপাতা সবেতেই বরফ ঝুলছে সারা সিমলা শহরটাই বরফ মোড়া । পাহাড়ী শহরে এরকমই নাকি হয়। সারারাত বরফ পড়েসকালেঝকঝকে সূর্যের আলো  ফোটে আবার দুপুর গড়াতেই বরফ পড়া শুরু হয়। কর্মীরা কোদাল বেলচা দিয়ে অনবরত শহরের পথ বরফমুক্ত রাখছে ।

২২১৩ মি.উঁচুতে সুন্দর পাহাড়ী শহর সিমলা হিমাচল প্রদেশের রাজধানী । সিমলার আকর্ষণ বাঙ্গালীদের কাছে খুব বেশি । তা শরৎ সাহিত্যের পাঠকের কাছে অজানা নয় । অসুখের পর মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত সব গৃহিনীদের মুখেই ছিল – ‘ চল কিছুদিন সিমলে পাহাড়ে ঘুরে আসি। হিমাচলের উত্তর পশ্চিমে ১২ কিমি.প্রশস্ত অর্ধচন্দ্রকার এই সিমলাশহর । সিমলা কখনো ছিল নেপালের , কখনো পাতিয়ালা মহারাজার , তারপর বৃটিশদের । বৃটিশ সৈনিকদের আবিষ্কার সিমলা পাহাড় । সিমলার জল হাওয়া মাঝে নিজেদের দেশের আদল খুঁজে পেয়েছিল বৃটিশরা । গ্রীষ্মকালীন রাজধানীও বসে বৃটিশরাজের । ফার , ওক , দেওদার আর পাইনে ছাওয়া সবুজের সমারোহ সিমলার পাহাড়ে পাহাড়ে । আর আছে লিলি , রডোডেনড্রন ও নাম না জানা আরও কত ফুলের সজ্জা প্রকৃতিকে করে তুলেছে অপরূপা । গাছপালার ডালে মাথায় বরফ ঝুলছে। ভেবে অবাক হলাম এই বরফের মধ্যে রাত্রে বাঁদরগুলো  থাকে কি করে । বাহিনীত বিশাল । এখনও কালীবাড়ীর ছাতে,কার্নিশে বাঁদর ভর্তি । হাতে খাবার কিছুনা থাকলে ওরা ভ্রুক্ষেপও করে না । একজন দেখলাম ছাতের কল খুলে জল খেল আবার নিপুণহাতে বন্ধও করে দিল । ছাত থেকে বরফে মোড়া ঝকমকে সিমলা শহরের ছবি তুলতে লাগল সুমন তারপর হঠাৎ পেছন ফিরে দেখি তোমরা কে কি রকম সেজেছ বলে আমাদেরও ছবি তুলল কিছু কিছু ।

আমাদের যাত্রা হল শুরু প্রথমেই কুফরী যাব বলে । শহর থেকে ম্যালে এলাম । সেখানে একটুঘুরে ফিরে ট্যাক্সি ঠিক করলাম কুফরীর । শহর থেকে কুফরী বেশী দূরে নয়,তবে অনবরত পথ সাফ হচ্ছে যাতে গাড়ী চলাচলে অসুবিধা না হয় । কুফরী যাবার জন্য যেখানে থামতে হল সেখান থেকে আর ট্যাক্সি যাবে না । গামবুট পরে ঘোড়ায় চড়ে যেতে হবে । আমাকে নিয়ে এ ব্যাপারে কারুর কোন মাথাব্যথা নেই । বাদ সাধল শিখা । প্রথমে অনেকক্ষণ গোঁ ধরে বসে রইল ঘোড়ায় চড়তে পারবে না বলে । সুমন সাধতে সাধতে অতিষ্ট হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল তা হলে আমরা যাই তুমি একা একা ট্যাক্সিতে বসে থাক । শেষে আমি অনেক বোঝানোতে ট্যাকসি থেকে নামল , গামবুট পরল । তারপর অনেক কষ্টে প্রায় সবাই মিলে ছোড়ার পিঠে তুলে দিলাম। আমার মেয়েও এই প্রথম ছোড়ায় উঠছে তবু শ্বশুড়ীর অবস্থা দেখে চুপচাপই উঠল । আমি উঠলাম সহজেই । সুমন শেষে । পাহাড়ী পথে ঘোড়া চলা শুরু করতেই পিপি আওয়াজ বেরুতে লাগল মেয়ের গলা দিয়ে - ভয়ে কাঁদছে আরকি ! ঘোড়াওয়ালা এক ধমক দিয়ে বলল এ রকম শব্দ করলে ছোড়া বিগড়ে গিয়ে তোমাকে ফেলে দিয়ে ছুট লাগাবে। ব্যস একদম চুপ হয়ে গিয়েছিল , পরে আমাকে বলছিল – “ অবশ্য মা , ছোড়ার চলার তালে গা দুলিয়ে দিয়ে চারদিক দেখতে দেখতে ভুলে গেছি ভয়ের কথা । আমার কোন অসুবিধা হয়না । কেননা আমি বহুবার দার্জিলিঙে গিয়ে ছোড়ায় চেপে জলাপাহাড়ে এবং আরও এদিক সেদিক ঘুরেছি কর্তার সঙ্গে সঙ্গে , সেইজন্য ঘোড়া আমার কাছে অসুবিধাজনক নয় । কেদারধামও যমুনোত্রীতেও গোমুখে ঘোড়ায় চেপেই গেছি। তবে সেগুলি ঠিক ঘোড়া নয় সেকথা যথাস্থানে বলা যাবে ।

শেষ পর্যন্ত পৌছোলাম গুপী গাইন বাঘা বাইনের দেশ ঝুণ্ডিতে ভুতের রাজার বর ছাড়াই আমরা এসেছি এখানে। তাই শীতে পালাব না। কুরীতে ঢোকার রাস্তাটাও অনবদ্য । পাইন ওক দেওদারে ছাওয়া শান্ত সুনিবিড় পথ । পথের ডানদিকে ঢাল আর বাঁ দিকে গাছে গাছে বরফের ঝালর । ঢালের দিকেও দেওদারের বরফের ঝালর সূর্য কিরণে ঝলমল করছে কী যে মনজুড়ান সুন্দর পথ,পথের সৌন্দর্য্যের কথা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিনা যে দেখবে সেই বুঝবে সে সৌন্দৰ্য্য অনির্বচনীয় । ঘোড়া থেকে নেমে সামনে এগিয়ে বাঁয়ে একটু বাক্ নিতেই অবাক । সম্পূর্ণ বরফমোড়া এলাকা । চারিদিকে শুধু বরফ আর বরফ । অনেকখানি এলাকা নিয়ে সাদার মোড়কে পাহাড়ের কোলটি । ডানদিকে বেশ উঁচুমত জায়গা । যদি কোথাও গর্ত থাকে তাহলেই মুশকিল । স্কী খেলার তোড়জোর চলছে । সুমন ও শ্রী ঝাপিয়ে পড়ল বরফের মধ্যে । ওদের হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেল বরফের মধ্যে । ওরা ডাকতে লাগল আমাদের মা এস , মণি এস ’ – এমন সময় পিছন থেকে শিখার এক ধাক্কা খেয়ে পড়লাম মেয়ের উপর, দুজনেই চিৎপাত । এবারে শিখাও নেমে এল । অনেকক্ষণ আমরা দুইবুড়ি আর দুই যুবক-যুবতী বরফের মধ্যে হুড়োহুড়ি করলাম । বরফ ছোঁড়াছুড়ি লোফালুফি চলতে লাগল । শেষে ইয়াকের পিঠে বসে ছেলে মেয়ে দুটো ছবি তুলল । ততক্ষণে ঠান্ডায় হাত অসাড় হয়ে গেছে । গ্লাভস কোথায় খুলে পড়ে গেছে খেয়ালই করিনি । অনেক খোঁজাখুঁজি করে সুমন উদ্ধার করল আমার লাল গ্লাভস আর আমারটা খুঁজতে গিয়ে হারাল নিজের একটা । কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না । শিখা খুব বকাবকি করতে লাগল । বললাম । কোন ব্যাপার নয় পথের ধারেই কত দোকান একটা কিনে নিলেই হবে । ওখানে কফির দোকান পাওয়া গেল । সবাই গরম গরম কফি খেয়ে এবার ফেরার জন্য প্রস্তুত হলাম । খুব মন খারাপ করছিল কুফরী ছেড়ে যেতে । কুফরী আমার অনেকদিন মনে থাকবে । চারিদিক দেখতে দেখতে আবার বাহনের পিঠে উঠে পড়া । ফেরার পথে অনেক সুন্দর সুন্দর দৃশ্যের ছবি তুললাম আমরা । ঘোড়া পৌছল নির্দিষ্ট জায়গায় । গামবুট ভাড়াসহ ফেরৎ দিয়ে খাবার সন্ধানে এগুলাম । একটা জায়গায় বেশ গরম গরম ভাত,ডাল আর আলুভাজা খুব তৃপ্তিকরে খেলাম। এখানকার ভেজ খাবার বেশ ভাল । ট্যাক্সিতে ফিরে ড্রাইভারকে বললাম বরফ বাঁচিয়ে আর কোথায় কোথায় যাওয়া যায় চল । কুফরীর সৌন্দর্য আর বরফ খেলার আনন্দ আমাদের বেশ চনমনে করে রেখেছে।

বৃটিশের অবদান সিমলা পাহাড় । শহরের প্রাণকেন্দ্রে ম্যাল বা স্কান্ডাল পয়েন্ট । এখানে আমরা দেরী না করে অন্যত্র যাবার নির্দেশ দিলাম । ম্যালের শেষ মাথায় অ্যাঙ্গলো  এশিয়ান ক্রাইষ্ট চার্চ। ভারতের অন্যতম প্রাচীন সুন্দর কারুকার্যময় চার্চ এটি । চার্চের নানান রঙের কাচের জানলা, মুরাল চিত্র অনবদ্য। ম্যালের পুবে গ্যেইটি থিয়েটার । ম্যাল ও রিজের সংযোগে লাজপত রায় চক। দূরে দেওদার ও পাইনের মাথা ছাড়িয়ে দিকচক্রবাল ঢেকে তুষারমৌলী হিমালয়ের নানান নাম না জানা শিখর । রিজের পাশ দিয়ে ট্যুরিষ্ট অফিসের সামনে দিয়ে পথ গিয়েছে জাতু হিলস্ - এর । ২৪৫৫ মি . উচু জাতুর চুড়ায় হনুমান মন্দিরটিও খুবই সুন্দর । দূরে সিমলা শহরও দৃশ্যমান। সবচেয়ে সুন্দর বরফের উপর সূর্যের পতিত রশ্মি আলোয় চারিদিকের অপরূপ মোহময়ী ঝিকমিকান দৃশ্য । মন্দির চত্বরটি শ্বেত পাথর বাধানো। আরও ৫ কিমি . পশ্চিমে ২১৪৫ মি.উঁচুতে পাহাড়ী পথে প্রসপেক্ট হিল । নৈসর্গিক সৌন্দর্যের যেন তুলনা মেলেনা । এখান থেকে সিমলাপাহাড়ের দৃশ্য , তারাদেবীর মন্দির , বৈষ্ণোদেবীর মন্দির , কামনা দেবীর মন্দির দৃশ্যমান । পূর্ণিমার সন্ধ্যায় প্রসপেক্ট হিল থেকে একই সময়ে সূর্যাস্ত ও চন্দ্রোদয় দেখা যায় । যেমনটি দেখা যায় কন্যা কুমারীকা-তে । পাহাড় চূড়ায় কামনা দেবীর ছোট্ট মন্দির । পূজা হয় আজও । কামনা পূরণ হয় দেবী পুজায় । আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে পথেই পরে সঙ্কটমোচন মন্দির ।

অবজারভেটরি হিলে সুন্দর প্রকৃতিতে ঘেরা টিলার উপর প্রাসাদোপম ৬ তলা গার্ডেন হাউস রিট্রিট। কাঠের সিড়ি , পাথরের বাড়ী , স্বাধীনোত্তর ভারতের রাষ্ট্রপতির গ্রীষ্ম বাস হয় রিট্রিট । ভারত ইতিহাসের নানান স্মৃতিবিজড়িত এই ভবন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি - এর উদ্দেশে উৎসর্গ করেন রাষ্ট্রপতি ডা : সৰ্ব্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান ।

বিকেল গড়িয়ে আসছে । রাস্তার দুপাশে সেই সকাল থেকে দেখছি লোকেরা কোদাল বেলচা দিয়ে রাস্তার বরফ পরিষ্কার করছে । ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হল । ড্রাইভার শহরের দিকে তরিৎ গতিতে চলার চেষ্টা চালাতে লাগল কিন্তু গাড়ী স্পীডনিতে গেলেই পেছনের চাকা পিছলোচ্ছে। সুতরাং সাবধানেই গাড়ী চলতে লাগল । ম্যালের কাছাকাছি এসে গেছি । প্রায় ,এমন সময় সাবুদানার মত অজস্র মিহি ধবধবে অজস্র ধারায় বরফ পড়া শুরু হল । বললাম গাড়ী থামাতে , বরফের মধ্যে হাঁটব বলে । ড্রাইভার বলল ঢালুপথে ব্রেককষলে গাড়ী সামলাতে পারবনা । দেখি সুবিধামত সমান জায়গা পেলে নামিয়ে দেব । সুবিধামত জায়গায় গাড়ী থামলে ড্রাইভারকে তার প্রাপ্য মিটিয়ে দিতেই সে হাসিমুখে চলে গেল । খুব উৎসাহী ছেলে ছিল ড্রাইভারটি । গাড়ী থেকে নেমেই আমরা সবাই সংকীর্তনের ভঙ্গিতে দুহাত তুলে বরফকুচি ধরব বলে হাঁটতে লাগলাম । আমরা ম্যাল থেকে রাস্তা শর্টকাট করতে গিয়ে ঢালু রাস্তা বেছে নিয়ে ভুল করলাম। সুমন ছাড়া আমাদের সকলের পায়েই জুতার তলা প্লেন । সুতরাং পালা করে সবাই পিছলে নামতে লাগলাম আর চিৎকার করতে লাগলাম রাস্তার ধারের রেলিং নাগালের মধ্যে না পেয়ে । সুমন একা রক্ষাকর্তা। একেটাকে ধরছে আর টেনে তুলে রেলিং ধরিয়ে দিচ্ছে । ওটা একটা বাকের মুখ । দ্রুততার সাথে সুমন সামলেছে তাই নইলে কাদায় গড়াতে গড়াতে কোথায় গিয়ে যে ঠেকতাম । এবারে রেলিং ধরে ধরে আমরা গন্তব্যে পৌছলাম বরফে বৃষ্টিতে ভিজে কাপতে কাঁপতে কালীবাড়ীতে ঢুকে গেলাম সেদিনের মত ।

পরদিন সকালে আবার মাকালীকে দর্শন ও প্রণাম সেরে বরফঢাকা রোদ ঝলমলে সিমলা শহরটাকে দেখতে লাগলাম । অর্ধচন্দ্রাকারে ঢাল বেয়ে নীচে বহুদুর শহরটা নেমে গেছে । আজ যাব ম্যালে অবশ্যই, তবে পায়ে হেঁটে সেই বাঁকটা ধরে যেটা কালীবাড়ী থেকে ম্যালে যাবার সংক্ষিপ্ত পথ । সেই ঢাল খাড়াই , সেই ভিজে কাদায় মাখামাখি এবং গতকালের মতই পিছল । এই রাস্তাটা কালীবাড়ী থেকে ম্যালে যাবার পক্ষে খুবই সংক্ষিপ্ত । তাই রেলিং ধরে ধরে আস্তে আস্তে সবাই নিরাপদেউঠে গেলাম উপরে । ট্যুরিষ্টরা অনেকেই ইতিমধ্যে ম্যালে জমায়েত হয়েছেন এবং নিজেদের মধ্যে হোটেলের সুবিধার কথা হচ্ছে । এমনি কথপোকথনরতা এক বাঙ্গালী মহিলার সাথে আলাপ হোল বললাম আমরা কালীবাড়ীতে আছি । প্রচুর বরফ পড়ছে বলে কুলু মানালীর রাস্তা বন্ধ তাই অনেকে ঘর বুক করেও ক্যানসেল করেছেন । আমরা তো ফাঁকা পুরীতে বেশ আরামে আছি,পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বাঙালী খাবার খাচ্ছি । আপনারাও একটু খোঁজ নিলেই পারতেন । ভদ্রমহিলার দল বড় । সবার মতেই সবাইকে চলতে হবে সুতরাং যেহেতু আগে থেকে বুক করেননি তাই খোঁজ নিতেও আসেননি সিমলা কালীবাড়ীতে। আরও অনেক কথা হল । কুফরীর আনন্দ সবাইকেই মোহিত করেছে সমতলবাসীদের । আমরা বাজারের দিকে রওনা হলাম । সকলের পাহাড়ে চলার উপযুক্ত জুতো কিনলাম । আমার ছিলই সঙ্গে কেন যে নিলাম না, তাই সকলের চাপে সবাই জুতো কিনলাম । সেমি প্ৰেশাস ষ্টোনের গহনার দোকানে বুড়ি ছুড়ি সকলকেই টানে । মেয়ে কিনল,আমি আর শিখাও কিনে দিলাম ওকে । শিখাও দুলটুল পরে, অনেক অনুরোধ করলাম নেবার জন্য কিন্তু কিনতে রাজী হল না । আমি ত জীবনেও দুলজাতীয় কোন কানের গয়না পরিনি, আর  এখনত প্রশ্নই ওঠে না । সবাই নিজের নিজের পয়সায় টুপি পড়ল তবে সুমনকে আমি টুপি পরালাম মৌলানা আবুলকালাম আজাদের মত দেখতে লাগছিল ওকে । কেউ হাসলাম না, তাহলে পরবেনা, টুপিটাতে কানঢাকা থাকে ওর আবার কানের ব্যথা হয় একটু ঠান্ডা লাগলেই । শাল , কার্ডিগান , শোয়েটার সবাই কিনলাম । শেষে বললাম তোরা কেনা থামাবি? এগুলো নেব কিভাবে সেটা একটু ভাব । মেয়ে বলল - বকবে না, যা পছন্দ হবে সুমন কিনে দেবে , একটা ব্যাগও না হয় কিনে নেব । বললাম - হাতও কি আরও দুটো করে কিনবি ? ” এইসব করতেই দুপুরের খাবার সময় হল । ঢুকলাম একটা খাবার জায়গায় । থালা, বাটি টেবিল চেয়ার সবই সুন্দর কিন্তু খাবার যখন পরিবেশিত হল সেটা কিন্তু তেমন মুখরোচক হল না । কি আর করা ! ঐ খেয়েই বেরিয়ে এসে বললাম পান খাব নইলে আমার কিন্তু সব বমি হয়ে যাবে । পথের ধারে একটা পানের দোকানে এলাম । পানওলা কি এক ধরনের মিঠা পাতার পান দিল যেমন পান সাজার ধরন তেমনি খেতে ভাল । মুখে দিতেই যেন প্রাণটা জুড়িয়ে গেল । এই পানওলার কথা আমি জীবনেও ভুলব না । ইনি ছোট বেলায় পড়া মধু বিক্রেতা নন , পানও ভাল , সাজায় ভালো  আবার কথাও খুব মিষ্টি বলে। মিষ্টি মশলাও ভাল মেশান।শিখা একটা মজাদার টুপি কিনেছে – শক্ত বোনা পাশে অনেকখানি ওল্টানো বাটিরমত । সেটা পড়েই নির্বিকার ঘুরছে । ঐ টুপি পরে ছবি তুলল । খুবই দিলখোলা মানুষ । টুপিটা দেখে মনে হচ্ছিল ঢাকার কুট্টিদের কথা বাবু এমন সরা দিলাম চিড়া ভিজাইয়া খাইবার পারবেন আবার মাথায় ভি দিবার পারবেন । শিখার টুপিটাও সেরকম বলল এখন মাথায় দিচ্ছি পরে দেখনা এটাতে করে সাবুদানা ধরব । সুমন হেসে বলল তোমার কি বুদ্ধি মা , সাবুদানা এক মিনিটও সাবুদানা থাকবে না জল হয়ে যাবে তুমি কি ঘরে গিয়ে চায়ের বদলে ঠান্ডা জল খাবে ? তবে ত আমার পরিশ্রম কমল । এইসব কথা বলতে বলতে আমরা ম্যালে পৌছলাম ।

একটা ফাঁকা বেঞ্চিতে বসে বললাম আমি এখানেই বসলাম, তোরা যেখানে খুশি  ঘুড়ে বেড়িয়ে নে। আমি আর চড়াই উৎরাইকরতে পারছিনা । সবাই সবার বোচকা বুচকি আমার কাছে জমা দিয়ে ঘুরে ঘুরে দোকান দেখতে লাগল আর কত যে ছবি তুলল । তার হিসাব নেই । সুমন বলল মনি এস , তোমার ছবি তুলি । বললাম - বসেইতো আছি,সুন্দর একখানা বেঞ্চিতে, তোলনা কত ছবি তুলবে ! সবাই পালা করে আমার পাশে বসে ছবি তুলল । কত ভঙ্গিমা , কত হাসি ।

আসন্ন সন্ধ্যায় আবার শুরু হয়ে গেল বরফ পড়া প্রথমে একটু ঝিরঝিরে বৃষ্টি তারপর সাবুদানা এবং পরে দানা ক্রমশ বড় হতে লাগল । ছেলে মেয়ে দুটো মাথায় গায়ে দেদার বরফ নিচ্ছে দেখে বকলাম বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ঠান্ডা লেগে যাবে । কাল সকালেই ফেরার তাড়া । বোচকা বুকি সামলে সেই ঢালু পথেই ফেরা, সবার পায়েই উপযুক্ত জুতো তবুও আমি রেলিং ধরে ধরেই নামতে লাগলাম । মজার ব্যাপার শিখা ওর টুপিটাকে মাথার উপর উল্টো ধরে থাকল মানে বাটিতে বরফ ধরা ।

ঘরে ফিরলাম । জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পোষাক পালটে বিশ্রাম নিচ্ছি । কিছুপরেই উঠে সব গোছগাছ করতে হবে । কাল সকালে ১০ টায় ট্রেন । মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল । তবুও সন্ধ্যারতি দেখবার জন্য ছাতে কালীমন্দিরে গেলাম । দেখলাম ছাতের খোলা  অংশটা সাদা হয়ে গেছে বরফে । দেখে ঘরে ফিরে সব গোছ গাছ করতে লাগলাম । প্রয়োজনীয় দুএকটা কথা ছাড়া কারুর মুখে আর কথা নাই ।

পরদিন সকালে ষ্টেশনে এলাম মালপত্র কুলির পিঠে বেঁধে। সময়মত ট্রেনে উঠলাম । ট্রেনের পথে সবাই এত চুপচাপ কেন ? একি দুদিনের পরিচিতকে এতটাই আপন করে নিয়েছি যে বিদায়বেলায় মনটা এমন ভারী হয়ে উঠেছে ! মন সত্যি খুব ভারাক্রান্ত । বিদায় কুফরী , বিদায় সুন্দরী সিমলা , বিদায় ম্যাল । কিছুক্ষণ পর মন হালকা করার জন্য সুমন বলল আমি আবার আসব কুলু,মানালী তো দেখা হল না । আমি বললাম , আমার অনেক দেরী হয়ে গেছে । পাহাড়ে আর আসার সাহস নেই । বিদায় , বিদায় , সুন্দরী সিমলা । শ্যামলা সিমলা । 

লেখক পরিচিতি

যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।