Advt

Advt

ঈশ্বর ভাবনার বিবর্তন ও বৈদিক সাহিত্যে শক্তির স্বরূপ - ড. রঘুনাথ ভট্টাচার্য, Ishwar Bhabnar Bibartan O Vaidik Sahitye Shaktir Swarup by Dr. Raghunath Bhattacharya, Tatkhanik Bengali Magazine Online Reading Free

 

Ishwar Bhabnar Bibartan O Vaidik Sahitye Shaktir Swarup by Dr. Raghunath Bhattacharya,


সুপ্রাচীনকাল থেকেই মানুষ ঈশ্বরকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন । আর সেই ভাবনার লিখিত রূপ হচ্ছে বেদ । বেদের মধ্যে ঋগ্বেদ ' হচ্ছে পৃথিবীর প্রাচীনতম সাহিত্য। ঋগ্বেদের মধ্যে আমরা ক্রমপরিণত ঈশ্বর ভাবনার সুপ্রাচীন রূপটির পরিচয় লাভ করি । বৈদিক যুগের ব্যাপ্তি হাজার বছরের । সেই হাজার বছরে ভারতবর্ষের মানুষের পূর্বপুরুষগণের ঈশ্বরভাবনার বিবর্তনের ধারাটিও স্পষ্ট । সে ধারা আরও পরিণতির দিকে কিভাবে গেছে তার পরিচয় রয়েছে - রামায়ণ , মহাভারত , ন্ত্র ও প্রাচীন পুরাণগুলোতে । অপরদিকে , বৈদিক সভ্যতার পাশাপাশি সিন্ধুসভ্যতার বিকাশের যে প্রমাণ পাওয়া যায় সেখানেও প্রাচীন মানুষের ঈশ্বর ভাবনার রূপরেখা বিদ্যমান । উভয় সভ্যতার মধ্যে কোনটি প্রাচীনতর , কোনটি কতখানি মূলগতভাবে ভারতীয় অথবা অভারতীয় , তা নিয়ে সর্বসম্মত কোনও সিদ্ধান্তে আসা এখনো সম্ভব হয়নি । আবার উভয় সভ্যতার মধ্যে সংঘর্ষ ও সমন্বয়ের তত্ত্ব নিয়েও বাদ - প্রতিবাদ এখনো থামেনি ।

ভয় , বিস্ময় এবং আনন্দ ঈশ্বরভাবনার জন্মদান করে থাকলেও মানুষের প্রথম ঈশ্বরভাবনা পুরুষকেন্দ্রিক ছিল অথবা নারীকেন্দ্রিক ছিল- সে বিষয়ে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত এখনো জানা যায়নি । তবে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে , মানুষ তখন ঈশ্বরকে যেমন পুরুষ ভেবেছে , তেমনি আবার নারীও ভেবেছে । এর প্রমাণ যেমন ঋগ্বেদ ' - এ  আমরা পেয়েছি , তেমনি পেয়েছি সিন্ধুভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোতেও । বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক । কারণ , মানুষ যখন ঈশ্বরের কল্পনা করেছে তখন সে তার নিজের আদলেই তাকে কল্পনা করেছে । মানুষ তো শুধু পুরুষই নয় , মানুষ নারীও । সুতরাং আদিম মানুষের ঈশ্বর ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে এসেছিল পুরুষ - ঈশ্বর সম্পর্কে পিতৃভাবনা এবং নারী - ঈশ্বর সম্পর্কে মাতৃভাবনা । আনন্দের ব্যাপার এই , ভারতেই হোক অথবা পৃথিবীর অন্যকোনও দেশেই হোক , “ মা ' শব্দটি সুপ্রাচীনকাল হতে কোনও না কোনওভাবে জননী সম্পর্কে প্রযুক্ত হতে দেখা যায় । শিশু যখন প্রথম পৃথিবীর আলো দেখে তখন তার মুখে ভাষা থাকে , থাকে ক্রন্দনধ্বনি । আশ্চর্য , সেই ধ্বনিটি সবদেশেই ' মা ' - এর মতোই শোনায়।প্রকৃতির নিয়মে কিছুকালের মধ্যে শিশুর মুখে ভাষা ফোটে । মানবশিশুর মুখে উচ্চারিত প্রথম শব্দটিই মা । সেজন্য সংস্কৃত , ল্যাটিন প্রভৃতি প্রাচীন ভাষাতেই হোক অথবা ইংরেজি , জার্মানি , বাংলা যেকোনও আধুনিক ভাষাতেই হোক,জননীকে যে শব্দে আমরা ডাকি তার প্রথমে বা শেষে মা বা মা ’ - র কাছাকাছি একটি ধ্বনি আছেই । আর মা’-ই শিশুটিকে বাবা বা অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় । সে অর্থে মা-ই হচ্ছেন শিশুটির পথ - নির্দেশক।

সেজন্য পণ্ডিতগণ মনে করেন , ঈশ্বর ভাবনার উন্মেষলগ্নে মানুষ ঈশ্বরকে নারীরূপেই দেখেছে এবং স্বাভাবিক ভাবেই সেই নারীরূপের মধ্যে মাতৃরূপটিই ছিল প্রধান। কারণ , আদিম সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক । তখন মায়ের পরিচয়েই সন্তানের পরিচয় চিহ্নিত হতো। নারী ছিল স্বাধীন

আদিম সমাজ যখন ক্রমে কৃষিনির্ভর হয়ে পড়ল তখন বীজবপন হতে শস্য সংগ্রহ এবং শস্য সংরক্ষণ প্রভৃতি সমস্ত বিষয়ে নারীরাই ছিল অগ্রণী । এতে নারীই হয়ে উঠেছিল পরিবার তথা গোষ্ঠীর ভরকেন্দ্র । ফলত নারীর প্রতি স্বাভাবিকভাবেই পুরুষেরা নির্ভর করতে আরম্ভ করল । নারীর প্রতি এই নির্ভরতা তাদের মাতৃবন্দনায় ব্রতী করল । এই মাতৃবন্দনাই সমাজকে মাতৃপ্রাধান্য দান করল ।

মাতৃপূজার বিষয়টি ছিল প্রাচীন সমাজের একটি সাধারণ বিষয় । পারস্পরিক কোনও যোগাযোগের কারণে নয় , প্রাচীন সমাজে মাতৃ প্রাধান্য তথা মাতৃ - উপাসনার স্বাভাবিক উদ্ভবের কারণেই প্রাচীন সভ্যতাগুলোর দেবীমূর্তি বা দেবীভাবনার মধ্যে একটি সাদৃশ্য আছে । আবার ভারতবর্ষের সুপরিচিত মহিষমর্দিনী দুর্গার মূর্তির সঙ্গে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের যুদ্ধপ্রিয়া দেবী ভির্গোর এক অদ্ভুত সাদৃশ্যও এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় । প্রাচীন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের এই দেবীও মহিষমর্দিনী । ভারতীয় পুরাণের মতে , দুর্গা মহিষরূপী অসুর ও তার অসংখ্য অনুচরকে বধ করেছিলেন । মহিষ ' আর কিছুই নয় , সংস্কৃতি, নারীলোভী, হিংস্র , বর্বর এক জনগোষ্ঠী এবং মহিষাসুর তাদের নেতা । ভূমধ্যসাগর অঞ্চলেও প্রাচীনকালে খেম্' নামে আদিম এক মিশ্র জনগোষ্ঠী বসবাস করত । তাদের টোটেম ' বা ঈশ্বরের প্রতীক ছিল মহিষ । অর্থাৎ মহিষ ছিল তাদের কাছে খুব পবিত্র । ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের সুসভ্য জনগোষ্ঠী মন্‌খেম্‌রদের পরাভূত করেছিল । যুদ্ধদেবী ভির্গোর মহিষমর্দিনী মূর্তির মাধ্যমে মন্‌খেম্‌রদের উপর তাদের ঐ বিজয়ের ঘটনাই রূপায়িত । অবশ্য ভির্গো এবং দুর্গার এই সাদৃশ্যের মধ্যে পারস্পরিক প্রভাবের বিষয়টি অবান্তর । কারণ , প্রাক্ ঐতিহাসিক সেই প্রাচীনযুগে পারস্পরিক সংযোগের সম্ভাবনা ছিল না । উভয় ক্ষেত্রেই প্রাচীন সমাজে মাতৃপূজার ভাবনাটি স্বতন্ত্রভাবে উদ্ভূত হয়েছিল এবং হয়েছিল আদিম সমাজের মাতৃপ্রাধান্যের স্বাভাবিক ধারা অনুসারেই ।

ভারতবর্ষের ইতিহাসের সূচনা সিন্ধুসভ্যতা হতে ধরা হয় । হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত দেবীমূর্তিগুলোর মধ্যে মাতা পৃথিবীর মূর্তি অন্যতম । মূর্তিগুলোর মধ্যে একটি মূর্তির অঙ্গ হতে একটি বৃক্ষকে উদ্গত হতে দেখা যায় । এর থেকে অনুমান করা যেতে পারে শস্য , প্রাণশক্তি ও প্রজননশক্তির প্রতীকরূপে আদিম মানুষ দেবী পৃথিবীর কল্পনা করেছিলেন । শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সমগ্র জগতের মধ্যে এই মূর্তিটিই সম্ভবত পৃথিবী দেবীর প্রাচীন মূর্তি । মিশরীয় দেবী মাউত , মেক্সিকান দেবী মায়োএল , জার্মান দেব নের্থাস , গ্রিক দেবী রুহী , রোমান দেবী সিবিলি, এশিয়া মাইনরের অর্থাৎ ফ্রিজীয়দের গদান মা ছিলেন পৃথিবী - দেবী ।

ভারতের বৈদিক সাহিত্যেও পৃথিবী - দেবী বিশেষ মহিমান্বিতা । ঋগ্বেদের ঋষি বলেছেন , “মাতা পৃথিবী মহীয় " - বিস্তীর্ণা পৃথিবী আমার মাতা । ( ১১৬৪। ৩৩ ) ঋগ্বেদে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দৌ ' বা স্বর্গ বা আকাশ এর সঙ্গে পৃথিবীর নাম উচ্চারিত । ঋগ্বেদে দৌ ' জগতের পিতা - রূপে এবং পৃথিবী জগতের মাতা - রূপে কল্পিত । দৌ ' এবং পৃথিবী মিলে বেদের দ্যাবা- পৃথিবীর কল্পনা । এ প্রসঙ্গে ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত বলেছেন :-

এই সকল বর্ণনা দেখিলে বেশ বোঝা যায় যে , পৃথিবীকে যে এই মাতৃরূপে বর্ণনা , ইহা বৈদিক কবিগণের নিছক কবি - কল্পনা মাত্র নহে ; ইহার পশ্চাতে বৈদিক কবিগণের একটা ধর্মবোধ প্রচ্ছন্ন ছিল- পৃথিবীর সীমাহীন বিস্তার , তাহার রূপ বৈচিত্র্য , তাহার অন্নদা এবং ধনদা রূপ , সর্বোপরি পৃথিবীর বুকে লুক্কায়িত অনন্ত প্রাণশক্তি নিরন্তর অসংখ্যরূপে তাহার প্রকাশ এই সকল একত্র হইয়া মুগ্ধ কবিগণের চিত্তে একটা বিস্ময়জনিত শ্রদ্ধা জাগাইয়া তুলিয়াছিল । এই শ্রদ্ধার প্রগাঢ়তাই মানুষের ধর্মবোধের উদ্বোধন এবং সেই ধর্মবোধকে অবলম্বন করিয়াই পৃথিবীর দেবীমূর্তি । "

ঋগ্বেদের মতে আদি পিতা দৌ বা আকাশের সঙ্গে আদি জননী পৃথিবীর মিলন ঘটে বর্ষণের মাধ্যমে। আকাশ হতে পতিত বৃষ্টিধারা পৃথিবীকে সন্তানবতী বা শস্যশালিনী করে । মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন হতেই এমন একটি ধর্ম বিশ্বাস বহু জাতির মধ্যে প্রচলিত ছিল যে , বর্ষণের মাধ্যমে আকাশরূপী পিতা - ঈশ্বর পৃথিবী রূপিণী মাতা - ঈশ্বরের গর্ভসঞ্চার করেন এবং এর ফলে পৃথিবী বৃক্ষ , লতা , গুল্ম , ফল , ফুল ও শস্যে পূর্ণ হয়ে উঠেন । ঋগ্বেদে আদিত্যগণের জননী ' দেবী আদিতি ও দেবী পৃথিবী অভিন্না । আদিত্যগণের জননী আদিতি পরবর্তীকালে দেবমাতা হয়ে গেছেন । আরও পরবর্তীকালে তাকে আমরা প্রজাপতি দক্ষের জননী এবং কন্যা উভয় রূপেই দেখতে পাই । সেখান হতে তিনি দক্ষকন্যা সতীতে - যিনি রূপান্তরে উমা , গৌরী , দুর্গারূপে আমাদের মধ্যে পূজিতা হন । ঋগ্বেদের এই পৃথিবী- অদিতির কল্পনাই সনাতন - ভারতের শক্তিপূজার আদি উৎস । ' রাত্রিসূক্ত ' দেবীসূক্ততে ঐ কল্পনারই আরেক প্রকাশ ঘটেছে । এই দুই ধারা হতেই পরবর্তীকালের শক্তিতত্ত্ব ও শক্তিসাধনার ঐতিহ্য প্রধানত গড়ে উঠেছে । ঋগ্বেদের অন্যান্য নারী - দেবতার মধ্যে বিশেষ স্থান উষা ও সরস্বতীর । মানবজননী পৃথিবী , আদিত্যবৃন্দের মাতা আদিতি , সূর্যপ্রেয়সী উষা , জ্যোতিরূপিনী সরস্বতী , দেবীসূক্তের দেবী এবং রাত্রিসূক্তের রাত্রি পরবর্তীকালে পৌরাণিক যুগে একীভূতা হয়ে অসুরনাশিনী, জগদ্ধাত্রী , রুদ্র - শিবজায়া জগন্মাতা দুর্গা ও কালীতে পরিণত হয়েছেন ।

বৈদিক সাহিত্যে উষা এবং সরস্বতী স্বতন্ত্রভাবে ও আপন মহিমায় বন্দিতা ও আরাধিতা হয়েছেন । উষার মধ্যে শক্তির দুটি বিভাগ সুস্পষ্ট । একটি তার জননীরূপ , অপরটি তার জায়ারূপ । সূর্যকে যেন তিনি জন্ম দেন , তাই তিনি তাঁরই জননী । তারই উৎসঙ্গে বা কোলে সূর্যের আবির্ভাব । এই জননীই সেই আদি কৌমারী শক্তি , যার কোনও জনক বা পিতা এবং পালক বা পতি নেই । এই কুমারী মাতাই আদি পিতাকে বা সৃষ্টিকর্তা প্রসব করেন বা জন্ম দেন । এই তাঁর ঘোষণা ঋগ্বেদের বাক্‌সূক্তে : অহং সূবে পিতরমস্য মূর্ধন্ " - আমিই এর মাথায় অর্থাৎ সৃষ্টির শিখরে এই পিতাকে প্রসব করে থাকি । কিন্তু তার নিজের উদ্ভবস্থল বা যোনি কোথায় ? তাকে জন্ম দেন কে? তার তল বা সন্ধান পাবে কে ? সে যে অতল সমুদ্র , চৈতন্যের মহাসাগর । সেখানেই এই শক্তির যোনি বা উৎস- মম যোনিরপ্‌স্বন্তঃ সমুদ্রে " - বলেছেন নিজেই সাঙ্কেতিক ভাষায় । জননীরূপেও যেমন তার পরিচয় সকলের অগোচর, তেমনি জায়ারূপে বা প্রিয়ারূপেও তাকে কোনোওদিনই ধরা - ছোঁয়ার নাগালের মধ্যে পাওয়া যায় না । বৈদিক ঋষি একটি আশ্চর্য উপমায় এটি প্রকাশ করেছেন । উষা আসেন প্রথমে , আগে আগে ; তারই পিছন পিছন আসেন সূর্য , কিন্তু কোনও দিনই সূর্য তার নাগাল পান না , তাকে ধরতে পারেন না । সূর্য আসতে আসতেই উষা কোন্ সুদূর দিগন্তে যেন মিলিয়ে যান , ধরা দেন না । অথচ সূর্য তার অন্বেষণে রোজই এভাবে ছুটে আসেন পিছন পিছন , যেমন পুরুষ ছোটে স্ত্রীর পিছনে — “ মর্যো না যোষাম্‌ অভ্যেতি পশ্চাৎ । তবু তাকে ধরা গেল না আজ পর্যন্ত , সেই হলো তার চিরন্তনী রহস্যময়ী নারীরূপ বা শক্তিরূপ । সুতরাং বৈদিক দেবী উষার মধ্যেও আমরা শক্তির সেই আদিমতম রূপের পরিচয় পাই , যিনি সব দেবতার পূর্বভাবিনী , অগ্রগামিনী ।

সরস্বতীকেও বৈদিক ঋষিরা চিনেছেন অম্বিতমে নদীতমে " রূপে , জননীশ্রেষ্ঠা ও নদীশ্রেষ্ঠারূপে । এ যেন মাতৃস্নেহের প্রবাহিণী রূপ । এই বৈদিক সরস্বতী বীণাবাদিনী বাগদেবী নন। তিনি মাটিকে উর্বর করেন , শস্য শ্যামলা করে তোলেন আপন স্নিগ্ধ রসধারায় , আদর্শ মায়ের মতো মমতায় । পরমা শক্তিময়ী , সম্পদশালিনী , পবিত্ৰকারিণী । তিনি আমাদের । পাকা নঃ সরস্বতী । বাজেভির্বাজিনীবতী " । তিনি প্রেরণাদাত্রী , আবার উদ্বোধয়িত্রী সুমতির , “চেতণ্ডী সুমতীনা" । তাই বাক আর মন দুটিকেই যেন তিনি ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে তোলেন । এই প্রচোদন , প্রবর্তন , প্রেরণএটিই শক্তির মূল কাজ এবং এখানেই আমরা দেখতে পাই সাবিত্রীরূপিণী গায়ত্রী ও সরস্বতীর একাত্মতা। সে জন্যই সন্ধ্যাবন্দনায় স্বায়ংকালীন উপাসনায় । গায়ত্রীকে সরস্বতীরূপেই ধ্যান করার বিধান ।

বৈদিক উপাসনায় সব দেবতায় পশ্চাৎপটে যেমন অদিতিরূপিণী মহাশক্তি বিরাজমনা , তেমনি একক স্ত্রী দেবতারূপে প্রকটিতা উষা ও সরস্বতীর মধ্যেও বিশ্বের আদিভূতা সনাতনী শক্তিরই প্রকাশ ও বন্দনা । অতএব বেদে শক্তিপূজার কোনও নিদর্শন পাওয়া যায় না - এ ধারণা নিতান্তই ভ্রান্ত । এছাড়াও ইড়া , সরস্বতী , মহী এই ত্রয়ী স্ত্রীদেবতা এবং বাক্‌রূপিনী দেবী আপন মহিমায় বৈদিক দেবশালায় বিরাজমানা। বৈদিক উপাসনায় এভাবে মূল থেকে শিখর পর্যন্ত , ভিত্তি থেকে চূড়া পর্যন্ত শক্তিরই আরাধনা , তেমনি তন্ত্র বা আগমশাস্ত্রেও এই শক্তিকেই সর্বত্র কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করা হয়েছে এবং সেই সঙ্গে শক্তির স্বরূপও বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে । সে কারণেই তান্ত্রিক সাধনা শক্তিসাধনারূপেই সর্বত্র সুপরিচিত । বৈদিক ঋষিরা দু 'চোখ মেলে এই শক্তিকে প্রত্যক্ষ করেছেন প্রকৃতির নানা অভিব্যক্তির মধ্যে , আর তান্ত্রিক নিজের মধ্যে তার স্বরূপের মনন করেছেন এবং সেই ভাবনায় আবিষ্ট হয়ে তার অর্চনায় আত্মনিয়োগ করেছেন - এইটুকুই শুধু পার্থক্য । তান্ত্রিক উপলব্ধি করেছেন , এই শক্তির মূলত তিনটি রূপ : ইচ্ছা , জ্ঞান ও ক্রিয়া । সমগ্র সৃষ্টিই তাই এই মহাশক্তি বা আদ্যাশক্তির ইচ্ছার প্রসার । সে ইচ্ছার উপর কারও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই , তিনি সেখানে স্বাধীন , স্বতন্ত্র । তাই একে তার স্বাতন্ত্র্যশক্তি বলা হয় । শিবসূত্র ' গ্রন্থে তাই এই ইচ্ছাশক্তিকে চেনানো হয়েছে এই বলে : ইচ্ছাশক্তিরুমা কুমারী । " ইনি সেই কুমারী উমা , আদিম কৌমারী শক্তি । সেই ইচ্ছারই পরিকল্পনা প্রথম হয় জানে , শেষে তা রূপ নেয় ক্রিয়ায় । শক্তির এই বিবর্তন বৈদিক সাহিত্যে দৃশ্যমান । যা ঈশ্বর ভাবনার বিবর্তনেরও পরিপূরক ।

সহায়ক গ্রন্থ

১। সগীতাবাদ রহস্য চণ্ডী , প্রকাশক : শ্রী অনিল বান্ধব মুখোপাধ্যায় , ১৩৩২ বঙ্গাব্দ , কলকাতা ।

২। উপাসনায় শক্তিতত্ত্ব , গোবিন্দলাল মুখোপাধ্যায়, শারদীয় সংখ্যা , ১৪০১ , কলকাতা ।

 ৩। কথা প্রসঙ্গে শক্তি পূজার উৎস সন্ধানে , উদ্বোধন , ১৪০৬ , কলকাতা ।

 লেখক পরিচিতি

রঘুনাথ ভট্টাচার্য-র জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায় । ধামরাই কলেজ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন । বাংলায় স্নাতকোত্তর ও পিএইচ ,ডি । বিভাগীয় প্রধান , বাংলা বিভাগ , নবযুগ কলেজ , ধামরাই , ঢাকা ।