সাগর পথে
গীতাঞ্জলি
নন্দিতা সাহা
ইন্দিরাপুরম
আমাদের প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি যতটাই বিশাল, ঠিক ততটাই গভীর। সেই গভীরে আমরা অনেকেই হয়তো পৌঁছতে পারি না। তাকে নিয়ে এত কথা, এত কাহিনী ! কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি! তাকে নিয়ে আলোচনা যতই করি, ততই যেন অপ্রতুল। আজ আমি না হয় তার "গীতাঞ্জলি" নিয়েই দুটি কথা লিখি।
গীতাঞ্জলি কাব্য টি কিন্তু মূলত কবির কনিষ্ঠ পুত্র শমীন্দ্রনাথের আকস্মিক মৃত্যুর পর তিনি লিখেছিলেন। তখন সুখ বেদনার মধ্য দিয়ে এক নতুন ভক্তিরসে কবির মন ভরে উঠেছিল। আর তারই মুখ্য প্রকাশ গীতাঞ্জলিতে। শমীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে (৭অগ্ৰহায়ণ,১৩১৪), প্রথমে যে গানে তার হৃদয়ের প্রকাশ হল তা হল, 'অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে'। তারপর লেখা হলো একের পর এক নতুন গান , কবিতা । ১৫৭ টি নতুন গান, কবিতার একটি সংকলন,"গীতাঞ্জলি "নামে প্রকাশিত হয় ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউজ থেকে (১৯১০)। প্রকাশক সতীশ চন্দ্র মিত্র। এ সময় ধীরে ধীরে কবির শরীর অসুস্থ হয়ে পরলো । সকলের অনুরোধেই তিনি রওনা হলেন লন্ডন (১৯১২, ২৪ মে)। একটু হাওয়া বদল হবে আর সেইসঙ্গে চিকিৎসা ও ঠিকঠাক মতোই হয়তো হবে ! তখন থেকে তার মনে শুরু হলো গীতাঞ্জলি অনুবাদের প্রবল আগ্রহ। না না, তাই বলে ঘরে বসে কিন্তু কবি গীতাঞ্জলি অনুবাদ করেন নি। যখন অনুবাদ শুরু করলেন তখন তিনি বিস্তীর্ণ জলরাশি উপর ভেসে চলেছেন । ওপরে নীল আকাশ ,চারিদিকে নোনা হাওয়া, কখনো সমুদ্রের ঢেউ উথাল-পাথাল, কখনো শান্ত সমুদ্র ,শঙ্খচিল ,মাছরাঙ্গা, নানা রংয়ের মাছের জলকেলি। এরই মাঝে চলল সেই মহা কর্মকান্ড। আর এই কর্মযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে রইল নীল আকাশ, সমুদ্র, বাতাস, চন্দ্র, সূর্য ,তারা।
চলার আনন্দে বিভোর কবি প্রথম অনুবাদ করলেন ,'আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ। ' প্রথম অনুবাদটা শেষ হতেই কবি একের পর এক গীতাঞ্জলির কবিতা অনুবাদ করে চলেছেন। দ্বিতীয় কবিতা, "কোলাহল ত বারণ হল/ এবার কথা কানে কানে।" অবশ্য এই জায়গাটিতে দ্বিমত আছে। কবি নিজে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী কে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, 'কোলাহল ত বারণ হল' গান টি দিয়ে তিনি অনুবাদ শুরু করেছিলেন। তবে তাঁর ডায়েরি অন্য ছবি দেখায়। লিখতে লিখতে একদিন খাতা শেষ হয়ে গেল । সে কি ! এখন উপায় ! এই মাঝ সমুদ্রে! কিন্তু কবির কলম ত থামবে না! উপায় তো একটা করতেই হবে । আবার বাক্স থেকে আরেকটি খাতা বের করলেন প্রতিমা দেবী । তুলে দিলেন কবির হাতে ।
লিখতে লিখতে ১৬ জুন লন্ডনে এসে পৌঁছে আনন্দে আত্মহারা কবি প্রথম পাণ্ডুলিপিটি তুলে দিলেন রটেনস্টাইনের হাতে। ইতিপূর্বে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর রচনার সঙ্গে সামান্য একটু পরিচয় হয়েছিল রটেনস্টাইনের। খাতা ভরা এই কবিতাগুচ্ছ পড়ে সাহেব অভিভূত। তিনি সেই পান্ডুলিপি আরো তিনজন বিখ্যাত লোকের হাতে তুলে দিলেন, ডব্লু. বি. ইয়েটস, আ্যন্ড্রু সিসিল ব্রাডলি এবং স্টপফোর্ড ব্রুক । তারপরেই তৈরি হল ইতিহাস । নোবেল পুরস্কার। আমাদের কবি, প্রথম নন-ইওরোপীয়ন, পেলেন এই সম্মান। গর্বে ভরে উঠল বাঙালি। দেশ পৌঁছে গেল শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে।।
সব ছবি দিয়েছেন - লেখিকা নন্দিতা সাহা
লেখিকার পরিচিতি -
স্টেটস্ম্যান, সুখবর, সকালবেলা ইত্যাদি খবরের কাগজে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। প্রসাদ, সারথি পত্রিকায় গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন। 'Times of India'-তে বেশ কয়েকবার কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। কবিতা দিয়ে সাহিত্য জীবনের শুরু।বর্তমানে কিশোর ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য গল্প লিখতেই বেশি ভাল বাসেন ।