Advt

Advt

সবুজপত্র - ড. রঘুনাথ ভট্টাচার্য ঢাকা, বাংলাদেশ, Sabujpatra by Dr. Raghunath Bhattacharya, Dhaka, Bangladesh, Tatkhanik Bengali Magazine Online Reading Free

 

সবুজপত্র

ড. রঘুনাথ ভট্টাচার্য

ঢাকা,

বাংলাদেশ

প্রমথ চৌধুরীর ( ১৮৬৮-১৯৪৬ ) সম্পাদনায় ও কালাচাদ দালালের প্রকাশনায় ১৩২১ সালের ২৫ বৈশাখ সবুজপত্র ' আত্মপ্রকাশ করে । পত্রিকার আঙ্গিক সর্বপ্রথম পাঠককে চমকিত করে। এমন সূক্ষ্ম রুচিশীল শিল্পসম্মত প্রচ্ছদটি ছিল দুর্লভ । ছবি ও বিজ্ঞাপনবিহীন পত্রিকাটির প্রচ্ছদপটের রঙ সবুজ । এতে আচার্য নন্দলাল বসুর ( ১৮৮৩-১৯৬৬ ) আঁকা সবৃন্ত তালপাতার ছবি রয়েছে । প্রতি সংখ্যার মূল্য ছিল চার আনা , বার্ষিক মূল্য দু'টাকা ছয় আনা । এটি মুদ্রিত হত কলকাতা হরিচরণ মান্নার কান্তিক প্রেস থেকে । ' সবুজপত্র ' -র প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যাটি ছিল লম্বায় ১৯.৫ সে.মি. এবং প্রস্থে ১৪.৫ সে.মি .। ডবল ডিমাই কাগজে অর্ধ - ফুলস্ক্যাপ সাইজে প্রকাশিত পত্রিকার পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৬৮। ওঁ প্রাণায় স্বাহা ' বাণীটি ছিল পত্রিকার মূলমন্ত্র ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেয় জন্মদিনটিকে বেছে নিয়ে সবুজপত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে । পত্রিকাটির প্রকাশের মূলে মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের ( ১৮৮৮-১৯২৯ ) উৎসাহ এবং প্রমথ চৌধুরীর আগ্রহের প্রধান প্রেরণা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( ১৮৬১-১৯৪১ ) । প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন এ পত্রিকার প্রাণ পুরুষ । সবুজপত্রের আদর্শ ও আঙ্গিক সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ উল্লেখযোগ্য । মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রথম শর্ত এই হলো যে ,যারা ওজন করে বা গজের মাপে সাহিত্য - বিচার করে তাদের জন্য এ কাগজ হবে না ।

সবুজপত্রের বেড়ে ওঠার মধ্যেও রয়েছে চমৎকারিত্ব । পত্রিকাটি তারুণ্যের স্বপ্ন নিয়ে প্রকাশিত হয়। সমাজের যে অংশ সংস্কারবদ্ধ জড়তাধর্মী সুপ্তপ্রায় ,সবুজপত্র সেখানে প্রবল প্রাণধর্মের স্রোত প্রবাহিত করতে চেয়েছিল । একটা নতুন কিছু করার জন্য নয় ,বাঙালির জীবনে যে নতুনত্ব এসে পড়েছে তা পরিষ্কার করে প্রকাশ করার জন্য সবুজপত্রের আবির্ভাব । এর মারফৎ সমকালীন সাহিত্য - চিন্তায় ইউরোপীয় গতি , মুক্তি ও আনন্দের বাণী ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন প্রমথ চৌধুরী। তাই ছড়িয়ে দিলেন মৃত্যুহীন যৌবনের সবুজ রঙ জাগ্রত প্রাণের অবাধ দীপ্তি । এভাবেই সবুজপত্র আধুনিক বিশ্বের অন্তর্নিহিত জীবনবোধ ও মানসপ্রবণতাকে আমাদের সমাজ ও ব্যক্তির চেতনায় সঞ্চার করার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছিল । সবুজপত্র পত্রিকার লক্ষ ছিল বাঙালির মনকে জাগিয়ে তোলা , পুরাতনের সংস্কার করা, সাহিত্যকে নতুন পথে নিয়ে যাওয়া এবং মানসিক যৌবন প্রতিষ্ঠা করা ।

সবুজপত্রকে কেন্দ্র করে একটি লেখক গোষ্ঠীও তৈরি হয়েছিল । যারা সবুজপত্রের জীবন - দৃষ্টি ও সাহিত্যাদর্শের সাথে একমত পোষণ করেছেন । বিংশ শতাব্দীর চিন্তা - চেতনাকে এই পত্রিকা স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছে । শব্দ সৃষ্টির পরীক্ষা - নিরীক্ষা , ভঙ্গি ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য , এক কথায় পুরনো ভাব ও ঢঙ বর্জন করে নতুন ভাবে সাহিত্য সৃষ্টি করা সবুজপত্রগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য  বৈশিষ্ট্য ।

 সবুজপত্র ' প্রখর বুদ্ধিবাদের ধারক । পত্রিকাটি যখন প্রকাশিত হয় তখন বঙ্গদেশে সত্যিকারের সাহিত্য - পত্রিকার যুগ চলে গেছে- প্রবাসী ভারতবর্ষ'-র মতো পাঁচমিশালী ব্যবসায়ী পত্রিকার আধিপত্য ছিল তখন প্রবল । সাহিত্য পত্রিকা তখনও মিয়মাণভাবে টিকে ছিল ।

সবুজপত্রেঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির মনকে জাগিয়ে তোলা । উদ্দেশ্য ও আদর্শ সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল বলেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে স্মৃতি ও আশার মধ্যে মধ্যস্থতা করতে পেরেছিল । প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্য আধুনিকতার সমন্বয়ের বিষয়টি সবুজপত্রের মুখপত্রে অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা হয়েছে । মননচর্চা ও সৃজনশীলতার ঘোষিত আদর্শ থেকে সবুজপত্র কখনোই বিচ্যুত হয়নি । এই পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতা , গল্প ও উপন্যাসেও মুক্তির বাণী ধ্বনিত হয়েছে । নতুন চিন্তা - ভাবনাকে জীবনের ক্ষেত্রে গ্রহণ করার সংকল্প ছিল বলেই সবুজপত্র ' সমকালীন চিন্তার সংকীর্ণতা থেকে , মানসিক জড়তা থেকে , আবেগের আতিশয্য থেকে এবং আপ্ত বাক্যের শাসন থেকে চিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি দিতে চেয়েছে অতীতকে অস্বীকার করে নয় , অতীতকে সজীব করাই ছিল নবযুগের সাধনা ।

সমকালীন সাহিত্যাঙ্গনে সবুজপত্রের পক্ষে এবং বিপক্ষে অনেক তর্ক - বিতর্ক হয়েছিল । সাহিত্যিক মহলে সবুজপত্রের প্রসিদ্ধির কারণ হিসেবে বলা যায় ,এই পত্রিকার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে গদ্যে ও পদ্যে রবীন্দ্র - সাহিত্যের নতুন পর্যায়ের সূচানা । বলাকার বিখ্যাত কবিতাগুলি প্রথম ছাপা হয় সবুজপত্রে । সেই সঙ্গে নতুন করে উৎসারিত হলো রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের ধারা । উপন্যাসের ক্ষেত্রেও ঘরে - বাইরে ' লেখা হলো চলতি ভাষায় । প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধের পাশাপাশি সবুজপত্রে প্রকাশিত হয় তাঁর সৃষ্টিকর্মের উজ্জ্বলতম গল্পগুলি । বাংলা গদ্য রচনায় প্রমথ চৌধুরী যে বিশিষ্ট স্রষ্টা , সবুজপত্রের মতন বাহন না পেলে তা সম্ভব হতো না এদিক দিয়ে দেখলে সবুজপত্রকে বলতে হয় শুধু সঠিক নয়- একটি প্ল্যাটফর্ম । আর এই প্ল্যাটফর্ম - এর উদ্দেশ্য ছিল শুধু চলতি ভাষাকে বিশ্বে গদ্যরীতির প্রবর্তন নয়- আঠার ও উনিশ শতকে ইউরোপের মূল ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের আদর্শকে ভারতের শাশ্বত মাটিতে প্রতিষ্ঠা করা

 সবুজপত্রের গুণকীর্তন করে সমসাময়িক মাসিক ও ষান্মাষিক পত্রিকাগুলো সম্পাদকীয় ও বিশেষ নিবন্ধে লিখেছে :

“সবুজপত্র সে যুগের সর্বশ্রেষ্ট পত্রিকা । উচ্চাঙ্গের সাহিত্যরস রিবেশন করিয়া বাঙ্গলা সাহিত্যের এক নূতন যুগ আনে । সবুজপত্রের বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে , তাহাতে কোন বিজ্ঞাপন ছাপা হইত না একান্তভাবে বাণীর সেবাই ছিল তাহার ধর্ম। " ( সম্পাদকীয় , প্রম চৌধুরী , মাসিক বসুমতী , শ বর্ষ ,ভাদ্র ১৩৫৩,১ম খণ্ড ,পঞ্চম সংখ্যা ,পৃষ্ঠা -৪১)।

 পরিচয় ' (ষান্মাসিক ) পত্রিকার ১৯৫৩ সনের শারদীয় সংখ্যায় সবুজপত্র সম্পর্কে বলা হয়:

 যুগসন্ধির যে চাঞ্চল্য ছিল তখনকার আবহাওয়া , সবুজপত্র তাতে সজোরে আন্দোলিত হয়েছিল । নবীন মহলে নতুন প্রাণের সঞ্চার হোলে , সনাতনীর কোটর থেকে শোনা গেল কটুক্তি" ( প্রমথ চৌধুরীপরিচয় , ১৯৫৩ ,ষোড়শ বর্ষ , ১ ম খণ্ড , প্রথম সংখ্যা , পৃষ্ঠা ২৪৮ ) ।

অপরদিকে সবুজপত্রের বিপক্ষে অবস্থান নেয় মানসী,” মানসী ও মর্মবাণী । রবীন্দ্র - ঘনিষ্ঠ হলেও সবুজপত্রের ভাষারীতিকে পত্রিকাগুলি সমর্থন জানায়নি। উপাসনা ' সাহিত্য সবুজপত্রের ভাষারীতি ও রবীন্দ্রসাহিত্যে তন্ত্রহীনতাকে সমালোচনা করেছে । মাসিক সাহিত্য পত্রিকার ১৩২১ সনের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় রমাপ্রসাদ চন্দ প্রমথ চৌধুরী সম্পর্কে বলেছেন:

তিনি ভাষা তৈরী " করিতে যে সময়টা নষ্ট করেন , যদি ভাব বা মত ফুটাইতে সেই সময়টা নিয়োগ করেন,তাহা হইলে ,আমাদের ভাষাকে অনেক সুবর্ণপত্রের দ্বারা সমৃদ্ধ করিতে পারিবেন ।

প্রকৃতপক্ষে সবুজপত্র ' কেবল ভাষা নিয়ে লড়াই করেনি , করেছে ভাব নিয়েও ।

বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও সবুজপত্র ' ১৩৩৪ সালের ভাদ্র সংখ্যা পর্যন্ত নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হয় । অর্থাৎ দশ বছর প্রকাশের পর তা বন্ধ হয়ে যায় । মাঝে মাঝে বিরতিসহ সবুজপত্রের ১০৮ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল । একটি দশকব্যাপী লড়াই চালিয়ে সবুজপত্র বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পালাবদলে যে নতুন দিগন্তের উন্মেষ ঘটিয়েছিল সেই পথ ধরেই আমাদের আধুনিক সাহিত্যের নবযাত্রা সূচিত হয় । বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সবুজপত্র এক বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে ।

লেখক পরিচিতি

রঘুনাথ ভট্টাচার্য-র জন্ম বাংলাদেশের ঢাকায় । ধামরাই কলেজ , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন । বাংলায় স্নাতকোত্তর ও পিএইচ ,ডি । বিভাগীয় প্রধান , বাংলা বিভাগ , নবযুগ কলেজ , ধামরাই , ঢাকা ।