আমার
শিলং ভ্রমণ
(পর্ব – ১)
যূথিকা চক্রবর্তী,
নতুন দিল্লি
ভারতের শৈলশহরগুলির মধ্যে অন্যতম সুন্দরী পাহাড়ী
শহর হল শিলং। এখানকার জলবায়ু খুবই মনোরম । গরমের কষ্ট নেই আবার শীতেও বরফ পড়ে না। সারা বছরই যাওয়া যায়। শিলং-এ। খাসী পাহাড়ের এই পার্বত্য শহর ইংরেজদেরই কেবল প্রিয় ছিল না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথেরও
প্রিয় ছিল। নানান রবীন্দ্রস্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে এখানে। পাইনে। ছাওয়া রবীন্দ্রনাথের
বসতবাটী মালঞ্চ আজও অতীত স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। ডা: বিধানচন্দ্র রায়েরও প্রিয় ছিল
শিলং শহর। তারই বসতবাটীতে বসেছে আজকের সার্কিট হাউস। খাসীরাই এখানে প্রধান যদিও বাঙ্গালীও
কম নেই শিলং-এ। এখানকার সমাজজীবন মাতৃতান্ত্রিক, মেয়েরাই প্রধান।
তাদের পদবীতেই চলছে সমাজ সংসার। ছেলেরা নেশাসক্ত অকর্মণ্য তবে গৃহকত্রীর প্রতাপের চাপে
গৃহকর্মও করে। এদের জাতীয়তাবোধ প্রচন্ড। জাতীয়তাবোধে
সকলকে সচেতন করার জন্য প্রতিবছর এখানে নাচের আসর বসে – সেও দেখবার
বিষয়। কিন্তু আমরা গিয়েছিলাম মে মাসে, তখন নাচ দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
চালের তৈরী মদ এদের প্রিয় পানীয়, আর প্রিয়
হল পান এবং কাঁচা সুপারী। বাসে করে এসে আমরা শিলং শহর থেকে ৪ মাইল
আগেই বড়াপানীতে নেমে পড়লাম। এখানেই উমরোই মিলিটারী ক্যাম্প।
খুবই সুন্দর তার নৈসর্গিক পরিবেশ ? চারদিক পাহাড় ঘেরা, পাশ দিয়ে
বয়ে চলেছে পাহাড়ী নদী উমরোই। নির্দিষ্ট জায়গা
থেকে আমরা ফোন করে জানালাম আমাদের আগমন বার্তা। কিছু পরেই আমাদের আবাহনের জন্য এসে
পৌছুল এক ৩ টনী মিলিটারী জীপ। তাই দেখে জীপে উঠব কি হেসে বাঁচি না। অনেক কসরত করে অত
উঁচু জীপে তো কোনরকমে উঠলাম – এবার জীপ যেই
চলতে আরম্ভ করল চড়াই উত্রাই বেয়ে আমরা ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে তিনজনে জীপের ভিতর প্রায়
গড়াগড়ি। প্রাণপণে রড ধরে বসে থাকলেও ব্যালান্স রাখা দুঃসাধ্য হয়ে উঠছিল।
প্রথমে হাসাহাসি, পথের অগ্রগতির সাথে সাথে আমাদের হাসাহাসি তো থেমে গেলই, এবার যেন আতঙ্ক চেপে বসল বুকে সুস্থভাবে
পৌছতে পারলে হয় কাঙ্ক্ষিত স্থানে। ৪ কিমি যে এত দীর্ঘ হয় জানতামই না যেন। যাহোক একসময় গিয়ে পৌছলাম ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে। টিঙ্কু ওরফে
শ্রী কমল চক্রবর্তী বলল কোন কষ্ট হয়নিতো আসতে ? জলভরা চোখ
নিয়ে বললাম আরামেই এসেছি, কেমন সুন্দর ডিল্যাক্স পাঠিয়েছিলে! ওর দাদা পরিবেশ
হাল্কা করে দিয়ে বললেন, না রে, তোদের এই তিন
টনী মিলিটারী জীপে আমরা তিনটে প্রাণী প্রায় গড়াগড়ি খেতে খেতে এসেছি। মেয়ে বলল ছোটকাকা আবাহনটা ভালই হয়েছে এবার চলো তোমার কোয়াটার্সে। চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা সবুজ একখন্ড
উপত্যাকায় ওদের ক্যান্টনমেন্ট। সারি সারি কোয়াটার্সের একটায়
ঢুকলাম। স্নান খাওয়া সেরে বিকেলে বের হলাম ওদের ক্যান্টনমেন্টটা
ঘুড়ে দেখতে। সুন্দর ব্যবস্থা। সবই
আছে। থাকবে নাইবা কেন? দেশরক্ষার কাজে যারা সদা জাগ্রত প্রহরী, তাদের সুখে খামতি থাকবে কেন সরকারের পক্ষ থেকে।
সেদিন ছিল পূর্ণিমার পরদিন। একটু রাতেই ফুটল জ্যেৎস্না। আমি মুগ্ধ হয়ে জ্যোৎস্না মাখা
পাহাড়, বন দেখছি আর বকবক করে যাচ্ছি – এত সুন্দর
পরিবেশে ওরা থাকে বলে হিংসা হচ্ছিল। এমন সময় হঠাৎ মুগ্ধতার ছন্দপতন। এখানে হঠাৎ হঠাৎই
বৃষ্টি হয়। আবার সঙ্গে সঙ্গেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়। দুপুরে হয়ত তেমনই একটু বৃষ্টি
হয়েছিল। ঘাসগুলি ভেজা ভেজা টের পাচ্ছিলাম। একজায়গায় একটু জল জমে ছিল। ঘাসে চারিদিক ঢাকা
বলে বুঝতে পারিনি৷ সেইখানেই পড়ল আমার পা – আর পপাৎ ধরণীতলে।
মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল এই আরম্ভ হল। যা হোক উঠলাম – হাঁটুতে একটু
লেগেছিল। শাড়ীটা কাদা মাখা হয়ে গেল। টিঙ্কু সান্ত্বনা দিল - শুকলেই ঝেড়ে ইস্তিরি করে দেব, দেখো, কাঁদার দাগ
থাকবে না। এখানে কাঁকরভরা ঝুরো মাটি। এমন
পরিষ্কার যে সব দেখা যাচ্ছে । পড়লে কি করে ? একটু সাবধানে
চল, ভেজা ঘাসে পা পিছলাতে পারে। ব্যস আর যাবে কোথায়। কর্তা ফেটে পড়লেন ক্ষোভে – যেখানে যাবে
সেখানেই একদুবার পড়া চাই-ই চাই। আকাশমুখো হয়ে চলে — কোনদিকে একটু
খেয়াল নেই। মামন, কতবার তোমাকে বলেছি
মাকে একটু চোখে চোখে রেখ ।টিঙ্কু থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘চলত
দেখি, ক্যান্টিনে
বসে চা আর পকোড়া খাই। রাত্রে ঠিক হল পরদিন আমরা শিলং যাব এবং শিলং শহর দেখে বেড়াবো যেখানে যা দ্রষ্টব্য আছে। সেইমত পরদিন সকালে তৈরী হয়ে নিলাম বেলা ১০ টার
মধ্যেই। আর কোয়াটার্সের সামনে এসে হাজির হল আবার সেই জীপ | আমরা হৈ হৈ
করে উঠতেই টিঙ্কু বলল – ‘এটা একটনী জীপ – এটাই সবচেয়ে
ছোট। এ ছাড়া এখানে আরতো কোন গাড়ী নেই। কি
আর করা অগত্যা উঠলাম সেই একটনী জীপে তবে এবারে ঘরের থেকে একটা চেয়ার এনে সেই চেয়ারের
সাহায্যে সহজেই ওঠা গেল। পথের ঝাকুনির কষ্ট ভুলিয়ে দেবার জন্য ছিল পথের সৌন্দৰ্য্য আর টিঙ্কুর মজার মজার কথা। ও খুব মজার মজার কথা এমনভাবে বলে যে কান্নাভুলে
হাসি ফোটে। প্রথমেই এলাম শিলং বাজারে।এ বাজারটা খুবই ছোট। দেখলাম
দার্জিলিঙের মতই মেয়েরা পশরা সাজিয়ে বসেছে দোকানে দোকানে। কিছুনা কিনে শুধু দড়দাম করাতে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছিল। কিনবোনা যখন তখন শুধু
শুধু এদের বিরক্ত না করে চারদিক ঘুরে দেখে চলে যাওয়াই ভালো।
একটা রেনকোট কেনার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু টিঙ্কু বলল ওদের চীপক্যান্টিন থেকে কেনাই অনেক
সস্তায় হবে – জিনিষও ভালো হবে। তাই হাটবাজার দেখে আমরা একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে
শিলং শহর দেখতে বেরিয়ে পরলাম।
প্রথমেই গেলাম গল্ফক্লাব। শহরের একটু নীচুতে পাইন বনে ঘেরা গল্ফ ক্লাব। আরও নীচুতে নেমে দেখলাম কালীমন্দির। মনে হল যেখানে বাঙালী, সেখানেই মাদুর্গা এবং মাকালী। তবে শিলং শহরে বাঙালীর আধিক্য চোখে পড়ার মত। মহাসমারোহে দুর্গাদেবীর আরাধনায় মেতে ওঠে শুধু বাঙ্গালীসমাজই নয় খাসীরাও যোগদান করে দলে দলে। তাদের রং বেরঙের জাতীয় পোষাকে সমবেত নৃত্য সকলের মন কাড়ে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে রূপ পেয়েছে ওয়ার্ড লেক। কৃত্রিম লেকের মাঝে দ্বীপ। কাঠের সেতুতে পারাপার। প্রচুর মাছও আছে লেকে তাদের দেখতে দেখতে সময় কেটে যায়। লেকের পাশে রাজপথ। ওপারে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও রাজভবন। কিন্তু খুবই মোহিত হয়েছি শিলং-এর প্রজাপতিশালা দেখে । সেখানে মনমাতান কত না রং বেরং-এর প্রজাপতি, দেখে আশ মেটে না। এর পরে গেলাম চিড়িয়াখানায় । নাম তার লেডি হায়দরী পার্ক। আর আছে ষ্টেট মিউজিয়াম। এরপর গেলাম শিলং-এর বড় বাজারে। সেখানে বাঁশ ও বেতের কাজকরা সুন্দর সুন্দর ঘর সাজানোর জিনিস রয়েছে প্রচুর। পর্যটকদের টানবেই। শহর থেকে ১০ কিমি. দূরে ১৯৬৫মি. উঁচুতে শিলং পিক। মনোরম পরিবেশ। বসন্তকালে নানারকম অনুষ্ঠান হয়ে থাকে শুনলাম। এটা পিকনিকের পক্ষেও খুবই সুন্দর জায়গা। পায়ে হেঁটে বেড়িয়ে নিলাম একটু। পিক থেকে শিলং শহর সুন্দর দেখায়।
(চলবে…) দ্বিতীয় পর্ব আগামীকাল
লেখক পরিচিতি –
যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার
পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র
কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান
শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে
ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।