Advt

Advt

আমার শিলং ভ্রমণ (পর্ব – ২) - যূথিকা চক্রবর্তী, Aamaar Shilong Vramon (Part - 2), by Juthika Chakraborty, Tatkhanik Bangla/Bengali Free Online Magazine

 

ভ্রমণ কাহিনী

Image by Tareq Shuvo from Pixabay 

 আমার

শিলং ভ্রমণ

(পর্ব ২)

যূথিকা চক্রবর্তী, নতুন দিল্লি

 

এবারে আমাদের গন্তব্য শহর থেকে ১২ কিমি. দূরে এলিফ্যান্ট ফলস্। ১৭৭ ধাপ সিঁড়ি ভেঙে পথ নেমেছে। ফলসের মাঝামাঝি জায়গায় দুইপারের দুই পাহাড় জুড়ে আছে সেতু। তারই নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে ঝরনা। ভারী সুন্দর কিন্তু এত সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামার যে পরিশ্রম তা কিন্তু খুবই কষ্টকর। একদম নীচে পাথরের বড়-বড় খন্ড ছড়ানো রয়েছে। ঝরনার জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে বেশ ভালই লাগছিল। ওখানে ধারেই ছিল আন্দামানের মাডভলক্যানোর মত ব্যাপার। যেখানে নীচের থেকে গমকে গমকে জল উঠছিল। আশে পাশে জঙ্গল। শুনলাম এখানে সিনেমার স্যুটিং-ও হয়। ছবি-টবি তোলাহল। উঠতে ইচ্ছা করছিল না কেননা উপরে তাকালেই আতঙ্ক অতগুলো শ্যাওলাধরা চওড়া চওড়া সিঁড়ি ভেঙে তবে পরে ওঠা। যত কষ্টই হোক উঠতেই হল। শহরে ঢুকে বাঁ দিকে বিশপ আর বিডন। শ'খানেক ফুট উঁচু থেকে গার্ণার ফলসের জলধারা মিশেছে বিশপের সাথে। এরই জলধারা থেকে উমিয়ম নদীর জন্ম। বিডন থেকে তৈরী হচ্ছে জলবিদ্যুৎ। এই বিদ্যুৎ শিলং শহরকে আলোকিত রাখে। এ ছাড়াও জল প্রপাত রয়েছে আরও অনেক। তাদের মধ্যে Seven Sirters ফলস, সুইট ফলস, স্প্রেড ঈগল ফলস, সতী ফলস উল্লেখ্য। স্প্রেড ঈগলের নামকরণ রবীন্দ্রনাথের। হাঁটতে হাঁটতে পায়ের খিল খুলে যাবার অবস্থা। পেটে টান ধরেছে, বিশেষ করে গরমপানীয়র তেষ্টা পেয়েছে খুব।

এবার একটা রেষ্টুরেন্টে বসে অল্পকিছু খাওয়া দাওয়া করে আগামীকাল চেরাপুঞ্জি যাবার গাড়ীর ব্যবস্থা করে ঘরে ফেরার পালা। ঘর! সে-ওত দেখবার মতন জায়গা। রান্নাঘরের জানলা দিয়ে দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। মেঘ আসে যায়, পাহাড় ঢাকা পড়ে আবার মেঘমুক্ত হয়ে ঝলমল করে ওঠে রোদে। একদিন দেখি অন্য কোথাও নয় একটা লাইন ধরে একঝাক বৃষ্টি এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। তাতে রোদ পড়ে আলোর ঝিকিমিকি খেলা ।হাঁকরে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, তারপর আমাদের ক্যাম্পাসের মধ্যে যখন বৃষ্টির লাইনটা এল তখন সব জামা কাপড় ভিজিয়ে দিয়ে চলে গেল। এদিকে রান্না পুড়ে ছাই। যত বলি টিঙ্কু তুমি কি সুন্দর জায়গায় আছো, ও ততো  বিরক্ত হয়, বলে এটা একটা মুক্ত জেলখানা। কোথাও পালাবার পথ নেই। ৪ কিমি. চড়াই উত্রাই পেরিয়ে, তবে লোকালয়। যখন কাজ থাকে না, তখনও আমি অফিসে গিয়ে কাজ খুঁজে নিয়ে কাজ করি। একা একা হাত পা গুটিয়ে থাকতে একদম ভালো লাগেনা। তোমার মত আকাশ বাতাস মেঘ পাহাড় আর রোদ্দুরের খেলা দেখে আমার মন ভরে না। তবে চলো, কাল ত যাচ্ছি চেরাপুঞ্জি এক কথায় অপূর্ব। তবে যদি বর্ষাকাল হত আনন্দে তুমি পাগল হয়ে যেতে। যাক গে, কাল নিজের চোখেই দেখ।

পরেরদিন চলেছি গাড়ীতে করে চেরাপুঞ্জির পথে। কর্তা ড্রাইভারের পাশে, মামা পিছনের সিটের জানলার একধারে, অন্য জানলায় টিঙ্কু। তখন অগত্যা আমি মাঝখানে চড়াই উত্রাইয়ের পথে এ ওর গায়ে ঢলে ঢলে পড়ছে। মেয়ের হালকা পাতলা দেহ, ওর চাপ কিছুই মনে হচ্ছে না, কিন্তু টিঙ্কুযেন মনে হল ইচ্ছে করেই বড় বেশী চাপের সৃষ্টি করছে। ওর দুষ্টামি ধরে ফেলতেই হেসে বলল, বস, বস, আর চাপ দেব না। শিলং ছাড়িয়ে কিছুটা যেতে মাঝপথে এক আশ্চর্য জিনিস ভূমিকম্পেসৃষ্ট সংকীর্ণ গিরিসঙ্কট। পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেই। চেরাপুঞ্জি বৃটিশদের অবদান। উত্তরপূবের সদর দপ্তর বসেছে চেরাপুঞ্জিতেই। পথগুলি বাঁধান চওড়া এবং মসৃন দুপাশে সারবেঁধে ফার গাছের শ্রেণী অপূর্ব সুন্দর লাগে। সবুজ পাইন পেরিয়ে মাওজং, মাওপেং, লিমপো, আরও কত নাম না জানা খাসী গ্রাম ছাড়িয়ে চলেছি আমরা পাহাড় ঘুরে ঘুরে। সবুজ গালিচায় মোড়া পাহাড় মাথা তুলে একের পর এক দাঁড়িয়ে আছে। চলার পথের দৃশ্য সত্যিই নয়নাভিরাম। প্রায় চূড়ায় পৌছে গাড়ি থামিয়ে নেমে এলাম পথের পাশে। বেশ চওড়া একটা সমতল জায়গা দেখে খাদের ধারে বসলাম। মেঘ, মেঘ আর মেঘ। মেঘ এসে যখন দুই পাহাড়ের মাঝের খাদ ঢেকে দিচ্ছে তখন যে দৃশ্যের সৃষ্টি হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে যেন মহাসমুদ্রের ধারে বসে আছি, আর ঢেউগুলো পায়ের কাছে আছড়ে পড়ছে। মেঘের কি খেলা। মেঘে মেঘে মাখামাখি। মন চলে গেল শেষের কবিতায় – “চপল স্বভাব অমিত যখন ভাবছে যে পাহাড়ের পথ ধরে যেখানে খুশী হাঁটা লাগাতে, এমন সময় আষাঢ় এল পাহাড়ে পাহাড়ে বনে বনে তার সজল ঘনছায়ার চাদর লুটিয়ে। খবর পাওয়া গেল চেরাপুঞ্জির গিরিশৃঙ্গ নববর্ষার মেঘদলের পুঞ্জিত আক্রমণ আপনবুক দিয়ে ঠেকিয়েছে। এইবার ঘনবর্ষণে গিরিনিঝরিনীগুলো খেপিয়ে কুলছাড়া করবে।

মেয়ের ডাকে সম্বিত ফিরে পেলাম। শুনতে পেলাম টিঙ্কু বলে চলেছে বর্ষাকালে পথের পাশের গাছের গোড়া বেয়ে ঢালু জমি থেকে অনর্গল ধারায় ধেয়ে আসে জলধারা পথ ধুয়ে পাশের খাতে বয়ে যায়। তৈরী হয় কত না ঝরণাধারা। বর্ষায় যে চেরাপুঞ্জির সৌন্দর্য্য না দেখেছে সে চেরাপুঞ্জির প্রকৃত সৌন্দর্যকে পুরোপুরি উপভোগ করতে পারবেনা। নাই বা দেখলাম বর্ষার চেরাপুঞ্জির রূপ কিন্তু এখনই বা কম কিসে! আরও কিছুদূর এগিয়ে এলাম মওসিনরামে। এখানেই পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী বৃষ্টিপাত হয়। আরও এক দ্রষ্টব্য এখানে আছে। গুহার ভেতর ষ্ট্যালাগমাইটের শিবলিঙ্গ। ঝুলন্ত চুনাপাথরের দন্ড থেকে বছরভর জল ঝড়ে পড়ছে শিবের মাথায়। আরও কিছুদূরে মোসমাই কেভ। ভেতরে অন্ধকার জলে স্যাতসেতে। ঢোকার সাহসই হল না। বেশ কয়েকটি মনোলিথ পিলার তোরণের মত সাজিয়েছে মোসসমাই গুহার প্রবেশপথ। এখান থেকে বাংলাদেশের প্রান্তর দেখা যায় ! ফেরার পথে চেরাবাজারের কাছে রামকৃষ্ণমিশন আশ্রম। ছয়সাত শ ছেলেমেয়ে আসে পড়তে। এখানে হাতের কাজের অনেকরকম নমুনা দেখালেন স্বামীজী। একটা চাদর কিনলাম সামান্য কিছু দানপত্রে ফেলে নমস্কার জানিয়ে চলে এলাম। আরও কিছুটা দূরে দেখা পেলাম কালিকাই ফলসের। বর্ষায় এর রূপনাকি এলিফ্যান্ট ফলসকেও ছাপিয়ে যায়। আশে পাশের অর্কিডের সম্ভার পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পরের দিন আমরা ক্যাম্পাসের বাইরে উমরোই নদীর তীরে ঘুরে ঘুরে নুড়ি কুড়ালাম। আমাদের সঙ্গী হিসেবে ছিলেন আমার ইঞ্জিনীয়ার দেওরের সহকর্মীর কিছু ছেলেমেয়ে এবং আর একজন সহকর্মীর স্ত্রীও। বাঁধের উপরে উঠে ছবি তোলা হল। পাহাড়ের ঢালুতে দেবদারু গাছের ছায়ায় ছায়ায় দেবদারুবনচারিণী আমার মেয়ে ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল। গিয়ে দেখলাম পাইনবনে পাইনের ফুল কুড়াচ্ছে। অংশনিলাম সেই সুদৃশ্য ফুল কুড়ানো। এখনও তা আমার বাড়িতে ঝুলছে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে। দেওদারের পাহাড়ী ঢালে গা এলিয়ে বসে থাকতে ভালই লাগছিল। সূর্যাস্ত দেখে ফিরে এলাম সেই পাঁচিলহীন জেলখানায়। এবার গেলাম চীপ ক্যান্টিনে কেনাকাটা করতে। অনেক প্রইয়োজনীয়। জিনিস বাইরের বাজারের চাইতে অনেক কম দামে পাওয়া যায় এখানে। মিলিটারির লোকেদের পরিবারের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সেইজন্য দেশের প্রতিটা মিলিটারী ক্যান্টনমেন্টে সস্তার দোকান আছে । শুধু সস্তাই নয়, জিনিসগুলো সব এক নম্বর।

 

সমাপ্ত

 

লেখক পরিচিতি

যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।