আমার অসম ভ্রমণ
(পর্ব – ২)
যূথিকা
চক্রবর্ত্তী, নতুন দিল্লি
কিছুদূর এসে কাছারি ঘাট। কাছারি ঘাট থেকে নৌকায় ব্রহ্মপুত্রনদের বুকে উমানন্দে যেতে নৌকাগুলিকে দেখায় মোচার খোলার মত। বর্ষায় এদৃশ্য কল্পনাও করা যায় না। এখানে ঘাটে বসে ব্ৰহ্মপুত্ৰনদের দৃশ্য দেখলাম। গুয়াহাটীতে আমার কর্তা ছিলেন ৪/৫ বছর কর্মসূত্রে। কাজেই পরিচিত স্থানগুলিতে কখনও পায়ে হেঁটে, কখন রিক্সা করে ঘুড়ে ঘুরে দেখলাম। বশিষ্ঠ আশ্রম আশ্রমের পাশ দিয়ে তিন পাহাড়ী নদী। সন্ধ্যা, ললিতা ও কান্তা মিলিত হয়েছে আশ্রমে বশিষ্ঠ গঙ্গারূপে। ষ্টেট জু-এর লাগোয়া বোটানিক্যাল গার্ডেন। দিঘালি পুকুর পাড়ে আর্টগ্যালারী। আমার কর্তা একজন আর্টিষ্ট সুতরাং আর্টগ্যালারী দেখাবেনই। পাশেই রয়েছে প্ল্যানেটেরিয়ম, গান্ধীমন্ডপ, নুনমাটী তৈলশোধনাগার, নেহরুপার্ক। শহর থেকে সরাইঘাট সেতু পেরিয়ে একটু দূরে ব্রহ্মপুত্রের উত্তরপাড়ে সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশে পাশাপাশি দুই পাহাড়ে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম তীর্থ হাজো। বৈষ্ণব, বৌদ্ধ ও মুসলিমদের নানান পুরাণ কাহিনী আছে হাজো নামের পশ্চাতে। নামে কিবা আসে যায়। সর্বধর্মবলম্বীদের কাছেই হাজো এক মহান তীর্থ।
গুয়াহাটী থেকে বাসে এন. এইচ. ৫১ ধরে চারিআলি বা চৌরাস্তা ছাড়িয়ে আরও কিছুদূরে শাল সেগুনে ছাওয়া এক টিলায় কামরূপের খাজুরাহো। ২৪টির অধিক মন্দির কমপ্লেক্স মদন কামদেবে। কথিত আছে — পাল রাজাদের কালে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় সুন্দর প্রকৃতির কোলে গড়ে উঠেছিল কামদেব বা পঞ্চরথ। শিব উপাস্য দেবতা আজও পূজা পাচ্ছেন। অনাদর আর অবহেলায় ধ্বংস হয়েছে অনেক কিছুই। দিনে দিনে বেড়িয়ে এখান থেকে আমরা ফেরার পথ ধরলাম।
যেহেতু আমার স্বামীর পরিচিত জায়গা তাই যতটা সম্ভব এখানে কাটিয়ে আমরা কাজীরাঙ্গা যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। বিশেষ করে আমাদের কিশোরী কন্যা লক্ষ্মীশ্রী। পরদিন বাসে করে এলাম আমরা কাজীরাঙ্গা জাতীয় উদ্যানে। টুরিষ্ট বাংলোয় কোন ঘর মিলবে না জানালেন কেয়ারটেকার ভদ্রলোক। আমরা তিনজনেই হতাশায় প্রায় ভেঙ্গে পড়লাম। কিন্তু রাখে হরি মারে কে! ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাইলাম অফিসঘরে বসে যদি আমরা একটু বিশ্রাম করি ওনার তাতে কোন আপত্তি আছে কিনা। একটি কিশােরীর ভেঙ্গে পড়া দেখে উনি খুবই সদয় ব্যবহার করলেন। জলের সাথে চা-ও খাওয়ালেন। ইতিমধ্যে ম্যানেজার ভদ্রলোক এলেন। ওনার সাথে কথাবার্তার প্রসঙ্গে উনি যখন জানলেন আমি একটি উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা, আমার স্বামী এ্যাডভোকেট এবং একজন বড়মাপের শিল্পী, তখন উৎসাহিত হয়ে জানালেন ওনার স্ত্রী ও স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের সহশিক্ষিকা! সুতরাং কি মনে হল ভদ্রলোকের জানিনা, বললেন ‘আমি আপনাদের থাকবার একটা ব্যবস্থা করতে পারি, কিন্তু সেটা বেশ রিস্কের। শুনলাম সেদিন ওখানে নির্বাচন তাই সমস্ত ঘর বুক করা থাকলেও সেদিন সব ফাঁকা। কিন্তু কেউ যদি এসে পড়ে তবে সেক্ষেত্রে আমাদের সে ঘর ছেড়ে দিতে হবে এবং অসময় এবং অসুবিধা হলেও অন্যঘরে যেতে হতে পারে। আমরা সানন্দে রাজী হলাম। বড় বড় জানলাওয়ালা বারান্দার ধারের ঘর পেলাম। সন্ধ্যে বেলায় গেলাম বনবিভাগের অফিস থেকে ভোরবেলায় হাতির পিঠে চেপে বনে ঘোরার টিকিট কাটতে। এইখানে বলে রাখি কাজীরাঙ্গার একশৃঙ্গীগন্ডারের বিশ্ব পরিচিতি। এর চেহারা প্রাগৈতিহাসিক - – ২ মি. উঁচু, ওজন ২ টনেরও বেশী। কিন্তু চলাফেরায় যথেষ্ট দ্রুত ও চটপটে। বাইসন,শম্বর, বুনো শুয়োর, হরিণ, বাঘ, চিতাবাঘও আছে এখানে। নানা দেশের পাখীর আড্ডাখানাও এখানে। দুই দফায় ঘোরান হয় তবে উচিৎ ভোরেই যাওয়া কেননা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্তুরাও ঝোপের আড়ালে নিজেদের গোপন আড্ডায় বিশ্রাম নিতে ঢুকে পড়ে। আমরা তাই প্রথম ব্যাচের টিকিট কাটলাম।
পরদিন নির্দিষ্টসময়ের আগেই বনবিভাগের দপ্তরের পাশে হাতি পয়েন্টে পৌছলাম। কাজীরাঙ্গায় আসবার জন্য যে মেয়ে অস্থির হয়ে পড়েছিল, সেই হাতিরপিঠে চড়তে গিয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে একসা। কিছুতেই উঠবেনা। অনেককরে বোঝাতে শেষে আগে আমি উঠলাম তারপর ও উঠে আমার হাত জাপটে ধরে কোনরকমে বসল। বোঝালাম – সহজ হও। নিজেকে সামলে নিজেকেই থাকতে হবে, পড়ে গেলে বিষম বিপদ। ওর বাবা বসল আমাদের বিপরীত দিকে আরেক জনের সঙ্গে। হাতলওলা বেঞ্চির দুদিকে বসার ব্যবস্থা – ৪ জনের বেশী নয়। হাতল আঁকড়ে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে হবে। হাতি চলা শুরু করল দুলকি চালে খাল বিল জলা ঘাস জমির মধ্যদিয়ে। ৬/৭ ফুট লম্বা ঘাস আমাদের গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। বাঘ যদি থাকে এর মধ্যে তবে ভয় পেলেও অবাক হবার কিছু নয়।
কিছুদূর যাবার পরই আমরা গন্ডারের দর্শন পেলাম একেবারে সামনা সামনি – যাকে বলে মুখোমুখি। ফটো তোলা হল। কিছুদূর যাবার পর আবার তিন চারটাকে একসঙ্গে দেখতে পেলাম। হরিণ দেখলাম একটা। দূরে একদল বাইসন চরে বেড়াচ্ছে মনে বললাম 'বাবা, তোমরা দূরেই থাক। বুনো শুয়োরেরও দেখা পেলাম। একজায়গায় একটা গর্ত দেখিয়ে মাহুত বলল, এটা গন্ডারদের পায়খানা জানিনা সত্যি মিথ্যা। এতক্ষণে অবশ্য আমার মেয়ে চাঙ্গা এবং পটাপট ছবিতুলে যাচ্ছে। হঠাৎই প্রায় অঘটন! এক মা গন্ডার তার ছােট্ট বাচ্চাকে সামনে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ কি মনে করে আমাদের হাতির দিকে ফিরে রুখে দাঁড়াল! হাতিও থমকে দাঁড়িয়েছে। একটুক্ষণ তারপরই শিক্ষিত হাতি আস্তে আস্তে ডাইনে বাঁক নিয়ে অন্যপথ ধরল। গন্ডারটাও তার। বাচ্চাকে নিয়ে জঙ্গলে হারিয়ে গেল। আমরা ঘুরে ফিরে অবশেষে এসে পৌছলাম নামবার জায়গায়। এখানেও একটা ছোট হাতি, একেবারে বাচ্চাও নয়, শুড় বুলিয়ে সবাইকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। কেউ কেউ শুড়ের ডগায় পয়সা দিলে সেটাকে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিচ্ছে! আমার মেয়েও দেখলাম হাতির গুঁড়ে হাত বুলিয়ে দিব্যি ভাব করে নিল।
এবার কাজীরাঙ্গা থেকে ফেরার পালা। গেষ্ট হাউসে ফিরে দেখলাম তখনও কেউ আসেনি। ম্যানেজার বাবুকে অজস্র ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশে। এবারে আমাদের যাত্রা শিলং-এর দিকে। গুয়াহাটীতে যেমন আমাদের কোন হোটেলে উঠতে হয়নি তেমনি শিলং-য়েও আমরা আমার ছোট দেওরের কোয়ার্টারসে উঠেছিলাম। আগামী পর্বে সেকথা লিখবো ।
লেখক পরিচিতি –
যুথিকা চক্রবর্তীর জন্ম ১৯৪২-এ । মালদায় বেড়ে ওঠেন। সেখানে তার পড়াশোনা শুরু হয়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও বাংলায় স্নাতকোত্তর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে। ১৯৬২-তে মালদহ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পবিত্র কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করে পরবর্তীতে ১৯৭১ থেকে ২০০২ পর্যন্ত সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার গুরুদায়িত্ব পালন করে ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখালেখিতেও তার সহজাত অধিকার। তিনি সেতার বাদন ও বই পড়তে ভালোবাসেন। বর্তমান ভ্রমণকাহিনীটি তার অন্যান্য পরিচয়কে সমুন্নত করে তুলেছে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত বই একটি।