আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস,
২১শে ফেব্রুয়ারী
রেখা নাথ, নতুন
দিল্লি
মানুষের এক অনন্য বৈশিষ্ট হল তার ভাষা । যা তাকে অন্যান্য প্রাণী থেকে
স্বাতন্ত্র প্রদান করে। যে ভাষায় আমরা প্রথম মা বলতে শিখি এবং শৈশব থেকে যে ভাষায়
আমরা নিজেদের জীবনে মনের ভাব - সুখ,দুঃখ,হাসি,কান্না,জ্বালা,যন্ত্রণা,রাগ ও অনুরাগ ইত্যাদি প্রকাশ করি
সে ভাষাই আমাদের মাতৃভাষা। ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায় - "বাংলা ভাষাই বাঙালীর অস্তিত্বের ভিত্তি ।
বাংলা বলি বলেই আমরা বাঙালী ।" আর এই বাঙালী জাতিকে
নিজের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে ঝরাতে হয়েছে রক্ত। সেই রক্তক্ষয়ী
সংগ্রামের ইতিহাস জানতে হলে পিছনে ফিরে তাকাতে হবে ।
প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত ভারতবর্ষের পূর্ব দিকে এক
বিস্তীর্ণ, বর্ধিষ্ণু অঞ্চল- শস্যশ্যামল বঙ্গভূমি নামে যার
পরিচিতি । প্রাক আর্য ও আর্য মানবগোষ্ঠীর সমন্বয়ে এই ভূখন্ডে আত্ম
প্রকাশ ঘটে বাঙালী জাতির । প্রাথমিক পর্যায়ে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য ও শৈব নাথাচার্যদের
অনুশীলনের মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভিত স্থাপিত হয় । চর্যাগীতিকা বা
চর্যাপদ ও নাথগীতিকা বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন । পরবর্তীকালে অনেক বিদ্বজ্জনের
প্রয়াসে বাংলা ভাষার প্রসার ঘটে । রামমোহন, বিদ্যাসাগর,বঙ্কিমচন্দ্র,রবীন্দ্রনাথ
ও নজরুলের নিরন্তর অবদানে ঋদ্ধ ও সুসংস্কৃত হয়ে বাংলা ভাষা বিশ্বের দরবারে ও বিশ্ব
সাহিত্যে সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি অর্জন করেছে ।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করে,
প্রায় দুশো বছরের বৃটিশ শাসনের অবসান ঘটে কিন্তু ধর্মের ভিত্তিতে ভারতের বিভাজন হয়
। জন্ম হয় পাকিস্তানের । পাকিস্তান ,
নিজেকে ঘোষণা করে ইস্লামিক রাষ্ট্র হিসাবে। এবং ভারত পরিচিতি পায় একটি
ধর্মনিরপেক্ষ রাস্ট্র হিসাবে । পাকিস্তান রাষ্ট্র গড়ে ওঠে পশ্চিম ও পূর্ব দুটি
খণ্ড নিয়ে। পশ্চিম খণ্ডটি গড়ে ওঠে ভারতের উত্তর পশ্চিমাংশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের নিয়ে,পশ্চিম পাকিস্তান নামে আর ভারতের দক্ষিণ পূর্বভাগে, বঙ্গদেশ- পূর্ব পাকিস্তান হিসাবে । পূর্ব পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশ ।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (পূর্ব বাংলার ) জনসংখ্যার ৪
কোটি ৪০ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৪ কোটি ১৩ লক্ষ মানুষই ছিল বাংলা ভাষাভাষী । আর সমগ্র
পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৪% বাঙালী , ২৮% পাঞ্জাবী ও ৭% ছিল উর্দু ভাষাভাষী এবং
অন্যান্য ভাষা ছিল পশতু, বেলুচি,সিন্ধী ও মাকরানী । পূর্ব পাকিস্তানে ৯৮% বেশী
মানুষ বাংলা ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও টাকার নোটে , ডাক টিকিটে, মনি অর্ডার ফর্মে
,টিকিটে – কার্যত সরকারী সব ক্ষেত্রে ইংরাজীর সঙ্গে উর্দুর ব্যবহার প্রচলিত হয় ।
লোক সেবা আয়োগের প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষাগুলোতে, সামরিক, নৌ ও বিমান বাহিনীর
নিযুক্তিতে বাংলা ভাষা বর্জিত হয় । সংবাদমাধ্যমগুলিতেও উর্দুকে প্রাথমিকতা দেওয়া
হয় । পাকিস্তান গণপরিষদেও সরকারী ভাষা হিসাবে ইংরাজী ও উর্দু ভাষাকে মান্যতা দেওয়া
হয় । ১৯৪৮ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী গণপরিষদের প্রথম সভাতেই বাঙালী সদস্যরা ইংরাজী ও
উর্দুর সঙ্গে বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবি জানান । তাঁদের অনুরোধ উপেক্ষিত হয় ।
মহম্মদ আলী জিন্নাহ্ পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন । ক্ষমতায়
অধিষ্ঠিত হবার কিছুদিন পরই ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মহম্মদ
আলী জিন্নাহ্ ঘোষণা করেন - উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা !
বাঙালাভাষী জনতা উচ্চকন্ঠে তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং দাবী করে একমাত্র উর্দু নয়
বাংলা ভাষাকেও আর একটি রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে । এভাবেই ১৯৪৮ সালে
ভাষা আন্দোলনের সুত্রপাত হয় পূর্ব পাকিস্তানে । ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ সর্বদলীয়
সংঘর্ষ সমিতির প্রতিষ্ঠা হয় ও ১১ই মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘট ডাকা হয় । রাস্তায় রাস্তায় মানুষ শ্লোগান দিতে থাকে "রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলা চাই" । ১৯৫০ সালে
প্রধানমন্ত্রী লিকায়ত আলী খান এবং ১৯৫২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা
নাজিমুদ্দিনও একই রকম ঘোষণা করেন যে – একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা
। এতে সারা দেশের ছাত্র সমাজ ও বুদ্ধিজীবীরা তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার হলেন । ৪ঠা
ফেব্রুয়ারী সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে পালিত হয় ধর্মঘট । সর্বদলীয় সংঘর্ষ সমিতি প্রতিবাদে ২১ শে ফেব্রুয়ারী
দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দিল এবং তারা আবার উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসাবে
স্বীকৃতি দিতে দাবী জানায়। পাকিস্তান সরকার ১৪৪ ধারা জারী করে ২০শে ফেব্রুয়ারী
থেকে । সমস্ত রকম সভা ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে । সর্বদলীয় সংঘর্ষ সমিতি স্থির করে
১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবে না । যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তা মানে না । তারা
বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে জমা হয় এবং ২১শে ফেব্রুয়ারীর সকালেই দশজনের একটি দল বেরিয়ে
আসে । পুলিশ তাদের আটকাতে ব্যর্থ হয় । সারাটা দিন ধরে বিভিন্ন স্থানে পুলিশ ও জনতার
মধ্যে সংঘর্ষ বাধে । শেষে সামরিক বাহিনীকে ডাকা হলে তারা অনেক রাউন্ড গুলি চালায়
। শহীদ হয় বেশ কিছু ছাত্র ও সাধারণ জনতা কিন্তু পুলিশ শবদেহগুলি সরিয়ে ফেলায় তাদের
প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি । ২৪শে ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান সরকার যে প্রেসনোট জারী
করে তাতে ৬ জন ছাত্রের নিহত হবার কথা স্বীকার করে , তারা হল রফিক,বরকত,
জব্বর,শফিউর, ওয়াহেদুল্লা ও আবদুল । সরকারী সূচিতে যে দুজনের নাম পাওয়া যায়নি তারা
হল আবদুস সালাম ও সালাউদ্দীন । এই ভাষা আন্দোলন শেষ অবধি সমাপ্তি ঘটে ১৯৫৬ সালে
যখন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় । ভাষা আন্দোলনের জন্য
পূর্ব পাকিস্তানের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম,
সেই সময় পরোক্ষে বীজ বপন হয়েছিল যার পরিণিতি আমরা দেখতে পাই বাংলাদেশের স্বাধীনতায়
। বাংলাদেশের ইতিহাসে ২১শে ফেব্রুয়ারী শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
ভাষা একটি দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক । আর এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য
সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে শক্তিশালী হাতিয়ার আর মাতৃভাষা হল একটা জাতির পারিবারিক ও
ব্যবহারিক ভাষা । ১৯৯৮ সালের ২৯শে মার্চ
বহুভাষী ও বহুজাতিক ভাষাপ্রেমী জনসমষ্টি দ্বারা কানাডায় গঠিত "মাদার
ল্যাঙ্গুয়েজ লাভারস অব দি ওয়ার্লড" নামে একটি সংগঠন জাতিসংঘের মহাসচিব, কফি
আনানের কাছে একটি আবেদন পেশ করেন । এতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে দক্ষিণ
আমেরিকা,এশিয়া, অষ্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকা
মহাদেশের অনেক জাতি,গোষ্ঠীকে মাতৃভাষা ব্যবহার না করার জন্য বাধ্য করা হচ্ছে এবং
কোথাও ভুলে যাবার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে । বাংলা ভাষাকেও এ ধরণের ঘটনার
মুখোমুখি হয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করতে হয়েছে । ২১শে ফেব্রুয়ারীর ঘটনা বিশ্বে একক ও
অনন্য । অতএব ২১শে ফেব্রুয়ারীকেই
"আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" ঘোষণা দিলে সব মাতৃভাষাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাবার দৃষ্টান্ত
হবে । এটাই ২১ এর চমৎকার সাফল্য । আবেদনে
স্বাক্ষরকারী মোট দশজন ছিলেন সাতটি ভাষার প্রতিনিধি । স্বাক্ষরকারী ভাষার প্রতিনিধিরা
হলেন – দুজন বাংলাদেশী, রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম , অরুণা যোশী, রিনাতে
মার্টিনস, নাসরিন ইসলাম,ডঃ কেলভিন চাও,জেমস মরিন ,সুসান হজিনস, আলবার্ট তিনজন ও
কার্মেন ক্রিষ্যোবাল । সাতটি ভাষা হল - বাংলা, হিন্দী, জার্মান,কাছি , ক্যান্টনিস
, ইংরেজি ও ফিলিপেনো । এই বিষয়টি সমর্থন
জানায় ২৮টি সদস্য রাষ্ট্র ।
১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর প্যারিসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের শিক্ষা,বিজ্ঞান ও
সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো) সাধারণ পরিষদের ৩০ তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে বাংলাদেশ
সহ ২৭ টি দেশের সমর্থন নিয়ে,সর্বসম্মতভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারীকে " আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে মান্যতা দেয় । ইউনেস্কোর প্রস্তাবে বলা হয় --
"১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের অনন্য ত্যাগের
স্বীকৃতি স্বরূপ এবং ১৯৫২ সালের এই দিনের শহীদদের স্মৃতিকে সারা বিশ্বে স্মরণীয়
করে রাখতে ২১শে ফেব্রুয়ারী
"আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ।
প্রতি বছর '২১শে ফেব্রুয়ারী' ইউনেস্কোর ১৮৮টি সদস্য দেশ এবং
ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে উদযাপিত হবে । " ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী সারা বিশ্বব্যাপী
প্রথম পালিত হয় "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" ।
পূর্ব পাকিস্তানের (পূর্ব বাংলার ) জনসাধারণ বিশ্বদরবারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে,
নিজেদের চরম বলিদানের বিনিময়ে রক্ষা করেছে মাতৃভাষার মর্যাদা এবং পরিশেষে অনেক
অশ্রুপাত এবং রক্তস্রোতের মধ্যে দিয়ে অর্জন করেছে স্বাধীনতা একটি নবীন রাষ্ট্রের
আবির্ভাব হয় – বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে ।
২১শে ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ সহ পশ্চিম বঙ্গ ও সমস্ত বাংলা ভাষাভাষীর জীবনে একটি
গৌরবোজ্জ্বল দিন।
লেখক পরিচিতি -
যদিও জন্ম পলাশীপাড়া, নদীয়া জেলা পশ্চিমবঙ্গ, কিন্তু তার শৈশব বেড়ে ওঠা, শিক্ষা-দীক্ষা সব এলাহাবাদেই। এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থশাস্ত্রে এম.এ.। ১৯৮১ সালে এলাহাবাদ থেকে একটি ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা তৃণীর’ প্রকাশ করতেন।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় (দেশে ও বিদেশে) লেখা প্রকাশিত হয়। হিন্দি ও ইংরাজিতেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। পানামার কবি রাখোলিও সিনান-এর দশটি স্প্যানিশ কবিতা বাংলাতে অনুবাদ করেছেন। অনুশীলন পত্রিকা, সুইডেন থেকে রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড ২০১৩ সালে প্রাপ্তি। ২০১০ সালে প্রকাশিত হয়েছে ঈশ্বর ও মানুষ’ (অণুগল্প ও ছোট গল্প সংকলন)।